গার্লফ্রেন্ড

গার্লফ্রেন্ড

-কই ? কি হল ? কিনে দাও ! দাওওওও !

দুই তিন বছরের মেয়ে যদি এমন করে কিছু কিনে দেওয়ার বায়না করে তাহলে মেনে নেওয়া যায় ! কিন্তু কোন এইচএসসি পড়া মেয়ে যদি এমন বাচ্চা দের মত আহ্লাদ করে করে তাহলে তাকে থাপড়ইতে ইচ্ছা করে ! আমার এখন তাইফাকে থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করছে কিন্তু দিতে পারছি না ! তাইফা আবার বলল

-কই দাও !

-দেখো বাইরের জিনিস খেতে হবে না ! এগুলো আনহাইজেনিক !

-হোক আমি খাবো !

-না !

-খাবো !

-না !

-খাবো !

আমি কঠিন চোখে তাইফার দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম ! কিন্তু সেদিনে তাইফা বিন্দু মাত্র খেয়াল না দিয়ে আবারও সেই কথা বলতে লাগলো ! সে ফুচকা খাবেই !

আমি বললাম

-আইসক্রিম কিনে দিতে পারি ! কিন্তু ফুচকা না !

তাইফা কিছুক্ষন কি যেন ভাবলো ! তারপর বলল

-আচ্ছা ঠিক আছে ! কিন্তু পরের বার কিন্তু ফুচকা খাওয়াতে হবে !

মেয়েদের কে নিয়ে বের হওয়া দুনিয়ার সব থেকে প্যারাময় একটা কাজ ! কিন্তু এই কাজটাই করতে হচ্ছে কদিন থেকে ! কোন প্রকার অজুহাত দিয়ে কাটানো যাচ্ছে না ! কোন রকমে বাড়িতে কাটালেই এই বদ মেয়েকে কিছুতেই পেছ ছাড়ানো যাচ্ছে না ! ঢাকায় আসার পর থেকে সব সময় ফয়সাল এখানে নিয়ে চল ওখানে নিয়ে চল ! আরে আমি কি বাস ড্রাইভার নাকি যে এখানে ওখানে নিয়ে যাবো !

তাইফা এবার এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়েছে ! দিয়ে কাউকে কিছু না বলে একা একা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে এসেছে খালার বাসায় ! এই মেয়ের এতো সাহস আমি নিজ চোখে না দেখলে ঠিক বিশ্বাস করতাম না ! অবশ্য তাইফার খালা মানে রুনু আন্টির মুখে তাইফার কথা আগে থেকেই শুনেছি ! মেয়ের কৃত্তিকলাপের কথা আমার কম বেশি জানতাম ! মেয়েটার গল্প শুনে একবার দেখার ইচ্ছা ছিল মনে কিন্তু সেই ইচ্ছা যে এমন ভাবে পূরন হবে ভাবি নি !

তাইফার খালার সাথে আমার আম্মার আবার গলায় গলায় ভাব ! পাশি পাশি ফ্ল্যাটে থাকার কারনে দুজনে একে অন্যের জানের বান্ধবী ! যতই মেয়ে ডানপিটে হোক ঢাকা শহরে একা একা একটা মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে কেউ নিশ্চিন্তে থাকতে পারে না যদি সেই মেয়েটি নতুন হয় ! তাই আমার উপর দায়িত্ব পড়েছে তাইফাকে ঢাকা শহর ঘুরিয়ে দেখানোর ! আমি এখন সেই দায়িত্বই পালন করছি ! তাইফার জন্য একটা কোন আইসক্রিম কিনে আনলাম !

-তোমার টা কই ?

-আমি খাবো না !

-কেন ?

-এমনি ! তুমি খাও ! তাইফা আইসক্রিম খেতে খেতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল

-তুমি এতো বোকা কেন বল তো ?

আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম আসলে মেয়েটা কি বলতে চাচ্ছে ! এই তিন দিনে এই একটা প্রশ্নই তাইফা আমাকে অন্তত বিশ বার করেছে ! কেন করেছে কে জানে ? আমি প্রত্যেকবারই বলেছি আমি জানি না ! এখনও তাই বললাম ! তাইফা প্রত্যেকবার আমার মুখের কথা শুন হেসেছে, এবারো হাসলো ! বলল

-নাও ! আইস ক্রিম খাও !

-তুমি খাও !

-আহা ! একটা বাইট নিলে কিছু হবে না !

-আরে খাবো না !

-আচ্ছা আমার এটো খাবে না ? যাও আমিও খাবো না !

এই কথা বলতে বলতে অর্ধেক আইসক্রিম টাই তাইফা ফেলে দিল রাস্তার উপর ! আমি অবা হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম ! এই মেয়ের মাথায় আসলেই সমস্যা আছে ! আমার এমন একটা ব্যাবহার করছে যেন আমি তার অনেক কিছু হই ! আমার উপর হঠাৎ করেই এমন জোর কেন কাটাচ্ছে ! আশ্চার্য ! এই মেয়ের সমস্যা কি ? আইসক্রিম ফেলার পর আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে ফিরে বসলো ! আমার সাথে কথা বলবে না ! উল্টো দিকে তাকিয়েই বলল

-তোমার সাথে কথা নাই ! যাও ভাগো ! কি আর করবো আবার একটা আইসক্রিমনিয়ে এলাম ! আগে এক কামড় খেয়ে ওকে দিলাম ! বলল

-এই যে আইসক্রিম খেলাম । এবার নাও !

-না নিবো না !

-আরে কি আশ্চার্য নাও ! আমি তো খাচ্ছি ! তাই না ? নাও !

-প্রথমবার কেন নিলে না ?

-ভুল হয়েছে ! ঠিক আছে ! নাও ! আর এমন হবে না ! এবার তাইফার মুখে হাসি ফুটলো সে আমার কাছ থেকে আইসক্রিম নিল ! আবার সেই প্রশ্নটা করলো

-এই বল না, তুমি এটো বোকা কেন ?

-আমি বোকাই !

-সুইট বোকা ! তোমার গার্লফ্রেন্ডের কপাল ভাল অনেক !

-কেন ?

-কারন আছে !

এই ভাবেই দিন চলতে লাগলো ! আমার অবশ্য আর কোন কাজ নেই ! ভার্সিতে সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস থাকে ! বাকি তিন দিন বাসাতেই থাকি । বাইরে বের হওয়াটা ঠিক পছন্দ না ! ঘরে বসে সময় কাটে ! এখন তাইফার সাথে সময় কাটে !

যেদিন আমি বাইরে যাই না সারাটা দিন আমার সাথে ! মনে হয় ওর খালার বাড়ি থেকে আমাদের বাসাতেই ও বেশি থাকছে ! আমার সাথে আড্ডা মারছে আরও ভাল করে বললে আমাকে বিরক্ত করছে । আম্মার সাথে হাসাহাসি করছে ! আম্মা কে খালামনি খালা মনি বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে ! আম্মা কম যান না ! আম্মা এরই ভিতর ওকে তুই বলে ডাকা শুরু করে দিয়েছে ! আমি দেখছি আর অবাক হচ্ছি ! প্রথম দিনও খানিকটা অবাক হয়েছিলাম ! ঘরে বসে মুভি দেখছিলাম কোথা থেকে একটা অপরিচিত মেয়ে আমার রুমে এসে বলল

-এই তোমার নাম ফয়সাল না ?

আমি প্রথমে কিছু বলতেই পারলাম না ! কোথা থেকে কোন মেয়ে আমার ঘরে এসে আমার নাম এমন ভাবে জিজ্ঞেস করবে এটা আমি কোন দিন ভাবতেই পারি নি ! আমি কিছু বলছি না দেখে মেয়েটি বলল

-শুনো, বিকেল বেলা ফ্রি থাকবা ! আমাকে টিএসসি তে নিয়ে যাবা ! মনে থাকবে !

-তুমি কে ?

আমার এই কথা শুনে মেয়েটি আমাকে একটা ভেংচি কেটে চলে গেল ! আমি বোকার মত বসে থাকলাম কিছুক্ষন ! পরে মা এসে সব কিছু বলে গেল ! মেজাজ টা একটু খারাপ হল কারন মেয়েটা আমর থেকে প্রায় তিনচার বছরের জুনিয়র অথচ আমাকে কত সহজেই না তুমি করে বলছে ! তাই উপর আমার এক দিনেইকেবল একটা হুকুম হুকুম ভাব দেখাচ্ছে ! মানে কি ?

এভাবেই দিন কাটতে লাগলো ! একটা সময় আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম আমারও তাইফার সাথে সময় কাটাতে ভাল লাগে ! আমি নিজেই ওর জন্য অপেক্ষা করতে থাকি । কখন আসবে কখন আমাকে বিরক্ত করবে, আমার মোবাইল নিয়ে ঘাটাঘাটি করবে ! বলবে

এই টা তুমি কি রাখছো মোবাইলে ?

এই টা কর ছবি ?

এই মেয়েটা কেন ?

এই ছেলেটা কেন ?

এই টা লক কেন ?

এই টা এমন কেন ?

রাতের বেলা মাঝে মাঝেই তইফা আমাকে ফোন করে ছাদের নিয়ে যায় ! রেলিংয়ের উপরে বসে কত গল্প করি আমরা ! কত রকমের কথা ! কত অদ্ভুড রকমের কথাই না মেয়েটা জানে ! তারপর এই দিকে দিনে ঢাকা শহরের এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আমরা এক সাথে ঘুরে বেড়াই নাই ! কিন্তু সব কিছুর একটা শেষ আছে ! দেখতে দেখতে তাইফার যাওয়ার দিন চলে এল ! ইন্টার পরেরই ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিতে হয় তাইফারও দরকার ! তাই তাকে ফিরতে হবে ! ওর চলে যাওয়ার কথা শুনে কেমন একটা লাগলো যেন !

যাওয়ার দিনও তাইফাকে স্টশনে পৌছে দিতে আমিই গেলাম ! ও আর কাউকে আসতে দেয় নি । বলেছে আমি তোমাদের বাসায় এসেছি একা বিদায় নেবোও এখান থেকে ! কারও স্টেশনে আসতে হবে না ! আম্মা তো কেঁদেকেটে অস্বস্থির ! ট্রেনে ওকে সিটে বসিয়ে দিয়ে ওর পাশেই বসলাম ! এই প্রথম বারের মত দেখলাম ওর মুখ টা কেমন একটু গম্ভীর !

-কি হল ?

-কি হবে ?

-মুখ এমন বাঁদরের মত করে রেখেছ কেন ?

-বাঁদর ?

-হুম ! মহিলা বাঁদর ! গম্ভীর হলে তোমাকে তেমনই লাগে !

-মার খাবা ! বলে দিলাম !

এই বলে তাইফা অন্য দিকে তাকালো ! আমার কেন জানি মনে হল মেয়েটা চোখের পানি আটকানোর জন্য অন্য দিকে তাকালো ! বুকের ভেতর টা হঠাৎই আবার কেমন করে উঠলো ! সেই অনুভুতিই আমি কিছুতেই প্রকাশ করতে পারলাম না ! কিছু বলতে যাবো তখনই ট্রেনের হুইসেল দিয়ে দিল ! ট্রেন ছেড়ে দিবে ! এখনই নেমে পড়া উচিৎ ! আমি বললাম

-যাই কেমন ?

-তুমি এসো আমাদের ওখানে ! কেমন ?

-হুম ! আসবো !

-আসবে তো ?

-হুম !

আমি ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম ! দরজার কাছ পর্যন্ত তাইফা এল ! আমি দরজা দিয়ে নেমে যখনই ওর দিকে ফিরে চাইলাম তখনই দেখি ওর চোখে পানি ! এই প্রথম বারের মত ওর চোখে পানি দেখে সত্যি সত্যি বুকের ভেতর টা একটা মোচড় দিয়ে উঠলো ! মনে কিছু না ভেবে ট্রেন থেকে ওকে নামিয়ে নিয়ে আসি ! বলি তোমার যাওয়ার দরকার নেই ! আমরা রাতের বেলা ছাদের বসে গল্প করবো, সারা দিনরোদের ভিতর টো টো করে ঘুরে বেড়াবো ! তুমি যেও না!

ট্রেন ততক্ষনে চলতে শুরু করে দিয়েছে ! আমি একটু পিছিয়ে পরেছি ! দাড়িয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছি ট্রেনটা একটু একটু করে তাইফা কে আমার কাছ থেকে দুরে নিয়ে যাচ্ছে ! আমি যেমন ওর দিকে তাকিয়ে আছি ও তেমন আমার দিকে তাকিয়ে আছে ! এক ভাবে !

একটু হেসে হাত নাড়ার চেষ্টা করলাম ! কিন্তু মুখ দিয়ে হাসি আসলো না ! একটু পরেই তাইফা গেটের কাছ থেকে ভিতরে চলে গেল ! আমার মন টা একটু খারাপ হল ! ভেবেছিলাম শেষ পর্যন্ত মানে যতক্ষন দেখা যায় ততক্ষন তাইফা গেটের কাছে দাড়িয়ে থাকবে !

তবুও ফাকা গেট টার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুটা সময় ! ট্রেন টা বেশ দুরেই চলে গেছে ! আমি পেছন ফিরে হাটা শুরু করলাম ! ঠিক তখনই আমার কেন জানি মনে হল পিছন ফিয়ে তাকাতে ! আমি পেছনে ফিরে তাকাতেই অবাক হয়ে দেখলাম তাইফা আবার গেটের কাছে এসেছে ! তবে এবার ওর কাধে ব্যাগ !

আামর ভিতর হঠাৎই একটা ভাবনা সৃষ্টি হল ! ও কি করতে যাচ্ছে ? নেমে পড়বে নাকি ? বোকা মেয়েটা কি করতে যাচ্ছে ? ট্রেন ততক্ষনে চলছে ভালই গতিতে ! আর কিছক্ষনের ভিতরেই স্টশনের প্লাটফর্ম পার হয়ে যাবে ! আরে কি করতে যাচ্ছে মেয়েটা ? আমি তাইফা বলে চিৎকার দেওয়ার আগেই তাইফা ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে আশ্চর্য দক্ষতায় প্লাটফর্মের উপর দাড়িয়ে পড়লো ! আমরা যেভাবে ঢাকার চলন্ত বাস থেকে নেমে পড়ি ঠিক তেমনই ! আমার মতই অনেকেই তাইফার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন ! আমি দৌড়ে গেলাম ওর কাছে ! বলল

-এটা কি ছিল ?

-দেখলা না !

-তুমি কি পাগল নাকি ?

-হুম ! কোন সমস্যা ?

-তোমাকে না থাপড়ানো দরকার ! এভাবে কেউ লাফ দেয় ! যদি কিছু হত ! তাইফা সুন্দর করে হেসে বলল

-আরে কি হবে ? মনে নেই আমরা কত বার চলন্ত বাস থেকে এভাবে নেমে পরেছি !

-তুমি কেন নেমে পড়লে ?

-কেন জানি তোমাকে ছেড়ে যেতে মন চাইলো না ! তুমি তো আর বলবা না থেকে যেতে তাই গাধার মত আমি নিজেই নেমে পড়লাম ! আমি আসলেই কোন কথা বলতে পারলাম না ! কেবল তাইফার দিকে তাকিয়ে রইলাম !

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত