বন্ধন

বন্ধন

রাত ৩টা বাজে……

মারিয়া- কি ব্যাপার রাকিব তুমি এখনও ঘুমাও নাই কেনো সকালে তোমার অফিস আছেত ঘুমাও তাড়াতাড়ি অনেক রাত হয়ে গেছে।

রাকিব- ঘুম আসছে না।

মারিয়া- কি ব্যপার তুমি কান্না করছ কেনো?

রাকিব- আজকের তারিখটা কত জানো মারিয়া?

মারিয়া- আজকেত ৩১অক্টোবর।

রাকিব- আজকের এই দিনটায় আমি আমার দুইজন আপন মানুষকে হারিয়েছি।জানো আজকে আমি এমন ভালোভাবে আছি শুধু তাদের দুজনের জন্যে।

মারিয়া- কারা তারা দুজন?

রাকিব- আকাশ আর মারুফ

মারিয়া- আকাশ আর মারুফ আমাদের দুই ছেলের নাম রাকিব।

রাকিব-হ্যা আকাশ আর মারুফের নাম দিয়েই আমাদের দুই ছেলের নাম রেখেছি। আমাদের দুই ছেলেকে দেখলে মনে হয় আকাশ আর মারুফ আমার সাথে আছে।

মারিয়া- উনাদের কথা তুমি আমাকে আগে কখনো বল নাই আর তারা এখন কোথায় আমাদের বিয়েতে আসে নাই আর এতবছর হয়ে গেলো তাও তাদেরকে দেখালাম না।তারা হয়ত ভালো আছে তোমাকে তারা মনে করে না। কিন্তু তুমি তাদের জন্য কান্না করছ কেনো।

রাকিব- তারা থাকলেত আমাকে মনে করবে।

মারিয়া- থাকলেত মানে।তারা এখন কোথায়?

রাকিব- শুনবে তুমি তাদের দুই বন্ধুর কাহিনী

মারিয়া- হ্যা বল।

রাকিব- তাহলে শুনো।

১০বছর আগে- দুই বন্ধু আকাশ আর মারুফ বলতে গেলে তারা বন্ধুর থেকেও অনেক বেশিকিছু।একসাথে স্কুল ও কলেজ পাশ করে এখন তারা ভার্সিটিতে পড়ছে। স্কুল কলেজে যেমন তাদেরকে একনামে চিনত ঠিক ভার্সিটিতেও তাদের এক নামে সবাই চিনে। আর চিনবেই না কেনো তারা পড়াশোনায় যেমন এগিয়ে তেমনি দুষ্টুমিতেও এগিয়ে।আর সব থেকে বড় আশ্চর্যের বিষয় হল তাদেরকে দেখতেও একি রকম লাগে দুজনের চেহারার ভিতরে অনেক মিল রয়েছে। অনেকে আবার বলে তারা জমজ ভাই। কিন্তু না তারা কেউই জমজ ভাই না দুজনই আলাদা পরিবার থেকে বেড়ে উঠেছে।সবদিক থেকেই তাদের মিল রয়েছে শুধু একদিক বাদে আর সেটি হল মারুফ সব সময় চোখে চশমা পড়ে থাকে।সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিলো তাদের দুষ্টুমি ভরা বন্ধুত্ব।কিন্তু একদিন সকালে ক্রিং ক্রিং ক্রিং

মারুফ- উফফফ এত সকালে কে ফোন দেয় একটুও ঘুমাইতে দেয় না ভালো লাগে না কত ভালো স্বপ্ন দেখছিলাম সব শেষ হয়ে গেলো। (ফোন রিসিভ করে না দেখে) হ্যালো কে?

আকাশ- আমি আকাশ তুই কি এখনো ঘুম থেকে উঠিস নাই আর এদিকেত খবর হয়ে গেছে।

মারুফ- কি খবর হয়ে গেছে?

আকাশ- আর বলিস না রাকিবকে আজকে সকালে পাঠাইছিলাম তোর ভাবির কলেজে।তাকে একটু দেখে আসতে আর কে জানো ওকে বিরক্ত করে তার ছবি তুলে আনতে কিন্তু ও যেয়ে সেই ছেলের সামনে যেয়ে তার ছবি তুলছে আর সেই ছেলে ওকে ধরে মারছে এখন পড়ে আছে বাসায় আর কান্না করতেছে। তুই কিছু কর নাইলে ওর বাসায় কেউ জানলে সমস্যা হবে।

মারুফ- তোর প্রথম ভুল রাকিবকে পাঠানো।জানিস যে ও একটু সহজ সরল। আর ওকেই পাঠাইছিস আমাকে পাঠালে কি আর মার খেতো এভাবে।

আকাশ- আরে ওই ছেলে তোকে আর আমাকে চেনে আগেও আমাদের স্কুলের সামনে দেখছে। আর রাকিব কে দেখে নাই তাই ওকে পাঠাইছিলাম কিন্তু বোকাটা মার খেয়েছে।এখন তুই আয় ওই ছেলেকে কিছু করা লাগবে।

মারুফ- আচ্ছা রাখ। আমি আসতেছি আজকে ওই ছেলেকে পুতে ফেলব মাটিতে আমাদের রাকিবের গায়ে হাত দেয় ওর সাহস কিভাবে হল।

আকাশ- ঘরে বসে ফাপড় না দিয়ে করে দেখা।bye

মারুফ- আচ্ছা আসতেছি। কিছুক্ষণ পরে আকাশ আর মারুফ রাকিব কে নিয়ে সেই স্কুলের সামনে গেলো।

মারুফ- রাকিব ভাই তোমার কোথায় কোথায় মারছে ওই ছেলে।

রাকিব- প্রথমে মুখে তারপরে হাত আর পায়ে।

আকাশ- এবার তাহলে দেখো কি হয়।ধামাকা হবে।

অতঃপর আকাশ আর মারুফ সেই ছেলেকে আচ্ছামত মার দিলো। এমন মার দিলো যা ওই ছেলে অনেকদিন বাসা থেকে বের হতে পারবে না।মারামারি শেষে তারা ফিরে যেতে লাগল তিনজনে তাদের আড্ডাখানায়। কিন্তু তখনি মারুফ মাথা ঘুরে পড়ে যায় আর নাক মুখ থেকে রক্ত পড়তে শুরু করে।তা দেখে আকাশ আর রাকিব তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় আর মারুফের বাড়ির লোকজনকে খবর দেয়।তারা চলে আসে হাসপাতালে।

ঘটনার কিছুদিন পর মারুফ এখন অনেকটা সুস্থ।ডাক্তার তাকে আজকে বাড়ি নিয়ে যেতে বলেছে। বাড়ি ফিরার পর কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার আগের মত জীবন শুরু হয়ে গেলো দুইজনের দুষ্টুমি আর মারামারি দিয়ে। এভাবে কেটে গেলো আরো কিছুদিন। কিন্তু একয়দিন আকাশকে খুব দুর্বল দুর্বল লাগে আর বেশীরভাগ সময় জোর আর কাশি লেগে থাকে। আগের মত সেই স্মার্টনেসটা ওর ভিতরে নাই কেমন একটা নোংরাভাবে চলে।এই নিয়ে মারুফের সাথে ওর ঝগড়া হয় যে মারুফ এতভালোভাবে চলে আর আকাশ কিভাবে নোংরা ভাবে চলে যা মারুফের কাছে ভালো লাগে না।এই নিয়ে ঝগড়া হলে দুজনের ভিতরে দূরত্ব বেড়ে যায়। যার যার মত চলতে থাকে কেউ কারো সাথে এখন আর কথা বলে না।

একদিন সকালে মারুফের কাছে আকাশের বাসা থেকে ফোন আসে। মারুফ রিসিভ করতে ওইপাশ থেকে আকাশের আম্মু কান্না করেন আর বলেন আকাশ অসুস্থ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সব শুনে মারুফ হাসপাতালে যায়।যেয়ে দেখে আকাশকে অপারেশন থিয়েটার এ নিয়ে যাওয়া হয়েছে।এসব কিছু মারুফ বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে কি।তখনই অপারেশন থিয়েটার থেকে ট্রলিতে করে একজনকে মুখ ঢেকে নিয়ে বের হচ্ছে। আর ট্রলিটা এনে মারুফের সামনে এনে রাখা হয় আর ডাক্তার সেই ট্রলিতে রাখা মানুষটার মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে দেয়। মারুফ মোটেও প্রস্তুত ছিলনা যে এই ট্রলির মৃত মানুষটা তার আকাশ হবে।সে ডাক্তাকে বলতে থাকে আমার বন্ধু এমনভাবে শুয়ে আছে কেনো ওর কি হয়েছে পাগলের মত করতে থাকে।তখন ডাক্তার বলেন

ডাক্তার- তোমার মনে আছে তুমি কিছুদিন আগে অসুস্থ হয়ে এসেছিলে এখানে তোমার মুখ থেকে রক্ত বের হয়েছিল আর তুমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে।কিন্তু তুমি জানো না যে তোমার কি হয়েছিলো সেদিন।

মারুফ- কি হয়েছিলো আমার?

ডাক্তার- তোমার একটা কিডনি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো অনেক আগে থেকে কিন্তু সেদিন যদি তোমার কিডনি পালটানো না হত তুমি তাহলে আজ এখানে থাকতে না।তাই সেদিন তোমার বন্ধু আকাশ তোমাকে তার একটা কিডনি দিয়ে দেয় কিন্তু তাকে আমরা নিষেধ করি যেনো একটা কিডনি নিয়ে সে বেশি ধকল না নিতে তাহলে তার জীবনের ঝুকি হবে আর সে আমাদের কথা না শুনে তাকে আমরা বাচাতে পারলাম না দুঃখিত।

এসব কথা মারুফ শুধু এক পলকে তাকিয়ে শুনলো এরপরে সে মাথা ঘুরে পড়ে গেলো আর সে যে চোখ বন্ধ করল আর চোখ খুলে নাই কোনোদিন। সেদিন একসাথে দুজনকে পাশাপাশি কবর দেওয়া হয়। আর আমিও ওখান থেকে চলে আসলাম এই শহরে আব্বু আম্মুকে নিয়ে কারন ওখানে থাকলে ওদের দুজনের কথা খুব মনে পড়ত।তাই এখানে এসে নতুন ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাই আর পড়াশোনা শেষ করে চাকরি পেয়েই তোমাকে আমার জীবনে নিয়ে আসি।আর ওদেরকে হারাতে চাই না বলেই আমাদের ছেলের নাম দিয়েছি আকাশ আর মারুফ আর দেখো আমাদের ছেলে দুইটা হয়েছে জমজ আমরা আগে ওদের দুজন কে বলতাম জমজ আর আজ আমার ছেলে দুইটা হয়েছে জমজ।

মারিয়া- আসলে উনাদের বন্ধুত্ব খুব গভীর ছিলো।আমাকে একবার নিয়ে যাবে ভাইয়াদের কবরের কাছে?(কান্না করতে করতে)

রাকিব- হুম কালত ওদের মৃত্যু বার্ষিকী চল আমরা কাল যেয়ে ওদের কবর জিয়ারত করে আসব।এখন ঘুমাও।আর একটু পর সকাল হয়ে যাবে।

মারিয়া- আচ্ছা। পরেরদিন আজ বহুবছর পর ফিরে এলাম সেই শহর যেখানে রয়েছে আমার অনেক স্মৃতি।

রাকিব-মারিয়া গাড়ি থেকে নামো আমরা চলে এসেছি।

মারিয়া- আচ্ছা কিছুদূর এগিয়ে যেয়ে

রাকিব- মারিয়া এই দেখো এখানে ঘুমিয়ে আছে আমার ভাইটু আর সুইটু।

মারিয়া- ভাইটু আর সুইটু মানে কি?

রাকিব- ওদেরকে ভালোবেসে আমি এই নামে ডাকতাম মারুফকে ভাইটু আর আকাশকে সুইটু বলে ডাকতাম।

মারিয়া- খুব দারুণ নামত।আচ্ছা মারুফ ভাইয়া আর আকাশ ভাইয়া এনাদের আব্বু আম্মুরা কি এখানে থাকেন।

রাকিব- নাহ উনারা সবাই গ্রামে চলে গেছেন।এখানে আর কেউ থাকেন না।আর ওদের গ্রামের বাড়িতে আমি কখনো যাই নাই তাই আমি চিনিও নাই। কারন ওরা আমার জীবনে হঠাৎ করে আসছে আর হঠাৎ করেই চলে গেছে।কিন্তু জানো একটা কথা মারিয়া।

মারিয়া- কি কথা?

রাকিব- ওরা একজন আর একজনের কথা রাখছে।ওরা একজন আর একজনকে বলত যে আমাদের মধ্যে কেউ যদি আগে মারা যায় তাহলে যে বেচে থাকব সেও একা হয়ে যাবো আর যে মারা যাবো সেও একা হয়ে যাবো কিন্তু ভেবে দেখ দুজনে যদি একসাথে মারা যাই তাহলে ওপারে যেয়েও আমরা একসাথে থাকতে পারব আর রাকিব ভাইকে ভুত হয়ে ভয় দিব হাহা।কিন্তু ফাজিল দুইটা কোনোদিন আমাকে ভয় দিতেও আসে নাই।আমাকে ওরা ভুলে গেছে।

মারিয়া- তারা আছে তোমার সাথেই আছে তোমার মনের ভিতরেই আছে।তাদের কথা ভেবে কখনো কষ্ট পাবে না ঠিক আছে।

রাকিব- হ্যা চলো যাওয়া যাক সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে আবার বাসায় আব্বু আম্মু আর আকাশ-মারুফ রয়েছে।

মারিয়া- হুম চল।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত