টিউশনিগুলো শেষ করে ছেলেটা বেশ রাত করে ঘরে ফিরে। গোসল করে টেবিলে ঢেকে রাখা অর্ধেকটা ডিম ভাজি আর ভাত দিয়ে রাতের খাবার সেরে ড্রইং রুমে চলে যায়। চলতে থাকা টিভি অফ করে দিয়ে ছোট বোনদের ধমক লাগিয়ে রুম থেকে বের করে দেয়। ফ্লোরে কাথা বিছিয়ে শুয়ে পড়তেই রাজ্যের ক্লান্তি ভর করে তার শরীরে। তবু মনের টানে কল দেয় একটি মেয়েকে। মেয়েটি কল না ধরে ওপাশ থেকে কল কেটে দেয়। ছেলেটি মন খারাপ করে ঘুমোতে চেষ্টা করে। মিনিট বিশেক পর মেয়েটা কল দিতেই ছেলেটা কল কেটে ব্যাক করে।
বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তখন কল ধরলেনা কেন?” “তখন কারেন্ট ছিলোনা”, মেয়েটা বিষাদ মাখা গলায় কৈফিয়ত দেয়, “ফ্যানের শব্দ না থাকলে কথা পাশের রুমের বাবা মা শুনে ফেলতে পারে। তাই কারেন্ট আসার পর ফ্যান ছেড়ে কল দিলাম” ছেলেটা কথা না বাড়িয়ে চুপ করে থাকে মেয়েটা তখন হঠাৎ গলায়উচ্ছাস এনে কলকল করে বলতে থাকে “জানো আমি যা চঞ্চল! তুমি যদি আমাকে বিয়ে করো তাহলে জীবনে এক মূহুর্তের জন্যও তোমাকে আমি বোর হতে দিবোনা, তুমি অনেক হ্যাপি থাকবে, বিয়ে করো আমাকে নইলে আমার মতো এমন বউ পরে আর পাবেনা,পস্তাবে কিন্তু!…” ছেলেটা তবু চুপ করে থাকে মেয়েটাও তাই চুপ হয়ে যায় পরে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোমার চাকরীর কিছু হলো? ছেলেটা জবাব দেয় ” প্রতিদিন তো বিডিজবস ঘাটি, তোমার কথামতো মতিঝিলের পথে পথেও হেটেছি, চোখের সামনে পাওয়া প্রতিটি অফিসে সিভি জমা দিয়েছি।”
: তবু কেউ চাকরী দিলোনা?
: না দিয়েছে…
: তাহলে?
: মাত্র আট হাজার টাকা বেতন।
“তো সমস্যা কি!!”
মেয়েটির চোখে পানি এসে যায়, অধৈর্য গলায় বলে উঠে “এতেই হবে চলো বিয়ে করে ফেলি।” “কিন্তু বিয়ে করে তোমায় রাখবো কোথায়? আমার ঘরে আমার নিজেরই কোন রুম নেই। আব্বার বেতনে খুব ছোট ঘর ভাড়া করে থাকি আমরা। রাতে আমি ড্রইংরুমের ফ্লোরে ঘুমাই। ছেলেটি নিরুত্তাপ গলায় বলতে থাকে।”
: সেখানেই উঠবো আমি।
: এটা সম্ভব? আমাদের ড্রইংরুমে দরজা পর্যন্ত নেই।
: তাহলে আলাদা ঘর ভাড়া নাও।
দরকার হলে বস্তিতে নাও, আমার কোন আপত্তি নেই, শুধু তোমার সাথে ঘর করতে পারলেই আমি খুশি। : আমি জানি তুমি আমার সাথে বিয়ে করে সংসার করতে সব রকম কষ্ট স্বীকার করতে রাজী। :কিন্তু এটাই সব? আমার বাবা সামনের বছর রিটায়ার করবে। সংসারের সব দায়িত্ব আমার কাধে আসছে এখন।
এঅবস্থায় আমার বিয়ে করে সংসারে ঝামেলা বাড়ানোটা কেউ সহ্য করবেনা। বাসার কেউ তোমার সাথে ভালো ব্যাবহার করবে না। তোমার মা বাবার সাথেও ভালো ব্যবহার করবেনা। এসব সহ্য করতে পারবে? মেয়েটা সম্ভিৎ ফিরে পায়, ধীরে ধীরে উত্তর দেয়: “আমার বাবা মার অনেক আদরের সন্তান আমি। আমার জন্য তারা কত ত্যাগ স্বীকার করেছে। আমি সব কষ্ট সহ্য করতে পারবো কিন্তু আমাকে কষ্ট করতে দেখাটা তারা সহ্য করতে পারবেনা। ভালো ঘরে বিয়ে না হলে বা আমি তাদের অমতে বিয়ে করলে আত্নীয় স্বজন প্রতিবেশিরা মা বাবাকে অনেক খোঁচা দিবে, অপদস্থ করবে। তাদের মেয়ে হয়ে এসব আমি সহ্য করতে পারবোনা। আমি তোমাকে ভালোবাসি কিন্তু সন্তান হিসেবেমা বাবার প্রতি আমার যে ঋন তাঅতিক্রম করতে পারবো না আমি।”
সেটাই, ছেলে হিসেবে মা বাবা পরিবারের প্রতি আমারো অনেক দায়িত্ব। এখন আমার কাজ তাদেরদেখাশোনা করা।এই মূহুর্তে বিয়েকরে তাদের অখুশী করতে পারবোনা আমি। আমি তোমাকে ভালোবাসি কিন্তু বাবা মা সবার আগে। ছেলে মেয়ে দু’জনেই চুপ করে থাকে।নীরবতা ভেঙে ছেলেটা একসময় হাহাকার করে উঠে, “আমাদের হাতে কি আর সময় নেই? আর দু’বছর সময় পেলেঠিকি সব সামলে উঠে তোমাকে বিয়ে করতে পারতাম। ”
মেয়েটাও কষ্ট সামলে বিষাদমাখা গলায় উত্তর দেয়, “সেই সেকেন্ড ইয়ার থেকে মা বাবা আমার জন্য ছেলে দেখছে। কিছু কিছু পাত্র একটু বেশিই ভালো ছিলো। কিন্তু নানা অজুহাতে দুই বছর ধরে সব বিয়ের প্রস্তাব না করেছি। তাই বাবা রাগ করে সিদ্ধান্তজানিয়েছেন যে আর আমাকে কোন ছেলের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবেন না। এই বছরের ভেতর যে পাত্রকেই যোগ্য মনে হবে তার সাথেই বিয়ে দিবেন আমার। আমার অনুমতি ছাড়াই। এবছরটাই সময় আছে আমার। আর মাত্র কয়েক মাস।” দুজনেই চুপ হয়ে যায়। ছেলেটা মোবাইলে এলার্ট মেসেজ পেয়ে ত্রস্ত হয়ে বলে উঠে, “আমার মোবাইলের ব্যালেন্স শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর দুই মিনিট থাকতে পারবো আমি।” মেয়েটা উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করে “কেন আজকে রিচার্জ করোনি?”
: টাকা ছিলোনা।
টিউশনির সব টাকা দিয়ে সিভি প্রিন্ট করে ফেলেছি। এই মাসের বাকি কয়েকদিনও রিচার্জ করে কল করতে পারবো না। স্যরি। মেয়েটাও হতাশ হয়ে যায়, “আমার মোবাইলেও তো ব্যালেন্স শেষ প্রায়। এখন সব শেষ করলে বাবা নতুন করে রিচার্জ করে দিবেনা। আর সন্দেহ করবে ফ্লেক্সি কোথায় কল দিয়ে শেষ করলাম। থাক কয়েকদিন কথা না হোক।
সময় সময় ফ্রি মেসেজ গুলো পাঠাবো আমি” জানালার ফাক গলে একই চাঁদের আলো প্রবেশ করে শহরের দুই কোনের দুজনের ঘরে সেদিকে চেয়ে থেকে বলতে থাকে মেয়েটি “শুনো, এই একমিনিট আসো চুপ করে থাকি দুজন। তুমি ঘুমানোর চেস্টা করো।” দুজন চুপ করে থাকে। মেয়েটা ফিসফিস করে বলে উঠে, “আমার বিয়ে হয়ে গেলে একটা গার্লফ্রেন্ড যোগার করে নিও। তুমি একা হয়ে গেলে টেনশন হবে আমার। নিজের ব্যাপারে খুব খামখেয়ালী তুমি, একটুও যত্ন নাওনা, আমি কল না দিলেতো সকালে ঘুম থেকেও উঠতে পারোনা তুমি” মেয়েটির গলায় অনুযোগের সুর। ছেলেটি ভ্রু কুঁচকে বুকের কষ্ট সামলে রাখে। চার বছরের প্রেম তাদের, ক্যাম্পাসের সেই প্রথম দিন গুলো থেকে। দুজনের জীবনের প্রথম প্রেম, যেন এক শ্বাস ভাগাভাগি করে বেঁচে থাকা দুই আত্না।
মেয়েটাকে ছাড়া ছেলেটা কিভাবে বাঁচবে ভেবে পায়না। আত্না মারা যাবে তার নিশ্চিত জানে সে। ছেলেটার চোখেও পানি চলে আসে এখন।” মেয়েটা বুঝতে পেরে সান্তনা দেয়ার অর্থহীন চেষ্টা করে” আরে মোটে তো অনার্স পাশ করলে, একদিন অনেক বড় হবে তুমি, তখন দেখো কত ফুটফুটে বউ পাও তুমি।” কিন্তু তোমাকে তো পাবোনা কত স্বপ্ন ছিলো আমাদের নিজেদের বিয়ে নিয়ে, ভালোবাসার সন্তান নিয়ে মেয়েটি এসব শুনে সামলাতে পারেনা, নিঃশব্দে কেঁদে দেয়। ধরা গলায় ফিসফিসিয়ে বলে আমাকে কোনদিন ভুলোনা কেমন, আমার চেয়ে বেশি তোমাকে কেউ কোনদিন ভালোবাসেনি।”
নিস্পাপ প্রেমের সাক্ষী দুই ছেলে মেয়ে অপেক্ষা করতে থাকে, ধীরে ধীরে তাদের ভালোবাসার অপমৃত্যু পরিনতির এদেশে বয়ঃসন্ধি আসে ঠিক সময়ে যৌবন আসে ঠিক সময়ে প্রেমটাও জীবন ছুঁয়ে আসে প্রথম বসন্ত দিনে শুধু প্রেমের কোন পরিণতি আসেনা…..