পাত্র দেখতে এসে একটা বিষয় খেয়াল করলাম ছেলে শুধু আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। হয়তো মনে মনে ভাবছে মানুষ পাত্রী দেখতে যায় আর এই মেয়ে নিজে পাত্রী হয়ে পাত্র দেখতে আসছে ঘটনা বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার। অবশ্য আমি কিছু মনে করছি না। উনার এই রকম ভাবাটা স্বাভাবিক। আমার দিকে তাকিয়েই সে প্রশ্ন করে ফেললো “আমার জীবনেও এমন ঘটনা আমি দেখিনি। যেখানে আমি আপনাকে দেখতে যাওয়ার কথা। কিন্তু বিষয়টা তো উল্টো হয়ে গেলো তাই না?” পাত্রের নাম বখতিয়ার হাসিন অর্ক। যদিও বখতিয়ার হাসিন এই শব্দের অর্থ আমার জানা নেই। তবে অর্ক শব্দের অর্থ সূর্য্য। সবাই বলে থাকে এই সূর্য্য দিনের সময় শেষে হারিয়ে যায় বা অস্ত যায়। কিন্তু সূর্য্য কি আসলেই অস্ত যায়? যায় না। আমি অর্ক সাহেবকে তার কথার ঠিকঠাক প্রত্যুত্তর না দিয়ে বললাম “আপনি রান্না করতে পারেন?” আমার কথা শুনে জনাব অর্ক উনার পাশে বসে থাকা বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু নেড়ে চড়ে বসলো।হয়তো আমার কাছ থেকে এমন প্রশ্ন আশা করেনি। আমি অর্ককে আবার বললাম “আপনার কাছে বাচ্চাদের কেমন লাগে? মাঝে মাঝে আমি বাচ্চাদের মত আচরন করি। তখন সামলাতে পারবেন?” উনি একটু চুপ করে থেকে হাসলো। উনার মা আমার মাকে আস্তে করে বললেন “আপা মেয়ের কোন সমস্যা আছে?” আমার মা একটু হেসে শুধু বললো “জ্বি না আপা।” অর্কের বাবা মায়ের চেহারা দেখে আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি তারা আমাকে অনেক কিছু বলতে চায়, আমার কাছ থেকে জানতে চায়, কিন্তু কোথাও যেন আটকে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মানুষ যা বলতে চায় তা বলতে পারে না। কথা গুলো নিজের ভিতরে আটকে রাখে। আমি জনাব অর্ককে আবার প্রশ্ন করলাম “আপনি বিয়ে ব্যাপারটাকে কি মনে করেন বা এটাকে কিভাবে দেখেন?” যতগুলো পাত্র দেখতে গিয়েছি কাউকেই এই প্রশ্নটা করা হয়নি। আমার মা বাবা সহ সবাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। অর্ক একবার মাথা নিচু করে আমার দিকে তাকিয়ে তার হাসিটা দিয়ে একটু সময় নিয়ে বললো “বিয়ে ব্যাপারটা নিয়ে এমন করে ভাবিনি। আপনি নিজেকে মাঝে মাঝে বাচ্চা মনে করেন। কিন্তু আমার কাছে এই প্রশ্নটা করার আগ পর্যন্ত আপনাকে বাচ্চা বাচ্চা মনে হয়েছে। যখন প্রশ্নটা করলেন তখন মনে হলো বাচ্চারা তো এমন প্রশ্ন করতে পারে না।আমার কাছে বিয়ে মানে হলো এতোদিন আমি পৃথিবীটাকে যতটুকু পেরেছি দুইটা চোখে এঁকেছি আর বিয়ের পর চারটা চোখে পৃথিবীটাকে যতটুকু পারা যায় আঁকতে হবে, চোখের মাঝে পৃথিবীর অদ্ভুত রুপটা বন্দি করতে হবে। এই আঁকার মধ্যে মাঝে মাঝে যখন বৃষ্টি পড়বে তখন আঁকা রংগুলো চোখ দিয়ে বেয়ে বেয়ে পড়বে। তখন সেই জলরাশি মুছে দিয়ে আবার পৃথিবীটাকে আঁকতে হবে। কি কঠিন করে বলে ফেলেছি তাই না? একটু সহজ করে বলি শুনোন বিয়ে মানে হলো অন্য আর একজন মানুষের ভালো লাগা মন্দ লাগার মাঝে প্রবেশ করা। অপর মানুষটার দায়িত্ব নেওয়া।” আমি অনুধাবন করি একটা মানুষের ভিতরের অনুভূতি কতটুকু গভীর হলে এমন করে কথা বলতে পারে।এমন করে ভাবতে পারে। আমি আর কিছু প্রশ্ন না করে ব্যাগ থেকে পাঁচশত টাকা নিয়ে উনাকে দিয়ে বললাম “এটা রাখেন।আমরা পরে জানাবো পছন্দ হয়েছে কিনা। কিছু খাইনি বলে মনে কিছু নিবেন না। উঠি তাহলে।” আমার কথা শুনে অর্ক হাসতে লাগলো। আমি জানি না উনি কেন এমন করে হাসছে। হয়তো আমার উদ্ভট এমন আচরনে। যখন উনাদের বাড়ি থেকে বের হলাম উনি আমাকে ডাক দিয়ে বললো “সবি তো করলেন। সব ছেলে পক্ষরা পাত্রী দেখতে গিয়ে পাত্রী দেখার পর খুশি হয়ে কিছু টাকা পাত্রীর হাতে দিয়ে আসে। কিন্তু আপনি আমাকে দিলেন। আমার কেমন লাগছে আমি আপনাকে তা বলবো না। টাকাটা আমার কাছে যত্ন করে রেখে দিব। তবে বিষয়টা আমার কাছে অদ্ভুত লেগেছে। সবই যখন করেছেন আর একটা কাজ বাকি আছে ওটাও করে যান। পাত্রী দেখার পর পাত্ররা পাত্রীর কাছ থেকে নাম্বারটা নেয় বা যেকোন ভাবে পাত্রীর নাম্বার জোগাড় করে।আপনারও এখন দায়িত্ব আমার নাম্বারটা নেওয়া। কি ঠিক বলেছি?
আজকে একটা বিশেষ দিন। এই দিনটাতে আমি সালেহা আপার পাশে যতটা সময় পারা যায় থাকি। মানুষটাকে দেখলে কষ্ট লাগে, মায়া লাগে। আমাদের মানুষের মনে অনেক রকমের কষ্টরা বাস করে। কেন যেন এই কষ্ট গুলোর নাম আমি দিতে পারি না। ভাবি মানুষ গুলো এই কষ্টকে নিজের মাঝে জায়গা দিয়ে কি করে পৃথিবীর মাঝে বেঁচে থাকে? উনি একজন যুদ্ধ শিশু। ঠিক আজকের এই তারিখে ১৯৭২ সালের জুলাইয়ে তিনি পৃথিবীর মুখ দেখে। সালেহা আপার মায়ের নাম ছিল আফিয়া আক্তার। যুদ্ধের সময় এই আফিয়া আক্তারের পরিবারের সবাইকে যখন মেরে উনাকে পাকবাহিনীরা তুলে নিয়ে গিয়ে সতীত্ব নষ্ট করলো তখন উনার বেঁচে থাকার ইচ্ছা ছিল না।দিনের পর দিন এই আফিয়া আক্তারের উপর নির্যাতন চলতো। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যখন নির্যাতন চলতো আকাশটা ঠিক ততবার কেপে উঠতো। কান্না করতে করতে আফিয়া আক্তার বার বার বলতো “আমারে মাইরা ফেল। আল্লাহর দোহাই লাগে আমারে মাইরা ফেল। আল্লাহ তোগরে কোনদিন ক্ষমা করবো না। এ কষ্ট আর সহ্য হয় নারে। আমারে মাইরা ফেলোস না ক্যা হারামীরা?” আফিয়া আক্তারের বয়স তখন ছিল উনিশ। এই নির্যাতন টানা তিনমাস চলতে থাকে। একটা সময় আফিয়া আক্তার বুঝতে পারে তার মাঝে আর একজন আসছে। এই ব্যাপারটাও যখন পাকবাহিনীরাও বুঝতে পারলো তখন তাকে গুলি করে মারার জন্য আদেশ আসে ইলিয়াস নামক এক পাক সেনার উপর। মারার পর যেন মাটিতে পুতে দেয় এটাও বলেছিল। কিন্তু ইলিয়াস তাকে না মেরে বলেছিল “মেবি এক আদমি হু।কাবি কাবি মুজে আপনে আপসে নাফরাত হে। তুম হার রোজ রয়াতা, মে জানতা তা লিকেন কুচবি নেহি কারসাকা।মুজে মাফকার দো। আগার মে তুমহি মারদো, তুম মেসে এক আর আহাহে মে উছিকো কেছে মারদু?” যার অর্থ ছিল “জানেন আমিও একজন মানুষ। মাঝে মাঝে আমার নিজের প্রতিও ঘৃনা হয়। আপনি প্রতি দিন যখন কান্না করতেন আমি বুঝতাম কিন্তু কিছু করতে পারতাম না। আমাকে মাফ করে দিবেন। আপনাকে আমি মেরে ফেললেও আপনার মাঝে আরেকজন যে আসছে তাকে আমি কি করে মারবো বলেন?” আফিয়া কান্না করতে থাকে। আফিয়ার কান্না দেখে হঠাৎ করে ইলিয়াস বলে “আপনাকে আমি একটা জীবন দিব নতুন জীবন, নিবেন? আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। আপনাকে আমার সেই প্রথম দিন দেখেই ভালো লেগেছে। কিন্তু আমার হাত পা তো বাধা ছিল এটা কি বুঝতে পেরেছেন? প্রতিটা দিন আপনি যখন কান্না করতেন আমিও কান্না করতাম। আপনার জন্য কাঁদতাম। আপনাকে নিয়ে আমি এখান থেকে চলে যাবো যে করেই হোক। যাবেন আমার সাথে?” কথাগুলো উর্ধুতে বলেছিল। আফিয়া আক্তার বুঝতে পারেনি কি করবে। ইলিয়াস, আফিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরে। যখন আফিয়ার হাতটা ইলিয়াস ধরেছিল তখন আফিয়া অনুভব করে এই ধরাটা কোন জানোয়ারের ছোয়া না। রক্ত মাংসে গড়া একটা মানুষের ছোয়া। ভালো মানুষের। তারপরই ইলিয়াস আফিয়াকে নিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু দেশের বাহিরে যেতে পারেনি। পালিয়ে পালিয়ে এ স্থান থেকে ঐ স্থানে থেকেছে। একটা সময় দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু এদেশের মানুষ ইলিয়াসকে বাঁচতে দেয়নি। পাক সেনা দলের মানুষ মনে করে মেরে ফেলে। ইলিয়াসকে মারার আগে আফিয়া কান্না করে বলেছিল “আপনারা উনারে মাইরেন না। আপনাগো পায়ে পড়ি মানুষটারে ছাইড়া দেন। আমি বহুত আগেই মইরা যাইতাম বিশ্বাস করেন কিন্তু এই মানুষটার লাইগা আমি বাইচা আছি। মানুষটা আমারে বড় ভালোবাসে।” কিন্তু কেউ কথা শুনেনি। তখন এদেশের মানুষের ভিতরে একটা আগুন জ্বলছিল।দাউ দাউ করা ভয়ানক আগুন।
সালেহা আপা আমাকে জিজ্ঞেস করলো “নুসরাত তোমার পাত্র দেখা কেমন লাগলো? ছেলেকে পছন্দ হয়েছে?” আমি আপার দিকে তাকিয়ে থাকি। এই সালেহা আপাই হলো আফিয়া আক্তারের মেয়ে। এ সমস্থ কিছু সালেহা আপা আমাকে বলেছিল। উনার মা এখনো বেঁচে আছে। বেঁচে থাকলেও বাঁচার মত না। চলাফেরা করতে পারে না। বিছানায় পড়ে আছে। কেউ যখন উনার সামনে যায় শুধু চুপ করে তাকিয়ে থাকে। কিছু বলে না। সালেহা আপার একটা সন্তান আছে, স্বামী আছে। পরিবার আছে। তবু মাঝে মাঝে উনাকে আমি বিষণ্ন দেখি। হয়তো এই বিষয়টা উনাকে মাঝে মাঝে ঠিক থাকতে দেয় না। তবু আমার খুব ভালো লাগে যখন দেখি সালেহা আপা তার পরিবার নিয়ে হাসিখুশি আছে। এতো কিছুর মাঝেও উনি এই পর্যায়ে আসছে তা দেখে আমি পুলকিত হই। উনি আমার সাথেই চাকরি করে। উনি প্রায় বলে “জানো নুসরাত, মা প্রায় আমাকে অবহেলা করতো, চড় থাপ্পড় মারতো। কিন্তু মারার কিছুক্ষন পরই কাছে এসে বলতো মনে কষ্ট পাইছিস, ব্যাথা পাইছিস মা?” একটু একটু করে যখন বড় হতে লাগলাম তখন জানতে চাইতাম কে আমার বাবা। মা কিছু বলতো না। কিন্তু একটা সময় বলতে বাধ্য হলো। তারপর দিন থেকে আমি প্রতিটা রাত কেঁদেছি নুসরাত । নিজের প্রতি ঘৃনা হয়। মায়ের তো কোন দোষ ছিল না। একদিন মায়ের কাছে গিয়ে বলেছিলাম “জন্মের পর আমাকে মেরে ফেলোনি কেন? মা শুধু চোখ ভরা জল নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল “মানুষ মারতে পারি না। ভয় লাগে।” আমি সালেহা আপাকে বলি “আপা ছেলের নাম অর্ক।একটু গভীর টাইপের কথাবার্তা বলে। ফোন নাম্বার নেওয়া হয়েছে কিন্তু ফোন করা হয়নি। ভাবছি একদিন করবো।” সালেহা আপা শুধু একটা হাসি দেয়। আর বলে আচ্ছা।
দুদিন পর হঠাৎ করে অর্কের সাথে আমার দেখা হয়ে গেলো যখন আমি বাসায় যাওয়ার জন্য রিকশায় জ্যামে আটকে পড়ে আছি। প্রথমত খেয়ালই করিনি ও আমার পাশের রিকশায় ছিল। অর্ক আমাকে দেখেই বললো “এই যে ভালো আছেন? চিনতে পেরেছেন আমাকে?” আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা দিয়ে বুঝালাম পেরিছি এবং ভদ্রতার সহিত তাকে বললাম “আপনার কি অবস্থা? আপনি ভালো আছেন তো?” সে একটা হাসি দেয়। আমি বুঝিনা উনি সব সময় হাসে কেন? আমি তো এমন হাসতে পারি না। আচ্ছা যে মানুষ গুলো সব সময় এমন করে হাসে তাদের কি কোন দুঃখ নেই? নাকি তাদের দুঃখ গুলো এই জগতের মানুষকে বুঝতে দেয় না।। হাসি দেওয়ার পরই আমাকে বললো “মন খারাপ ছিল। আজকে অফিসের বস থেকে ঝাড়ি খেয়েছি। ব্যাটা বড় জাউড়া। আপনাকে দেখে মন ভালো হয়ে গেলো। সেদিনের পর আপনার কথা মাথায় যত বার এসেছে বা আপনাকে নিয়ে যতবার ভেবেছি ঠিক ততবার আমার হাসি পেয়েছে। আচ্ছা আপনি কি আমার হাসি নিয়ে কোন কিছু ভাবছেন? ভাবতেই পারেন বা আমাকে মনে মনে বকা দিয়ে বলতে পারেন বদমাইশ ছেলে কথায় কথায় হাসিস কেন? হা হা হা। তা অফিস থেকে নিশ্চয় ফিরছেন?” আমি বললাম “হ্যাঁ অফিস থেকে ফিরছি। একটা কথা বলবো?” অর্ক মাথে নাড়ে। আমি বললাম “সত্য কথা বলতে কি আমি আপনার হাসি নিয়ে একটু ভেবেছি এই যে আপনি কথায় কথায় হাসেন কেন কিন্তু কোন বকা দেইনি।” অর্ক বললো “আমরা মানুষেরা ভাবুক। কত কিছু নিয়ে ভাবি।এই সেই নিয়ে ভাবি। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় কি জানেন আমাদের মনের ভিতর একটা ভাবুক নামের সফটওয়্যার আছে। এটা আমাদের ভাবতে সহায়তা করে। এই দেখুন না আমার এখন মন বলছে আজকে রাতে বৃষ্টি আসবে। বৃষ্টি আপনার পছন্দ?” আমি চুপ করে থাকি। যখন জ্যাম ছুটে গেলো তখন তাকে জানালাম আপনার সাথে নিশ্চয় আবার কোন এক সময় দেখা হবে এবং কথা হবে।
গভীর রাতে যখন প্রচন্ড বৃষ্টি আসলো আমি তখন জানালার শিক ধরে অর্কের কথাটা ভাবলাম।মানুষটা কি করে বুঝতে পারলো বৃষ্টি আসবে? কিন্তু এই বৃষ্টির শব্দটা আমার মনকে ভালো লাগার ছোয়া দিতে পারে না। যখন টুপটুপ করে বৃষ্টি পড়ে তখন মনে হয় বুকের মধ্যে কেউ পাথর নিক্ষেপ করছে। তখন একটা শূন্যতা অনুভব করি।একা লাগে খুব একা। আমি তো একা ছিলাম না। সারাদিন বড় আপুর সাথে ফাজলামো করতাম। তাকে জ্বালাতাম। আমার বড় আপুর নাম ইশরাত জাহান নাবিলা। ওর একটা সমস্যা ছিল কথা বলতে পারতো না। কিন্তু আমি ওর কথা বুঝতাম। ও কি বলতে চায়, কি বুঝাতে চায় সবকিছু। মা যখন আমাকে শাসন করতো আমি দৌড়ে নাবিলা আপুর কাছে চলে যেতাম। ও আমাকে আদর করে ডাকতো নুসু। কেউ না বুঝলে আমি তো বুঝতাম। আমাকে বলতো “নুসু মাকে জ্বালাতে তোর ভাল্লাগে? আর একবার মাকে বিরক্ত করলে তোকে পাঁচতলা ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিব।” কিন্তু ও নিজেই ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে মারা যায়। সেদিন রাতের আকাশটা থমথমে ছিল। ঝিড়ঝিড় করে বৃষ্টি হচ্ছিল। এই বৃষ্টি আসলেই সেদিনের কথা আমাকে মনে করিয়ে দেয়। প্রতিটা পাত্র পক্ষ যখন ওরে দেখে যাওয়ার পর ফিরিয়ে দিত আমি বুঝতাম ওর মনের বিষণ্নতা। মারা যাওয়ার তিন দিন আগে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল “আমি যদি কোথাও চলে যাই তুই কি আমাকে খুঁজবি?” আমি হেসে বলেছিলাম “নাতো তোকে খুঁজবো কেন?” ওর মুখটা কেমন জানি হয়ে যেতে দেখলাম। তারপর ইতস্তত হয়ে বললো “মাকে কোন দিন কষ্ট দিবি না ঠিকাছে? আর আমার ভালো বাবাটাকে দেখে রাখবি।” আমি ওর কথা গুলোকে পাগলামি ভেবেছিলাম। আমি বুঝিনি সত্যি বুঝিনি তুই কেন এমন করে বলে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলি। আমি যদি বুঝতাম তোকে সত্যি যেতে দিতাম না। আপু তুই কি ওখান বুঝতে পারিস আমি আমার প্রতিটা দীর্ঘশ্বাসে তোকে খুঁজি? কেন এমন করলি?
আমি মনের সংকোচতা নিয়ে অর্ককে ফোন করে বললাম “আপনার কেন মনে হলো আজকে বৃষ্টি আসবে?” ও কিছুটা সময় নিয়ে বললো “আমি জানতাম আপনি আমাকে আজ ফোন দিবেন।আপনার ফোনের জন্যই জেগে আছি বিশ্বাস করেন। আপনার নিশ্চয় মন খারাপ। মন খারাপ কারণ ছাড়া হয় না। তবু আমরা যখন কাউকে জিজ্ঞেস করি মন খারাপ কেন? অনেকে বলে এমনিতে মন খারাপ।সেই অনেকে বুঝতেও পারে না আসলে মন খারাপটা হঠাৎ করে হলো কেন? কিন্তু মন খারাপের কারণ থাকে। কারণ ছাড়া আকাশের নীল রংটা কালো হয় না।আপনার মন খারাপের কারণটা জানতে পারি নুসরাত?” এই কথার প্রত্যুত্তর কি দেওয়া যায় আমি বুঝতে পারলাম না। ভেবেছিলাম অর্ককে মিথ্যে বলে দিব আপনাকে আমার পছন্দ হয়নি। যেমন করে সবাইকে বলে দিতাম। কিন্তু এই মানুষটাকে কথাটা বলতে মন সায় দিচ্ছে না।তাকে আমার জীবনের গল্প শোনাই। শোনাই পাত্রী দেখা কোন সাধারণ বিষয় না। এই বিষয়টায় কতটা জর্জরিত হয়ে আমার বোন আত্মহত্যা করেছিল। আর এটাও শোনাই কেন আমি একজন মেয়ে হয়েও পাত্র দেখতে যাই। সে আমার জীবনের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কিছুক্ষন সময় নিয়ে আমাকে বলে “আপনি আমাকে যতটা হাসি খুশি ছেলে মনে করেন আমি ততটা এমন না। প্রতিটা মানুষের জীবনের গল্প থাকে। সেই গল্পের মাঝে মিশে থাকে রং ধনুর সাত রং। আজ না হয় আপনার জীবনের গল্প আমাকে শুনালেন। কথা দিচ্ছি কোন একদিন আমার জীবনের গল্প আপনাকে শুনাবো। শুভ রাত্রি নুসরাত।
সাত দিন পর ঢাকার হাতিরঝিলে বসে বর্ণিল আলোকচ্ছটা আমার চোখে যখন আঁকতে শুরু করলাম তখন অর্ক আমাকে বললো “দেখা করার জন্য ধন্যবাদ। এই প্রকৃতির মাঝে অনেক কিছু মিশে আছে। প্রকৃতি তার রুপ লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে না। সে তার রুপ আমাদের মাঝে মেলে ধরে আর বলে আমাকে দেখো, এবং অনুভব করো হৃদয়টা দিয়ে। গভীর থেকে গভীরে। আমাদের মানুষের মাঝে মাঝে দালান কৌঠা থেকে বের হয়ে একটু চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নেওয়া দরকার।ইট পাথরের এই ঘন বসতিপূর্ণ জীবনযাত্রার মাঝে এমন জায়গা ছাড়া কোথায় একটু প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেওয়া যায় বলেন?” আমি চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে অনুধাবন করি একটা মানুষের মন কত কিছু নিয়ে ভাবতে পারে।ভাবনার আঁকা স্বপ্ন গুলো আবার কি চমৎকার করে উপস্থাপন করতে পারে।অর্ক আমার চুপ থাকা দেখে বললো “আজকে আমার জীবনের গল্প শোনানোর কথা। আমার জীবনের গল্পটা মেঘের আকাশের মত বিশাল না।রোদ আসলে যেমন মেঘের ভাবটা কেটে যায় ঠিক তেমন। আপনাকে আমার জীবনের গল্প শোনানোর আগে একটা কবিতার শেষের কয়েকটা লাইন দিয়ে শুরু করি। আমার পছন্দের কবিতা। নির্মলেন্দু গুনের কবিতা। মন দিয়ে শুনেন এবং অনুভব করেন।
প্রিয়জন চলে গেলে মানুষই ব্যথিত হয়
আকাশ নির্বিকার, আকাশ কখনও নয়।
তোমরা মানুষ, তাই সহজেই দুঃখ পাও
হে ঈশ্বর আমাকে আকাশ করে দাও…
কবিতাটা বলেই অর্ক একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলি “আকাশের কি কোন দুঃখ থাকে না?” অর্ক আমার কথা শুনে হাসি দেয়। হাসতে হাসতেই বললো “না আকাশের কোন দুঃখ থাকে না। দুঃখ থাকে আমাদের মানুষের। আমারও দুঃখ আছে। যার জন্য দুঃখ আছে সে মানুষটা আমার থেকে তিন বছরের বড়। তার নাম মালিহা। ভার্সিটিতে তার সাথে আমার দেখা বা পরিচয়।এই একটা মানুষকে আমার সমস্ত কিছু দিয়ে চেয়েছিলাম।রোজ ওর পিছু পিছু ছুটতাম একটু দেখার জন্য, একটু কথা বলার জন্য।ও যখন ওর চোখের পলক ফেলতো আমার ভিতরে কি যেন একটা হতো বিশ্বাস করেন।সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমার ভালো লাগার কথা তাকে জানাবো। যেদিন আমার ভালো লাগার কথা তাকে জানালাম ও খুব হেসেছিল। ওর ফ্রেন্ডরা মজা করেছিল। আমি বলেছিলাম “অনুভূতি মানুষকে কিভাবে পরিচালনা করে সেটা আমি জানতাম না বা বুঝতাম না। একটু একটু করে যখন জানলাম বা বুঝতে শিখলাম তখন মনে হলো এতো বিশালত্বের মাঝে মানুষ কি করে এমন হাজার হাজার অনুভূতি নিজেদের মাঝে লুকিয়ে রাখে? আমার ভিতরে যে অনুভূতিটা আছে সেটা আপনার জন্য।” এর কিছুটা সময় পর ও আমাকে ভদ্রভাবে বিশাল একটা লজ্জা দিয়ে বলেছিল “তুমি আমাকে যে ফলো করো, কেন করো সেটা আমি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছি।আমার একজন ভালোবাসার মানুষ আছে তার সাথে তোমাকে একদিন পরিচয় করিয়ে দিব ঠিকাছে ভাইয়া?” আমার খুব খারাপ লেগেছিল তখন।আমি জানতাম ওর কোন ভালোবাসার মানুষ ছিল না।কিন্তু ও কেন আমাকে এই কথাটা বলেছিল যখন বুঝতে পেরেছিলাম তখন আমি আর ওর সামনে যাইনি।এরপর ঠিক সাত বছর পর ওর সাথে হঠাৎ করে দেখা।আমাকে দেখেই ও কি বলেছিল জানেন? বলেছিল “আমার সাথে কি তোমার দেখা করার একটা বার উচিৎ ছিল না?এই শহর ছেড়ে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে? এই আমি কত খুজেছি। যখন হঠাৎ করে হারিয়ে গেলে তখন একটু একটু করে অনুভব করতে পেরেছিলাম তুমি আমাকে কতটা চেয়েছিলে।এতো অভিমান তোমার? কত অপেক্ষা করেছি জানো? আমার এই অপেক্ষার সময়টাকে বাসার সবাই পাগলামি ভাবতো। একটা সময় আর অপেক্ষা করতে পারিনি।” অর্ককে এখন আমার কি বলা উচিৎ আমি ঠিক জানি না।কথা গুলো বলার পর সে হাসতে থাকে। আমি বুঝিনা একটা মানুষের ভিতরে কিছু একটা হওয়ার পরও এমন করে হাসে কিভাবে?
বাবাকে চা বানিয়ে দেওয়ার পরই আমি খবর পেলাম সালেহা আপার মা মারা গেছে।আমি ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়ি।হঠাৎ করে একগাদা জল আমার চোখের কোনে এসে জমা হয়।মানুষটা কি পরিমান যন্ত্রনা নিয়ে পৃথিবীর বুকে বেঁচে ছিল।আমার ভীষন কষ্ট হতে লাগলো। জীবনে এই প্রথম একটা মানুষের জন্য একটা অন্য রকম কষ্ট আমাকে ছুয়ে দিল।আমি জানি না সালেহা আপার মনে এখন কি চলছে। আমাকে যে একবার যেতে হবে।
কিছুদিন পর অর্কের পরিবার থেকে জানিয়ে দিল “অর্কের বাবা মা এই বিয়েতে রাজি না।” ভালোই হয়েছে আমি যদি অর্ককে না করে দিতাম উনি কি পরিমাণ কষ্ট পেত এটা আমি অন্তত বুঝতে পেরেছিলাম। আমি উনাকে ফিরিয়ে দিতেও পারছিলাম না। আমার জীবনে এতো কষ্ট বয়ে গেছে এটা নিশ্চয় সহে যেতে তেমন একটা অসুবিধা হবে না।
ঘুম থেকে উঠে সকালটাকে দেখলাম অন্ধকারে ছেয়ে আছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। মা একবার এসে বলে গেলো “আজকে অফিসে যাওয়ার আর দরকার নেই।” আমি মাকে কিছু প্রত্যুত্তর জানাইনি।বাবার ডায়াবেটিসটা ইদানিং একটু বেড়েছে।কেমন যেন বিষণ্ন মন নিয়ে বসে থাকে। আপু আত্মহত্যার পর আমার ভালো বাবাটা কেমন যেন হয়ে গিয়েছে।প্রায় রাতে আমি বুঝতে পারি বাবা আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না করে। আমি তার কান্না করাটাকে থামাই না।কেন যেন ইচ্ছে করে না। ড্রয়িং রুমের দিকে যখন গেলাম তখন মনের ভিতর একটা ছোট খাটো ধাক্কা খেলাম অর্ককে দেখতে পেয়ে।বাবা মা আর ও তিনজনেই বসে চা খাচ্ছে। আমি বেশ অবাক হলাম এই দৃশ্যটা দেখে। আমাকে দেখেই অর্ক সোফা থেকে উঠে বললো “নিশ্চয় ঘুম ভালো হয়নি?” আমি চুল কানে গুজে একবার ওর দিকে তাকাই আর একবার বাবা মায়ের দিকে তাকাই। আমার এমন তাকানো দেখে ও বললো “আমি যে এখানে আসছি আপনাকে জানাতে নিষেধ করেছি উনাদের। আমি জানি গতকালকের নিউজটা পেয়ে আপনার মন ভালো নেই।ইনিয়ে বিনিয়ে কিছু একটা বলে এখন আপনার মন ভালো করে দিব এই যোগ্যতাটা আমার নেই। আমি আসলে দেখতে এসেছি মন যখন খারাপ থাকে তখন আপনাকে কেমন দেখায়। অবাক হচ্ছেন তাই না? অবশ্য আর একটা কারণে আসছি। বাবা মাকে রাতে বলে দিয়েছি আমার জীবনে অনেক কবিতা জমা হয়ে আছে। আমার জীবনের জমে থাকা প্রতিটা আবেগ, বেদনাময় কবিতা কাউকে শুনাতে ইচ্ছে করে।সেটা শোনানোর দরকার। আমি জানি আপনার মত ভালো শ্রোতা আমি আর কাউকে পাব না। তাই আপনাকে আমি কবিতা শুনাতে আসছি। শুনবেন না?” আমার চোখে জল আসে।এই লোকটা এমন মায়ামায়া ভাবে কি করে কথা বলে? এমন মায়ামায়া ভাবে কথা বললে কি করে আমি ফিরিয়ে দিতে পারি? আমার মুখ দিয়ে কথা বের হয় না।আমি অনুধাবন করি আমি কি কখনো একজন ভালো শ্রোতা ছিলাম? আজকে এই বৃষ্টিঝড়া দিনে আমি শুধু একজন শ্রোতা নয় উপলব্দি করতে চাই মেঘে মেঘে কত বেলা কেটে যায়…