আমি জাকির। আজ একটি নামকরা মাল্টিন্যাশনাল কম্পানির ডিভিশন ম্যানেজার হিসাবে এই শহরে আসলাম।
অফিসের প্রথম দিন হিসাবে যতেষ্ঠ প্রস্তুতি নিয়েই অফিসে এসেছি। স্টাফবৃন্দ আমাকে স্বাগতম জানাতে জড় হয়েছে।
আমিও হাসি মুখে তাদের সাথে কুশল বিনিময় করছি। হটাৎ দুটি চোখের সামনে এসে আমার দৃষ্টি আটকে গেল। সেই মায়াময়
দুটি চোখ। ২ বছর পরে মেয়েটা যেন আরো বেশি সুন্দর হয়ে গেছে। সেই চেহারা, সেই অবয়, শাড়িতে তাকে কোন কিশোরী নয়,
পুর্ণ নারী লাগছে। আবার আমার সাজানো দুনিয়া এলোমেলো হয়ে গেল। সোজা আমার কেবিনে ঢুকে পড়লাম। মাহি এখানে
কেন..? আমার দুনিয়া ধ্বংস করে দেওয়া মাহি। আমি ভাবছি এমন সময় কাচ ডোর ঠেলে মাহির আগমন।
: জাকির তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।
: আমি আপনার অনেক সুপিরিয়র, কোন সাহসে আমাকে তুমি বলছেন।
: প্লিজ একটি বার শুনো।
: আপনার কোন কথা শোনার মত মানসিকতা আমার নেই। ভবিস্যতে কখন আমার সামনে আসবেন না।
৪ বছর আগের কথা। আমি HSC ২য় বর্ষে পড়ছি। ফুটবলটায় একটু জোরেই লাথি দিয়েছিলাম। সোজা লাগল এক সুন্দরির
মাথায়। সবাই দেখি ভয়ে চুপসে গেল। উপায় না দেখে আমিই গেলাম বল আনতে।
: আমি দুঃখিত, বুঝিনি বলটা এসে আপনার গায়ে লাগবে।
: দুঃখিত মানে। মেরে নিয়ে দুঃখিত। মেয়ে দেখলেই বল মারতে ইচ্ছে হয়?
: আপনি যেমনটা ভাবছেন তা নয়, এটা একটা এক্সিডেন্ট।
: আবার মিথ্যা। আপনি জানেন আমি আপনার কি করতে পারি।
: ধুর, কোন পাগলের সাথে প্যাচাল পাড়ছি। ভাবলাম ক্ষমা চেয়ে নি। এখন দেখি পুরাই পাগল।
: কিহ্, আমাকে পাগল বললেন?
: যান তো, রাস্তা মাপেন।
এর দুইদিন পর শহরের কাউন্সিলারের বাড়িতে টিউসনি পেলাম। আশাতীতরকম বেতন। ছাত্রকে পড়াচ্ছি, বাইরে খুবএকটা
মনোযোগ নেই। কেউ একজন সামনে সরবত দিল। গ্লাস মুখে তুলে সামনের জনের দিকে তাকালাম।
চেহারা দেখে এতটা শক্ড হয়ে গেছি যে লবনে ভরা সরবতের গ্লাস কখন খালাস করে দিয়েছি তা টেরও পাইনি।
সামনে সেই পাগল মেয়েটা দাড়ানো। পরে জানলাম এটা কাউন্সিলর সাহেবের বড় মেয়ে মাহি। এভাবেই পরিচয়। আমাকে
সায়েস্তা করতে গিয়ে একসময় মাহি আমার উপর দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেকদিন নিজেকে মিথ্যা বললেও একদিন ঠিকি ওরকাছে ধরা
পড়ে গেলাম যে আমিও ওকে অসম্ভব ভালবাসি। SSC শেষে আবার মাহি আমাদের কলেজেই এডমিশন নিল। চলতে
থাকল আমাদের পথচলা। আমি ফাইনাল ইয়ার এক্সাম দিচ্ছি। মাহি ২য় বর্ষে উঠল। কাউন্সিলর সাহেব মারা
গেছেন কিছুদিন আগে। মাহির বড়ভাই চাচ্ছে দ্রুত মাহিকে বিয়ে দিয়ে দিতে। অবশেষে নিজের কলিগ রায়হান সাহেবের সাথে
মাহির বিয়ে ঠিক করে ফেললো। রায়হান সাহেব ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। আর আমি…. বেকার। একদিন মাহি আমাকে
আমাদের সবথেকে প্রিয় যায়গায় ডাকলো।
: জাকির আমাকে ভুলে যাও।
: কি বলছো মাহি।দেখ আমার এক্সাম চলছে। এটা শেষ হলেই দেখো আর কোন প্রবলেম থাকবে না।
: কিছুই আর হবে না। আমি চাইনা যে তুমি আর আমার জীবনে থাক।
: আমাদের ৩ বছরের প্রেম, তোমার এতো ভালবাসা সব কি……
: ওগুলো মিথ্যে ছিল।
: আমি তোমাকে ভালবাসি মাহি আমি তোমার জন্য সব করতে পারি।
: ওসব ভালবাসা মূল্যহীন। আমার ফিওন্সে ভাল জবে সেটেল্ড। আমার ভালো চাইলে আমার রাস্তা থেকে সরে দাড়াও।
: আমি জানি তুমি এমন করতে পারো না।
: তোমাকে শুধু একটি জিনিস আমার দেওয়ার আছে। পরিক্ষা শেষে এসে নিয়ে যেও।
নাহ্ পরিক্ষা শেষে ওর সাথে আর আমি দেখা করি নি। অতটা ক্ষমতা আমার ছিল না। আমার বাবাও সরকারি বড় পদের
কর্মকর্তা। পরিচিতির সুবাদে তখনি এই কম্পানিতে ভাল একটা জব পেয়ে যায়। আমার এক টার্গেট তখন, জীবনে বড় হওয়া।
আমার আইডিয়া গুলো পরিচাক পরিষধের খুব পছন্দ হতে থাকে। এরপর আমার লাইফে শুধু উত্থানেরই গল্প। আজ 2 বছরের মাথায় আমি
ডিভিশন ম্যানেজার। প্রায় দুই সপ্তাহ্ হতে চলল আমি এখানে জয়েন করেছি। মাহি বেশ কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে। প্রতিবারই ওকে
অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছি। ও আজ অন্য কারো স্ত্রী, আমি চাইনা আবার ওর মায়ায় জড়িয়ে পড়তে। আজ লান্চ আওয়ারে
অফিসের বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালাম। মাহি চলে যাওয়ার পর থেকে এটাই আমার একমাত্র সঙ্গি। হটাৎ কেউ আমার
ঠোট থেকে সিগারেট টা টান নিয়ে ফেলে দিল, আর ৬ বছর পর সেই শাষন আবার শুনতে পেলাম। ” খবরদার যেন এটা আর খেতে না
দেখি”। হ্যা, মাহি এভাবে আমাকে শাষণ করত। কিন্তু আজ আর আমার সহ্য হলো না। গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম।
: কেন আমার পিছু ছাড়ছো না। তোমায় দেখলে আমার ঘৃনা হয়। নিজের স্বামী সংসার নিয়ে সুখে থাকো, আর আমাকে
একা বাচতে দাও।
কাদতে কাদতে মাহি চলে গেল। যাক, আমার কি। মায়ের ফোন এলো তাকে আনতে একটু
শপিংমলে যেতে হবে। বিধাতা হয়তো আরো বড়ো চমক এখানেই আমার জন্য
রেখেছিল। শপিংমলে দেখা হলো রায়হান সাহেবের সাথে। সাথে ছোট্ট একটা বাচ্চা
আর এক মহিলা। কেন যেন মহিলাটাকে উনার স্ত্রী বলে মনে হচ্ছে। আমাকে একটু
দেখতেই হবে।
: হ্যালো রায়হান স্যার। কেমন আছেন।
: জ্বী ভাল, কিন্তু আপনি..?
: আপনার সাথে অনেক আগে পরিচয় হয়েছিল, আমি জাকির। কিন্তু এনারা..?
: ইনি আমার স্ত্রী, আর এরা আমার মেয়ে। নিজের কানকেও আমি বিশ্বাস করতে
পারছি না। তাহলে মাহি.? ও কি বলতে চেয়েছে আমাকে। মাকে বাড়ি ড্রপ করে
দ্রুত অফিস গেলাম। নাহ্ মাহির কোন খোজ নেই। আমার ডেক্সের উপর দুটি খাম।
একটিতে মাহির রিজাইন লেটার। অপরটি একটি চিঠি।
~ জাকির, জানি সেদিন ভুলটা আমার ছিল। কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম। ভাইয়া
তোমাকে মারার প্লান করছিল। তোমার পরিক্ষার যেন ক্ষতি না হয় তাই আমি
ভাইয়ার কথায় রাজি হয়ে তোমাকে ঐগুলো বলতে বাধ্য হই। শেষ যে জিনিষটা
তোমাকে আমি দিতে চেয়েছিলাম সেটা আমি নিজে। পরিক্ষা শেষে তোমার সাথে
পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল আমার। কিন্তু তুমি দেখা না করে চলে গেলে, ফোন নম্বর
বদলে ফেললে। শেষে আমার জিদের কাছে হার মেনে আমার বিয়ে ক্যান্সেল হয়। পড়া
শেষ করি, জব শুরু করি, তোমার অপেক্ষায় দিন গুনি। আমি জানতাম একদিন তোমার
দেখা ঠিক পাব। পেয়েও গেলাম। কিন্তু তুমি আমার কথাটাও শুনলে না। একটাবার
বলার সুজোগ চেয়েছি, সেটাও দিলে না। তাই চলে গেলাম, তোমাকে তোমার মত থাকতে দিয়ে।
গাড়ি নিয়ে সাথেসাথে বেরিয়ে পড়লাম। অফিস থেকে মাহির বাসার ঠিকানাও নিয়ে
নিয়েছি। দরজাটায় নক করতেও কেমন যেন ভয় লাগছে। নক করার আগেই দরজা খুলে গেল।
: হুম ভেতরে আস। ঘেমে একি হাল তোমার নাও সরবত খাও। এক ঢোকে আবার গ্লাস সাবাড় করে
দিলাম। সেইই লবনে ভরা সরবত, কিন্তু তবু কেন যেন খুব মিস্টি লাগছে।
: আমি জানতাম তুমি এভাবে ছুটতে ছুটতে আসবে। কি ভেবেছিলে, আমি ব্যাগপত্র বাধছি। আমি আমার জাকিরকে চিনি।
ও আমার কাছে আসবেই। আমার ভালবাসার টানে আসবে। কি বলব আমি, বলার ভাষা আমার নেই।
শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম মাহিকে। আর যেন কখন পালাতে না পারে, ওকে আর আমি
হারাতে দেব না। দুজনের চোখেই অঝোর ধারায় জল ঝরছে। এটা সুখের কান্না। এতে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা লেখকের নেই।