দ্বৈরথ

দ্বৈরথ

বিয়ের রাতে আমার স্ত্রী বেশ সাবলীল ভাবে বলেছিলো, “আপনাকে একটা অনুরোধ করবো, রাখবেন?” আমি চুলে জমে থাকা জরিগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বললাম, “হ্যাঁ, বলো।” “আপনি, আমাকে কখনো আমার নাম ধরে ডাকবেন না” আমার স্ত্রীর অমন নিষেধাজ্ঞায় তাৎক্ষণিকভাবে কিছুটা হোঁচট খেয়েছিলাম। খাট থেকে সামান্য দূরের টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে অর্ধেকটা পানি খেয়ে খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলেছিলাম, “আচ্ছা। ডাকবো না।”

সন্ধ্যায় এ ঘরটায় এরোসল স্প্রে করে দরজা জানালা বন্ধ রাখা হয়েছিলো। গন্ধটা তখনো পুরোপুরি যায়নি। ফ্যান ছাড়বো কিনা ভাবছিলাম। আমার স্ত্রী বিছানার দিকে আসার ইশারা করে বললো, “একটু এদিকে আসবেন?”
সারাদিন ধরে পরে থাকায় শেরওয়ানির উপরের অংশটা বেশ ভারী লাগছিলো। সেটা খুলে বিছানায় ওর মুখোমুখি বসতে আমাকে বললো, “আপনি জানতেন আমার আগে একবার বিয়ে হয়েছিলো। একথা জেনেও কেনো বিয়ে করলেন?” আমি ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। এ প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেয়া সম্ভব না বলে শুধু চেয়ে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলাম। আমি বললাম, “সারাদিন তেমন কিছু খাওনি বোধহয়। রাতের জন্য হালকা কিছু আনিয়ে রাখবো?”

আমার দিকে চেয়ে বললো, “একটা কিছু জানতে চেয়েছিলাম। উত্তর না দিলে থাক, বললে সত্যিটা বলবেন।”
আমি চাচ্ছিলাম না অন্তত সে রাতে ওর মনে পুরোনো স্মৃতি জেগে উঠুক। সে রাত যেনো শুধু একান্ত আমাদেরই হয়। আমি বললাম, “এ নিয়ে না হয় পরে অন্যসময় কথা হবে। তুমি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসো।” একটা মৌন হতাশা নিয়ে ড্রেসিংটেবিলে রাখা কাগজের প্যাকেটে মোড়া কনডমের প্যাকেট সরিয়ে ড্রয়ারে রেখে দিলাম। মনকে প্রবোধ দিয়েছিলাম এই ভেবে যে, কাপড়ের পিন, চুলের ক্লিপ বা গহনা খুলতে খুলতে গিয়ে যদি এসব জিনিস চোখে পড়ে তবে হয়ত ভাববে লোকটা আর সবার মতোই কামুক পুরুষ। ইচ্ছা চরিতার্থের জন্য ঢাল তলোয়ার সাজিয়ে রেখেছে!

বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে বলেছিলো, “আপনি আধা ঘন্টার জন্য বাইরে যাবেন?” এ মুহূর্তে আমি যার জন্য এই কফি শপে অপেক্ষা করছি সে আমার স্ত্রীর প্রাক্তন স্বামী। ভদ্রলোকের নাম শাহরিয়ার চৌধুরী, তবে আমার স্ত্রী তাকে ‘রুপম’ নামে ডাকতো। আমার ডাক নামের সাথে অনেকটা মিল থাকায় গত এক মাসে আমাকেও মাঝে মাঝে ভুল করে ‘রুপম’ বলে ডেকে ফেলতো। প্রথমদিকে ভাবতাম হয়ত ‘রূপক’ ই বলেছে। পরে একদিন সে নিজেই বললো, “আপনি কিছু মনে করবেন না। ওর নাম রুপম ছিলো।”

তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ভাবান্তর না দেখিয়ে আমি আড়ালে যেতাম। এমন ঘটনায় বেশিরভাগ সময় আড়াল বলতে বলা যায় ওয়াশরুমে যেতাম। গা থেকে সমস্ত কাপড় খুলে শাওয়ার ছেড়ে ভালো করে সাবান মেখে পরিচ্ছন্ন হয়ে দেয়ালে সাঁটা আয়নায় নিজেকে দেখতাম। ঊর্ধ্বাংঙ্গ থেকে নিম্নাংঙ্গের দিকে চোখ কয়েকবার উঠানামা করাতে সামান্য লজ্জাবোধ জেগে উঠতো। লজ্জাবোধ দুঃখবোধের উপর দারুন প্রভাব বিস্তার করে বলে আমি স্বাভাবিক হয়ে ওয়াশরুমের বাইরে শুধু মুখ বের করে বলতাম, “টাওয়েলটা একটু দাওতো।” তখনো আমি আমার স্ত্রীকে কোনো নাম ধরে ডাকিনি। সম্ভবত বিয়ের পঞ্চমদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ওকে বলেছিলাম, “আমার বেশ সমস্যা হচ্ছে। তোমাকে অন্ততঃ কোনো একটা নাম ধরে ডাকা দরকার।” সে এমনিতেই আমার সাথে কম কথা বলতো। আমার কথার প্রেক্ষিতে বলেছিলো, “ঠিক আছে। আপনার পছন্দের যে কোনো নাম ধরে ডাকতে পারেন। তবে ‘কাকলী’ ছাড়া অন্য যে কোনো নাম।”

আমি নাম খোঁজা বাদ দিয়ে ওর কাছে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলাম। কেমন যেনো একটা কাপুরুষতার দায় আমার মাথায় ভর করেছিলো। ব্যাপারটা এমন যে, বিয়ের দুদিন পর থেকে অফিসে যেতেই সমবয়সী কলিগরা খোঁচা দিয়ে বলতো, “কি ইশতিয়াক সাহেব, ভাবী কেমন সেবা যত্ন করছে?”অন্যজন হেসে বলতো, “ডিসপেনসারিতে গিয়েছিলেন? না মানে এই ফার্স্ট এইড জাতীয় কিছু?””কেনো ভাই? ফার্স্ট এইড কেনো?” বলতে তিনি গা ঝাড়া দিয়ে হাসতে হাসতে বলতেন, “বিয়ের পর ছেলেদের হাঁটুর ছাল চামড়া উঠে যায়….না, মানে, আপনি চাইলে আপনাকে একটা মলম দিতে পারি, ছেলা জায়গায় খুব ভালো কাজ করে।”

আমার মন খারাপ হয়ে গেলেও বুঝতে দিতাম না। সামান্য হেসে চেম্বারে বসে পিসি অন করতাম। ওদের কথা শুনে আমার বয়স্ক পিওন দাঁত কেলিয়ে হাসতো। কাপুরুষের মতো নিজেকে সংবরণ করে রাখা ছাড়া ওকে ধমক দেয়ার জন্য আমার কাছে কোনো যৌক্তিক কারণ ছিলোনা। কফি শপের ওয়েটার দুবার বলে গেলো, “স্যার, আপাতত কিছু দিবো?” আমি মাথা নেড়ে না বললাম। শাহরিয়ার সাহেবের আসার কথা সন্ধ্যা সাতটায়। আমি একটু আগেই চলে এসেছি, সাতটা বাজতে এখনো পনেরো মিনিট বাকি আছে। ভদ্রলোককে একটা ফোন দিবো কিনা ভাবছি। ওয়েটার আবার বললো, “স্যার, ম্যাডাম কি রেস্তোরাঁ চেনেন?”

ওয়েটারের এমন অযাচিত প্রশ্নে রাগ হলো। এমন নিরব পরিবেশে রাগ প্রকাশ করার সুযোগ থাকেনা। রাগ প্রকাশের জন্য বেশ জোরে কথা বলতে হয়। চোখমুখে রক্ত জমিয়ে গলার টেন্ডন দুটো টান করে ধমক দিলে রাগ প্রশমিত হয়।
এমনভাবে এর আগে একদিন রাগ প্রশমিত করেছিলাম। আমার দেয়া ‘কেয়া’ নামে ডেকে ওকে বলেছিলাম, “কেয়া, একটু বারন্দায় আসো তো।” ঘরের আলো নিভিয়ে কাকলী বারান্দায় দরজায় দাঁড়ালো। পেছন থেকে বললো, “আমার প্রশ্নের উত্তর এখনো পাইনি।” আমি বুঝেও না বোঝার ভান করে কথাটা এড়িয়ে বললাম, “আসো আসো, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।” সে খানিকটা এগিয়ে বললো, “এ কয়দিনে আপনার কাছে কিছু গোপন করিনি আজও করবো না। কেনো যেনো আমি আপনাকে মেনে নিতে পারছিনা। আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি ঘরে যাচ্ছি।”

আমি ওর পিছু পিছু অন্ধকার ঘরে গিয়ে হাত ধতে বলেছিলাম, “কেয়া, তোমার অতীত নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নাই। তুমি শুধু শুধু কেনো পেছনের কথা ভাবো?” কিছুক্ষণ চুপ থেকে কাকলী বলেছিলো, “আপনি আমাদের বাসায় যেদিন এসেছিলেন আমি আপনাকে সবকিছু বলতে চেয়েছিলাম। আপনি আমার কথা না শুনে কেনো বিয়ে করলেন? আমার বাবাকে অনুগ্রহ করতে এমনটা করার কোনো প্রয়োজন ছিলো কি?” এবার ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম, “শোনো, এখন তুমি আমার স্ত্রী। আমি সব জেনে শুনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মানুষের জীবনে দূর্ঘটনা ঘটতেই পারে। তাই বলে জীবন থেমে থাকবে? আর তোমার আগের সংসার মাত্র ছয় মাসের ছিলো। এমন তো না যে সেটা কয়েক বছরের দীর্ঘ সংসার ছিলো যার মায়া তুমি কাটাতে পারবে না!” আমার হাতের পরিধির বাইরে সরে একটু উচ্চস্বরেই বললো, “এ জন্য আপনি মহামানব হয়ে গেছেন? প্লিজ আমাকে ধরবেন না।”

বারান্দার চাঁদটা সেদিন ভীষণ সুন্দর ছিলো। বাসার সামনের নিম গাছের উঁচু ডালের ফাঁক দিয়ে এত সুন্দর চাঁদটা আমার স্ত্রীকে দেখাতে চেয়েছিলাম। শুনেছিলাম চাঁদের আলোয় এক ধরণের মায়া থাকে, সে মায়ার মানুষ অতীতের সাথে বোঝাপড়া করে একটা সমাধান পায়। একটা সঞ্জীবনী শক্তিতে হৃদয় কোমল হয়। ভালোবাসায় জোয়ার আসে।
তেমন ভাবে সে রাতেই আমার জোয়ার এসেছিলো, ইচ্ছা হচ্ছিলো ওর সাথে নাকে নাক ঘষে দুটো কথা বলি, কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলি, “এমন একা একা তোমার ভালো লাগে? আরেক কানে মুখ নিয়ে নির্লজ্জ হয়ে বলি, আমি চাইনা তুমি পিল খাও, পিল খেলে সাস্থ্য বেড়ে যায়। লাইটটা নেভাবো?” বারান্দায় দাঁড়িয়ে একা একা বলা মনের কথা মন থেকে মনে পৌঁছালো না। প্রতি মিনিট মিনিট করে কালক্ষেপণের মুহূর্তে ভেতর থেকে এক ধরণের রাগ চেপে বসলো। গ্রীলের ফাঁক দিয়ে চাঁদের দিকে থুতু ছোঁড়ার সময় বড় এক মেঘের বহর চাঁদটাকে আড়াল করে নিলো। দু’বার থু থু করে সদ্য লুক্কায়িত চাঁদের উপর ক্ষোভ ঝাড়া ছাড়া তখন আমার পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব ছিলো না।

ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে ডিমলাইটের আলোয় দেখলাম কাকলী বিছানায় শুয়ে আছে। ওর এক পা ভাঁজ করে উঁচিয়ে রেখেছে, অন্য পা’টা লম্বা করে এলিয়ে বাম হাতের উল্টো পিঠটা চোখের উপর চাপিয়ে রাখা। আমি সন্তর্পণে ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াতে এক ধরণের উত্তাপ অনুভব করেছিলাম। পরিণয় সূত্রে বাঁধা সামাজিক বৈধতার মোক্ষম সুযোগে ইচ্ছে হচ্ছিলো খামচি দিয়ে কাকলিকে টেনে ধরি, গলা চেপে ধরে বলি, কিসের এতো অবজ্ঞা আমাকে? কিসের এতো দ্বৈরথ? স্বামীর সাথে কিসের এতো দূরত্ব? ইচ্ছে হচ্ছিলো রাগে কটমট করে বলি, খোল্ হারামজাদি, এক্ষুনি কাপড় খোল্! চোখের উপর থেকে হাত নামিয়ে আমাকে বললো, “কিছু বলবেন?”

আমি নরম গলায় ঢোক গিলে বললাম, “গরম লাগলে ওড়নাটা সরিয়ে রাখতে পারো। ঘর তো অনেকটাই অন্ধকার।”
কাকলী কিছু বললো না। শরীরকে দু’বার নড়িয়ে খানিকটা ডানে চেপে ওপাশ হয়ে শুয়ে পড়লো। আমার কথার জড়তায় ও একদমই বুঝলো না যে আমি ওর সামান্য মনোদৈহিক ভালোবাসায় ভিজতে চেয়েছিলাম। এমন তো নয় যে সে জানেনা এমন ভালোবাসায় কোনো কার্পণ্যতা থাকতে নেই। এসব ব্যাপারে কার্পণ্যতা শুধু শুধুই দূরত্ব তৈরী করে। আমার নৈশ স্বামীত্বকে উপর্যুপরি অবজ্ঞা করার ভীষণ রাগ হয়েছিলো। আমি চাইলেই খামচি দিয়ে ওর সমস্ত কাপড় ছিঁড়ে নিতে পারতাম। তাতে কি হতো? খামচি দিয়ে কাপড়ের আড়ালের শরীরকে বের করে আনা গেলেও খামচি দিয়ে শরীরের অন্তরালের মনকে বাইরে আনা যায় না।

ওয়াশরুমের আয়নার সামনে আমার ছলছল চোখ মুছে দাঁড়াতে আয়নার ভেতর দিয়ে দেখলাম পেছনের দেয়ালে এক জোড়া টিকটিকি সঙ্গমরত। আমার অসহ্য রকমের অপমানবোধ হলো। এক সদ্য বিবাহিত পুরুষ সত্ত্বার অপমান ঠেকাতে আমি হস্তমৈথুনে অবতীর্ণ হয়েছিলাম। একদম অন্তিম মুহূর্তে গগণবিদারী চিৎকারে রাগ ঝাড়লাম আমার দূর্ভাগ্যের উপর। কাকলী দৌড়ে এসে ওয়াশরুমের দরজায় আঘাত করে বলছিলো, “দরজা খুলুন, দরজা খুলুন। কি হয়েছে? দরজা খুলুন।” আমার স্ত্রীর ডাকা ‘রুপম’ নামের শাহরিয়ার চৌধুরী এলেন। ভদ্রলোককে প্রথমবার দেখে বেশ হাস্যোজ্জ্বল স্বভাবের মানুষ বলেই মনে হলো। মনে হলো আমার উল্টো প্রকৃতির মানুষ হবেন। নানা ধরণের তুলনার বিষয়গুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। লোকটার পা নাচানো, কথার ফাঁকে ফাঁকে সামান্য হাসা, কনুই ঠেঁসে টেবিলে বসা ছাড়াও এই ভদ্রলোকের প্রায় সব ক্রিয়াকলাপের সাথে আমার স্ত্রী পরিচিত। আমি সামান্য উঠে হাত মেলানোর পর বললাম, “প্লিজ বসুন।”

খানিক আগের ভয় পাওয়া ওয়েটার হাত দুটো সামনে একত্রিত করে কফির সাথে অন্য কিছু চাই কিনা জানতে চাইলো। শাহরিয়ার সাহেব আমাকে বললেন, “তারপর! কাকলী কেমন আছে?” আমি ঠিক জানতাম না গত দু’দিন ধরে কাকলী কেমন আছে। গত পরশু কাকলী চলে যাওয়ার আগে আমার টেবিলে রেখে যাওয়া চিঠিটা পকেট থেকে বের করে ভদ্রলোককে দিতে তিনি পড়া শুরু করলেন। কয়েক মিনিটে পুরো চিঠিটা পড়ে আঙ্গুল ভাঁজিয়ে খুব যত্ন করে চিঠিটা ভাঁজ করলেন।

ঠিক এমন ভাবেই ছুটির দিনের এক দুপুরে আমি ঘরে ঢুকে পড়াতে আমার স্ত্রী বিছানায় রাখা ওড়না ভাঁজ করে গায়ে তুলে নিয়েছিলো। আমি ওর পাশে বসে বলেছিলাম, “কেয়া, বিকেলে কোথাও বেড়াতে যাবে?” “আমার কিছু কেনাকাটা ছিলো।”কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বললাম, “তুমি উনাকে খুব ভালোবাসতে তাই না?”কোনো সময় না নিয়েই কাকলী বলেছিলো, “ভালোবাসতাম, এখনো বাসি।” ওদের ডিভোর্সের কারণ আমার কখনোই জানতে ইচ্ছে করতো না। তখনো করেনি। আমি মৌনতা ভেঙ্গে প্রাসঙ্গিকতায় বললাম, “আমি যে তোমাকে ভালোবাসি। স্ত্রীকে ভালোবাসার সামান্য অধিকার আমার কি থাকতে পারে না?” আরো খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে কাকলী ওর ওড়নার ভাঁজ খুলে আমার দিকে সোজা হয়ে বললো, “দরজাটা চাপিয়ে আসুন।”

এক ধরণের বিব্রতকতায় আমি স্তব্ধ হয়ে বসে ওর সৌষ্ঠবের দিকে আড়দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলাম। আড়ষ্ট অধিকারে কোনো প্রাপ্তিই সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করা যায়না বলে আমি চুপ করে ছিলাম। ব্যাপারটা কাকলী সহজ করে দিলো। বললো, “আপনি আমার স্বামী, আপনি যে কোনো সময় আমার কাছে আসতে পারেন। এখনও পারেন।”
সত্যি বলতে আমি এরূপ আহ্বান এমনভাবে চাইনি। আমার চাওয়ার ধরণে ভিন্নতা ছিলো। যেমন, নির্ঝঞ্ঝাট কোনো মুহূর্তে ওর হাতে হাত রেখে আমি বলতে চেয়েছিলাম, এই শোনো, আমি একটা টিপ পরিয়ে দেই? সে কিছুটা লজ্জা পেয়ে আমাকে বলবে, ড্রেসিং টেবিলে কয়েকটা আটকানো আছে, আপনার যেটা পছন্দ হয় পরিয়ে দিন। আমি চিমটি দিয়ে কালো রঙা একটা টিপ খুলে এনে ওর কপালের ঠিক মাঝখানটায় পরিয়ে আমার আঙ্গুল ভাঁজ করে ওর থুতনি উঁচিয়ে বলবো, দেখি আমার সোনা বউকে কেমন লাগছে! ও পুরো মুখ নব্বই ডিগ্রি আনুভূমিকভাবে ঘুরিয়ে লজ্জার আড়ষ্টতায় কিচ্ছু বলবেনা।

আমি ডান হাত প্রসারিত করে ওর বক্ষপরিধিয় বাহু বরাবর এক সুষম চাপে ওকে শুইয়ে দিবো। বন্ধ চোখে আগত প্রশান্তির সে মুহূর্তে ওর মুখে খুব সূক্ষ্ম হাসি আমি খেয়াল না করে কানের খুব কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলবো, ‘বউ, ও বউ! আমার সোনা বউ!’ আমার কথা জড়িয়ে আসবে। ও একবারও চোখ না খুলে তিরতির করে শুধু সামান্য কাঁপতে থাকবে! আমার ইচ্ছে হলোনা এমন আহ্বানে সাড়া দেবার। ওর আহ্বান অগ্রাহ্য করে বলেছিলাম, “তুমি রেডি হও, কেনাকাটা সেরে কোথাও বেড়িয়ে আসবো।” সে রাতেই আমি জৈবিক চাহিদায় অপ্রকৃতিস্থ হয়ে মিলিত হয়েছিলাম। পুরোটা সময়ের এক পর্যায়ে কাকলী অনেকটা আবিষ্ট হয়ে আমার কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করেছিলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির মৃদুমন্দ বাতাসে ঘাম শুকানোর সময় কাকলী আমার পেছনে এসে বলেছিলো, “আমি দুঃখিত। তারপরেও আমি বোধহয় আপনাকে ভালোবাসতে পারবো না।”

আমি অন্তত সে সময় ওর মুখে অমন কথা প্রত্যাশা করিনি। বরং চেয়েছিলাম আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলুক, ‘আপনি ঘরে আসুন, আমি ফ্যানের স্পীডটা বাড়িয়ে দিচ্ছি।” চিঠিটা আমার হাতে দিয়ে শাহরিয়ার সাহেব বললেন, “এখন সে কোথায় আছে বলতে পারেন?” আমি বললাম, “সম্ভবত ওর বাবার ওখানে। আমি অবশ্য এখনো কোনো খোঁজ নেইনি।” একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভদ্রলোক বললেন, “কাকলী আমার মামাতো বোন। ছোট্ট বেলা থেকেই আমাকে ও পছন্দ করতো। আমি যে অপছন্দ করতাম তেমনটা না। আসলে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক যখন বিয়ে পর্যন্ত গড়ালো তখন ধীরে ধীরে বিপত্তি শুরু হলো। খুব সিলি ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া হতো। ওর অদ্ভুত চঞ্চলতায় ধরা বিভিন্ন বায়না আর ছেলেমানুষি অভিযোগে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম।”

ওয়েটার কফি এনে দিতে ভদ্রলোক পানি চাইলেন। আমি কফির ফেনাতে একটা চুমুক দিয়ে বললাম, “আমি আসলে এমন কিছু জানতে চাচ্ছিলাম না। যেটা আপনাদের মাঝে ছিলো সেটা একান্তই আপনাদের। এমনকি আমি ওকে একবারও এসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করিনি। যে জন্য আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছি সেটা অন্য কারণে।”
আমাকে থামিয়ে শাহরিয়ার সাহেব বললেন, “আমার মনে হয় আপনার এগুলো জানা প্রয়োজন। কেনো আমি ওকে ডিভোর্স দিলাম এটা অবশ্যই আপনার জানার দরকার আছে। ইভেন, আমি আপনার সাথে এর আগেও যোগাযোগ করে কথা বলতে চেয়েছিলাম। পরে অবশ্য হয়ে ওঠেনি।”

আমি মগের হাতলে হাত রেখে বললাম, “আমি একটা অনুরোধ নিয়ে আপনার কাছে এসেছি।”ভদ্রলোক মৃদু হাসি চাপিয়ে বললেন, “রূপক ভাই, আপনার স্ত্রী আপনাদের বাসর রাতে আমাকে ফোন দিয়েছিলো। আমি ওকে অনেকক্ষণ বুঝিয়েছি। যেটা অতীত হয়ে গেছে সে অতীতকে ভেবে কি হবে? বর্তমান নিয়ে বাঁচতে শেখার কথা বারবার বলে রেখে দিয়েছিলাম। আপনি ভয় পাবেন না। আমি তার পর থেকে আর কোনো যোগাযোগ করার সুযোগ দেইনি।” আমি বললাম, “আমি সে কথা বলছি না। আমি আপনাকে অন্য একটা অনুরোধ করতে এসেছি।” শাহরিয়ার সাহেবের একটা ফোন কল এলো। আমি মুখ উঁচিয়ে তাকাতে দেখলাম লোকটার নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।

এমন ঘাম আমি কাকলীর নাকেও জমতে দেখেছিলাম। দ্বিতীয় সঙ্গমের রাতে মেয়েটা ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। আমার স্বল্প নিষ্পেষণে ওর কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতেও তেমন প্রতিবাদ না করে অস্ফুটে একবার বলেছিলো, “সরি আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম।” কাঁচা ঘুম থেকে জাগাতে এমন অনভিপ্রেত চাওয়ায় সে দৃশ্যত সায় দিয়েছিলো ঠিকই তবে এক পর্যায়ে আধোঘুমো কাকলী আমাকে অস্বাভাবিক ক্ষিপ্ততায় জাপটে ধরে বলেছিলো, “রুপম, আমাকে আর ছেড়োনা। অনেক, অনেক আদর করো।”

সঙ্গমরতা স্ত্রীর মুখে প্রাক্তন স্বামীর নাম শুনে মুহূর্তেই আমার স্নায়ু স্তিমিত হয়ে গেলো। ওর নাকের বিন্দু বিন্দু ঘামে আমার নাক ঘষতে একদম ইচ্ছে হলো না। আমি দূরত্ব সৃষ্টি করে দুহাতে ভর দিয়ে উঁচুতে উঠলাম।
গণগণ আগুনে চুলায় লাকড়ির অনুপস্থিতিতে কাকলী আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলেছিলো, “ধ্যাত!”
সেদিন খুব ভালোভাবে বুঝেছিলাম যে মানুষটা কাকলীর শরীর ও মন জুড়ে আছে সে আমি নই। শুধুমাত্র ওর বাবার অনুরোধ রাখতে আমার সাথে বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলো মাত্র! এমন বন্ধনের অধিকার গুলো পঙ্গু হয়, সে পঙ্গু অধিকারে আর যাই হোক অন্ততঃ মনের কুঠুরিতে ঢোকা যায় না। ফোন কেটে ভদ্রলোক বললেন, “আপনার অনুরোধ আমি শুনছি, তার আগে আমার কিছু কথা আপনাকে শুনতে হবে।” “বলুন।”

“বিয়ের পর থেকেই মা বাচ্চা নেয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছিলো। বলেছিলো নাতি নাতনির মুখ না দেখা পর্যন্ত তাঁর শান্তি হবেনা। মায়ের শান্তির কথা ভেবে কাকলীর সাথে সম্পর্কের খারাপ সময়গুলোতেও মিশতে হতো। পরপর পাঁচ মাসেও কনসিভের কোনো লক্ষণ না দেখে ডাক্তারের কাছে গেলাম। আসলে সমস্যাটা আমারই ছিলো।” ভদ্রলোক থেমে গেলেন। আমার মতোই মগের হাতলে হাত রেখে কফিতে চুমুক দিতে চেয়েও দিলেন না। খানিকটা সময় নিয়ে বললেন, “কাকলীর সাথে প্রায়ই ঝগড়া হতো, আপনি জানেন, আমি কক্ষণো চাইতাম না ও আমার থেকে দূরে চলে যাক। সেদিনের রিপোর্ট দেখে মনে হচ্ছিলো আমার পায়ের নিচে কোনো মাটি নেই। এক মাসে পরপর কয়েকবার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তাররা সাফ সাফ জানিয়ে দিলো আমার দ্বারা কখনোই বাবা হওয়া সম্ভব না। একটা অনুর্বর পুরুষ কি এমন সুন্দর ফুলের মতো মেয়ের জীবনে জড়িয়ে থাকতে পারে? আপনিই বলুন!”
এসব কথা আমি একদমই জানতাম না।

অথবা এমন ঘটনার প্রেক্ষিতে শাহরিয়ার সাহেব স্বেচ্ছায় কাকলীর পরবর্তী সুন্দর জীবনের জন্য ডিভোর্স দিয়েছেন এধরণের চিন্তা একবারও আমার মাথায় আসেনি। এখন আমার কি বলা উচিত ভেবে না পেয়ে বললাম, “আপনি এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে দেশের বাইরে যেতে পারতেন। শুনেছি বাইরে ভালো চিকিৎসা হয়।” অলক্ষ্য দৃষ্টিতে একপাশে তাকিয়ে ভদ্রলোক বললেন, “ডিভোর্স পেপারে সাইন করার সময় আমার কেমন লেগেছিলো আপনি ভাবতে পারেন? আমি নিশ্চিত হয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। আসলে আমি বরাবরই চেয়েছিলাম, ও ভালো থাকুক। হয়তো আট দশ বছর সন্তান ছাড়া কেটে যেতো, কিন্তু আমারই কারণে ও আজীবন মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকতো। আমার জন্য এটা মানা আরো বেশি কষ্টকর ছিলো।” আমি বললাম, “আপনারা একটা বাচ্চা দত্তক নিতে পারতেন।”

ভদ্রলোক এবার সামান্য হেসে বললেন, “রক্তের বন্ধনের ভালোবাসাগুলো একদম আলাদা হয় রূপক ভাই, সেখানে কক্ষনোই কৃত্রিমতা থাকেনা। যে রক্ত আমাদের নয় তাকে চাইলেই আপন করা যায়? যায় না। তার চেয়ে এই বেশ ভালো হয়েছে। যেখানে আমি ওকে কিছুই দিতে পারবোনা সেখানে মেয়েটা কেনো এমন করলো তা আমার মাথায় ধরছে না।” কফিটা শেষ করে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, “এবার আপনার কথা বলুন।” আমি ভদ্রলোকের কাছে এই অনুরোধ নিয়ে এসেছিলাম যে, আমার সাথে কাকলী একদমই মানাতে পারছে না। এই এক মাসে আমার যতটুকু কাছে এসেছে সবটাই ওর মনের বিরুদ্ধে এসেছে। আমার সাথে হয়তো কখনোই মেয়েটা সুখি হতে পারবে না। তাই তারা আগের সব ভুল বোঝাবুঝি ঠিক করে নিয়ে যেনো একসাথে ভালো থাকে! এমুহূর্তে ভদ্রলোকের মুখের এধরণের কথা শুনে এখন আমি কি বলবো?

আমার কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না। ক্ষণিকের মাঝেই আমার ভেতরের চাপা অভিমানটুকু কাকলীর উপর থেকে উবে গেলো। লোকটার এত বড় সমস্যা থাকার পরেও কাকলী ওর সাথে থাকতে চেয়েছিলো! কত বৃহৎ মনের মানুষ হলে মনের কুঠুরিতে এতটা ভালোবাসা লালন করা সম্ভব? ভদ্রলোকের প্রতি আমার স্ত্রীর এমন নিখাদ ভালোবাসাতে ওর প্রতি আমি শ্রদ্ধার পাশাপাশি নতুন করে অন্য এক গভীর ভালোবাসা অনুভব করলাম। আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার ভালোবাসার মানুষ, আমার কাকলী ভালো থাকুক আমিও চাই। আমি চাই, হ্যাঁ, এখন থেকে চাই আমার কাছেই সে ভালো থাকুক! সে যেনো আর কখনোই অন্য কারো না হয়!

আমি ভদ্রলোককে বললাম, “আপনাকে আমি আগে কখনো দেখিনি। আমার স্ত্রী যাকে এতো ভালোবাসে তাকে একবার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। তাই আপনাকে এখানে ডাকা।” ভদ্রলোক আমার অনুরোধ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করায় আমি ছোট্ট করে বলেছিলাম, “আচ্ছা অন্যদিন।” বাসায় ফেরার পর থেকে শূন্য ঘরে বড্ড একাকী লাগছে। দুদিন আগেও কাকলী হয়ত সোফায়, বিছানায় অথবা বারান্দায় বসে ছিলো। আমি বাসায় ফেরাতে ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও আমার দিকে ঠান্ডা পানির গ্লাস এগিয়ে বলেছিলো, “মা আপনাকে দেখা করতে বলেছেন।”

আমি সে সন্ধ্যায় অপ্রাসঙ্গিক প্রত্যুত্তরে বলেছিলাম, “কেয়া, আমি একটু অধিকার চাই, তোমার কাছে কাকলী নামে ডাকার যৎসামান্য অধিকার চাই।” কাকলী সামান্য মাথা নিচু করে মৌনতায় নিশ্চুপ ছিলো। আজকের মতোই নিরব, নিস্তব্ধ গত পরশু সন্ধ্যায় আমার সামনে থেকে মেয়েটা দৌড়ে বারান্দায় চলে গিয়েছিলো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নায় নিসৃত সে চাপা শব্দের প্রকৃত অর্থ আমি কেনো, পৃথিবীর কেউই জানার সাধ্য রাখে না! এ টেবিলেই কাকলী আমার বুকপকেটে রাখা চিঠিটা রেখে গিয়েছিলো, গতকাল। হার্ট শেইপের হাতলওয়ালা আমার নিত্য ব্যবহার্য্য কফির মগটাতে চাপা দিয়ে চিঠিটা এখানে রেখেছিলো। পকেট থেকে চিঠিটা বের করে আরও একবার পড়তে ইচ্ছে হলো। ও কখন লিখেছিলো চিঠিটা?

“আপনাকে কিভাবে সম্মোধন করবো তা অনেকক্ষণ ভেবেও ঠিক করতে পারিনি। আমি দুঃখিত। আমার এমন অপারগতার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। এ বিয়েতে আমার কোনো মত ছিলোনা সেটা আপনি শুরু থেকেই স্পষ্ট বুঝেছেন। আপনার সাথে আমার এমন অস্বচ্ছ সম্পর্কে আমার অবহেলা বা অবজ্ঞা যাই বলুন, সেটা একান্ত আমার মন থেকে এসেছে। আপনাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আমি ছোট করবো না তবে এ বিয়েটা না হলে আমি ঠিক আপনাকে চিনতে পারতাম না। একজন স্বামী পরিত্যাক্তা মেয়েকে বিয়ে করার সাহস সবার থাকেনা।

আপনি জানেন আপনার আর আমার বাবা দীর্ঘদিনের বন্ধু ছিলেন, এখনও আছেন। রুপম আমার স্বামী ছিলো, কাগজ কলমে সে এখন আমার স্বামী না থাকলেও ওর জন্য আমার মনের ভেতরে যতটুকু স্থান রাখা আছে তা একেবারে ছোট নয়। কি করবো বলুন, কিছু মেয়েরা জীবনে একজনকেই অন্তর থেকে ভালোবাসতে পারে। ওরা চাইলেও তাদের ভালোবাসাগুলো মেকী বানিয়ে অন্যদের দিতে পারে না। আপনি নিশ্চয় বুঝেছেন আমি সে ধরণের একটা মেয়ে।

এখন হয়তো ভাবছেন আমি রুপমকে ভুলে আপনাকে ভালোবাসতে কখনোই চেষ্টা করিনি। করেছি। এই এক মাসে আমি নিজের মনের সাথে সংগ্রাম করে আপনাকে ভালোবাসতে চেয়েছি। এমন চাওয়াতে যখনি আমি আপনার কাছে গিয়ে দুটো কথা বলতে যেতাম তখনই মনে হতো আমি যেনো রুপমকে কথাটা বলছি। ভীষণ অপরাধবোধে আমি সংকুচিত হয়ে যেতাম, তখন হয়ত আপনি ভাবতেন আমি আপনাকে অবজ্ঞা করছি। আপনি যেভাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখতেন রুপমও দেখতো। একই হৃদয়ে যে ভালোবাসায় ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম, সেই এঁটো ভালোবাসায় আপনাকে সিক্ত করলে আমার কাছে আপনার অমর্যাদা হতো। আমি পারিনি আপনার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। আপনি আমার সামাজিক স্বামী, আপনাকে আমি ঠকাতে পারিনি।

রাতগুলোতে আপনি আমার কাছে আসতে চাইতেন। আমার মাঝে মাঝে মনে হতো রুপম আমার কাছে শুয়ে আছে। পরক্ষণেই যখন বুঝতাম সেটা আপনি ছিলেন তখন নিজেকে গুটিয়ে নিতাম। যে শরীরের পরতে পরতে ভ্রমণের অধিকার অন্যকে দিয়েছিলাম সেই একই এঁটো অধিকার আপনাকে দিতে আমার সংকোচ লাগতো। তারপরেও কিছুবার আমাদের অনিয়ন্ত্রিত ভ্রমণ হয়েছিলো। আপনি সাময়িক সুখি হলেও আমি অসহ্য চাপা কান্নায় মনমরা হয়ে থাকতাম। অথচ এই আমিই কতো উচ্ছ্বল ছিলাম!

আপনি হয়তো ভাবতে পারেন আমি এসব বলে আপনার কাছ থেকে সরে যেতে চাইছি। বিশ্বাস করুন, আমি আমার নিয়তি সব মেনে নিয়ে এই এক মাস ধরে মনের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলাম। মনের উপর জোর খাটে আপনিই বলুন?
আমি চলে যাচ্ছি। কখনো যদি সময় আমাকে দয়া করে আমার ভেতরের অতীতগুলোকে মুছে আপনাকে ভালোবাসতে শেখায় তবে যদি আপনি অনুগ্রহ করেন, আমি ফিরবো। অন্যথায়, আমায় ক্ষমা করবেন।

ইতি

কেয়া।” চিটিটা ভাঁজ করে টেবিলে রাখতে আবারো চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। ওয়াশরুমের বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে পানির ঝাপটা দিতে আয়নার ভেতরে দেখলাম সেই দুটো টিকটিকিকে। একটার স্বচ্ছ পেট ভেদ করে দুটো সাদা ডিম দেখা যাচ্ছে। পুরুষটা ওর পাশে চুপটি করে বসে আছে। মেয়েটা দু’একেই হয়ত ডিম দেবে, ডিম থেকে বাচ্চা হবে, সংসার পূর্ণতা পাবে! অমন একটা নির্ঝঞ্ঝাট সংসার দেখে আমার দুঃখবোধ সামান্য হলেও প্রশমিত হলো।
বারান্দার গ্রীলের ফাঁকে আজও চাঁদ উঠেছে। পুব আকাশে হলদেটে থালার মতো রূপ নিয়ে সারা পৃথিবীকে সূর্যের ক্ষীণ উত্তাপ বিলাতে বিলাতে যেনো আমাকে বললো, “এই ছেলে, কিছু বলবি?”

চাঁদের দিকে চেয়ে আমি মনে মনে বললাম, “ওকে একটু বলে দিও আমি ভালো নেই। ওকে বলো, আমাকে কোনো অধিকার দিতে হবেনা, শুধু এ ঘরে আমার পাশে একটু বসে থাকুক! বলবা তো?” হয়ত আমার কাকুতি মাখা কথায় এখনো চাঁদটা হাসছে। হাসুক। আমি নির্লজ্জের মতো আবারো বললাম, “ও চাঁদ, আমার ভালোবাসা ওর কাছে পৌঁছে দিও। দিবা তো?” যে আকাশের নিচে আমি বাস করি, সে একই আকাশে জ্বলে থাকা চাঁদ কাকলীও দেখে। সে চাঁদের কাছে আমার পাঠানো ভালোবাসায় ও কি নতুন করে ভালোবাসতে পারে না? পারেই তো! অদূরের কোনো একদিন পারেই তো!
আমার কাকলী, পারেই তো!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত