প্রেমিকার সাথে রেস্টুরেন্টে বসে নাস্তা করছিলাম। হঠাৎ-ই আব্বুর ফোন আসলো। কল ধরার সাথে সাথেই বলল ‘ তাড়াতাড়ি একটু বাসায় আয় তোর আম্মুর শরীরটা তেমন একটা ভাল দেখাচ্ছে না। ‘ কথাটা বলেই কল কেটে দিল। নাস্তা শেষ করে বাসায় গিয়ে দেখি কেউ নেই বাসা ফাঁকা। আব্বু আবার কল দিয়ে বলল চট্টগ্রাম মেডিকেলে দ্রুত যেতে।
খুব টেনশন ধরে গেল। আব্বু কথাটা বলার সময় উনার কন্ঠে অনেকটা কাঁন্নার ছাপ বুঝতে পারছিলাম। দ্রুত মেডিকেল পৌঁছে দেখি আব্বু বাহিরে সিটে বসে আছে। আমাকে দেখেই সিট থেকে উঠে জড়িয়ে ধরে কাঁন্না করে দিল। কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। আমি কিছু বুঝতে না পারলেও আব্বুর কাঁন্নায় নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। কিছুক্ষণ পর আব্বু একটু স্বাভাবিক হয়ে বলল-
– বাবা তোর মা তো ব্রেইন স্ট্রুক করছেরে বাবা। আমি অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখি তোর মা ডাইনিং রুমে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। মাথায় প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হয়েছে। এখনো জ্ঞান ফেরেনি ডাক্তার বলল ওর অবস্থা আশংঙ্খাজনক।
আমি আব্বুকে সান্ত্বনা দিয়ে বুঝালাম সব ঠিক হয়ে যাবে। আব্বু আমাকে আবার জড়িয়ে ধরে বললেন সেটাই যেনো হয় বাবা। একটু পর ডাক্তার এসে জানালো আম্মুর জ্ঞান ফিরেছে এবং উনি আমার সাথে দেখা করতে চায়। ডাক্তার আব্বুকে জানালো আমি যেন একা দেখা করি। তাই আব্বুকে বাহিরে রেখে আমি গেলাম।
আম্মুর কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আম্মু কাঁপুনি গলায় বলল- বাবা আমি বোধয় আর বাঁচবনা। আমার মনে হচ্ছে এক্ষুনি আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে। আমি আম্মুকে নিষেধ করলাম এসব কথা না বলতে তবুও আম্মু শুনলনা। বলল-
‘ আজ সকালে তোর রুম থেকে সিগারেটের প্যাকেট পেলাম। তুই কেনো সিগারেট খাস বাবা। আমি না পেয়ে যদি আজ তোর আব্বু পেতো তাহলে তোর আব্বু কতটা কষ্ট পেতো? বাবা তুই অনেক রাত পর্যন্ত বাহিরে আড্ডা দিস জানিস তোর আব্বু এটা পছন্দ করেনা। এসব কেনো করিস বাবা। কোন মেয়ের সাথে নাকি সারাদিন ঘুরেবেড়াস ওটা তোর বড় চাচা দেখে গতকাল রাতে তোর আব্বুকে কত খারাপ করে কথা বলে গেল। মানুষ তোর নামে কত নালিশ দিয়ে যায় এটা ওটা। তোর আব্বুতো তোর উপর কখনো হাত তুলেনি। কখনো একটা থাপ্পড় পর্যন্ত দেয়নি। তুই কেনো এগুলো করে অই মানুষটাকে এত কষ্ট দিচ্ছস বাবা। প্লিজ বাবা আমার মাথায় তুই হাত রেখে বল তুই ভাল করে পড়াশুনা করবি তোর বাবার কথা শুনবি, উনার পাশে থাকবি। বল বাবা বল। ‘
আমি আম্মুর মাথায় হাত রেখে শপথ করলাম। আম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁন্না করে দিলেন। কাঁদতে কাঁদতে আমার বুকেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। আমি চিৎকার দিয়ে ডাক্তারকে ডাকলাম। ডাক্তারকে বললাম আমার আম্মু অজ্ঞান হয়ে গেছে। প্লিজ দেখুন আমার আম্মুর জ্ঞান ফিরিয়ে আনুন। প্লিজ ডাক্তার বললেন ‘ স্যরি শি ইজ নো মোর! ‘ আমি কতবার ডাক্তারকে বললাম আমার আম্মু মরতে পারেনা। প্লিজ ডাক্তার আমি আমার আম্মুকে একবার বলতে চাই আমি আম্মুকে অনেকটা ভালবাসি, আম্মু আমাকে এভাবে রেখে চলে যেতে পারেনা। ডাক্তার কোনো কথা না বলে চলে গেলেন।
আব্বু দৌড়ে এসে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কাঁন্নার শক্তিটাও যেনো হারিয়ে গেল। আব্বুকে কতবার বললাম আম্মুকে তুমি বলোনা প্লিজ আমি আম্মুকে ভালবাসিতো। আমি আর কখনো আম্মুকে কষ্ট দিবোনা তো। প্লিজ আব্বু তুমি আম্মুকে বলো। আব্বুর চোঁখ-বুক কাঁন্নায় ভেসে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে আমিও অজ্ঞান হয়ে গেলাম। জ্ঞান ফিরে দেখি আমি হসপিটালের বেডে। আব্বু আমার পাশে বসা। আমার মাথায় উনার হাত। আমার জ্ঞান ফিরতে দেখে আব্বু আমাকে জড়িয়ে ধরল। অনেকটা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলাম।
আম্মুর মৃত্যুর আজ তিন দিন। এখন খুব ভালভাবেই আম্মুর অনুপস্থিতি টের পাচ্ছি। আমি কতই না অন্যায় করেছি। কতবার উনাদের কষ্ট দিয়েছি। দিনের পর দিন ভার্সিটিতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়েছি। বাহিরে খাবার খেয়েছি আম্মুর-আব্বুর সাথে খাওয়া হয়নি।
নিজের কাপড়, পড়ার টেবিল, বিছানা সব অগোছালো করে রেখে গেছি, আবার খুব রাতে বাসায় ফিরলে সব গোছানো দেখেও কখনো বুঝতে পারিনি এতো কষ্ট করে কে সব গোছিয়েছে। গোসল শেষে কাপড়গুলোও নিজে ধুতাম না, আম্মু সব ধুয়ে দিতো। সে খবর কখনো রাখলাম না।
ভার্সিটি ফি; হাত খরচ চাইতেই আব্বু দিয়েছে। আর সেই টাকা আমি নষ্ট করেছি দিনের পর দিন। কখনো ভাবলাম না এই টাকাটা আব্বুর কত কষ্টে উপার্জনের টাকা।
আজ আব্বুকে জড়িয়ে ধরে আমাকে বলতেই হবে। মাফ চাইতে হবে। জীবনে অনেক ভুল করেছি। আম্মুকে হারিয়েছি আমি। আর কোনো ভুল করে আমার আব্বুটাকে হারাতে চাইনা। আজ আমাকে বলতেই হবে – তুমি আমাকে মাফ করে দাও বাবা। আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালবাসি বাবা। খুব বেশি ভালবাসি।
[ আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দু বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে। (৩১:১৪) ]
[ নবীজী স. বলেছেন, পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন, আর পিতা-মাতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন।]