অদ্ভূত কারণে আমার ছোট ভাই আমার চোখের বিষ ছিল৷ আমি চাইতাম আমার একটা বোন হবে৷
বোনটাকে আদর দিয়ে বড় করবো৷
বড় হয়ে দুই বোন থাকবো বান্ধবীর মতো৷
একসাথে ঘুরবো-ফিরবো,আড্ডা দিবো৷
ভাগাভাগি করবো সবকিছু৷
আমার একটা বোন হলে, আমার আর কোনো দুঃখ থাকবেনা৷
একাকিত্ব আমাকে গ্রাস করতে পারবেনা৷
দু’বোন মিলে একসাথে হাতে মেহেদী লাগাবো৷ শাড়ি পরবো একসাথে৷
সবকিছুই থাকবে একরকম৷
যেদিন মা আমাকে চুপিচুপি বলল,
তোমার আরেকটা খেলার সঙ্গী আসবে আম্মু!
সেদিন আমার আনন্দের সীমা ছিল না৷
অনুভূতিটা কেমন সেটা আমি বলে বোঝাতে পারবোনা৷
আমার জীবনের সেরা অনুভূতিগুলোর একটা৷
এরপর থেকে যখনই বাবার সাথে বেরোতাম৷ সবসময় দু’টো করে জিনিস কিনতাম৷
একটা আমার জন্য৷ অপরটা আমার অনাগত বোনের জন্য৷
আব্বু আমার কান্ড দেখে হাসতেন৷
মাঝে মাঝে বাবা বলতেন,
আচ্ছা আম্মু তোমার যদি ভাই হয় একটা! তাহলে?”
আমি জবাব দিতাম না৷
আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমার বোনই হবে৷
সেই হিসেবে সবকিছু ঠিকঠাক করে রেখেছিলাম৷
তারপর আসলো সেই দিন৷
আম্মুর বেদনা শুরু হলো৷
আমি পাশের রুমে বাবাকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিলাম৷
কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলাম আমার মনে নেই৷
পরদিন সকালে হই হুল্লোড়ে ঘুমটা ভাঙে৷
আমার ফুফীর কোলে একটা বাচ্চা৷
সবাই বলাবলি করছে আমার ভাই হয়েছে৷
আব্বুকে চোখে পরলো আমার৷
ঝিম ধরে বসে আছেন৷
ছোট ফুফী এসে জড়িয়ে ধরলো আমাকে৷
ফুফী ও কাঁদছে৷
কীছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম, আমার মা আর নেই দুনিয়াতে৷
আমার একটা ভাই হয়েছে৷
যা আমি কখনোই চাইনি৷
সেই থেকে মনের ভেতরে দিনে দিনে ক্ষোভ জমেছে আমার৷
তার দুই দিন পরেই আমার রেজাল্ট এসেছিল৷
৩য় শ্রেণী থেকে ৪র্থ শ্রেণীতে উঠেছি৷
অন্যবার মা আমার জন্য বিরিয়ানী রাঁধতেন রেজাল্টের দিন৷
সেবার কেউ রাঁধেনি৷
বাবা আমাকে বুঝালেন,
আসলে আমার একটা ভাই দরকার৷
কিন্তু আমার কিছুতেই বাচ্চাটাকে সহ্য হয় না৷
বাবা মাঝে মাঝে মাঝে জোর করে আমার কোলে তুলে দেয়৷
আমি নাহু নাহু করার পরে শেষমেষ কোলে নিয়ে বসে থাকি৷
বাচ্চাটা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে৷
আমার অসহ্য লাগে দিন দিন৷
সে আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো৷ অন্যদিকে আমার চোখের বিষ হতে লাগলো দিনদিন৷
আমি কীছুতেই সহ্য করতে পারতাম না৷
মাঝে মাঝে যখন কান্না করতো৷
আমি মুখ টিপে ধরতাম৷
আমার খাঁমছির দাগ এখনো তার মুখে৷
বাবা আমাকে প্রায়ই বুঝাতেন,
আম্মু এটা তোমার ভাই৷ ওর মা নেই৷ তুমিই ওর সব দেখবে৷
আমি মাথা নাঁড়াতাম৷
কিন্তু সেটা বাবাকে দেখানোর তাগিদে৷
আস্তে আস্তে সে হাঁটতে শুরু করলো৷
আমাকে দেখলেই এলোমেলো পায়ে উৎসাহের সাথে দৌঁড়ে আসতো৷
আমি পাশ কাটিয়ে চলে যেতাম৷
সে কি বুঝতো জানি না৷
একটু বসে আবার আমার পেছন পেছন ঘুরতো৷
ওর ক্ষুধা লাগলে কান্না জুড়ে দিতো৷
আমি বিরক্ত হতাম৷
শেষমেষ একটু খানি পানি খাইয়েই দায়িত্ব সারতাম৷
ছোট চাচীর একটা মেয়ে হয়েছে৷
আমি খুব আদর করি তাকে৷
ঠিক এভাবেই অবহেলা করে গিয়েছি আমার ছোট ভাইটাকে৷
ছোট থেকে এত অনাদর,অবহেলার পরেও আমার পেছনে থাকতো সারাক্ষণ৷
বুদ্ধি হওয়ার পরও সবসময় লেগে থাকে৷
সারাক্ষণ আপু আপু করে ডাকে৷
আমার বিরক্ত লাগে৷
আমার এখনো আফসোস লাগে একটা বোন হলো না আমার৷
সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে মায়ের জন্য৷
আমি বড় হলাম৷ বন্ধু-বান্ধব হলো অনেকগুলো৷
বাবার চুলে পাকা ধরেছে৷
আমার ভাইটাও ততদিনে প্রাইমারি পেরিয়ে হাই স্কুলে উঠেছে৷
তার প্রতি আমার ভালোবাসা না জন্মালেও৷ আমি দেখতাম তার ভালোবাসাটা দিনদিন দৃঢ় হচ্ছে৷
সে যা কিছুই খেতো৷ সবকিছুতে আমার একটা ভাগ রাখতো৷
অথচ এই কাজটা একজন বড় বোন হিসেবে আমারই করা উচিত ছিল৷
তারপরও আমার মনে ভালোবাসা জন্মায় না৷ আমার বান্ধবীদের দেখি, তাদের ভাইদের নিয়ে গল্প জুড়ে দেয়৷
অনেকে আফসোস করে ভাই নেই বলে৷
আমার এসব সহ্য হয় না৷
আমার বান্ধবীরা বাসায় আসতো মাঝে মাঝে৷ তাদের সাথেই আড্ডা জুড়ে দিতো আমার ভাই৷
আমার বান্ধবীদের প্রায় সবাই স্নেহ করতো আমার ভাইটাকে৷
মাঝে মাঝে বলতো,
আমার সাথে যাবা? আপু অনেকগুলো ভালোবাসবো!”
আমার ভাইয়ের উত্তর ছিল,
আমার আপু আছে৷ আমাকে অনেক ভালোবাসে!”
অথচ আমি তাকে কোনোদিন ভালোমতো ভাই ডাকিনি৷
আদরের বদলে পিটিয়েছি৷
হুটহাট হাত তুলে বসতাম তার শরীরে৷
জবাবে কোনো প্রতুত্যর ছিল না তার৷
কেমন অসহায় চোখে তাকাতো আমার দিকে৷
খুব বেশি ব্যাথা পেলে, চোখের পানি বেরিয়ে আসতো আমার সামনে৷
সকালে মারলাম বিকেলেই সব স্বাভাবিক৷ আমার সাথে লেগে থাকাটা তার অভ্যাস৷
ও একা ঘুমাতে ভয় পেতো৷
বাবা না থাকলে আমার রুমে এসে পরে থাকতো৷
ফ্লোরে একটা বালিশ নিয়ে বসে থাকতো৷
রুমের লাইট বন্ধের আগ পর্যন্ত আমার দিকে বারবার তাকাতো৷
সম্ভবত আমার খাটে শোয়ার অনুমতি চাইতো৷
আমি কঠিন মুখে শুয়ে পরতাম৷
তারপর সেও ঘুমিয়ে পরতো ফ্লোরে৷
আমার যখন মায়ের কথা মনে পরতো৷
খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিতাম৷
আমার ভাই ভাতের প্লেট নিয়ে আমার রুমে আসতো৷
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে আমতা আমতা করে বলতো,
আপু আমি খাইয়ে দিই?”
আমি রাগী চোখে তাকাতাম৷
সে চুপ হয়ে যেতো৷
প্লেট রেখে আস্তে করে সরে পরতো৷
পরীক্ষার সময় আমি রাত জেগে পড়তাম৷
আমার ভাইও আমার পাশে বসে থাকতো৷
আমি দেখতাম,
ঘুমের তাড়নায় তার চোখ লাল হয়ে যেতো৷ ঢলে পরতো মাঝে মাঝে৷
তাও আমার পাশে বসে থাকতো৷
আমার নিষ্ঠুর মনে তখনও ভালোবাসা বা মায়া কোনোটাই অনুভূত হতো না আমার মনে৷
মাঝে মাঝে তাকে ঐ অবস্থায় রেখেই ঘুমিয়ে পরতাম আমি৷
এমনও হয়েছে সেই আমার পড়ার টেবিলে ঘুমিয়ে পরেছে৷
মাঝে মাঝে কেমন চাহনী দিয়ে তাকাতো আমার দিকে৷
আমি বুঝতে পারি, এই চাহনীতে অনেক বেদনা আষ্ঠেপৃষ্ঠে আছে৷
আমার নিজেকে অনুভূতিহীন মনে হতো৷
তার জ্বরের সময় আমি কখনো তার ধারে পাশে ঘেষি নি৷
দায়িত্বের খাতিরে দেখেই চলে আসতাম৷
ঘুমের ঘোরে আপু, আপু বলে জড়ানো কন্ঠে ডাকাডাকি করতো৷
আমার মন পর্যন্ত পৌছাতোনা ঐ ডাক৷
কিন্তু আমার অসুস্থতায় আমার চেয়ে তার কষ্ট বেড়ে যেতো৷
রাত জেগে আমার পাশে বসে থাকতো৷
মাথায় জলপট্টি দিতো জ্বরের সময়৷
তারপর হুট করে একদিন ভয়ংকর রকমের অসুস্থ হয়ে পরলাম৷
বাবা তখন প্রচন্ড রকমের দুশ্চিন্তায়৷
আর আমার ভাইটা বাবার চেয়ে বড় চিন্তায়৷
আমি দেখতাম, রাতের পর রাত সে আমার শিয়রে বসে থাকতো৷
আমি চোখ মেলতেই তাড়াহুড়ো করে বলতো,
আপু কিছু লাগবে? কিছু খাবা? আমি খাওয়াই দিই?”
আমার চোখ বেঁয়ে পানি চলে আসতো তখন৷
কোনোমতে চাপা গলায় বলতাম,
নাহ৷ তুই ঘুমিয়ে যা৷”
সে চুপচাপ বসে থাকতো তারপরও৷ হুট করে আমি অনুভব করি,
আমার অপরাধের ক্ষমা আছে কি?”
আমার কি উচিত ছিল না,
বড় বোন হিসেবে মায়ের দায়িত্বটা পালন করার?
এত অনাদর-অবহেলার পরও আমার পিছনে লেগে থাকা ভাইটার৷
নিজেকে হুট করে পৃথিবীর নিষ্ঠুর মানুষগুলো একজন মনে হলো৷”
আচ্ছা আমার কি উচিত না, ভাইটাকে একটু ভালোবাসা৷
এক আকাশ ভালোবাসার বিনিময়ে এক চিমটি ভালোবাসার?”
পরক্ষণেই নিজেকে স্বার্থপর মনে হলো৷
ভাইটা হয়তো ভাববে,
আমি অসুস্থতার সুযোগের সৎ ব্যবহার করছি৷
আমার নিজের কাছেই নিজে লজ্জিত ছিলাম৷”
অসুস্থতা আমাকে ছাড়ছিল না কিছুতেই৷ আমার ভাইটা দিন-রাত পুরোটা সময় আমার পাশে বসা৷
গভীর রাতে ঘুমিয়ে পরতো আমার মাথার পাশে৷
আমার খাটে সে বসতো না কখনো৷
আমার খাটের পাশে বসে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পরতো৷
নিয়ম করে মাঝরাতে ঘুম ভাঙতো আমার৷
আমি মাথায় হাত বুলোতাম৷ চুলে বিলি কেটে দিতাম৷
আমার ভাগ্যবান মনে হলো নিজেকে৷
এমন নেয়ামত আল্লাহ সবাইকে দেয়না৷
আমি আস্তে করে কপালে চুমু খেতাম৷
ঘুমের ঘোরে আমার হাতটা তার মাথার নিচে রেখে আরামে ঘুমাতো৷
আরেক অসুস্থতার রাতে আমার ঘুম ভাঙলো৷ বরাবরের মতোই আমার খাটের পাশে ঘুমিয়ে পরেছে৷
খুব সাবধানে আমার পাশে তুলে শোয়ালাম৷
ওর ঘুমটা ভেঙে গেল হুট করে৷
একলাফে আমার খাট থেকে নেমে গিয়ে বলল,
আপু আমি ইচ্ছে করে শুইনি৷
ঘুমের ঘোরে উঠে গেছি হয়তো৷
আমি ইচ্ছে করে উঠিনি আপু সত্যি৷
আমিতো ঘুমের ঘোরে উঠিনা কখনো!!”
কথাশুনে আমি মলিন ভাবে হাসি৷
আমার দিকে অবাক হয়ে তাকায় আমার ভাইটা৷
চোখগুলো ভালোভাবে কচলে নিয়ে তাকায় আমার দিকে৷”
“ভাই আমাকে বুকে নিয়ে ঘুমাবি একটু? আমার ঘুম আসছেনা!”
কথাশুনে তারমুখের আনন্দের ফোয়ারা বয়ে যায়৷ সেটা আমি খুব বুঝতে পারি৷
চোখ দিয়ে টুপটুপ পানি ঝরছিল৷
আমিও কান্না ধরে রাখতে পারিনি৷
ভাই-বোন মিলে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিয়েছিলাম৷
তারপরের দিনই বাবাকে খুশি দেখালো৷
বাবা হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলল,
ডাক্তারগুলো আজকাল বেক্কল হয়ে গিয়েছি৷
একজনের রিপোর্ট অন্যজনকে দিয়ে বসে৷”
আমি কারণ জিজ্ঞেস করতেই বলল,
-অন্যজনের কিডনি রোগের রিপোর্টটা তোকে দিয়ে বসেছে৷ মা একটা কথা বলি তোকে?
-বল বাবা৷
-আমার ছেলেটাকে আর কষ্ট দিস না রে৷ তোকে প্রচন্ড রকমের ভালোবাসে ছেলেটা৷ তোর এত অবহেলার পরো হাসিমুখে বলে আমার আপুকে আমি ভালোবাসি৷
সেদিন ডাক্তার যখন বলল,
তোর কিডনীর সমস্যা৷
তোর ভাইটা উঠে পরে লাগলো তার একটা কিডনী তোকে দিবে বলে৷
এমন ভাই সবার কপালে জোটে না রে মেয়ে৷”
বাবা চলে গেলেন৷
ভাইটা আমার বাসায় ফিরেনি এখনো৷
বাবার ফোন থেকে নাম্বারটা নিয়ে ফোন করলাম৷
-কই তুই?
– বাইরে৷
-বোনের খুব ঘুম পাচ্ছে৷ কিন্তু সে ভাইয়ের বুক ছাড়া ঘুমাবেনা৷ ভাই কি তারাতারি আসবে একটু?
-তারাতারি না ভাই উড়ে আসবে এখনই৷
আমি হাসি৷ ভাইটার অনেক ভালোবাসা প্রাপ্য৷ অনেকগুলো ভালোবাসবো আমার ভাইটাকে৷
সব পুষিয়ে দিতে হবে তো৷