বুকপকেটে ফোনটা কেঁপেই চলছে অনবরত। ভেজা হাতে একবার দেখে নিলাম, অর্থি। জ্বরের মাত্রাটা স্বাভাবিকতা ছাড়িয়েছে মা’র, অনবরত জলপট্টি বদলাতেই ফোনটা ধরা হয়ে উঠছে না। নিভু নিভু চোখে তাকালেন একবার, হয়তো কিছু বলার চেষ্টা করছে; কিছু না বলেই চোখ বন্ধ করলো আবার। জানি অস্বস্তি উনাকে চেপে ধরেছে, কিন্তু কিসে স্বস্তি নিহিত তা এমন মূহুর্তে ভুলেই বসেছি আমি।অনেকটা সময় পর ফোনটায় চোখ বুলালাম একবার, মাত্র একুশবার কল দিয়েছিলো। কল দিলাম, রিং হতে না হতেই ধরলো অর্থি।’কতবার কল দিয়েছি জানো?”একুশ বার।”একবার ফোনটা ধরেও বলতে পারতে ব্যস্ত।”ব্যস্ততা বুঝতেই যদি তবে এতবার কলও দিতে না।’এমন কথায় ফোন রেখে দিবে এটাই স্বাভাবিক, হলোও তাই।
অভিমানগুলো যখন অপমান হিসেবে পরিচিতি পায়, তখন সবাই চায় কেউ ‘দুঃখিত’ বলুক; অর্থিও ব্যতিক্রম নয়। অকারণে যে অভিমান জন্মে তা ভাঙ্গাতে যাওয়া মানেই অকারণগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়া, বিধেয় আর ফোন দিতে মন চাইলো না।সন্ধ্যার কিছুটা আগে ডাক্তার ডাকতেই হলো। ভালো-মন্দ যাচাই করলো চিকিৎসা শাস্ত্রের মাপকাঠিতে, খাটের স্ট্যান্ডে ঝুলানো হলো নির্দেশনানুযায়ী স্যালাইন।নিঃশ্বাসের নিয়মিত উঠা-নামা দেখেই বুঝলাম ঘুমিয়েছে। বিছানা থেকে উঠে মুখে পানি ছিটিয়ে ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করলাম অনেকটা সময়; পারলামও হয়তো।
ফোন দিলাম অর্থিকে, ধরলো না। এতটা তাড়াতাড়ি ও কখনোও ঘুমায় না, এটা বেশ জানি; আবার দিলাম। এক-দুই-তিন ছাড়িয়ে আটবার। বিপরীত ক্রিয়াতে সত্যিকার অর্থে সাফল্য না থাকলেও মানুষ পৈচাশিক আনন্দ পায়, হয়তো অর্থিও তাই করছে।গ্যাসের চুলোটায় ছোট্ট পাতিলে চা তৈরীর চেষ্টা করলাম, পারলামও অল্প সময়েই। কাপটায় চুমুক দিয়ে পরিশ্রান্ত ভাবটা কমানোর মন্ত্র জপছি, এমন সময়ই ফোন দিলো অর্থি।
‘খাবার টেবিলে ছিলাম, তাই ধরতে পারিনি।’প্রশ্ন করতামই না, তবুও উত্তরের উপযাজকতায় তৃপ্ত হলাম।’তখন খুব রাগ করছো?”রাগ করবো কেন? আসলে সময়গুলো বদলে গেছে আগের তুলনায়।”সময় কখনোই বদলায় না, বদলায় মানুষ।’কথার পৃষ্ঠে কথা হলো অনেকটা সময়। থাকলো প্রশ্ন, থাকলো উত্তর আর থাকলো যুক্তি দিয়ে নিজেদের ব্যর্থতাগুলোকেও সঠিকতা দানের অদম্য চেষ্টা। বেড়েই চললো রাতের যাত্রা, নিজস্ব নিয়মেই। ঘুমে ডুবে যাওয়া পড়ন্ত বয়স্ক মুখটা দেখেই চলেছি বিরতী দিয়ে দিয়ে। ঘুম ভাঙবে না নিশ্চিত, তবুও ‘যদি’র আশায় জেগে পাহারা দেওয়া। বিকেলের দিকটায় একটু সুস্থ দেখালো মা’কে। ধীরগতিতে হেটে এদিক-ওদিক চলা, নরম সুরে টুকটাক কথা বলা; স্বস্তি ফেরালো অনেকটাই।
নিয়মিতই কথা হলো অর্থির সাথে, সময়ের ব্যাকরণ না মেনে। মা’র শরীরটাও শুকিয়ে সুস্থ হলো অনেকটা।
প্রায় সপ্তাহ পেরিয়ে দেখা করলাম অর্থির সাথে, দেখা বলতে সঙ্গ নিলাম। মায়ের ওষুধ আনতে শহরে যাওয়া, তাই ওকেও জোর করা।’বিয়ের বিষয়ে কিছু ভাবলে?”ভেবেছি, তবে একটা চাকরী দরকার শুধু।’ ‘চাকরী না হলে কি বিয়ে করবে না?’অর্থির এমন প্রশ্নে আটকেছি এর আগেও অনেকবার, তবুও এমন প্রশ্ন করবেই কেন জানি। হয়তো আমারও জানা উচিত উত্তর; কিন্তু কিছু উত্তর মহাজাগতিক নিয়মেই ঘুরে বেড়ায়, ধরা দেয় না। ‘বাড়িতে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, বিয়ের কথা আসলে আর আটকানোর যুক্তি পাই না।”জানি।’
আমার জানি কথাটায় অর্থির কতটা অসহ্য লাগে তা ওর ক্ষণিক আচরণ দেখেই বোঝা যায়।রিকশার মৃদু ঝাঁকুনি সয়ে ফেরার পথ কমালাম। টুকটাক খুনসুটির আড়ালে জীবন দর্শন নিয়েই বেশি কথা হলো। মেয়েদের জন্মগত একটা বিদ্যা আছে; সম্পর্কে জড়ানোর আগে ‘তুমি চাইলে গাছতলাতেও থাকবো’, সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই ‘কিছু একটা কর, বাড়িতে বিয়ের চাপ আসছেই’। অসহ্য লাগে এসব।বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে আলাদা যান ধরলাম, সামাজিকতার প্রশ্ন থেকে বাঁচতে। আমরা পাপকে ভয় না করলেও সামাজিকতাকে ভয় করি, হয়তো এটাই বাঙালিপনা।
রাতগুলো কেমন যেন যন্ত্রণা দিতে শিখে গেছে আজকাল। এপাশ-ওপাশ করেই ভোর দেখা হয়ে যায়। চোখ একটু লেগে আসতেই চমকালাম, দরজায় অনবরত কেউ শব্দ করেই চলেছে।’কে?’উত্তর আসলো না বাহির থেকে। কিছুটা বিরতী দিয়ে আবার শব্দ হলো। মোবাইলের টর্চ জ্বেলে বেরুলাম। ‘অর্থি! তুমি?’ হাঁপিয়ে ওঠা কণ্ঠে কিছু বলতে গিয়েও আটকালো।’এত রাতে কেন?”চলো, পালিয়ে যাই।”এ হয় না অর্থি। চলো বাড়িতে রেখে আসি।”মেয়েরা ঘর ছাড়ে শুধু ঘর বাঁধার জন্যই। ফিরিয়ে দিও না আমাকে।’ ‘তোমাতে আমার সুখ, জানি; কিন্তু মায়েতে আমার স্বর্গ।’
কথাটা শুনেই খানিক দূরে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুটা সময়। করণীয় জ্ঞান আমার শূন্য। জেনে বা না জেনেই এগিয়ে গেলাম কিছুটা ওর দিকে। আমার এগিয়ে যাওয়ার গতির সাথে পাল্লা দিয়ে পিছিয়ে চললো অর্থি। কিছু বলবার আগেই বাড়ির পথে হাটা দিলো সে। আটকানোর চেস্টা করলাম না একটুও, কারণ কিছু সময় অভিমানগুলো অধিকার ভাঙার ক্ষমতা অর্জন করে।
সে রাত গত হওয়ার আজ ঠিক চার বছর। অর্থির চলে যাওয়ার জন্য স্মরণ রেখেছি কি না জানি না, তবে সেই ভোরে মাও বিদায় নিয়েছেন। মৃত্যুর পূর্বে অসুস্থ ব্যক্তিরাও কেন জানি একটু সুস্থ হয়, মায়ের ক্ষেত্রেও তেমনি।বারান্দায় বসে মায়ের কবরটায় অজানা ভালোলাগাতেই তাকিয়ে আছি একদৃষ্টে।’চা দিয়েছি, এসো।’অর্থির ডাকে স্বাভাবিক হলাম।টেবিল থেকে কাপটা নিয়ে চুমুক দিলাম। ‘শরীর খারাপ তোমার?’কথা শেষ না হতেই কপালটা ছুঁয়ে দেখলো একবার। ‘জ্বর তো নেই। মন খারাপ?’ কাপটা টেবিলে রেখে হাত ধরে বসালাম অর্থিকে। অজানা প্রশ্নের ভয়ে হাতগুলো কাঁপছে ওর। ‘আমার বেকারত্ব তোমাকে কষ্ট দেয় না?’হেসে উঠলো অর্থি, শব্দ করেই। ‘না, কখনোই না।’ কেন?’
উত্তর না দিয়ে আমার ডান হাতটা পেটের খালি অংশটায় ধরলো, বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললো-‘যে আসছে তাকে তুমি দেখাশোনা করবে, সময় দিবে, মানুষ বানাবে; এজন্যই তোমার বেকার হওয়া দরকার ছিলো।’
হাতটায় অজানা আনন্দ এখনোও নেচে বেড়াচ্ছে। খাবার টেবিলটাতেও লুকিয়ে দেখলাম ওকে বারকতক।
পাশের গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতায় আছে ও। বাড়ি থেকে বেরুনোর সময় কিছু না বুঝেই জড়িয়ে ধরলাম অর্থিকে, ছাড়ানোর ব্যস্ততা দেখালো না ও। দরজা পেরিয়ে হেটে যাওয়াটাও আজ অনেকটা সময় ধরে উপভোগ করলাম।দরজাটা লাগাতে গিয়ে সেই রাতের কথা মনে হলো আচমকা। সেই অবিরাম চলতে থাকা দরজার শব্দ ভেসে উঠলো হঠাতই।আচ্ছা, অর্থিও কি সুখে আছে আমার মতোই? সে রাতের কথা সে কি ভুলে সংসারি হতে পেরেছে? হয়তো, হয়তো না।