বাবাই তুমি কি আম্মুর সাতে ভালবাছা কত্তেছো

বাবাই তুমি কি আম্মুর সাতে ভালবাছা কত্তেছো

বাচ্চারা যখন পড়ালেখা শিখা শুরু করে সেটা সবার আগে টের পায় ঘরের চার দেয়াল। আমার ছোট ছেলেটা পড়ালেখা এখনো শুরু করেনি। কিন্তু ইতোমধ্যে ঘরের দেয়াল গুলো টের পেয়ে গেছে বিদ্যাসাগর ইজ কামিং। আমার মেয়েটা এবার ক্লাস টুতে উঠেছে। আর ছেলেটা সবে তিন বছর। ওর বোনের পেন্সিল হতে শুরু করে ওর মায়ের লিপস্টিক, কাজল, আইলাইনার সব দিয়ে দেয়ালে একেকটা মাস্টারপিস তৈরি করছে।

আমি ছবির তেমন কিছু বুঝি না। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি থাকলে হয়তো বুঝিয়ে দিতেন আমার ছেলের এই শিল্পকর্মের শানেনজুল। ভিঞ্চি নিজেও দেয়ালে এক মাস্টারপিস এঁকেছেন- দ্য লাস্ট সাপার। আমার ছেলে তো তার চেয়েও এতো দুর্দান্ত ছবি আঁকে যে, ছেলে যদি বলে না দেয় তাহলে বুঝতামই না ওটা মাছ, ওটা ওর আম্মু আর ওটা হলো একটা হাতি।

আজ সকালে ওর মায়ের লাল লিপস্টিক দিয়ে বারান্দার দেয়ালে বসে বসে যা আঁকছিলো তা দেখে আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছে। এইটুকুন গ্যাদা বাচ্চা হার্ট আঁকা শিখলো কোথা থেকে। তাও আবার লাল রঙ দিয়েই যে হার্ট আঁকা হয় এটাই বা জানলো কি করে। নাকি লাল রঙ ব্যাপারটা কাকতালীয়। ওর মাকে ডাক দিয়ে দেখালাম ছেলের প্রতিভা।

কিন্তু প্রতিভার কিসের কি মূল্য দেবে। ছেলেকে ধরে পিঠে ধুপধাপ দুইটা লাগিয়ে হাত থেকে লিপস্টিকটা নিয়ে আমার দিকে হিংস্র সিংহিনীর মতো গর্জে উঠলো, “তোমার কি চোখ নাই হ্যাঁ। তু… তুমি দেখো না এত দামি লিপস্টিকটা তোমার ছেলে দেয়ালে ঘষে নষ্ট করছে। ওর হাত থেকে লিপস্টিকটা নিলা না ক্যানো?”

আমি ছেলের দিকে তাকিয়ে আছি। ছেলে নিচের ঠোঁট উল্টিয়ে চোখ পিটপিট করে একবার ওর মায়ের দিকে একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। ছেলে এখনই বুঝে গেছে ফ্যামিলি পলিটিক্স। মায়ের সামনে এখন কাঁদা যাবে না। কাঁদলেই আরো দুইটা ওর পিঠের উপরে পড়বে। আমার একটু আস্কারা পাওয়ায় ইশারার অপেক্ষা করছে। ইশারা পেলেই চোখের টাংকির পানি ছেড়ে দিয়ে নোকিয়া ৩৩১০ মোবাইলের রিংটোনের মতো হাই ভলিউমে ভ্যাএএএ করে কান্না শুরু করবে।

বউকে ক্লোজআপ কাছে আসার গল্পের নায়কদের মতো মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললাম, “বাবাই তো ছবি আঁকছিলো সোনা। খামাখা কেনো মারলে ছেলেটাকে। সামান্য এই লিপস্টিক ছেলের থেকেও বড় হয়ে গেলো তোমার কাছে!”

বউ আরো রেগে যাচ্ছে। ও রাগা শুরু করলে ওর শরীর কাঁপতে থাকে। কাঁপনেই বোঝা যায় রাগের মাত্রা কতটুকু। একটা চুটকি মনে পরে গেলো। চুটকিটা এমন। এক লোক বাসে উঠে ড্রাইভারের পাশে ইঞ্জিনের উপরের সীটে বসে খেয়াল করলো বাসে কোন স্পিড মিটার নেই। তো লোকটা বাস ড্রাইভারকে জিজ্ঞাস করলো, “ভাই আপনার বাসে তো মিটার নাই। বুঝেন কি করে কখন কত স্পিডে গাড়ি চলছে। মিটার না থাকলে তো সমস্যা।”

ড্রাইভার গিয়ার পাল্টাতে পাল্টাতে বলল, “কোন সমুস্যা নাই স্যার। গাড়ির স্পিরিট বারলেই আমি বুঝতাম পারি। গাড়ি অহন চলতাছে আপনার ২০ এ। মানে ঘন্টায় বিশ কিলুমিটার স্পিরিটে।”

লোকটি অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, “কি করে বুঝলেন?” ড্রাইভার বলল, “আমার সামনের লুকিং গেলাস যহন কাঁপে তহন ঘন্টায় ২০ এ চলে গাড়ি। যখন সাইডের লুকিং গেলাস কাঁপে তহন ৩০ এ চলে। যখন আমার হেলপার কাঁপে তখন ৪০ এ। যখন পেসেনজারও কাঁপে তখন ৫০ এ। যখন আমার বডি সহ স্টিয়ারিংও কাঁপে তখন ৬০ এ চলে গাড়ি। এর উপরে আমার গাড়ির স্পিরিট আর বাড়ে না।”

আমার বউয়ের রাগও এমন। এখন ওর কানের দুল কাঁপছে রাগে। মানে বউয়ের রাগ এখন ঘন্টা ২০ কিলোমিটার বেগে আছে। যখন ওর চুলের খোঁপাও কাপে তখন রাগ থাকে ৩০ এ। যখন ওর হাতের চুড়ি কাঁপে তখন রাগ ৪০ এ। যখন ওর হাতে কাচের প্লেট বা ফ্লাওয়ারভাস থাকে তখন ৫০ এ। এরপরে আর কত স্পিডে রাগ উঠলে বউয়ের অবস্থা কি হয় তা দেখি নাই। আমি মোটামুটি ৪০ এ গেলেই “শান্তি পরম ধর্ম” ব্রত নিয়ে গৃহত্যাগ করে এদিকওদিক কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করি। রাগ কমলে মেয়ে আমাকে ফোন দিয়ে বলে, “বাবাই আবহাওয়া এখন শীতল। তুমি আইসক্রিম নিয়ে আসো।”

আমার কথায় বউয়ের রাগ বাড়ছে। ছেলেকে আস্তে করে আমার সাইডে নিয়ে এলাম। নাইলে ছেলেটার পিঠ অহেতুক ভর্তা বানাবে। আমার উপরে বেশি রাগ করলে আমার ছেলে মেয়ের উপরে ঝারে। ও জানে আমার দুর্বল জায়গা কোনটা। বউ দেখলাম কিছু বলল না। তাড়াহুড়ো করে রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেলো। বউ যাওয়ার ১০ সেকেন্ড পরে আমি কিছু পুড়ে যাওয়ার গন্ধ পেলাম। মেয়েদের নাক আসলেই সাংঘাতিক। সবকিছুর গন্ধ মেয়েদের নাকেই আগে আসে। ছেলে ওর মাকে যেতে দেখেই আমার সামনে এসে এতক্ষণ জমিয়ে রাখা কান্না ভ্যাএএএ করে ছেড়ে দিলো। আমি ছেলেকে বুকে নিয়ে আদর করে দিলাম।

“বাবাই তুমি আম্মুর লিপস্টিক নাও কেন। তোমার আপুর রঙ পেন্সিল নিতে পারো না।” ছেলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আহ্লাদী কান্না। আমার কানের কাছে মিউমিউ করে বলল, “আম্মুর লিপিত্তিক দি ছুন্দুর ছুন্দুর দয়িং হয়।”

আর কি বলি। ছেলে যখন “ছুন্দরের” খোঁজ পেয়েই গেছে। ছেলেকে কোলে বসিয়ে ওর হার্ট আঁকা ছবি দেখিয়ে বললাম, “এই গুলা কি এঁকেছো বাবা।” ছেলে আমার প্রশ্ন শুনে চোখ মুছে হাত দুইটা নিয়ে সাপের মতো মোচড়াতে লাগলো। ওর চোখে মুখে দেখি লজ্জার ঝিলিক। আবারো জিজ্ঞাস করলাম কি এঁকেছে।

লজ্জায় মোচরাতে মোচরাতে বলল, “ভালবাছা।” বলেই হিহি করে হাসি। আমি ঢোক গিলে জিজ্ঞাস করলাম, “বাবা ভালবাসা কি?”

এবার দেখি ওর লজ্জা একটু কমেছে। আমার দিকে তাকিয়ে ও যেন অবাক হয়ে যাচ্ছে; আমি ভালবাসা কি সেটা জানিনা বলে। আমার সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে সামনের দিকে এনে বলল, “তুমি আম্মুকে এবাবে যে আদর করি দাও ঐতা ভালবাছা।”

মাথার উপরে ঠাডা পড়লেও এত চমকাতাম না। আর কিছু জিজ্ঞাস করার সাহস পাচ্ছি না। ছেলে যে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা হয়ে গেছে তা কে জানতো। বউকে বলে দিতে হবে- সাবধান, ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা আশেপাশেই আছে। এবার থেকে বউয়ের সাথে খুব সাবধানে “ভালবাছা” করা লাগবে। এখন মুশকিল হলো ছেলে আবার এই তথ্য সবাইকে বলে না বেড়ালেই হয়।

আরেকটা চুটকি মনে পরে গেলো। এক বাসায় নতুন দম্পতি বেড়াতে এসেছে। তো অনেক কথার পরে নতুন বউ বাচ্চা ছেলেকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “বাবু কে তোমাকে বেশি ভালবাসে? আব্বু নাকি আম্মু?” বাচ্চাটা বলল, “আম্মু বেশি ভালবাসে।” নতুন বউ বলল, “কেনো আব্বু ভালবাসে না?” বাচ্চাটা এবার বেশ বিরক্ত হয়ে বলল, “আব্বু তো খালি আম্মুকে ভালবাসে।”

আমার ছেলেটা কারো সামনে এমন কিছু বলে আমার ইজ্জতের চল্লিশা না করলেই হয়। কিন্তু ছেলেটা হয়েছে ওর মায়ের কার্বনকপি। মায়ের মতোই পাজির পাঝাড়া। তবে মেয়েটা আবার আমার মতোই হয়েছে। একেবারে লক্ষি একটা মেয়ে।

আমি অবশ্য কয়দিন থেকেই খেয়াল করছি ছেলের মতিগতি ভাল না। এই কয়দিনে বেশ কয়েকবার ঘুম থেকে উঠে সকালে ওর মায়ের সাথে মারামারি শুরু করে দেয়। ওর মায়ের চুল ধরে টানে আর বলে, “আমি তো একানে ঘুমু দিতি। একানে আত্তি কি করে।” ওর মা ছেলের হাত থেকে চুল ছাড়াতে ছাড়াতে মিটি মিটি হেসে বলে, “তোর বাবাইকে জিজ্ঞেস কর।” ছেলে আমার দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। যেন তার উত্তরটা চাই-ই-চাই যে, সে আমাদের দুইজনের মাঝখানে ঘুমায়। কিন্তু ঘুম থেকে উঠার পরে সে ওর মায়ের পাশে কি করে চলে যায়।

আমি কোন উত্তর দিতে পারি না। মনে মনে বলি, “ফাজিলের হাড্ডিগুড্ডি বড় হয়্যা বিয়া করলেই বুঝবি তোর মতো একটা বান্দর ছাওয়াল থাকলে রাইতে কি যে জ্বালা যন্ত্রণা হয়।” আর বউয়ের কানের কাছে ফিসফিস করে বলি, “এইটা কি সত্যি আমার পুলা। আমার পুলা তো আমার মতো লক্ষি হওয়ার কথা। হাসপাতালে চেইঞ্জ হয়ে যায় নাই তো।” বউ আমার দিকে তাকিয়ে মাড়িতে মাড়ি ঘষে। বেচারি যে মনে মনে আমার মাথা চাবাচ্ছে ঢের বুঝতে পারি। আমি পাশ ফিরে ভাবি ছেলের ঘুম ভাঙ্গার আগেই আবার ওকে আমাদের মাঝখানে নিয়ে আসবো।

আজ শুক্রবার। স্বাভাবিক ভাবেই বউয়ের একটু কাজকর্ম বেড়ে যায়। মেয়েটা আমার অনেক লক্ষি। সকালেই হোমওয়ার্ক শেষ করে মাকে টুকটাক সাহায্য করে। আমি বউকে সাহায্য করতে গেলেই বলে দেয়, “প্লিজ আমার কাজ বাড়াতে এসো না। তুমি বাবাইকে সামলে রাখো। এটাই আমার জন্য অনেক বড় হেল্প হবে। ছেলেটা তোমার মতো হইছে বলেই এই অবস্থা। একটা সেকেন্ড ছেড়ে দিলেই ঘর চিড়িয়াখানা বানিয়ে ফেলে।” আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না বউ। একটু আহত হলাম বউয়ের কথা। চিড়িয়াখানা বলে কি ছেলের সাথে আমাকেও ইঙ্গিত করলো নাকি!

বাবা মা গেছে গ্রামের বাড়িতে। যার কারণে একটু রক্ষা। নাহলে এতক্ষণে আমার মায়ের বেশ কয়েকটা নালিশ কানে ঢুকতো, “তুই কেমন ছেলে হ্যাঁ। বউমারে একটু সাহায্য করতে পারোস না। যা কাপড় গুলা নিয়া শুকাইতে দিয়া আয়। আর ফার্নিচার গুলা একটু মুছলে কি হয়। ফ্যানটা মুছছিস কয় বছর আগে খেয়াল আছে। ব্লা ব্লা ব্লা।” যা দেখি বাবা মা দু’জনেই আসলে সবচেয়ে ভাল আছেন। কিছুদিন আমার বাসায়। কিছুদিন বড় ভাইয়ার বাসায়। আবার কিছুদিন ছোট’পার বাসায়। ঘুরে ঘুরে সময় কেটে যায় উনাদের। অবশ্য এমনই হওয়ার কথা ছিল। সারাজীবন আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন বাবা মা। এখন উনাদের আরাম আয়েশ করে নাতিনাতকুর নিয়ে হাসিখুশিতে দিন পার করার সময়।

আমার প্রায়ই মনেহয় এই সংসার ধর্ম আমার জন্য না। আমি এই সংসারে আছি আবার নাইও। আমি আছি কারণ বউ খুব শক্ত হাতে সংসারটা ধরে আছে। বউ না থাকলে আমি এই সংসার জগত থেকে ছিটকে যেতাম। মেয়েরাই আসলে এই জগত সংসার এখনো টিকিয়ে রেখেছে। কি করে টিকিয়ে রেখেছে তা আমরা বুঝতেও পারি না। মেয়ে জাতটা না থাকলে এই পৃথিবীতে মায়া বলেও কিছু থাকতো না। কি লাভ একটা মেয়ের, আরেকটা সংসারে এসে সেই সংসারের হাল ধরার। বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করার। সবার দেখভাল করার। এসব করে মেয়েটা কি পায়? কিসের সুখ নিজের বাবা মাকে ছেড়ে অন্যের ঘরে পুরো জীবন কাটিয়ে দেওয়া। এই ত্যাগের কতটুকু বুঝি আমরা। বা বুঝতে চাই। এই যে আমার মা। কি কষ্টটাই না করেছেন আমাদের জন্য। এখন আমার বউও করছে। আমার মাথায় এতো কিছু ঢুকে না।

বউয়ের হাতে সংসার তুলে দিয়ে আমি আমার রাজ্যে ডুবে থাকি। এইটুকু সাপোর্ট যে আমি বউয়ের কাছ থেকে পাই এটাই আমার জন্য সেরা পাওয়া। গোসল করে নামাজে যাওয়ার জন্য তৈরি হতেই ছেলেও বায়না ধরলো ওকে নিতে হবে। কিন্তু বাবাইকে নেওয়া যাবে না আজ। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। মসজিদের ভিতরে জায়গা পাওয়া যাবে না। বাইরে নামাজ আদায় করতে হবে। এই গরমে বাবাইকে নিয়ে বাইরে বসা অসম্ভব। এইটুকুন বাচ্চার অনেক কষ্ট হবে। ওর মা ধমক দিয়ে ওকে ন্যাংটাপুংটা করে বাথরুমে নিয়ে গেলো। আজ সাপ্তাহিক ধোলাই দিবস। ছেলের মাথা থেকে পা পর্যন্ত আজ ডলে ডলে ময়লা বের করবে ওর মা।

ছেলেকে গোসল শেষে তোয়ালে পেঁচিয়ে দেবে লুঙ্গির মতো করে। বাচ্চাদের আমার সবচেয়ে আদর লাগে এভাবে। গোসল করে বের হয়ে কোমরে তোয়ালে পেঁচিয়ে সারা ঘর দৌড়ে বেড়ায়। আর কিটকিট করে হাসে। মনটাই ভরে যায় দেখলে। ছোট শরীরটা জড়িয়ে ধরলে হালকা ঠাণ্ডা ত্বকের স্পর্শটা ভীষণ প্রিয় আমার। শুধু বাচ্চার না। বউও গোসল করে বের হলেই সুযোগ পেলেই পিছন থেকে জড়িয়ে ধরি। তবে এখন থেকে সাবধান। ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরায় “ভালবাছা” ধরা না পড়লেই হয়।

নামাজ আদায় করে এসে কলিংবেল টিপতেই মেয়েটা দরজা খুলে দিলো। আমার হাত থেকে জায়নামাজ নিয়ে নিলো। বাইরে প্রচণ্ড গরম তাই সোফাতেই বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। এমন সময় দেখি মেয়েটা এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি এনে দিলো। বলল, “আম্মু ফ্রিজে রেখে দিয়েছে। বলেছে তুমি এলে দিতে। এটা লেবুর সরবত বাবাই।”

মেয়ের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে প্রায় অর্ধেক শেষ করে ফেললাম। মেয়েকে বাকি অর্ধেক খাইয়ে দিলাম। মেয়েটার হাত থেকে সরবতটুকু খেয়ে শুধু যে শরীরটা জুড়িয়েছে তা নয়। মনটাও জুড়িয়ে গেছে। অনেক লক্ষি মা আমার। গ্লাসটা নিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলো। মনে মনে ভাবি বউ এতকিছু খেয়াল রাখে কি করে!

বেডরুমে যেতেই দেখি ছেলেটাকে ঘুম পারাচ্ছে ওর মা। ছেলের একটা অভ্যাস হলো ওর মায়ের চুল ধরে ঘুমানো। ঘুমানোর সময় মায়ের চুল না ধরে ঘুমুতে পারে না। ছেলেকে বুকে নিয়ে পিঠে আলতো চাপড় দিয়ে ঘুম পারাচ্ছে গুণগুণ করে। আমাকে দেখে বউ বলল, “ভাত দেই টেবিলে?”

পাঞ্জাবিটা খুলে হ্যাঙ্গারে ঝুলাতে ঝুলাতে বললাম, “না থাক একটু পড়েই খাবো। বাবাই ঘুমাক।” বউ বাবাইয়ের হাত থেকে চুল ছাড়াতে ছাড়াতে উঠে বসে বলল, “তোমার দস্যি ছেলে ঘুমিয়েছে সেই কবে।” বউ উঠে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। একটু পরেই দেখি মেয়ে এসে হাজির। আমি ছেলের পাশে শুয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। মেয়ে আমার পাশে শুয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। “মামনি খেয়েছো?” মেয়ে আমার একটা পাকা চুল তুলতে তুলতে বলল, “হ্যা বাবাই। মা খাইয়ে দিয়েছে।”

একটু পরেই বউয়ের ডাক শুনলাম। খাওয়ার জন্য ডাকছে। আমি মেয়েকে ছেলের পাশে শুয়ে থাকতে বলে উঠে গেলাম। মেয়ে দেখি ওর ভাইয়ের মুখে একটা চুমু দিয়ে ভাইয়ের মুঠো করা হাতের ভিতরে একটা আঙুল ঢুকিয়ে দিয়েছে। মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেছে এই দুই বছরে। ভাইয়ের অনেক টেক কেয়ার করে। ছেলেও আবার হয়েছে বোনের নেওটা। বোনকে না দিয়ে একটা চকলেটও খায় না। বোন স্কুল থেকে ফিরবে তবেই খাবে। বোনকে প্রতিদিন পানির ফ্লাস্ক নিচে পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে স্কুলে যাওয়ার সময়।

টেবিলে বসতেই দেখি আজ একেবারে আমার পছন্দের মেনু। আলু ভর্তা, আলু ভাজি, ঘন ডাল, শুঁটকি ভর্তা, টমেটোর সালাদ অনেক মরিচ দিয়ে। সাথে আমের আচার। দেখেই ক্ষুধা তরতরিয়ে জেগে উঠলো। টেবিলে বসতেই বউ প্লেটে ভাত বেড়ে দিলো। ওর প্লেটে ভাত নেওয়ার সময় ওর হাতটা ধরে ফেললাম। চামচ সহ ভাত আবার বোলে রেখে দিলাম। বউ মুচকি হাসি দিয়ে আমার পাতে ভর্তা আর সালাদ তুলে দিলো। ভাত মাখিয়ে প্রথমে বউকে খাইয়ে দিলাম। প্রায়ই খাইয়ে দেই বউকে। বিয়ের পরে প্রথম প্রথম খুব লজ্জা পেতো। এখনো লজ্জা পুরোপুরি যায়নি। ঠোঁটের কোণে একটু লাজ ঝিলিক দিতেই থাকে।

খেতে খেতে বউকে বললাম, “শোনো! এবার থেকে কিন্তু খুব হুশিয়ার। বুঝলে?” বউ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, “মানে কি?” বউকে খাইয়ে দিতে দিতে বললাম, “মানে ঘরে একটা ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা আছে। তোমার তো আবার হুশ থাকে না চুমু খাওয়ার সময়।”

“দেখো একদম বাজে বকবে না। ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা মানে কি হ্যাঁ!”

“মানে তোমার পুত্রধন।”

“বাবাই সোনা! ও আবার কি করলো?” বউকে ছেলের সেই “ভালবাছা” আঁকা দেয়াল চিত্রের কথা বলে বললাম, “এবার বোঝো অবস্থা।”

বউ হাসতে হাসতে বলল, “একদম ঠিকই আছে। তোমার ছেলে না। এরচেয়ে ভাল আর কি আশা করতে পারো। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে বলে, আমি তো এখানে শুইছি, এখানে এলাম কি করে। হিহিহি!” কপালে হাত দিয়ে বউয়ের হাসি দেখি। গা জ্বালানো হাসি দেখতে দেখতে বললাম, “খুব মজা লাগছে তাই না। খুব মজা।”

“হিহিহি! মজাই তো। নিজেকে সামলাও বুঝলে। ভাবো তো ছেলে কিছু বুঝে না। ছেলে তোমার চেয়েও সেয়ানা, সোনার চান পিতলা ঘুঘু! হিহিহি!”

বউ এই গা জ্বালাই দেওয়া হাসি যে কোথা থেকে শিখেছে। আমি আগেই জানতাম এসব বউকে বলে লাভ হবে না। ও উল্টো সব আমার ঘাড়ে চাপাবে। চাপিয়ে দিয়েছেও। সবাই কত লক্ষি লক্ষি বউ পায়। আর আমি পাইছি পাজির পাঝাড়া এক পাগলী বউ। বউকে খাইয়ে ওর মুখ মুছে দিলাম। সে যাই হোক, একটা মাত্র বউ আমার। ওর এই জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করাই লাগে। সব শোধ নেই ঐ একটা সময়ে। ছেলে ঘুমানোর পরে ছেলেকে এখান থেকে ওখানে নেওয়ার পরে।

বউকে বললাম, “এক কাজ করি ছেলেকে বিয়ে দিয়ে দেই। এই যুগের রহিম রুব্বান। ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজবো নাক বলো?” বউ টেবিল পরিষ্কার করছিল। আমি প্লেট গ্লাস রান্নাঘরে নিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি রান্নাঘর থেকে আসতেই বলল, “শোনো তোমাকে আমি হাড়ে হাড়ে, গিরায় গিরায়, শিরায় শিরায় চিনি। ছেলের জন্য বউ দেখার নাম করে তোমার নিজের মেয়ে দেখার খায়েশ হয়েছে তাই না?”

“ধ্যাত্তেরিকা কিসব বলো না তুমি। এমনি মজা করছিলাম। আর তাছাড়া আমার কি সেই বয়স আছে নাকি?”

“ওহ তার মানে বয়স থাকলে কি করতে তাহলে শুনি?”

“ধুরু যাহ! তুমি খালি কথাও প্যাঁচাও মশার কয়েলের মতো।”

“শোনো মিস্টার বাইন মাছ। মশার কয়েল দেখছো। কয়েল পোড়া ছাই তো দেখো নাই। একেবারে ছাই দিয়ে ধরেছি তোমায়। কই যাবা তুমি হ্যাঁ! কোনো মেয়ের দিকে তাকালে চোখ ঘেটে তুলে ফেলবো না।” বেসিন থেকে হাত ধুয়ে বউয়ের শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বললাম, “কি করে ছাই দিয়ে ধরেছো একটু ট্রায়াল দিয়ে দেখাও না।”

“অসভ্য একটা।”

“এরপর…”

“প তে পাজি। প তে পচা।”

“আর…”

“ছোটলোক।”

“আর…”

“মনে পড়ছে নাতো আর।”

“কেনো স্কুলে আর কিছু শিখায় নাই বাবু। ইতর, বদমাইশ, লোফার।”

“ইতর, বদমাইশ।”

“আর…”

“ছোঁচা!”

হাসতে হাসতে বউকে পিছন থেকে ধরে চুলের খোঁপা খুলে দিলাম। বউ বলল, “তোমার মেয়ে এসে যদি দেখে?”

“মেয়েতো ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরাকে পাহারা দিচ্ছে।”

বউ আমার হাতে একটা চুমু খেলো। ওর ঘাড়ে আলতো চুমু দিলাম। কোমর খামচে ধরে আমার বুকের সাথে একেবারে মিশিয়ে ফেললাম। বউ ডুবে যাচ্ছিলো আমার মাঝে। এমন সময় বউকে ছেড়ে দিলাম। বউ আমার টিশার্ট খামচে ধরে বলল, “কই যাও।”

“রুমে যাই। এটা টেইলার ছিল ম্যাডাম। বাকিটা ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা রাতে ঘুমানোর পরে।”

“অসভ্য একটা।”

“এরপরে…”

“জানিনা যাও।”

রুমে গিয়ে দেখি মেয়েও ঘুমিয়ে গেছে ভাইয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে। বউ তখনো রেগেমেগে দাঁড়িয়েছিলো কোমরে হাত দিয়ে। ওর কানের দুল কাঁপছে। রাগ এখন ২০ কিলোমিটার বেগে বউয়ের শরীরে প্রবাহিত হচ্ছে। আজ আমার শরীরে যে অনেক গুলা নখের আচর পড়বে সেই হিসাব করে ফেলেছি। বউয়ের সামনে গিয়ে আলতো করে ওর গাল আঁজলা ভরে নিয়ে কপালে, সিথানে চুমু দিলাম।

বউয়ের রাগ কি করে পানি করতে হয় এটা বউয়ের চেয়ে আমি ভাল জানি। কিন্তু আমার এই পাগলী বউটা রেগে গেলে ওকে যে কি দুর্দান্ত সুন্দর লাগে তা দেখার লোভ ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম, “ছানাপোনা দু’জনেই ঘুম।” আমার বুকে আলতো করে মাথা রেখে বউ আমাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। টের পাচ্ছি পিঠে নখ ডেবে যাচ্ছে। বউয়ের মুখটা উপরে তুললাম। ও চোখ বন্ধ করে আছে। মুখের কাছে মুখ নিতেই ওর গরম নিঃশ্বাস পড়লো আমার ঠোঁটে। ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াবো এমন সময় ছেলের ঘুম জড়ানো কণ্ঠ শুনলাম।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত