বিয়ে এবং আমাদের বদলে যাওয়া

বিয়ে এবং আমাদের বদলে যাওয়া

একটা মেয়ে ক্ষানিকক্ষণ পর পর আমার দিকে তাকাচ্ছে। মেয়েরা তাকালে আমি খুব ইতস্তত বোধ করি। বেশ কয়েকবার স্থান পরিবর্তন করলাম। তবুও মেয়েটা পিছু ছাড়ছে না আমাকে খুব অপ্রস্তুত লাগছে। সুন্দরী মেয়েরা তাকালে আমার এমনই অসহ্য লাগে। কিন্তু তবু কাউকে কিছু বুঝতে দিচ্ছি না।ভাবছিলাম গিয়ে সরাসরি নিষেধ করি। কিন্তু এটা বিয়ে বাড়ি।

বিয়েবাড়িতে এসব কেউ ভ্রুক্ষেপ করবে না খুব বেশি গরম না তবু আমি খুব ঘেমে যাচ্ছি। মেয়েটা তাকাচ্ছে। আমি অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। বিয়ে বাড়িতে এসব খুব মামুলী ব্যাপার। প্রতিবাদ করা যাবে না রাগে একা-একাই বাড়ির বাহিরে আসলাম। দরজায় একটা বড় গেট। গেটে বড় বড় করে লেখা “শুভ বিবাহ”…লেখাটা ভুল কিনা পর্যবেক্ষণ করছি। মানে আজতো বিবাহ না।আজ বরের বাড়ি কণে পক্ষের “বৌভাত”।

তবু আমি একবার খুব জোরেশোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলাম “শুভ বিবাহ” “শুভ হোক তোমাদের পথ চলা” একা একা বাহিরে দাঁড়িয়ে আছি। পরিচিতরা সবাই ভিতরে। ভিতরে যেতে হবে। সেই মেয়েটাকে খুঁজতে হবে। বিবাহের আয়োজনে এসে নিজেকে আটকে রাখাটা ঠিক হবে না হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটার একটা নাম দিলাম। ‘দৃষ্টি’… নামটা নিজের কাছেই খুব অদ্ভুত লাগলো। অল্প করে হাসলাম হাঁটতে হাঁটতে সেই আগের স্থানে আসলাম। কিন্তু দৃষ্টি নেই… খোঁজা প্রয়োজন। খুব বেশিই প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ- এ আর কারো প্রতি এভাবে ছারখার দৃষ্টিতে যাতে না তাকায় তানিষেধ করে দিতে হবে। কিন্তু একা-একা খোঁজা বিরক্তিকর। তাছাড়া এখন অনুষ্ঠানের ভিতরে সমবয়সী পরিচিত কাউকে দেখছি না। যা আছে সব ছোট ভাই।

অনেকক্ষণ যাবৎ ঘুরতেছি কিন্তু কাউকে পাচ্ছিও না। অনুষ্ঠানের সময়ও ঘনিয়ে আসছে তাই একাই সব কাজ সম্পন্ন করতে হবে বলে মনস্থির করলাম  ঘুরতে ঘুরতে একটা পর্যায়ে আমি কণের রুমে গিয়ে বসি। অদ্ভুতভাবে দৃষ্টিও দেখি একই রুমে। কিন্তু এখন আমার দিকে তাকিয়ে নেই। আমার মধ্যেও অপ্রস্তুতি ভাবটা নেই। তাই খুব আগ্রহ নিয়ে কণের চোখের দিকে তাকাতে পেরেছি ক্ষুদ্র এ জীবনে যা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। যা জেনেছি সে অনুযায়ী আমি প্রায় নিশ্চিত করে বলতে পারি কণেরসাজে রঙ্গিন এ মেয়েটির মনটা আজ কালো মেঘে গ্রাস করে রেখেছে। জীবনের কোন না কোন এক সময়আজকের এই দিনটিতে অন্য কারো শাড়িতে রঙিন হতে চেয়েছিলো।

প্রিয় একটা মানুষকে পাশে চেয়েছিল শাড়ি ঠিক করতে গিয়ে, মেকাপ বক্স খুলতে গিয়ে, টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে গিয়ে, ক্যামেরার দিকে তাকাতে গিয়ে এ আনন্দঘন বিয়ের অনুষ্ঠানের কোন এক ফাঁকেই হয়তো সেই মানুষটির কথা তাহার খুব মনে পড়েছিলো। হয়তো মন খারাপ হয়েছিলো কিন্তু তবু সব মুখ বুঝে সয়ে ভালো থাকার অভিনয়করছে আমি তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি। জীবনে এই প্রথম কোনো নারীকে এত্তো খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছি খাটের একপ্রান্তে লাল শাড়ি পড়ে লজ্জায় লাল হয়ে বসে আছে সে দক্ষিণের জানালাটা খোলা। দৃষ্টি সহ আরো দুজন জানালা আটকে দাঁড়িয়ে আছে। তবুও জানালা দিয়ে অল্প আলো আসছে। আলোটুকু ঠিক মেয়েটার ঠোঁটের উপর পড়ছে… সেই আলোটা হাসিমাখা গাড় লাল ঠোঁটে এমন ভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে যে মনে হয় পূর্ণিমা রাতে চাঁদ জোৎসনাছড়াচ্ছে। আমি তার ঠোঁট খুঁতিয়ে খুঁতিয়ে দেখছি আর ভাবছি কবেকোথায় যেন পড়েছিলাম। প্রেম জন্ম নিলে মেয়েদের ঠোঁটের দুপাশ শক্ত হয়ে কিছুটা উপরের দিকে উঠে যায়।

কিন্তু মিলাতে পারছিনা যে তারও কি ঠোঁটের কিছুটা অংশ উপরে উঠছে; নাকি না অনেকক্ষণ ধরে কণের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। এভাবে একটি মেয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা অনেক বিব্রতকর। কিন্তু শুধু মাত্র কণের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়। এই তাকানো বৈধ। আমি বৈধ ভাবেই কণের ঠোঁট এবং চোখের দিকে তাকিয়ে আছি সিগমান্ড ফ্রয়েড প্রায় ৩০ বছরের গবেষণার পর আক্ষেপ করে বলেছিলেন – ”নারী কি চায় আমি জানি না” “Was will das Weib?” ”নারী কী চায়?” জানে না কেউ, জানে না… জানি না আমি, আপনি কিংবা গুলির ঠুস হয়ে যাওয়া লাল শব্দ অথবা চাকুর শরীরে লেগে থাকা কিশোরের কালো বিষাক্ত রক্ত কয়টা দিন আগেও যাকে ভালোবাসায় আগলে রেখেছিলো আজ তাকে ভুলে অন্যের শহর রঙ্গিন করতে এসেছে। সুখী হয়েছে। কি অদ্ভুত নারীর চাওয়া পাওয়া(!) আমি কণের সামনে খাটের পাশের কাঠের চেয়ারে বসে আছি।

দৃষ্টিও আছে কণের পিছনে। দৃষ্টি আমার দিকে তাকাচ্ছে কি না জানি না। আগ্রহ নেই এখন। তবে কণে এতোটা সময় পর আমার দিকে তাকালো। আমার ভিতরে আবারো অপ্রস্তুতি ভাব চলে এসেছে। এখানে আর থাকা চলবে না। আমার প্রস্থান আবশ্যক হঠাৎ যে ভাইয়া বিয়ে করেছে আমি তাকে খুঁজতেছি। গত শুক্রবার রাতে তাদের বাসর হয়েছে। কি কথা হয়েছে? কোন মুখে নতুন সুর তুলেছে দুজনায়? জানতে হবে… ভাইয়াটা এইতো কয়দিন পরেই তার নতুন স্ত্রীকে নিয়ে বিয়ের পর কুয়াকাটা যাওয়ার প্লান করেছে। আর সেই ভাইয়াটিই এক কালে তার প্রেমিকাকে রাত দিন আশা দিয়ে বলেছিল “আর কয়টা দিন অপেক্ষা করো, একটা চাকরি নিয়েই বাবাকে দিয়ে তোমাদের বাসায় প্রস্তাব পাঠাবো”। আবার অজস্র কেঁদেছিলো মেয়েটিকে না পাওয়ার বেদনায়। উল্লেখপূর্বক গত বছরের কথা বলা যেতে পারে।

একদিন এক ভোর বেলা প্রাইভেট পড়তে যাচ্ছিলাম হঠাৎ কান্নার শব্দে পা টা থেমে এলো। খুঁজে দেখি আজকের এই ভাইয়াটাই সেদিন বসে বসে কাঁদছে… কিন্তু আমি সব জেনে, সব দেখেও প্রশ্ন করি নি। ইচ্ছে হয় নি(!) আচ্ছা স্ত্রীকে সাথে নিয়ে যখন কুয়াকাটার আকাশ দেখা হবে কিংবা যখন সাগরের পানিতে দু’পা ডুবিয়ে বসে থাকা হব সেখানে শুধুই কী পাশে বসে থাকা এই মানুষটিই থাকবে? সাগরের কোনো এক বিন্দু পানিতেও কী সেই দিনের সে শ্যামলা মেয়েটির অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না? ভাইয়াকে অবশেষে খুঁজে পেলাম। অনেক ব্যস্ত আজ। আমার সাথে একান্তভাবে কথা বলার সু্যোগ হবে কি না জানতে চাইলে ঘড়ি ধরে পাঁচমিনিট আমাকে দেয়ার আশ্বাস দিলেন কিন্তু এভাবে বাঁধাধরা সময়ের মধ্যে আমি কাউকে বোঝাতে কোনো কালেও সক্ষম হই নি। তাই তার দেয়া সময় ফিরিয়ে দিলাম। সে কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করলে আমিও ভ্রুকুঁচকে চলে এলাম ভাইয়াটার অতীত জীবন সে ভুলে গেলেও আমার চোখের সামনে এখন স্পষ্ট ভাসছে।

বার বার চেষ্টা করেও বাবা মাকে রাজি করতে না পারার অপরাধে হাত ছাড়া হয়ে গেল ভালোবাসার মানুষটা। সাহসের অভাবে আত্মহত্যা করতে পারেনি, হাত কাঁটতে পারেনি শুনেছি নয় মাস আগে মেয়েটার বিয়ে হয়ে যায়। তখনও চাকরি পায় নি তাই মেয়েটির বিয়েটাও বন্ধ করতে পারে নি এদিকে আমি দৃষ্টিকে খুঁজে পাচ্ছি না। থাক খোঁজারও ইচ্ছে নেই আর ভাবছি কণের ভালোবাসার গল্পটাও এখন জেনে নেই। জেনে নিলে ভালো হতো। একটা সুন্দর গল্প হতো। কিন্তু সে-ও যদি বাঁধাধরা সময় দিতে চায়? আজ তাদের বিয়ের বৌভাত অনুষ্ঠান। কি অদ্ভুত ব্যস্ততা(!) কি অদ্ভুতদর্শনের হাসি(!) আমার কিছুই ভালো লাগছে না। কোনো মেয়ে তাকাচ্ছে না। আমার গোলাপি পাঞ্জাবীর সৌন্দর্যতা কমে এসেছে।

অনুষ্ঠান থেকে কাউকে কিছু না বলেই বিদায় নিলাম একাকী চলে যাচ্ছি। দৃষ্টির বাসার ঠিকানা জানি না। জানবো না কাল থেকে কেমন থাকবে কোথায় থাকবে আর কার দিকে তাকাবে নিঃসঙ্গ মন খারাপ করে হারিয়ে যাচ্ছি। ভাবছি সেদিনকার সে শ্যামলা মেয়েটার কথা যাকে খুব অল্পতেই ভাইয়াটা ভুলতে পেরেছে কি অদ্ভুত মানুষ! কি অদ্ভুত মানুষের বিবর্তন! কয়দিনে কি অভাবনীয় পরিবর্তন! কণের গল্পটা জানার জন্য মনটা এখন বড্ড খুঁতখুঁত করছে কিন্তু আত্মসম্মানবোধ নিজেকে বাঁধা দিচ্ছে।

গাড়ি চলছে আমি ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছি আর অল্প অল্প হাসছি কয়দিন আগেও যে মানুষটিকে পাবার আশায় নিজের জীবনের অস্তিত্ব বিলীন হতো আজ সেই জীবনে পুরোনো মানুষটাকে নিয়ে কথা বলার পাঁচমিনিটের বেশি সময় হলো না। খুব ভালো লাগছে মানুষের সুখী হবার প্রচেষ্টা দেখে গাড়ি প্রায় গন্তব্যের কাছাকাছি চলে এসেছে। গাড়িতে একটা মেয়ে সেই প্রথম থেকে বারেবারে তাকাচ্ছে। আজ নিষেধ নেই কোনো। নেই নিজের প্রতি বাঁধা। গাড়ি জোরেশোরে চলছে আর আমি বিবর্তিত হয়ে পরিণত লাভ করেছি নতুন মানুষে…

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত