দুই বছর হতে চলেছে অর্পা আর ইমরানের বন্ধুত্বের।খুব ভাল বন্ধু তারা।একে অপরের কাছে সব কিছুই শেয়ার করে।কেউ কাউকে ছাড়া একটা মূহুর্তও থাকতে পারে না।কিন্তু কয়েকদিন হয় ইমরান অর্পার মাঝে কিছুটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছে।অর্পা আগের মত আর ইমরানকে সময় দেয় না,ফোনে কথা বলার সময়ও ব্যাস্ততা দেখিয়ে ফোন কেটে দেয়।কিন্তু কেন অর্পা এমন করছে তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না ইমরান।এ ব্যাপারে অর্পাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেও অর্পা চুপ করে থাকে।অর্পার এই কয়েকদিনের পরিবর্তন ইমরানকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।কারন ইমরান যে অর্পাকে তার মনের কুঠিঁরের খুঁটি বানিয়ে ফেলেছে।মনের অন্ত গহীনে জায়গা দিয়ে ফেলেছে তাকে।অর্পাকে ছাড়া একটা মূহুর্তও থাকতে পারছে না ইমরান।সারাক্ষন অর্পার ভাবনায় বিভর থাকে সে।হয়তো এটাই ভালোবাসা।ইমরান অর্পাকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছে।
অর্পার সাথে ইমরানের প্রথম পরিচয় হয় বাস স্টপে।গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পরছে।অনেকক্ষন ধরে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে সে।মাথাটা প্রায় ভিজে গেছে।হঠাত্ খেয়াল করলো তার মাথার উপরে কেউ একজন ছাতা এগিয়ে ধরেছে।মাথাটা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখে একটা মেয়ে কাজল কালো চোখে তার দিকে চেয়ে আছে।ঠোঁটের কোন এক চিলতে হাসির রেখা।দুই গালে টোল পরে আছে।কপালে একটা বড় নীল রঙের টিপ দেয়া।আহা যেন একটা স্বর্গের অপ্সরী তার দিকে এভাবে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।ইমরান কিছু সময়ের জন্য স্তব্দ হয়ে যায়।নিরবতা ভেঙ্গে মেয়েটি বলল
–আপনি ইমরান ভাইয়া,তাই না?(মেয়েটি)
–জি।কিন্তু আপনি আমাকে চিনেন কিভাবে?আর আমার মাথায় বা কেন ছাতা এগিয়ে ধরলেন?
–আপনি যে কলেজে পড়েন আমিও ঐ কলেজে ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষে পড়ি।আর আপনি ভিজে যাচ্ছিলেন তাই ছাতাটা ধরলাম।কলেজে যাবেন নাকি?
–হ্যাঁ । আপনিও যাবেন?
–জি।কিন্তু আপনি আমাকে আপনি করে বলছেন কেন?আমিতো আপনার জুনিয়র।
–অপরিচিত কাউকে আপনি করেই বলতে হয়।আর আমি কোন ক্লাসে পড়ি এটাও দেখি যানেন!
–শুধু এটা না।আপনি কি করেন,কোথায় থাকেন সব কিছুই জানি।
–ও তাই নাকি! তো কতদিন ধরে আমাকে অনুসরন করছেন?!
–এইতো কিছু দিন হলো।
–কিছুদিনের মধ্যেই এতোকিছু জেনে গেছেন! আর কিছুদিন হলে তো আমাকেই পুরু জেনে যাবেন।
–আমি কি আপনার ভালো একজন বন্ধুর জায়গা টা পেতে পারি।
–কেন নয়।অবশ্যই।
–আপনার নামটি তো জানা হলো না. . .
–আমি অর্পা. . . .
–খুব সুন্দর নাম. . .
–বাস আসছে।চলুন কলেজে যাওয়া যাক।
–চলুন।
–আমাদের মধ্যে এখন বন্ধুত্ব নামক একটি সম্পর্ক রয়েছে।সুতরাং আপনি করে বলা চলবে না।
–তাহলে কি করে বলতে হবে!?
–ন্যাকামি করিসনাতো।
–ও বুঝেছি।চল বাসে গিয়ে উঠি নাহয় বাস চলে যাবে।
–হুম।চল. . . .
দিন যতই যাচ্ছে।তাদের বন্ধুত্ব নামক সম্পর্কটিও গভীর হচ্ছে।কখনো রাত জেগে ফোন আলাপ,কখনো কলেজ ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে যাওয়া,কখনো কলেজের রাস্তার মোড়ে ফুসকা দোকানে বসে ফুসকা খাওয়া।আর সারাক্ষন খুনসুটি লেগে থাকা।একে অন্যের দৈনন্দিন রুলস করে দিয়েছে।কখন খাবে,কখন পড়বে,কখন ঘুমাবে।তাদের রুলস অনুযায়ী তারা চলে।এতো টেইক কেয়ার তা কি শুধু বন্ধুত্বের মধ্যে?কিন্তু ইমরান তো অর্পাকে তার মন মনিয়ায় জায়গা দিয়ে ফেলেছে।মনের ক্যানভাসে অর্পার ছবি একে রেখেছে।ভালোবাসার ডোর দিয়ে অর্পাকে তার মনের সাথে বেঁধে রাখতে চায়।কত স্বপ্ন সাজিয়ে ফেলেছে অর্পাকে নিয়ে।এ সবকিছুই অর্পার অজান্তে।ইমরান কখনোই অর্পাকে তার অপ্রকাশিত ভালোবাসার কথা বলেনি।কারন যদি অর্পা তাকে ভুল বুঝে দূরে চলে যায়।যদি তাদের এই বন্ধুত্বটা ভেঙ্গে যায়।তাহলে তো সে অর্পাকে ছাড়া থাকতে পারবে না।ইমরানের প্রতিটা স্বপ্নে,প্রতিটা মূহুর্তে শুধুই অর্পা।অর্পা যেন তার রক্তে মিশে গেছে।যখন ইমরান অর্পার মায়াবী চোখের দিকে তাকায় মনে হয় যেন পৃথিবীর সব সুখ এখানে এসে থেমে গেছে।খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছে সে অর্পাকে।কিন্তু কেন অর্পা তার এই অপ্রকাশিত ভালোবাসার কথা বুঝতে চায় না!নাহ ইমরান তার এই অপ্রকাশিত ভালোবাসার কথাটি জানাবেও না অর্পাকে।সবাই তো চায় তার ভালোবাসার মানুষটি সব সময় তার পাশে থাকুক।অর্পা তো তার পাশেই রয়েছে।তাকে ছেড়ে তো কোথাও যায়নি। কিন্তু এই কয়েক দিনের অর্পার পরিবর্তনের কারন টা ইমরান কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না।অর্পাকে ফোন দিচ্ছে অথচ তার ফোন দুদিন ধরে বন্ধ।ইমরান আর কিছু ভেবে পাচ্ছে না।পাগলের মত হয়ে যাচ্ছে। মনের মধ্যে অজানা একটা কষ্ট চেপে বসেছে।নাহ তাকে যে অর্পার সাথে যাভাবেই হোক দেখা করতেই হবে।
পরদিন সকালে ইমরান বাসা থেকে বের হয় দোকানে চা খেতে বসেছে।চায়ের অর্ডার দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে সে।প্রকৃতিও যেন তার মত কষ্টে আছে।তাই তো প্রকৃতি আজ মেঘলা হয়ে আছে।যে কোন সময়ই অশ্রু ঝরাতে পারে।প্রকৃতির কিসের কষ্ট?ও বুঝেছি সূর্যও আকাশটার সাথে অভিমান করেছে।তাই তো প্রকৃতি আজ মেঘলা রূপে সেজেছে।এগুলো ভাবতে ভাবতেই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি।অবশেষে আকাশটা কেঁদেই দিলো।
খুব অভিমানি আকাশটা।মনের কষ্টের কথা গুলো সবাইকে জানিয়ে দেয় আকাশটা।তাইতো সবার সামনেই কেঁদে দেয় সে।মৃদু হাসছে ইমরান।বৃষ্টি পরা পিচঢালা পথের উপর দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে হেঁটে যাচ্ছে একজোডা কপত কপতি।ইমরানের মনে পরছে অর্পার সাথে বৃষ্টিতে ভেজার মূহুর্ত গুলো।
একদিন আকাশটা মেঘলা থাকা শর্তেও দুজনে ঘুরতে বেরিয়েছে বাগানবাড়ি বটতলার উদ্দেশ্যে।রূপায়ন মোড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দুজন।হঠাত্ শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি আর বইছে দমকা বাতাস।বৃষ্টির বড় বড় ফোটা গুলো উপরে পরতেই ছোট বাচ্চাদের মত নাচতে শুরু করলো অর্পা।ইমরান তাকিয়ে আছে অর্পার দিকে।অর্পার সাড়া শরীরের জামা কাপড় ভিজে গেছে।বৃষ্টিতে ভেজা চুল গুলো লেপ্টে আছে।মাঝে মাঝে চুল গুলো বাতাসে উড়ছে।বৃষ্টির নোনা ফোটা গুলো গাল বেয়ে পরছে।অর্পাকে আজ বৃষ্টি ভেজা অপ্সরীর মত লাগছে।বৃষ্টিতে ভিজলে কি মেয়েদের এতো সুন্দর লাগে?সরাসরি কাছ থেকে না দেখলে তা হয়তো বুঝাই যেতো না।
হঠাত্ অর্পা বলে উঠলো
–এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?
–তোকে বৃষ্টিতে ভিজলে এতো সুন্দর লাগে জানতাম না।তাই তাকিয়ে আছি. . .
–হয়েছে আর ডং করতে হবে না।আমার হাতটা ধর।
–কেন?
–এতো কেন কেন করিস না তো।হাত ধরতে বলেছি ধর।
–ঠিক আছে।ধরছি. . . . . .
ইমরান অর্পার হাত দুটো ধরলো।দুজন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে।হঠাত্ অর্পা ইমরানের হাত ধরেই নাচতে শুরু করলো।
–এই কি করছিস?পাগল হয়ে গেলি নাকি!(ইমরান)
–চুপ কর।কোন কথা বলবি না।এমন একটা মূহুর্ত আর পাবি!
–চল ঐখানে গিয়ে বসি।
–চল. . . . . . . . . . .
পড়ছে অঝোর ধারায় বৃষ্টি।ভেজা ঘাসের উপর পাশাপাশি বসে আছে একজোড়া কপত কপতি।অর্পা ইমরানের কাঁদে মাথা এক হাতের উপর হাত রেখে বসে আছে. . . . .বইছে মৃদু বাতাস. . . .বাতাসের সাথে মাঝে মাঝে অর্পার চুল এসে পরছে ইমরানের চোখে মুখে।যেন অন্য রকম এক শিহরন বয়ে যাচ্ছে ইমরানের মনে।
-কি হলো মামা চা নেন।
দোকানদারের কথায় কল্পনার ঘোর কাটে ইমরানের।জটপট চা খেয়ে অর্পার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ইমরান।কিন্তু রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম থাকার কারনে বিকেলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে।
বিকেল পাচঁটা,
বাসের মধ্যে বসে আছে ইমরান।শো শো শব্দ বাস খুব দ্রুত চলছে।তিন ঘন্টা সময় লেগেছে গন্তব্যে পৌঁছাতে।তখন চারদিকে অন্ধকার হয়ে গেছে।মেঘাচ্ছন আকাশ থাকার কারনে আরো বেশি অন্ধকার লাগছে প্রকৃতিকে।গ্যাস লাইটের ছোট টর্চটির আলো রাস্তায় ফেলে এক মনে হেঁটে চলছে ইমরান।হঠাত্ গানের উচ্চ শব্দে ইমরানের ঘোর কাটে।হয়তো কারো বাড়িতে বিয়ের আয়োজন হচ্ছে।একটু সামনে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো লাল,নীল,সবুজ বাতির আলো।কিন্তু এটাতো অর্পার বাসা।আমি ভুল দেখছি না তো?এটা ভেবেই ইমরান চোখ কচলে দেখে আসলেই এটা অর্পার বাসা।গেইটে বড় অক্ষরে লিখা “শুভ বিবাহ” ।কিন্তু এ বাড়িতে তো অর্পা ছাড়া বিয়ে হওয়ার মত কেউ নেই।তার মানে. . . . . . . . . .অর্পার বিয়ে. . . . . . .
শুরু হলো অঝোর ধারায় বৃষ্টি।হাঁটু গেরে মাটিতে বসে “শুভ বিবাহ” লিখাটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইমরান।দুচোখ বেঁয়ে কষ্টের নোনা ফোটা গুলো গড়িয়ে পড়ছে।বৃষ্টির সাথে চোখের নোনা ফোটা গুলো মিলিয়ে যাচ্ছে।
রাত এগারটা,
হালকা ভেজা কাপড় নিয়েই ইমরানের নিজ গন্তব্যে যাওয়ার জন্য বাসে বসে আছে।শো শো শব্দে খুব দ্রুত বাস চলছে তার গতিতে।হঠাত্ করেই একটা বিকট আওয়াজ হলো।আর শুনা গেল হৃদয়ছোঁয়া কিছু মানুষের আত্ম চিত্কার।মূহুর্তের মধ্যে অন্য একটি গাড়ির সরাসরি ধাক্কায় বাসটি মুচরে গেলো।দুটি সিটের মাঝে ইমরানের নিস্তাজ দেহটি আটকে আছে।রক্ত গুলো বেঁয়ে পড়ছে সারা শরীর জোড়ে. . . . . . .