দেড় বছর হল বাবা গত হয়েছেন। এখন পরিবারে আমি, মা আর ছোট দু’বোন। বাবা চাকরিজীবী ছিলেন, তবে আমি ব্যবসায় নেমেছি। ডিলারশিপে বিজনেস। কার শো-রুম। বাবা খানিক সম্পত্তিও রেখে গেছেন, সব মিলিয়ে খারাপ যাচ্ছে না দিনকাল।
বিজনেস ডেপোলাপের কাজেই দিন-রাত ব্যস্ত থাকি। এরই মধ্যে হঠাৎ মা বিয়ের খুব তাগাদা দিতে লাগল বারংবার। প্রথম ক’দিন ব্যপারটা তেমন আমলে না নিলেও, মায়ের পিড়াপীড়িতে আর নিস্তার জুটলনা। শেষমেশ গা-বাঁচানোর জন্য বলেই দিলাম “ওকে, দেখো তোমরা মেয়ে তবে আমাকে এখন মোটেও ডিস্টার্ব করা চলবে না। মেয়ে দেখা হল, বড়লোকের মেয়ে তবে বেশ নম্র স্বভাবের। শুনে বিশ্বাস হয়নি, বড়লোকের সুন্দরী মেয়ে আবার ভদ্র..! অবশ্য বিয়ের পর তার আচরণে মানতে বাধ্য হয়েছিলাম, সে যথেষ্ঠ ভদ্র। মেয়ের ফ্যামিলি মোটামুটি ধর্ম কর্ম করে। সব মিলিয়ে ভালই।
যাহোক, ছোটখাটো আয়োজনে বিয়ে সম্পন্ন হল। এতিমের আবার কিসের ধুমধামের বিয়ে ! বিপত্তিটা বাঁধল বিয়ের দিনই। ঘটনাচক্রে আমার বিয়ের দিনই পোর্ট থেকে ২০ইউনিট জিপ রিলিজ হবার ডেট পড়ে। সব ঠিক থাকলে কোন প্রব্লেম হত না, তবু সরকারী লোকদের কলমের খোচা তো, কখন কি ঘটে বলা যায় না। সেদিন আমার বিজনেসে এক বড়সড় ধাক্কা লাগল। অজানা কারণেই ট্রেড লাইসেন্স চিজ করা হল। বিয়ের দিন কাউকে কিছু বুঝতে দিইনি, চাপটা পুরো নিজের মাথায়ই রেখেছিলাম। কি আর করা, বিয়ের ফিলিংটা হারিয়ে গেল। কোনরকমে বিয়ের সব ফর্মালিটি খতম করে বিকেলে বাসায় ফিরলাম। বাসার সব রুমে গেস্ট আছে বিধায় পাশে শিবুদের বাসার একরুমে চুপচাপ শুয়ে রইলাম। ভাছিলাম, কি দিয়ে কি করব। ওদিকে নতুন বউমা/ভাবি পেয়ে মা/বোন খুব খুশি। আমার কথা মনেই নেই কারো। বোন দু’টো যে ভাবির রুমই ছাড়ছেনা।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত এল, ঢুকলাম বাসর ঘরে। তখনও আমি খুব গভীরভাবে চিন্তিত। বউ সালাম করল। আমি জাস্ট “ঘুমিয়ে পড়ো” বলে পাশ কাটিয়ে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। টেনশন আবার আমার ঘুমের কোন ডিস্টার্ব করতে পারে না। বউ আমার এহেন আচরণে অবাক হলেও কিছু বলেনি। কিইবা বলার আছে..!
কয়েকদিন যেতেই বুঝলাম বউটা আমার অসম্ভব রকমের ভাল। যেমন সুন্দরী তেমন সুগঠনের অধিকারিনী, সাংসারিক, মিশুক, উদারহৃদয়ের হাসিখুশি প্রকৃতির এক প্রেমপাত্রী সে। কিন্তু আমি এখনও স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারিনি। অদ্ভুত জাতের আইনি ঝামেলায় পড়েছি কি না, এত সহজে কি আর নিস্তার মিলে..! বউকে মাঝে একদিন বলেছিলাম এ ব্যাপারে। সে শুধু বলেছিল ” সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।” বউ আমার যথেষ্টেরও বেশি কেয়ার করে। তখন অবধি আমার অপছন্দের কোন কিছু তার ভেতরে পাইনি।
দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে ঈদ চলে এল, আর সপ্তাহখানেক বাকি। সেসব ঝামেলা কাটলেও বউয়ের সাথে এখন অবধি সুষ্ঠু প্রেম নিবেদন করতে পারিনি। সেদিন ডিনারের পর আম্মার হাতে মোটা অংকের ক্যাশ ধরিয়ে দিয়ে বললাম, “এ থেকে তোমার আর বোন দু’টোর যা যা লাগবে কিনে নাও। আমার ফ্রী হতে আরো দু’চারদিন সময় লাগতে পারে, তখন শপিংমলগুলো ভিড় বাড়বে। তার চেয়ে এখনই রিল্যাক্সে সব কিনে নিয়ে আসো।” আরো বললাম, “টাকা আরো লাগলে অবশ্যই বলবে কিন্তু মা…” বউয়ের হাতেও টাকা দিয়ে একই কথা বললাম। বিয়ে হল প্রায় তিন মাস, বললামই তো এখনও প্রয়োজনের অতিরিক্ত তেমন কোন কথা হয়নি।
পরদিন সকাল নয়টায় ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে শো-রুমে গিয়ে বাসায় ফিরলাম রাত দশটার দিকে। বাসায় ফ্রেশ হয়ে বসতেই ছোটবোন একগাদা জামা-কাপড়সহ হাবিজাবি এনে সামনের টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, “ভাবি না, অনেক সুন্দর সুন্দর ড্রেস চুজ করে দিছে সবার।” বউয়ের আবার চয়েজ ভাল। সবার সবকিছু দেখলাম। বউ আমার জন্য আড়ং থেকে চড়া দামের পাঞ্জাবী, বিভিন্ন ব্রান্ডের হাতঘড়ি, বডি স্প্রে, সানগ্লাস এসব কিনেছে। সব পছন্দ হয়েছে তবু বললাম, “খারাপ নাহ, চলে…!” ওর মনটা খারাপ হলো ঠিকই তবু মুখের মিষ্টি হাসি দিয়ে সেটা ঢেকে দিল।
ওর ড্রেস দেখতে চাইলাম, আম্মু বলল “এত করে বললাম তবু বউমা নিজের জন্য একজোড়া জুতো কিনে, সব তোর জিনিসপত্র কিনল”।
শুনে আমার মেজাজ গেল চটে। হাতে নেই টাকা, উনি অনর্থক টাকা উড়িয়ে এসেছেন। রাগে হাতের পাঞ্জাবিটা টান দিয়ে ফেলে দিয়ে বললাম, “সমস্যা কি আপনার? শশুড়-শাশুড়ির কাছে আমাকে কিপ্টে বানাতে চান?? সবার শপিং হয়েছে, আপনারগুলো হয়নি শুনলে তারা কি ভাববে??? এত ভালবাসা দেখানোর প্রয়োজন নেই।”
দেখলাম নিজের মহাব্বতের বিনিময়ে আমার পক্ষ থেকে এমন আচরণ পেয়ে সে থ মেরে গেছে। শেষ কথাটায় একটু বেশি কষ্ট পেয়েছে বলে মনে হল।
ক্লান্ত শরীর, আর কিছু না বলে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে গেলাম। মাঝরাতে কারো ফুপানির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল, একটু পরেই বুঝলাম এ শব্দ আমার বউয়ের। অনেক চেষ্টা করছে কান্না থামানোর কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। আমার বেশ খারাপ লাগল। চুপচাপ শুয়েই ভাবছি, বউটাকে কষ্ট বেশি দেয়া হয়ে গেছে। কজনই বা পায় এমন বউ, রত্ন পেয়েও অবহেলা করছি।
আগামীকাল ঈদ। সকারে উঠে ফ্রেশ হয়ে, নাস্তা সেরে কাছে যা ক্যাশ ছিল তা নিয়েই বেরিয়ে পড়েছি। মলে গিয়ে নিজের জন্য আবার একখান পাঞ্জাবী নিলাম, বউয়ের কষ্টটা আরেকটু বাড়ানোর লক্ষ্যে। সেই সাথে বউয়ের ড্রেসসহ যাবতীয় প্রসাধনী, এটা সারপ্রাইজ। বাসায় পৌছে পাঞ্জাবিটা দেখালাম, বাকিগুলা লুকিয়েই রাখলাম। বউ বিকেলেই পাঞ্জাবিটা ধুয়ে দিল।
ঈদের দিন সকালবেলা। সবার মুখেই হাসি, তবে মা বাবাকে খুব মিস করছে, শুধু মা-ই নয় সবাই। তবে মায়ের মিসিংটা অন্যরকম। এদিকে বউয়ের মুখে হাসি আছে ঠিক কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি ওর ভেতরটা জ্বলছে। সবাই আপসে কুশলাদি বিনিময়ের পর আমি ঈদগাহের প্রস্তুতি নিতে বাথে ঢুকলাম। বের হয়ে দেখি, কাল বিকেলে ধোয়া পাঞ্জাবিটা মানে আমার কেনাটা বউ নিজ হাতে লন্ড্রি করে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রেখেছে।
আমার ভেতরটা যেন কেমন করে উঠল। অজান্তেই বলে উঠলাম, “নাহ এবার এর অবসান চাই।” বউ টেবিলে নাস্তা দিয়ে, বেলকুনিতে গিয়ে আনমনা হয়ে কি যেন দেখছে। আমি চুপিচুপি নিজের কেনাটা বাদ দিয়ে বউয়ের কেনা পাঞ্জাবি দুটোর একটা আলমারি থেকে বের করে গায়ে পরলাম। হাতে তার কেনা ঘড়ি, গায়ে পারফিউম তারই কেনা।
কিছু একটা ভেবে পা বাড়ালাম বেলকুনির দিকে। চুপিসারে ঠিক তার পেছনে গিয়ে অবস্থান নিলাম। সে টেরও পায়নি। বিয়ের পর সজ্ঞানে তাকে এখনও জড়িয়ে ধরা হয়নি, তাই কিঞ্চিৎ ইতস্ততবোধ করছি। কিন্ত আজ যে ধরতেই হবে।
খুব ধীরে ধীরে ওর কোমরে হাতজোড়া রাখলাম, শিহরনে শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। এতক্ষণে ওর খবর হল। ও ভয়ে এতটুকু মুখ করে তড়িৎ পেছনে ফিরে দেখে আমি। ওর কেনা ড্রেস, ঘড়ি, পারফিউম দেখে হা করে তাকিয়ে আছে। আমি মুখটা ওর অনেক কাছে নিয়ে বললাম, “আমি অনেক খারাপ না?”ও কোন উত্তর না দিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে। আমার চোখও ভিজে গেল, জড়িয়ো ধরলাম শক্ত করে। ও কেঁদে আমার পাঞ্জাবি ভিজিয়েই চলেছে। আমি চোখবুঁজে, হার্টবিট স্লো করে জাস্ট ফিল করছি।
একটু পর বোনের গলার শব্দে সম্বিত ফিরে পেলাম। বোন চোখে হাত রেখে, হেসে বলে উঠল, “আমি কিন্তু কিছৃ দেখিনি।” বউ একটু লজ্জা পেল। বোন আবার বউরে বলল “কি ভাবি, বলেছিলুম না লেগে থাকো হয়ে যাবে…” বউ ভেজা চোখেই ঠোট টেনে একটু হাসল। সত্যি এই হাসি আগে কখনও দেখিনি। বোনের কথার জবাবে বউ হেসে বলল “পন্ডিত, গেলি এখান থেকে…!”