একটু প্রেম

একটু প্রেম

জোৎস্নার আ‌লো আজ উপ‌চে প‌ড়ে‌ছে ধরায়।‌মেঘ মুক্ত গগন,বস‌ন্তের লগন,ফাল্গুনীর নিশী। মৃদু দক্ষীণা সমীর‌নে উড়‌ছে তেলমুক্ত কেশ,‌মৃদু ঢেও খেল‌ছে বি‌লের বদ্ধ জল।তার উপর ফাল্গুনীর ছায়া চিক চিক কর‌ছে তির্জক আকা‌রে বহু দূর পর্যন্ত।‌থে‌কে থে‌কে নিশাচর‌দের ডাক ভে‌সে আস‌ছে।‌শা‌ন্তির অভয় যেন চা‌রিধার।যতটা ভা‌লো লাগা মন‌কে দোলা‌চ্ছে,ততটা বেদনা হৃদয়‌কে হেলা‌চ্ছে।‌থে‌কে থে‌কে শেয়া‌লের হাক যেন প্রকাশ কর‌ছে করুন আ‌র্তি।‌ছোট্ট ডিঙ্গার ছি‌পে ব‌সে আ‌মি অপলক নে‌ত্রে জ‌লের বু‌কে ফাল্গুনীর ছায়া পা‌নে।অ‌পেক্ষায় আ‌ছি মাহমুদ ভাই আস‌বে ব‌লে।

আমার দেখা যত ভা‌লো মানুষ,তার মা‌ঝে মাহমুদ ভাই‌কে সেরা আস‌নে রে‌খে‌ছি।সত্য বল‌তে আ‌মি জীব‌নের প‌দে তার অনুকরন কর‌তে চেষ্টা ক‌রি,‌কিন্তু পে‌রে উ‌ঠি না।‌তার মত ম‌নে প্রা‌ণে ভাল মানুষীকতা নেই কি না তাই।
‌উনার চেহাড়া অমা‌য়িক,সুচা‌লো নাক,ঈষৎ লম্বা চিবুক,টানা পুরুষদীপ্ত দৃ‌ষ্টি ধারী দু‌টি চোখ।ঘন কেশ,‌উপর ক‌রে রাখা।‌সে এক অ‌নিন্দ অনন্য পৌরু‌ষের মূ‌র্তিমান রুপ।সাহস, বিদ্যা বুদ্ধি,শৃঙ্খলতা,সামা‌জিকতা তার প্র‌তি প‌দে প‌দে।‌তি‌নি একাধা‌রে যেমন উচ্চ‌বি‌ত্তের সা‌থে,‌তেমন নিম্ন‌বি‌ত্তের সা‌থে মি‌শেন।

ঐ তো উ‌নি আস‌ছেন,পড়‌নে সাদা চে‌কের লুঙ্গী,গা‌য়ে আকাশী ফতুয়া,আর হা‌তে বাঁশের বাঁ‌শি।মাহবুব ভাইএর বাঁ‌শির স‌ু‌রের বায়নাধারী আ‌মি অ‌নেক দি‌নের।অব‌শে‌ষে আজ বায়না পূর‌নে সু-মতি তার।
:‌কি ফিরুজ,তু‌ই তো আ‌গেই এ‌সে ব‌সে আ‌ছিস দেখ‌ছি।
:জী ভাই,
আজ এ ফাল্গুনীর রা‌তে,
চায় মন বাঁ‌শির সু‌রে হাড়া‌তে।
পা‌রি নি কো ঘ‌রে মন ফেড়া‌তে,
বেদনার্ত মন বিধুর হ‌তে চায়,
করুন সু‌রের নীরব মূর্ছনা‌তে।”
:”বাহ! বাহ! বাহ! দারুন বেঁধে‌ছিস।‌তোর কা‌ব্যিকতা আমা‌কে
মুগ্ধ ক‌রে জা‌নিস?”
‌ডিঙ্গার পাটায় বস‌তে বস‌তে বল‌লেন মাহমুদ ভাই।আ‌মি হা‌সি,
:”হা হা হা,‌কি যে ব‌লেন ভাই,কা‌ব্যিকতা!আর আ‌মি!‌সে বড় অকা‌লের ক‌বি দৈন্যতা বৈ নয়।”
:”হা হা হা,পা‌রিসও ব‌টে। ওওওও মা‌ঝি নাউ বাউ।‌শেয়া‌লে ধর‌বে।হা হা হা।”
:”অব‌শে‌ষে মা‌ঝি!হা হা হা”।
‌বৈঠা ঠে‌লে বললাম আ‌মি।‌কিছুটা নিরবতা,ধীরে ডিঙ্গা চালা‌চ্ছি বি‌লের শান্ত জ‌লের বুক চি‌ড়ে।‌কু‌নো ব্যাঙ এর কড় কড় শব্দ দূরাগত ম‌নে হ‌চ্ছে।মাহমুদ ভাই,দু পা ছ‌ড়ি‌য়ে বাঁ‌শি‌তে ফুঁ দি‌লেন।এ‌লোপাথা‌রি ছন্দহীন সুর উ‌ঠে‌ছে।ঝা‌লি‌য়ে নি‌চ্ছেন আঙ্গুল।‌কিয়দক্ষণ প‌রে বাঁ‌শিটা জ‌লে চুবানী দি‌লেন,ঝাঁ‌কি‌য়ে নি‌য়ে আবার ঠোট ছোঁয়া‌লেন।‌শিহর‌নে কেঁ‌পে উঠ‌লো আমার দেহ।‌বি‌মো‌হিত হলাম সু-করুন সু‌রে।‌নিস্তব্ধ যে‌নো চা‌রিধার,বৃক্ষরা‌জি অনড় নিরবতায় যেন বেদনাদগ্ধ।মাঝ বি‌লে আমরা দু‌টি প্রাণী মে‌তে উ‌ঠে‌ছি বেদনা বিলা‌সে।‌কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম,চাঁ‌দের আ‌লো‌তে চিক চিক কর‌ছে মাহমুদ ভাই এর গা‌লের প‌রে দু‌টি জল রেখা।মন উজার ক‌রে সু‌রে সু‌রে জানান দি‌চ্ছেন বেদনার রিক্ততা।কি এত বেদনা তার,‌কেন এত চাঁপা আ‌বেগ তার?‌জে‌নেই নে‌বো আজ।

অ‌নেক ক্ষণ পর থাম‌লেন মাহমুদ ভাই।একটা সিগা‌রেট ধ‌রি‌য়ে লম্বা লম্বা টান দি‌লেন।সবটা ধুয়া গলাধকরন ক‌রে আবার ছাড়‌লেন আকাশ পা‌নে।আ‌মি নি‌রব দর্শক শ্রোতা।মাহমুদ ভাই সিগা‌রেট শেষ কর‌লেন।ক্ষীপ্ত হা‌তে ছু‌ড়ে মাড়‌লেন জ‌লে।ফতুয়ার বুতাম খ‌ু‌লে হাত‌রে নি‌লেন লোমস বুক।‌হাহাকা‌রের ছাপ ফু‌টে উ‌ঠে‌ছে তার মুখায়‌বে,আচ‌রনে।

মানু‌ষের একটা স্বভাবজাত ক্রীয়া আ‌ছে এ‌ক্ষে‌ত্রে।অ‌ন্যের কষ্ট দেখ‌লে নি‌জের কষ্ট গু‌লোও মাথা চাড়া দি‌য়ে ভে‌সে উ‌ঠে সহম‌র্মিতায়।‌অপর মানুষ‌টির প্র‌তি যেমন জা‌গে সহানুভূ‌তি,‌নি‌জের প্র‌তি তেমনই জা‌গে আর্তনাদ।
আমারও তেমনটা হ‌চ্ছে।‌কিছু হাড়া‌নোর শূণ্যতা ম‌নে দৃশ্যত হ‌চ্ছে।
:”জা‌নিস ফিরুজ,ত্যাগ বড় অদ্ভুত।ত্যাগ যেমন ম‌নে প্রশা‌ন্তি দেয়,‌তেমন অপ্রা‌প্তির হাহাকারও দেয়।ত্যা‌গে মানুষ যেমন হয় মহান,‌তেমন হয় সর্বশান্ত।”
:”জী,ভাই।আচ্ছা ভাই,আজ ব‌লেই ফেলুন আপনার গল্প।”
:”শুন‌বি?রাত যে পোহা‌বে রে?”
:”কত রাতই তো নির্ঘুম কা‌টে,আজ না হয় আপনার গ‌ল্পে কাট‌লো।”
:’হুমমম।”
মাহবুব ভাই একটা সিগা‌রেট ধরা‌লেন।আকা‌শে ধুয়া উ‌ড়ি‌য়ে বল‌তে শুরু কর‌লেন–

“”””তখন আ‌মি মে‌ট্রিক দি‌য়ে‌ছি,অবস‌রের সময়টা‌তে একটা ফু‌লের বাগান গ‌ড়ি বাড়ীর সাম‌নে।ঘাসফুল থে‌কে বি‌ভিন্ন ফুল ছিল ব‌াগা‌নে।আমা‌দের বাড়ীর নাম হ‌য়ে যায় নন্দন কানন।অ‌নেক মানুষ দেখ‌তে আস‌তো ফু‌লের মাধুর্যতা।জা‌নিস,মানুষ নির্স্বার্থ ভা‌বে য‌দি কিছু ভা‌লো বা‌সে,যত্ন ক‌রে,তা কেবল ফুল আর ফুল গাছ।রা‌তে হাসনা‌হেনার গ‌ন্ধে সুবাসীত হ‌তো চারপাশটা,খুব ভা‌লো লাগ‌তো আমার।‌রে‌াজ সকা‌লে ব্রাস কর‌তে কর‌তে বাগান চর্চা ছিল আমার নিয়‌মিত কাজ।প্র‌তিটা বি‌কেল ছিল প্রশংসায় আনন্দময়।সবাই বাগান দে‌খে প্রশংসা কর‌তো।মা‌ঝে মা‌ঝে বি‌ভিন্ন অনুষ্ঠা‌নে শু‌ভেচ্ছা সরূপ শুভা পেতো আমার বাগা‌নের ফুল।

আ‌মি ইন্টা‌রে ভ‌র্তি হলাম,‌বেশ কাট‌ছিল দিন।এক‌দিন বি‌কে‌লে জানালার ধা‌রে ব‌সে রক্তাক্ত প্রান্তর পড়‌ছিলাম।‌ মে‌য়ে কন্ঠ শুন‌তে পেলাম,‌কে যেন ফিস ফিস ক‌রে বল‌ছে,”ইশ! যে মানুষটা এত সুন্দর ফুলবাগান ক‌রে‌ছে,‌সে মানুষটা না কত সুন্দর ম‌নের।আ‌মি দেখ‌বো তা‌কে”
“আচ্ছা দেখা‌বো,সাম‌নে পড়‌লে।”
“না,এখন দেখ‌বো”
“ওফ! তো‌কে নি‌য়ে পা‌রি না,এখন কি ক‌রে দেখ‌বি?”
“বাসায় আ‌ছে তো,ডাক দে”
“পার‌বো না,তুই ডাক”
“দাঁড়া দেখ‌ছি”
আমার বেশ আনন্দ হ‌চ্ছিল,আমার বাগা‌নের প্রশংসা আমায় খুব আনন্দ দি‌তো বরাবর।এ বাগান আমা‌র বাড়ীর সুনাম ক‌রে‌ছে,আমা‌কেও অ‌নে‌কে চি‌নে‌ছে।বাট আ‌মি অ‌নেক‌কে চি‌নি না।এক‌দিন ক‌লেজ হ‌তে ফিড়‌ছি,প‌থে মে‌য়ে‌দের এক‌টি দল,আমা‌কে দে‌খে বল‌ছে,ঐ যে বাগান ওয়ালা।আ‌মি ম‌নে ম‌নে হা‌সি।
:”এই যে শুন‌ছেন?”
আ‌মি চ‌কিত হই।‌মে‌য়ে দুটু্ আমার জানাল‌ার পা‌শে দাঁ‌ড়ি‌য়ে।একজন‌কে চি‌নি,‌বি‌লের ওপা‌ড়ে বাড়ী।আমার জেঠার শশুর বং‌সের মে‌য়ে।বাট অপরজন‌কে দে‌খি‌নি কখনও।অ‌নেক মানুষ আ‌ছে,যা‌দের সৃ‌ষ্টিগত ভা‌বে চো‌খে আর ঠো‌টে কাজল আঁকা থা‌কে।এ মে‌য়ে‌টিও তেমন।শ্যামলা বদ‌নে,কাজল আঁকা টানা মায়বীনী দু‌টি আঁ‌খিতে উৎসুক দৃ‌ষ্টি,সরু নাক,মসৃন এ‌লো কেশ,আর্ট করা ঠো‌টে চাঁপা লাজুক হা‌সি‌তে বেশ মা‌নি‌য়ে‌ছে মে‌য়েটা‌কে।অপরূপা লাগ‌ছে।
আ‌মি কিছুটা ইতস্তত ক‌রে বললাম,
:”জী বলুন।”
:”না মা‌নে,আ‌মি একটা গোলাপ নে‌বো,‌দে‌বেন?”
:”আচ্ছা,দাঁড়ান আস‌ছি।”
বের হ‌য়ে এ‌সে বাগা‌নের দরজার শিকল খু‌লে দিলাম।
:”আচ্ছা,‌ভেত‌রে ঢু‌কে পছন্দ মত ছি‌ড়ে নিন।”
মে‌য়েটা ভেত‌রে ঢুক‌লো,বাট মুহুর্তেই কেমন যে‌নো বাচ্চা‌দের মত চঞ্চল হ‌য়ে উ‌ঠে।আমার কা‌ছে ম‌নে হ‌চ্ছিল,চঞ্চলা ছুটন্ত অবুঝ এক কি‌শোরী।‌সে চারপাশটা বিচরন কর‌ছে,প্র‌ত্যেকটা গাছ,ফুল ছুঁয়ে দেখ‌ছে,ঘ্রাণ নি‌চ্ছে।দাঁ‌ড়ি‌য়ে থাকা প‌রি‌চিত মে‌য়েটা সং‌কোচ কর‌ছে।বাট সে শ্যামা নিঃশঙ্ক।‌সে বে‌ছে বে‌ছে,ঝ‌ড়ে যা‌বে এমন দে‌খে একটা গোলাপ ছিড়‌লো।আ‌মি বললাম-
:”ওটা ঝ‌ড়ে যা‌বে তো!”
সে হে‌সে মাথা দু‌লি‌য়ে বললে
:”ঝ‌ড়ে যা‌বে দে‌খেই ছি‌ড়ে‌ছি।ঝ‌ড়েই তো যা‌বে,আ‌মি না হয় ওর একটু মূল্যায়ন করলাম,ভাল‌বে‌সে।
আ‌মি আর কিছু বললাম না,‌ঘে‌রের দরজায় শিকল দি‌য়ে চ‌লে এলাম ঘ‌রে।ওরা আ‌রো কিছুক্ষণ দাঁ‌ড়ি‌য়ে ছি‌লো বোধহয়।
এর পর হ‌তে প্রায় নিত্য আস‌তো মে‌য়েটা,মা‌ঝে মা‌ঝে চে‌য়ে নিত ফুল।কখনও বা বাগা‌নে ঢু‌কে ছি‌ড়ে দি‌তো ঝড়া ফু‌লের ডগাটা।‌যে‌নো নি‌বির এক সম্পর্ক তার গাছগু‌লোর সা‌থে।

‌সে একা আস‌তো না,কখনও পি‌চ্চি একটা মে‌য়ে তার সা‌থে নয় তো আমার প‌রি‌চিত মে‌য়েটা।এক‌দিন ওরা ফি‌ড়ে যা‌চ্ছে,বাগান দর্শন ক‌রে।আ‌মা‌কেও ও প‌থে যে‌তে হ‌বে,বাবা ক‌য়েল আন‌তে ব‌লে‌ছেন।ওরা খা‌নেকটা চ‌লে গে‌ছে।আ‌মি তখন ব‌াবার নি‌র্দেশ পেলাম।আমা‌কে দে‌খে ওরা হাটার গ‌তি মন্থর কর‌লো।আ‌মি স্বাভা‌বিক হাট‌ছিলাম।আজ ওর সা‌থে পি‌চ্চিটা।ও‌দের পাশ কে‌টে যাবার একটু পর আওয়াজ এলো-
:”এই যে মহাসয়,খুব ব্যাস্ত না কি?”
আ‌মি পিছু ফি‌ড়ি কি‌ঞ্চিত হে‌সে ব‌লি-
:”নাহ তেমন ব্যাস্ত না,ক‌য়েল আন‌তে যা‌চ্ছি।”
:”এ পথটুকু তো আমরা একসা‌থে যে‌তে পা‌রি!”
আ‌মি হে‌সে দাঁড়ালাম,ওরা এ‌লে পাশাপা‌শি হ‌াটা ধ‌রি।
:”আপনার বাগানটা খুব সুন্দর।”
:”জী,ধন্যবাদ।ত‌বে আপ‌নিও বাগানটার যত্ন নেন খেয়াল ক‌রে‌ছি।”
:”হা হা হা,বাব্বাহ!‌সে খেয়াল ও রে‌খে‌ছেন দেখ‌ছি।আপ‌নি তো বেশ মিন‌সে।”
:”হতেও পা‌রি।বাট আ‌মি জা‌নি না।”
:”আমা‌কে চেনেন?”
:”হুম,‌চো‌খের দেখায় চি‌নি,প‌রিচ‌য়ে নয়।”
:”হা হা হা,আ‌মি হ‌চ্ছি,ঝুনুর চাচা‌তো বোন,ঝুনু‌কে চে‌নেন তো?”
:”হুম।”
:”আমার নাম সায়মা।এত‌দিন ঢাকায় ছিলাম,বাবার অ‌ফিস কুয়াটা‌রে।এখন বাড়ী থা‌কি।”
:”ওহ!খুওব ভা‌লো,‌তো কি‌সে প‌ড়েন আপ‌নি?”
:”এবার এস এস সি দে‌বো,কমার্স থে‌কে।”
:”ও,এখা‌নে না ঢাকায় পরীক্ষা?”
:”ঢাকায়”।
:”পরীক্ষার তো বেশী বা‌কি নেই, মন দি‌য়ে পড়‌বেন কেমন।”
:”হুম!একটা কথা জা‌নেন!আমার পড়‌তে ভা‌লো লা‌গে না,ই‌চ্ছেও ক‌রে না।”
:”হা হা হা তাই!”
:”হুম।আপনার হা‌সিটা অমা‌য়িক।”
:‌”সে খেয়াল আবার কখন কর‌লেন?”
:”আপ‌নি যখন হা‌সেন,‌বি‌শেষ ক‌রে বি‌কে‌লে আপনার বাগা‌নে এ‌লে,‌দেখা হ‌লে যে মুচ‌কি মুচ‌কি হা‌সেন,‌সেটা”।
:”বাহ!‌বেশ খেয়াল ক‌রে‌ছেন তো।বাট আমার তো কেবল হা‌সি।আপনার তো পু‌রোটাই সুন্দর।”

এবার যেন সায়মা লজ্জা পে‌লো।মাথাটা নিচু ক‌রে হাট‌ছে,তার মু‌খে আর কথা সর‌ছে না।আমা‌কেও প‌থের মোড় নি‌তে হ‌বে।ভা‌লো থাক‌বেন ব‌লে মোড় নিলাম।‌সে কেবল ডাগর চো‌খে মায়া দৃ‌ষ্টি দিয়ে বোঝা‌লো,আপ‌নিও ভা‌লো থাকুন।
এরপর থে‌কে মা‌ঝে মা‌ঝে টুকটাক কথা হ‌তো,সবটাই বাগান নি‌য়ে,‌কোন গা‌ছের ডাল ম‌রে গে‌ছে,‌কোন গাছ ছাট‌তে হ‌বে এসব।

পরীক্ষার দিন গু‌লো‌তে সায়মা আস‌তে পা‌রে নি,ঢাকায় ছিল ব‌লে।পরীক্ষা শেষ হ‌লে যে‌দিন এ‌লো,‌সে‌দিন ও‌কে দে‌খে ঘাব‌রে যাই,এ কি হাল তার!‌চো‌খের নি‌চে কা‌লি প‌ড়ে‌ছে,শু‌কি‌য়ে গে‌ছে বেশ।‌চিন্তার কব‌লে যেন তার আপাদমস্তক বিমর্ষ হ‌য়ে গে‌ছে।দুর্বলতাও ভর ক‌রে‌ছে দেহ ম‌নে।চঞ্চলা মে‌য়েটা শান্ত,ক্লান্ত প‌রিশ্রান্ত যে‌নো।আমা‌কে দে‌খে তার ঠো‌টে সদা হাস্য রেখা থাক‌তো,সে‌দিনও ছিল,ত‌বে তা ম্রীয়মান।ডাগর দু‌’চো‌খের দৃ‌ষ্টি কেবলই আমার প‌রে।‌বোঝা যা‌চ্ছে,এতটা পথ জা‌র্নি ক‌রে ফি‌ড়ে কাল বিলম্ব না ক‌রে সোজা এখা‌নে এ‌সে‌ছে।জ‌লে ভ‌রে উ‌ঠে‌ছে মায়াবীনী আঁ‌খি‌তে।গ‌ড়ি‌য়ে পড়‌তেও দেরী হ‌লো না।কান্না সংবর‌নের চেষ্টায় দাঁ‌তে চেঁ‌পে ধর‌ছে পাতলা উষ্ঠ।‌সে আজ একা এ‌সে‌ছে।আ‌মি হতভ‌ম্বের মত দাঁ‌ড়ি‌য়ে।একটা রজনী গন্ধা ছি‌ড়ে বা‌ড়ি‌য়ে দি‌য়ে বললাম-
:”ভা‌লো নেই বোঝ‌তে পার‌ছি,পরীক্ষার ধকল গে‌ছে তো!‌কেমন হ‌লো পরীক্ষা?””

‌সে চোখ মু‌ছে হা‌তে নি‌লো ফু‌লের ডাটা টা।‌কিছুটা স‌ম্বিত ফি‌ড়ে পাবার মত বল‌লো-
:‌”তেমন ভা‌লো নয়,ত‌বে পাশ কর‌বো।আপ‌নি কেমন ছি‌লেন এত গু‌লো দিন?”
:”হ্যা,ভা‌লো”।
:”ছাই ছি‌লেন,বাগনটারও যত্ন নেন নি ঠিকঠাক।কত গু‌লো ডগা আর ডাল ম‌রে আ‌ছে দে‌খে‌ছেন?”
:”হুম!ডগা গু‌লো তো আপ‌নি ছিড়‌তেন,তাই ও পা‌র্টে আমার আল‌সেমী হ‌য়ে গে‌ছে”।
:”হুম,এ আর ব্যা‌তিক্রম কি!‌ছে‌লে‌দের স্বভাবজাত।একটু আস্থা পে‌লে হাফ ছে‌ড়ে বাঁ‌চে”।
:”হা হা হা,হুমমমম”।
:”আর যা‌চ্ছি না।এখা‌নেই পড়‌বো।আপ‌নি আল‌সেমী বাড়া‌তে পা‌রেন,‌হি হি হি”।
:”হ্যা সে এম‌নি‌তেই বে‌ড়ে যা‌বে।এখন বাড়ী যান জলদী।‌গোসল দি‌য়ে ফ্রেস হ‌য়ে একটা লম্বা ঘুম দি‌য়ে,ক্লা‌ন্তি মুক্ত হোন”।
:”হুম!যা‌চ্ছি।কাল এ‌সে ডগা ছিড়‌বো”।
:”আচ্ছা।”
সে চ‌লে যা‌চ্ছে।আ‌মি ঠায় দাঁ‌ড়ি‌য়ে।একটা মানুষ এতটা বাগান প্রেমী হ‌তে পা‌রে?

তারপর প্রায়ই আস‌তো সায়মা।কথা তেমন হ‌তো না,হ‌তো চোখা চোখী।এক‌দিন বি‌কে‌লে,বাবা একটা সি‌ডি দি‌য়ে গান প্লে কর‌তে বল‌লেন।সম্ভবত বাবার পছ‌ন্দের গান ও গু‌লো।,‌বেঁজে চল‌ছে এক‌টি গান,কুমার বিশ্ব‌জিৎ এর গাওয়া-“তু‌মি রোজ বি‌কে‌লে আমার বাগা‌নে ফুল নি‌তে আস‌তে”।গানটা শেষ হ‌লে ভুল ক্র‌মে রি‌প্লে বাট‌নে চাপ প‌ড়ে আবার বেঁজে উ‌ঠে গান টি।
পর‌দিন সকাল থে‌কে মুসল ধা‌রে বৃ‌ষ্টি।ক‌লেজ যাওয়া ক্ষান্ত দিলাম।জানালার প‌া‌শে ব‌সে পড়‌তে‌ছিলাম-‌ফিরুজ এর লেখা “‌বেদনায় নীল আকাশ”এক‌টি প্রে‌মের উপন্যাস।হঠাৎ খেয়াল ক‌রি,সায়মা আস‌ছে ভি‌জে একাকার হ‌য়ে।হয়‌তো নৌকায় বিল পে‌ড়ি‌য়ে এ‌সে‌ছে।তার চো‌খে মু‌খে বিজয়ীর হা‌সি।জানালার সাম‌নে এ‌সে দাঁড়া‌লে বুঝ‌তে পা‌রি,দুরু দুরু ব‌ক্ষে তার উচ্ছা‌সিত আ‌বে‌গ।‌ঠো‌টের এক কো‌নে দাঁ‌তে চেঁ‌পে জানালার গ্রীল ধ‌রে দাঁড়ায়।প্রা‌প্তির হা‌সি‌তে উদ্ভা‌সিত রহ‌স্য তার।
:”এই যে এত ভিজ‌ছেন কেন?”
আ‌মি জিজ্ঞাসা ক‌রি।
:‌”বেশ ক‌রে‌ছি,‌বেশ লাগ‌ছে আমার”।
:”ও তাই না?অসুখ কর‌লে বেশ বেশ বেড় হ‌বে”।
সে হে‌সে উ‌ঠে হি হি হি ক‌রে,‌সে কি প্রাণবন্ত উচ্ছাসীত হা‌সি।এমন হা‌সি‌তে বু‌কে ঢেও না খে‌লে উপায় নেই।
:”তা জনাব,এত ঢাক ঢোল পি‌টি‌য়ে গান বাঁ‌জি‌য়ে পাড়ায় পাড়ায় জানান দেয়ার কি আ‌ছে নি‌জের ম‌নের জিজ্ঞাস্য”।
আ‌মি কিছুটা অবাক হ‌য়ে পরক্ষ‌ণেই বু‌ঝে যাই,ম‌নে বেঁ‌জে উ‌ঠে সে গানটা।আ‌মি ঠোট চেঁ‌পে হা‌সি।
:”কেউ কেবল ফু‌লের প্রে‌মে পড়‌লে নি‌জেই বাগান গ‌ড়ে নি‌তে পা‌রে,বুঝ‌লেন মশাই।উত্তর তো পে‌লেন।আর যে‌নো এমন ঢাক‌ ঢোল পেটা‌নো না হয়।””
সায়মার কথায় প্রথমবা‌রের মত হৃদ‌য়ে অনুভব ক‌রি প্রণ‌য়ের আ‌বেগ।‌কেমন যেন শূণ্যতা বু‌কে,তৃষ্ণার্ত হৃদয়।মুহু‌র্তেই বু‌ঝে ফে‌লি সায়মা আমার অন্তকরন জু‌ড়ে নি‌জে‌কে বি‌ছি‌য়ে‌ছে ধী‌রে ধী‌রে।ম‌নে হ‌চ্ছিল ও‌কে জ‌ড়ি‌য়ে বু‌কে নি‌তে পার‌লে শূণ্যতা পূর্ণ হ‌তো।‌হাহাকারও ক‌রে উ‌ঠে উত্তাল বক্ষ্য।পরক্ষ‌ণেই নি‌জে‌কে সংযত ক‌রি।‌প্রে‌মে সংযম অপরিহার্য উপাদান।‌যে প্রে‌মে সংযম যত বেশী,‌সে প্রে‌মে যথার্থতা,গভীরতা,সততা তত বেশী।
:”এই যে চুপ কেন হুম!ইশ! কি লজ্জা।কাল কোথায় ছিল?”
:”না মা‌নে গানটা….!”
আ‌মি থে‌মে যাই,কারন ও ওর ধারনা‌তে খু‌শি,আ‌মিও খু‌শি।
:”থাক আর মা‌নে মা‌নে কর‌তে হ‌বে না।আ‌মি যাই,ওরা সবাই নৌকায় ব‌সে আ‌ছে আমার জন্য”।
:”আচ্ছা জল‌দি যান,‌ফ্রেস হ‌য়ে কাঁথা মু‌ড়ি দে‌বেন,ন‌চেৎ স‌র্দি জ্বর হ‌বে”।
:”ও‌কে ও‌কে।আস‌ছি হুমমমম”।
টানা চোখটা মে‌লে উদাস দৃ‌ষ্টি‌তে বল‌লো সে,জানান দিল,‌যে‌তে তো চায় না মন,তবু যে‌তে হয়।অথবা চ‌লে তো যা‌চ্ছি আ‌মি,‌কিন্তু তব প্রেমে প্রীত এ মন সদা প‌ড়ে রয় তব ধা‌রে।

সায়মার রেজাল্ট হ‌লে সে ক‌লে‌জে ভ‌র্তি হয়।ক্লা‌সের ফাঁ‌কে রোজ বকুল তলায় ব‌সতাম আমরা।এটা সেট‌া কত শত কথা।আমার প্র‌তি ওর যত্নশীল দৃ‌ষ্টি ছিল তীক্ষ্ম।আমার প্র‌তি তার বিশ্বাস ছিল অগাধ।দুজ‌নের চিন্তা চেতনায় মিল ছিল খুওব।দু একটা অ‌মিল হ‌লে হয় ও মি‌লি‌য়ে নি‌তো,নয় আ‌মি মি‌লি‌য়ে নিতাম।‌প্রে‌মে আর কি চাই,এ‌কে অপ‌রের সা‌থে ম‌া‌নি‌য়ে মি‌শে যে‌তে পার‌লেই তো সে প্রেম হয় স্পাত দৃঢ়।

আমরা কখনও ভা‌লোবাসা বা‌সির কথা উচ্চার‌নে ব‌লি নি।বু‌ঝে নিতাম এ‌কে অপ‌রের প্র‌তি নিঃসংক বিশ্বা‌সে।আমরা এ‌কে অপর‌কে আপ‌নি ক‌রেই বলতাম।আ‌মি ও‌কে যত জান‌তে বোঝ‌তে পারতাম,তত অবাক হতাম।মানুষ এত ভা‌লো হয় কি ক‌রে।আমার জীব‌নে সে ছিল ম‌নোষ‌ত্বের অনু‌প্রেরনা।

আ‌মি ইন্টার পরীক্ষা দিলাম।ক‌লেজ যাওয়ায় ভাটা পড়‌লো।তবুও কখনও কখনও চলে যেতাম,লাই‌ব্রেরী‌তে বসতাম ওর সা‌থে।ও আস‌তো মা‌ঝে মা‌ঝে বাগান দর্শ‌নে।‌চোখ বাঁ‌কি‌য়ে তাকা‌তো গা‌ছের ডগা ছিড়তাম না ব‌লে।

‌যে‌দিন আমার রেজাল্ট হ‌লো,‌সে‌দিন সে সন্ধায় এ‌লো।তা‌কে দে‌খে চ‌কিত হই আ‌মি।ভীত সন্তষ্ট তার মায়া মুখটা,ক‌ম্পিত কায়া,হত‌বিহ্বল আঁখিপাত,কপা‌লের ঘাম গাল বে‌য়ে পড়‌ছে,না‌কের ডগায়ও বিন্দু বিন্দু ঘাম জ‌মে‌ছে।অপল‌কে আমার দি‌কে তা‌কি‌য়ে ব‌লে-
:”আপনার রেজাল্ট জে‌নে খুব খু‌শি হ‌য়ে‌ছি।”

আ‌মি কি বল‌বো,ওকে দে‌খে আমার বাকরুদ্ধ অবস্থা। অশ্রুশীক্ত হ‌য়ে উ‌ঠে তার দু‌’নয়ন। ক‌ম্পিত স্ব‌রে ব‌লে-
:”আজ হঠাৎ আমা‌কে দেখ‌তে এ‌সে‌ছিল। ও‌দের পছন্দ হ‌লে বাবা তা‌রিখ পাকা ক‌রে দি‌লেন এক বসায়। আমার কিছু বলার সু‌যোগ ছিল না। পরশু বি‌য়ের তা‌রিখ”।
সে থাম‌লো।কান্নায় বু‌জে আস‌ছে তার গলা।আমার ভে‌ঙ্গে যা‌চ্ছে বুক। ম‌নে প্রচন্ড উজ‌নের একটা হাতুড়ী‌তে কেউ পিটা‌চ্ছে বু‌কের চার দেয়া‌লে।
‌সে আবার বল‌লো-
:”আ‌মি জা‌নি,আ‌মি ব‌ুঝি,সাম‌নে আপনার উজ্জল ভ‌বিষ্যত। অন্তত আ‌মি নিজ হা‌তে আপনার সু- সম্ভাবনাময় ভ‌বিষ্যত নষ্ট কর‌তে পা‌রি না।তবুও আমার মন যে মান‌ছে না। আ‌মি না কষ্ট‌কে খুওব ভয় পাই। আপনা‌র বি‌চ্ছে‌দে আমা‌কে সারাজীবন কষ্ট বই‌তে হ‌বে।আ‌মি যে পার‌বো না তা”।

সে আবার থাম‌লো। চাঁপা কান্নায় তার বু‌কের ভাঙ্গন আ‌মি বুঝ‌তে পার‌ছি। আমার চো‌খে ততক্ষ‌ণে বাঁধ ভে‌ঙ্গে অশ্রু ধারা নে‌মে‌ছে।‌সে দু হা‌তে আমার চোখ মু‌ছে কাঁদ‌তে কাঁদ‌তে বু‌কে মাথা রাখ‌লো। ব‌লে উঠ‌লো আর্তনা‌দে-
:‌”প্লিজ কিছু করুন।‌ প্লিজ। আ‌মি আপনা‌কে জোর কর‌বো না।আপনার ভ‌বিষ্যতও নষ্ট কর‌তে পার‌বো না।আপনার বি‌য়োগও আ‌মি সই‌তে পার‌ছি না,পার‌বোও না।‌প্লিজ কিছু করুন আমার জন্য।‌
বি‌য়ে টা ভাঙ্গুন।”
কান্নায় আমার গলা আট‌কে আ‌ছে,শব্দহীন কান্নার যন্ত্রনা সেই বো‌ঝে,যে তা ক‌রে।তবুও আ‌মি বল‌তে চেষ্টা ক‌রি-
:”কাঁ‌দেনা,‌প্লিজ,দে‌খি আ‌মি কি কর‌তে পা‌রি।বাবা‌কে পাঠা‌বো কথা বল‌তে।আপ‌নি বা‌ড়ী যান।য‌দি কিছু কর‌তে না পা‌রি,কাপুরুষ ভে‌বে ধিক্কা‌রে ঘৃনা কর‌বেন আমায়”।
:”না না,‌সে কথা নয়।আ‌মি সমাজব‌র্জিত আপনার সম্মান লু‌ন্ঠিত কিছু আশা কর‌ছি না।আপ‌নি সু-পুরুষ।কখনও ভাব‌বেন না আপনার প্র‌তি সম্মান বৈ তিল প‌রিমান ঘৃনা হ‌বে আমার।আ‌মি চাই সবটা ঠিক রে‌খে কিছু করুন।না পার‌লে সে আমা‌দের ভা‌গ্যের বিরম্বনা।আ‌মি যাই,রাত হ‌য়ে গে‌লো।‌প্লিজ আমার বি‌য়ে টা ভাঙ্গুন।”
আর বিলম্ব না ক‌রে হাটা দেয় সায়মা দু‌র্বিসহ যাতনা নি‌য়ে।আ‌মি হত বিহ্বল হ‌য়ে ছু‌টি বাবার কা‌ছে।বাবার কা‌ছে সব বল‌লে,‌তি‌নি অভয় দি‌লেন,‌চিন্তা কর‌তে নি‌ষেধ ক‌রে বল‌লেন,‌তি‌নি যা‌বেন আলাপ নি‌য়ে।

তবুও এ মন প্রো‌বোধ মান‌ছে না।নির্ঘুম রাত কিছু‌তেই কাট‌ছিল না।ম‌ন যন্ত্রনাদগ্ধ হ‌চ্ছিল,সায়মা আমার থে‌কে বেশী কষ্ট পা‌চ্ছে।ও বোধহয় কিছু খায় নি।পাগ‌লের মত অ‌স্থিরতায় শুধুই কেঁ‌দে যা‌চ্ছে।অ‌স্থিরতায় ঘে‌মে যা‌চ্ছি বারবার।দুঃসহ বেদনার মা‌ঝে রাত্রী পোহা‌লে বাবা‌কে পাঠাই।বাবা ফিড়‌লেন অপমা‌নের যাতনা নি‌য়ে।সায়মার বাবা আমা‌দের সা‌থে আত্মীয় কর‌বেন না,সাফ জা‌নি‌য়ে দি‌য়ে‌ছেন।আমার মাথায় বজ্রপাত হয়।কাল বিলম্ব না ক‌রে ছু‌টে যাই ও পাড়ায়।আমার সহপা‌ঠি‌কে নি‌য়ে ছু‌টি পা‌ত্রের বাড়ীর খুঁ‌জে।ঝুনুর কা‌ছে জে‌নে নি‌য়ে‌ছি নাম ঠিকানা।পা‌ত্রের বাড়ীর পা‌শে গি‌য়ে খোঁজ নিই। যা জান‌তে পা‌রি ছে‌লেটা অ‌নেক ভা‌লো,জেলা প‌রিষ‌দে সরকারী উচ্চপদস্থ চাকু‌রে।‌ভাগ্যক্র‌মে দেখাও মি‌লে তার।সু-দর্শন এক যুবক।একটু কথাও হয় অপ‌রি‌চিত এর ছ‌লে।কথা বাত্রায় মাধুর্য্যতা ঝ‌ড়ে তার।‌নি‌জে‌কে তখন নগন্য,অ‌যোগ্য ম‌নে হয়।‌ফি‌ড়ে আ‌সি আমরা।পা‌রি‌নি নিজ প্রা‌প্তির জন্য এত ভা‌লো একটা পাত্রকে ভরকা‌তে।আ‌মি কি কখনও পার‌বো তার সম হ‌তে।পার‌বো না।আমার সায়মা ভা‌লো থাক‌বে।ওর বাবা আমা‌দের নাকচ ক‌রে‌ছে,কয়টা বি‌য়ে ভাঙ্গ‌বো আ‌মি?সায়মা সমাজ ব‌র্জিত কিছু চায় না।আ‌মিও না।এসমাজ‌কে কলং‌কিত কর‌লে যে বড্ড অকৃতজ্ঞতা হ‌বে।এ সমাজ আমা‌কে,সায়মা‌কে বে‌ড়ে উঠার সু‌যোগ দি‌য়ে‌ছে,আদর স্নেহ দি‌য়ে‌ছে,মানুষ হবার মত শিক্ষা দি‌য়ে‌ছে।এ সমা‌জের মু‌খে কাঁদা লে‌পে দেওয়া বেঈমানী হ‌বে।আমরা বাঁ‌চি নি‌জের জন্য,আর সমাজ বাঁ‌চে আমা‌দের সুন্দর ভা‌বে বেঁ‌চে থাকার জন্য।

সায়মার বি‌য়ের দিন ঝুনুর হাত ঘু‌রে চি‌ঠি পাই।‌জা‌নি‌য়ে‌ছে, সে ভাগ্য মে‌নে নি‌য়ে‌ছে,আমার আপ্রাণ চেষ্টা আমা‌কে তার কা‌ছে আ‌রো সম্মা‌নিত ক‌রে‌ছে।‌সে কষ্ট ব‌য়ে নে‌বে ব‌লে মন মা‌নি‌য়ে‌ছে।‌সে ভা‌লো থাকার চেষ্টা কর‌বে।আমা‌কে উচ্চ‌বিদ্যান হবার দি‌ব্যি দি‌য়ে শেষ ক‌রে‌ছে।

সে‌দিন হা‌তে সিগা‌রেট তু‌লি,আজও চল‌ছে।এরপর ঢাকা বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য়ে ভ‌র্তি।ঢাকায় থাকা।‌সেখা‌নে দূরাগত এক বাঁ‌শির সু‌রে বেদনা বিলা‌সে বাঁ‌শি চর্চা।মাস্টার্স পরীক্ষা শে‌ষে যে‌দিন বাড়ী আস‌বো মন‌স্থির ক‌রে‌ছি।‌সে‌দিন মু‌ঠো ফো‌নে ডাক আ‌সে ঢাকা মে‌ডি‌কেল ক‌লেজ হাসপাতা‌লে।‌সেখা‌নে পৌ‌ছে বার্ন ইউ‌নি‌টে গি‌য়ে পাগল প্রায় আ‌মি।আমার সায়মা আপাদমস্তক ব্যা‌ন্ডেজ বে‌ষ্টিত হ‌য়ে শু‌য়ে আ‌ছে।পা‌শে কাঁদ‌ছে তার স্বজন।তার বর একপা‌শে ভীতসন্তষ্ট চি‌ত্তে ব‌সে আ‌ছে।জান‌তে পা‌রি গ্যাস সি‌লিন্ডার দুর্ঘটনায় অ‌গ্নিপা‌তে ঝল‌সে গে‌ছে প্রেয়সীর মুখ ব্যা‌তিত পু‌রো শরীর।অবস্থা আশংকা জনক।এত দি‌নে সায়মার যে টুক‌ু খোঁজ জে‌নে‌ছি,‌সে ভা‌লো ছিল।‌কিন্তু তার স্বামীকে দে‌খে,আমার জানা কে মি‌থ্যে ম‌নে হ‌লো তখন।সায়মা ভা‌লো ছিল না।আমা‌কে ভা‌লো রাখার জন্য ওর ভা‌লোটা জানান দি‌তো আ‌মি নি‌শ্চিত।আজ আমার পৃ‌থিবী শূণ্য লাগ‌ছে।পু‌রো শরীর কাঁপ‌ছে।‌সে‌দিন প্রথম জীব‌নে আপন প্রাণনা‌সের কথা ম‌নে হ‌য়ে‌ছিল।ঘন্টা খা‌নেক পর সায়মা চোখ মে‌লে।আমা‌কে দে‌খে তার ডাগর সু-নয়ন জ‌লে ভ‌রে উ‌ঠে।আমা‌কে কা‌ছে ডা‌কে ইশারায়।টপটপ ক‌রে গড়া‌তে থা‌কে তার চো‌খের জল দু’‌কোন বে‌য়ে।সায়মা কথা বল‌তে চা‌চ্ছে,‌কিন্তু তার স্বর হ‌চ্ছে না।‌ফিস ফিস শব্দ হ‌চ্ছে।আ‌মি ওর মু‌খের কা‌ছে কান পা‌তি।

:”আ‌মি ভা‌লো ছিলাম না ফিরুজ,আমার বাবা মা কখনও আমা‌কে তেমন ভা‌লোবা‌সে নি,আমার সা‌থে ছোট থে‌কে ঠিক ক‌রে কথা ব‌লে নি,‌আমার বাবার আ‌গে একটা বি‌য়ে ছিল,আমার জন্মদাত্রী মা‌য়েরও আ‌গে একটা বি‌য়ে ছিল।আ‌মি তার সন্ত‌ান,আমার মা আমা‌কে ফে‌লে আবার অ‌ন্যের হাত ধ‌রে চ‌লে গি‌য়ে‌ছিল।আমার বর্তমান বাব মা কা‌রো সন্তান নই আ‌মি।সব টা সময় ভা‌লোবাসার জন্য এ বু‌কে হাহাকার ছিল।এজীব‌নে যে টুকু প্রেম পে‌য়ে‌ছি,তা আপনার কা‌ছে।আমার স্বামী গোপ‌নে বি‌য়ে ক‌রে‌ছে।আ‌মি একটু প্রে‌মের জন্য তার পা‌য়ে প‌ড়ে‌ছি,বাবা মা’র কা‌ছে আকুতী ভ‌রে কেঁ‌দে‌ছি।‌কেউ আমা‌কে একটু প্রেম দেয় নি।আমার জীব‌নে কোন চাওয়া ছিল না,শুধু একটু প্রেম,একটু প্রেম চে‌য়ে‌ছি।একটু প্রে‌মের জন্যই আজ বিদা‌য় হে পৃ‌থিবী।”
সায়মার কথা গু‌লো আট‌কে যা‌চ্ছিল।‌ফিস ফিস ক‌রে আর কত বলা যায়।আমার বু‌কে তখন মৃত্যু যন্ত্রনার তান্ডব।সায়মার ক‌ষ্টে ঘৃন্য ম‌নে হ‌চ্ছে মানুষগু‌লো কে।আ‌মি মুখ ফি‌ড়ি‌য়ে সায়মার পা‌নে তাকাই।ও চোখ বন্ধ ক‌রে আ‌ছে,‌দু কোন বে‌য়ে অনবরত পড়‌ছে জল।আ‌মি সোজা হ‌য়ে দাঁড়াই।একটু পর খিচুনী দি‌য়ে উ‌ঠে সায়মার দেহ।ছটফট ক‌রে উ‌ঠে কাৎরা‌তে কাৎরা‌তে সায়মা।ডাক্তার এ‌সে ইন‌জেক্শন দি‌লে একটু পর শান্ত হয় সে।তার একটু পর তার চো‌খের কোন বে‌য়ে বড় দু‌টি জ‌লের ফোটা টপ ক‌রে গ‌ড়ি‌য়ে প‌ড়ে।আমার আর বুঝ‌তে বা‌কি থা‌কে না।পৃ‌থিবী‌কে বিদায় ‌দি‌য়ে‌ছে সায়মা।প্রচন্ড চিৎকা‌রে কেঁ‌দে উ‌ঠি আ‌মি জীব‌নে প্রথমবার।আ‌মি বু‌ঝে গে‌ছি,সায়মার মৃত্যু রহস্য।খু‌নের ক্রোধ চাঁ‌পে ম‌নে,প্রচন্ড আ‌ক্রো‌শে স্ব‌-জো‌রে ক‌য়েক ঘা লা‌থি মা‌রি সায়মার স্বামীকে চিৎ ক‌রে ফে‌লে।আমার আর্ত‌চিৎকারে সে‌দিন প্রচন্ড ঘৃনা ‌ছিল,নর-নারীর এ‌হেন ত্যা‌গের খেলার প্র‌তি।‌বিবাহ বি‌চ্ছে‌দের প্র‌তি।কেন এত বিবাহ বি‌চ্ছেদ?‌কি‌সের স্বা‌র্থে?মানুষই তো।‌কেন মানা‌তে পা‌রে না এ‌কে অপ‌রের সা‌থে???””””””

মাহবুব ভাই একটু শব্দ ক‌রে কেঁ‌দে উ‌ঠে।আমার চো‌খে বহতা জ‌লের ধারা,‌নির্বাক কান্নায় ভি‌জে গে‌ছে বক্ষ্য।একটু প্রেম,একটু প্রে‌মের ত‌রে কেন এত বেদনা এ ধরায়?

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত