ভালবাসার গল্প

ভালবাসার গল্প

সকালের নাস্তার টেবিলে ইরা কে কেমন যেন গম্ভীর দেখলাম । আমি নাস্তা করছিলাম । ও চুপচাপ বসে ছিল । কিছু খাচ্ছিল না । বললাম

-কি ব্যাপার খাচ্ছ না কেন ?
-এখন খেতে ইচ্ছা করছে না ।
-এখন করছে না মানে কি ? অফিসে যাবে না ?
-আজকে ভাবছি অফিসে যাবো না ।
-কেন ? শরীর ভাল আছে তো ? জ্বর আসেনি তো ? আমি ইরার কপালে হাত দিলাম ।
-না তেমন কিছুই হয়নি । এমনি ইচ্ছা করছে না । আমি নাসতা খেয়ে উঠতে যাবো এমন সময় দেখলাম ইরা আমার হাত ধরে বসাল । বলল
-কাল রাতে ঘটনার জন্য আমি সরি । খুব বেশি সরি ।
-না ঠিক আছে । কিন্তু ঠিক বুঝতে পারলাম না তুমি এমনটা কেন করলে ? ইরা বলল

-তুমি জয়িতার সাথে কথা বলছিলে এটা আমার একদম সহ্য হচ্ছিল না । বারবার মনে হচ্ছিল আমার কাছ থেকে কি যেন হারিয়ে যাচ্ছে । মনে হচ্ছিল আমার কিছু একটা অন্য কেউ নিয়ে যাচ্ছে । বলতে বলতে ইরা বাচ্চা মেয়েদের মত কেঁদে ফেলল । চেয়ার থেকে উঠে ওকে জড়িয়ে ধরলাম । বললাম

-বোকা মেয়ে ! আমি তোমার হাজবেন্ড ! তোমার কাছ থেকে কে আমাকে নিয়ে যাবে বল ? ইরা আমাকে আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল । যেন আমি কোথাও হারিয়ে যাচ্চি । ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল
-কিন্তু জতিয়াকে তো তুমি ভালবাসতে ।
-বাসতাম । ও তো আমার পাস্ট । আর তুমি আমার প্রেজেন্ট আর ফিউচার । তুমি কেন ওর সাথে নিজেকে তুলনা করছো ?
-আমি জানি না । তুমি আর ওর সাথে কথা বলবা না ।

-আচ্ছা বাবা বলবো না । আর জয়িতা অল্প কয়েক দিনের জন্য এসেছে । ও চলে যাবে । কেবল ভার্সিটির রিইউনিয়নের জন্য এসেছিল । আমি এবার অফিসে যাই ?

-আচ্ছা । ইরা একটু হাসলো ।

ইরাকে একটা মিথ্যা কথা বলতে হল দেখে একটু খারাপই লাগছে । ওকে বললাম যে জয়িতার সাথে আর দেখা করবো না । কিন্তু দেখা না করলে কিভাবে হয় ? গত কাল ওর সাথে ঠিকমত কথা হয় নি । আমি খুব ভাল করেই জানি জয়িতা কেবল আমার সাথেই দেখা করার জন্য দেশে এসেছে । ঘর থেকে বেরতে না বেরতেই জয়িতার ফোন ।

-বল ।
-তোমার হ্যালো না বলার অভ্যাসটা আর গেল না , না ? আমি হাসলাম ।
-মন ভাল তোমার ?

জয়িতারও দেখছি অভ্যাসটা যাই নি । ও সব সময় ফোন করে আমাকে জিজ্ঞেস করত মন ভাল কিনা । যদি একবার ফোন রেখে ১০ মিনিট পরে আবার ফোন দিতাম তবুও এই প্রশ্নটা করতোই ও । একবার কি হয়েছে । ওর সাথে খুব ঝগড়া হয়েছে । একবার ঝাড়ি দিয়ে ফোন রেখেছি । কিছুক্ষন পর আবার ফোন দিয়েছি আরেক দফা ঝাড়ি দেবার জন্য । ফোন রিসিফ করেই জয়িতা খুব আদুরে গলায় বলল

-মন ভাল তোমার ?

এমনিতে আমরা একে অপরকে তুই করে বলতাম । কিন্তু মাঝে সাঝে ও আমাকে তুমি করে বলত । বিশেষ করে যখন আমি রেগে যেতাম । আমি আর কিছু বলতেই পারলাম না । এই মেয়েকে কি বেশি কিছু বলা যায় ?

-তোমায়ও তো অভ্যাসটা যায় নি ? জয়িতা বলল
-তুমি আসছো তো ?
-হুম । আসবো না কেন ?
-না মানে , তোমার ওয়াফ পছন্দ নাও করতে পারে ।
-ইরা পছন্দ করবে না ।
-তবুও আসবে ?
-হুম আসবো ।
– কেন ?
-জয়ি ইরা আমার কাছে ইম্পর্টেন্ট । কিন্তু তুমিও আমার কাছে কম জরুরী না !
-আচ্ছা ! বুঝলাম । এসো তাহলে ! কেমন ? আমি অপেক্ষা করছি ।

আমি ফোন কেটে দিলাম । রিক্সাওয়ালাকে এলিফ্যান্ট রোডের দিকে যেতে বললাম । জয়িতার এক মামার বাড়ি ঐ দিকটায় । আপাতত জয়ি ওখানেই উঠেছে । আজ কতদিন পর জয়িতার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি । প্রায় সাত বছর তো হবেই । আজ কতদিন পর ওর সাথে একটু কথা বলব ভালভাবে । আগে এমন কোন দিন ছিল না যে আমরা দেখা করতাম না । আমার এখনও খুব ভাল করে মনে আছে ওকে যেদিন প্রোপজ করি । ও খানিকটা অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিয়েছিল । বলল

-দেখ আবীর ইটস নট ফানি ।
-আরে ফানির কি দেখলি ? তোকে প্রোপজ করেছি আমি ।
-ওয়েল দেন আই ক্যান রিজেক্ট ইউ ইফ আই ওয়ান্ট ।
-রিজেক্ট করেই দেখ ! জয়িতা কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থাকল । বলল
-তুই যেটা চাচ্ছিস সেটা সম্ভব না ।
– কেন সম্ভব না ? আমাকে তুই একটা যুক্তি যুক্ত কারন দেখা ।
-দেখ আবীর তুই কি জোর করে আমার মুখ থেকে হ্যা বলাবি ?
-প্রয়োজন হলে তাই । জয়িতা কি বলবে ভেবে পেল না । আমি বললাম
-তুই আমাকে রিফিউজ কেন করবি বল ? একটা কারন আমাকে দেখা । জয়িতা এবারও কোন কথা বলল না । কেবল আমার দিকে তাকিয়ে থাকল ।

-বল আমাকে অপছন্দ করিস ? বল । করিস অপছন্থ ? জয়ি মাথা নাড়ল ।
-অন্য কাউকে ভালবাসিস ? এবার ও মাথা নাড়ল ।
-আমি যদি অন্য কোন মেয়ের সাথে এঙ্গেইজ হই , তোর ভাল লাগবে ?জয়িতা কোন উত্তর দিলো না ।
– কি কথা বলছিস না কেন ? জয়িতা ক্ষীন গলায় বলল
-তুই কারো সাথে এঙ্গেইজ হলে আমার কি ?
– কি বললি তুই ? আমার কি ? তাহলে ঐ দিন তুই রেগে গিয়েছিলি ক্যান ?
-কোন দিন ?
-পহেলা বৈশাখের দিন । আমি তোকে বাদ দিয়ে নীলুর সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম । তুই রেগে গিয়েছিলি কেন ? পুরোএক দিন আমার সাথে কথা বলিস নি মনে আছে ।
-আহা রাগবো না ? আমি তোমার জন্য সেজেগুজে আসবো আর তুমি অন্য মেয়ের সাথে ঘুরে বেড়াবা !
-তাহলে ?
-তাহলে কি ?
-তুই কি বুঝতে পারছিস না নাকি বুঝতে চাচ্ছিস না ?

জয়িতা অন্য দিকে তাকালো । আমি হাত দিয়ে ওর মুখটা স্পর্শ করলাম । দেখলাম ওর চোখে পানি চলে এসেছে । ওর চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললাম

-জয়ি , তুই এমন কেন করছিস বলবি আমাকে ?
-আবীর প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা কর । এই সম্পর্ক কেবল কষ্টই দেবে । আর কিছু না ।
-আমি আর কিছু জানি না । আমি আজ রাত তোকে সময় দিলাম । তুই যদি কাল সকালের আগে আমাকে ফোন না দিস এবং বলে একটু থাকলাম । জয়িতা বলল

-এবং ?
-এবং তোর আনসার যদি পজেটিভ না হয় তাহলে দেখিস । আমি গেলাম ।আমি জানতাম জয়িতা ফোন করবেই । রাত আড়াটার দিকে জয়িতার ফোন এসে হাজির ।
-কি করিস ?
-ছাদের উপর বসে আছি ।
-ছাদের উপর কি করিস ?
-জায়গা খুজছি ?
– কেন ?
-না কোন জায়গা থেকে লাফ মারবো তাই ঠিক করছি ।
-আবীর মার খাবি কিন্তু । তুই এক্ষনি রুমে আয় । এক্ষনি আয় ।
-আগে হ্যা বল ।

-আবীর প্লিজ রুমে আয় । প্লিজ । আমি হেসে উঠলাম । বললাম
-ভয় নাই । আমি রুমেই আছি । তোকে একটু ভয় দেখালাম । জয়িতা কোন চুপ করে থাকল । কথা বলল না । আমি বললাম
-কি হল কথা বলছিস না কেন ? একটু কান্নার আওয়াজ পেলাম ।
-আরে কাঁদছি কেন ?
-তুই সব সময় আমাকে জ্বালাতন করিস । তুই জানিস না তুই আমার কাছে কি ?
-জানি তো !
-তাহলে এমন কেন করিস ?
-আই লাভ ইউ বল । জয়িতা হাসল ।
– তুই এতো বোকা কেন ? সব কথা কি বলার দরকার হয় ।
-না । তবুও বল ।
-আচ্ছা বাবা বলছি ।

জয়িতা একটু চুপ করল । জয়িতার বাসায় পৌছাতে পৌছাতে ঘন্টা খানেক লেগে গেল । আগে অনেক বার এসেছি এই বাড়িটার সামনে । জয়িতা প্রায়ই আবদার করতো ওকে বাসা থেকে নিয়ে যেতে । কিন্তু একটা ব্যাপার প্রায়ই হত । আমি যখনই ওর বাড়ির সামনে এসে হাজির হতাম ঠিক তখনই ওর ফোন আসতো আমার মোবাইলে । ফোন করে বলতো

-বেল বাজাবি না । আমি নামছি । আমার মনে হত ও আমার জন্য জানলা দিয়ে তাকিয়েই থাকতো । আমাকে বেল বাজানোর সুযোগ দিতো না । কিন্তু আজ আর ঐ রকম কিছু হল না । আমি কিছুটা সময় অপেক্ষা করলাম যদি ওর ফোন আসে ! শেষে নিজেই ফোন দিলাম ।

-চলে এসেছো ?
-হুম ।
-উপরে এসো । তিন তালার বা পাশের ফ্লাট । মনে নেই তোমার ?

আমার প্রতি ও আগে থেকেই আসক্ত ছিল কিন্তু হ্যা বলার পর থেকে আমি ছাড়া আর কিছু যেন বুঝতোই না । সেই সকাল বেলা থেকে আমাদের একসাথে পথ চলা শুরু হত দুপুর বেলা পর্যন্ত চলত । যে দিন মাত্র একটা ক্লাস থাকতো সেই দিনও পুরোটা সময় একসাথে থাকা চাই ।

ওর এমন আচরন করাটা হয়তো আমি বুঝতে পারতাম । জয়িতা তখন সিক্সে পড়ত যখন ওর বাবা মার ডিভোর্স হয়ে যায় । ও বাবা মা কারো কাছেই থাকে নি । সত্যি কথা বলতে ওর বাবা মা ইচ্ছা করেই জয়িতাকে নিজের কাছে রাখে নি । মাসে মাসে কেবল খরচ পাঠিয়ে দিতেন । কিন্তু ভালবাসা পাঠান নি কখনও । জয়িতা বলতে গেলে তারপর থেকে হোস্টেলেই বড় হয়েছে । মাঝে মাঝে যেত ওর মামার বাড়িতে । কারো কাছ থেকে না ঠিক মত ভালবাসা পেয়েছে আর না কাউকে ঠিক মত ভালবাসতে পেরেছে । তাই আমাকে পাবার পর থেকে যেন এতো দিনের সব না পাওয়া ভালবাসা আমার কাছ থেকে পুষিয়ে নিচ্ছিল । কিন্তু একটা ব্যাপার আমার কাছে সব সময় খুব অদ্ভুদ লাগতো । ও কথনই আমার বিয়ের কথা বলত না । কেমন যেন এড়িয়ে যেত । পড়া লেখা শেষ করে যখন চাকরীতে ঢুকলাম স্বাভাবিক ভাবেই ওকে বিয়ে করতে চাইলাম । ও বলল

-তোর ফ্যামিলির সাথে আগে কথা বল ।

আমি আমার মাকে বললাম । সব শুনে মা রাজি হলেন না । তার এক কথা ব্রোকেন ফ্যামিলির কোন মেয়ে তার ছেলের বউ হবে না । কত ভাবে বোঝাতে চাইলাম কিন্তু কিছুতেই মাকে রাজি করাতে পারলাম না । কথা গুলো যখন জয়িতা কে বললাম ও একটুও অবাক হল না। ওর মুখ দেখে বুঝলাম ও যেন আগে থেকেই জানতো এমনটা হবে । কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে গেল । আমি ভেবেছিলাম জয়িতাকে দেখবো । কিন্তু দরজা খুলল পাঁচ ছয় বছরেয় একটা মেয়ে । এতো মিষ্টি চেহারা মেয়েটার । আমাকে দেখে মিষ্টি একটু হাসল । আর কেবল আমার দিকেই তাকিয়ে থাকল । আমি বললাম

-তোমার নাম কি ?
-তোমাকে কেন বলব ?
-শশী এসব কি হচ্ছে ? জয়িতাকে ঘরে ঢুকতে দেখলাম ।
-কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে নাম বলতে হয় ! জানো না? ছোট্ট মেয়েটা গিয়ে জয়িতাকে জরিয়ে ধরল । জয়িতা আগের মতই আছে । গতকালকের অনুষ্ঠানে ইরার জন্য ওকে ঠিক মত দেখতে পারি নি । আমি বললাম

-ভাল আছো তো ?
-তুমি এসেছো না ! এখন ভাল আছি ।
-আগের মতই আছো ? জয়িতা হাসল ।
-আচ্ছা এই মিষ্টি মেয়েটা কে ? জয়িতা শশীকে কোলে নিল । জয়িতা হাসল । জয়িতাকে হাসতে দেখে শশীও হাসল । জয়িতা বলল
-বলতো কে ?
-ওমাইগড ! এটা তোমার মেয়ে ? সত্যি তোমার মেয়ে ? এতো বড় হয়ে গেছে ? দেখি একটু কোলে নেই ।
শশীকে কোলে নিলাম । কেমন যেন আফসোস হল নিজের মনের মধ্যে । এই মিষ্টি মেয়েটা আমার নিজের হতে পারতো ! কোলে নিতেই শশী আমাকে জড়িয়ে ধরল । একটা ভাল লাগা বয়ে গেল আমার পুরো মন জুরে ।

-এতো মিষ্টি মেয়ে তোমার ?

তারপর থেকে জয়িতা যেন কেমন বদলে গিয়েছিল । আমার দিকে যখন তাকাত কেমন যেন একটা বিষন্নতা ওর চেহারায় ফুটে ওঠত । মনে হত ওর কাছ থেকে কি যেন একটা হারিয়ে যাচ্ছে । আর ও সেই জিনিসটাকে ধরে রাখার জন্য কিছুই করতে পারছে না । আমি কত কথা বলতাম । ও কিছু বলত না । আমি আর থাকতে পেরে ওকে বললাম

-তুই এমন কেন করছিস ?
-কেমন করছি ?
-এমন মন খারাপ করে কেন থাকিস ? জয়িতা কোন জবাব দিল না । আমি বললাম
-আমি তোকেই বিয়ে করবো ! কে রাজি হোক বা না হোক ! তুই বুজলি আমার কথা ? জয়িতা হাসল । বিষন্নতার হাসি !

-আবীর ! আমি তোকে বিয়ে করবো না । তুই কি জানিস মানুষের জীবনে মা বাবা কতটা ইম্পর্টেন্ট ! তাদের কাছে থাকাটা কত বেশি জরুরী ! অনেক বেশি জরুরী ।
-কিন্তু ..
-কোন কিন্তু না । তোর মা তোকে ২৪ বছর ধরে ভালবাসে । বুকের একটু একটু ভালবাসা দিয়ে তোকে বড় করেছে । আমার ২৪ মাসের ভালবাসা ঐ ২৪ বছরের ভালবাসার কাছে কিছুই না । তোর মাকে কিছুতেই কষ্ট দিস না । আমি হলে দিতাম না । তোরও দেওয়া উচিৎ না । তারপর থেকে জয়িতা আমার সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিল । আমি যোগাযোগ করতে চাইলেও ও করতো না ।
আবার বললাম

-তোমার মেয়েটা এতো মিষ্টি হয়েছে ! একদম তোমার মত । দেখতেও হয়েছে একদম তোমার মত । জয়িতা হাসল । এর চোখ দুটোতে কেমন যেন একটা রহস্য দেখলাম । ও বলল
-সবকিছু কিন্তু আমার মত না । চোখ দুটো হয়েছে একদম ওর বাবার মত ।

আমি শশীর চোখের দিকে তাকালাম । আসলেই শশীর চোখ দুটো জয়িতার মত না । কেন জানি চোখ দুটো আমার বড় পরিচিত মনে হল । কার মত এই চোখ দুটো ! তবে যার মতই হোক বড় পরিচিত মনে হল । শশী এখনও আমার কোল থেকে নামে নি । আমাকে কেমন জড়িয়ে ধরে রেখেছে । হঠাৎ জয়িতা ওর মোবাইল দিয়ে আমাদের ছবি তুলল । বেশ কয়েকটা । আমি বললাম

-কি করছো ?
-আমার মেয়ের জন্য ছবি তুলছি ? তুমি যখন থাকবে না এই ছবি ওকে তোমার কথা মনে করাবে । আমি ঠিক মানে বুঝলাম না । কেবল হাসলাম । জয়ি শশীকে বলল
-মামনি তুমি একটু ভিতরে যাও ! আমি একটু আবীরের সাথে কথা বলি !
-আমি থাকি না আম্মু ! বাবার সাথেতো আর থাকতে পারবো না ।

কথাটা শুনে আমি ধাক্কার মত খেলাম । শশী কি বলল ! বাবা !! আমার ঠিক তখনই মনে পরে গেল শশীর চোখ দুটো কেন এতো পরিচিত মনে হচ্ছিল । আয়নার দিকে চোখ পড়লে যে ঐ দুচোখ প্রতিদিন আমি দেখি ।

আমার বুকের মধ্যে কেমন একটা অনুভুতি শুরু হল । আমি জয়িতার দিকে তাকালাম । জয়িতার চোখ দুটো কেমন যেন অস্বস্থির । এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে । জয়িতার খোজ পাচ্ছিলাম না কিছুদিন থেকেই । কোথায় যেন ডুব মেরেছে । ওর ফোনও বন্ধ । একদিন হঠাত্ করেই আমার বাসায় এসে হাজির । ঐ দিন বাসায় একলা ছিলাম । মা গ্রামের বাসায় গেছিল । রাত তখন প্রায় এগারটা বাজে । এমন সময় জয়িতা এসে হাজির । ওকে এতো রাতে আসতে দেখে খানিকটা অবাক না হয়ে পারলাম না ।

-এতো রাতে ? এতো দিন কোথায় ছিলি ? আর তোর এই অবস্থা কেন ? জয়িতাকে কেমন জানি এবনরমাল মনে হচ্চিল । একটু যেন টলছিল । জয়িতা বলল
-ড্রিংক করেছি ।
-মানে ? কেন?

আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম । কি বলে এই মেয়ে ? খানিকটা ধরেই ওকে ঘরের ভেতরে নিয়ে এলাম । ওর কেমন জানি হুস নাই মনে হল । আমাকে বিড় বিড় করে বলল

-খুব ঘুম আসরে আবীর । একটু ঘুম পাড়িয়ে দিবি ?
-আয় ।

ওকে নিয়ে শোবার ঘরের দিকে গেলাম । যাওয়ার পথেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরলে । যখন ওকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম জয়ি তখনও আমাকে ছেড়ে দিলো না । ঘোলা চোখ নিয়ে আমাকে বলল

-একটু আদর করবি আবীর ? আমার প্রথমে মনে হল ওর হয়তো হুস নেই তাই কি করছে না করছে তার ঠিক নেই । কিন্তু ওর চোখের দিকে যখন ভাল করে তাকালাম আমার পুরো শরীরটা কেমন যেন কেঁপে উঠল । আমি নিজেকে আর সংবরন করতে পারলাম না ।

সেদিন আমার কি হয়েছিল জানি না কিন্তু মনে হয়েছিল জয়িতাকে এর আগে কথনও এতো আপন করে ভালবাসি নি । রাতে ঘুমানোর আগে কেবল এই কথাটা মনে হল এই জয়িতাকে ছাড়া আমার চলবে না কিছুতেই । কিন্তু সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে জয়িতাকে আর দেখতে পেলাম না । কেবল আমার মোবাইলের নিচে চাপা দেওয়া এক টুকরো কাগজ পেলাম ওর । এলোমেলো হাতে লেখা অল্প কয়েকটা লাইন আর কয়েক ঘন্টা পরেই আমার ফ্লাইট । বাবা কাছে যাচ্ছি । তোকে ছেড়ে যাচ্ছি । কাল এ কথাটাই বলতে এসেছিলাম । যেন বলতে পারি তাই খানিকটা ড্রিংক করে এসেছিলাম । তবুও বলতে পারি নি । তারবদলে কি হয়ে গেল দেখ ! যাগ গে তুই টেনশন নিস না । যা হয়েছে ভালই হয়েছে । তুই ভাল থাকিস । আর আমার কথা মনে রাখিস । তোকে অনেক ভালবাসি । আমি কোন মতে বললাম

-শশী কি বলল আমাকে ? জয়ি চুপ করে থাকলো অনেকক্ষন ।
– কি ব্যাপার কথা বলছো না কেন? তারপর হঠাৎ করেই জয়ি কথা বলা শুরু করলো ।

-যখন বাবার কাছে পৌছালাম তখনও আমি ভেবে পাই নি আমি কিভাবে বেঁচে থাকবো । কিন্তু ওখানে যাবার কিছুদিনের মধ্যেই আমি টের পেলাম আমার মধ্যে কিছু একটা হয়েছে । যখন সিওর হলাম কি যে আনন্দ লাগছি আমার কাছে ! তুমি নেই তবুও তোমার অস্তিত্ব আমার কাছে আছে । আমার বাঁচার অবলম্বন ।

-আমাকে তুমি একবার জানাতে পারতা না ? জয়িতা হাসলো !

-তাহলে তোমাকে আটকানো বড় কঠিন হয়ে যেত । অনেক কিছু বলতে চাইলাম । কিন্তু তারপর মনে হল কি দরকার ? কি লাভ এখন এসব জিজ্ঞেস করে ! আমি কেবল শশীকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম । আমার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম । জয়িতা বলল

-শশী জন্মাবার পর থেকে আমার পুরো জীবনটাই যেন বদলে গেল । আমার পুরোটা সময়ই কাটতো ওকে নিয়ে । জানে ওকে যখন জয়িয়ে ধরতাম মনে হত যেন তোমার গন্ধ আমি পাচ্ছি ওর গা থেকে । আমি বললাম

-কোন অসুবিধা হয় নি তোমার ? না মানে তুমি একা একটা মেয়ে হয়ে …. ! জয়িতা হাসল ।

-নাহ ! তেমন কোন সমস্যায় পরতে হয় নি । বোঝই তো ওখানকার কালচারটা মোটামুটি এরকম । অবশ্য বাবা প্রথম প্রথম একটু নাখোস ছিল । কিন্তু পরে আর কিছু বলে নি । আমি বললাম সব

-তো ভালই চলছিল । তাহলে দেশে কেন এলে ?
-গত বছর শশী ওর বাবাকে দেখার জন্য খুব চিত্কার চেচামিচি শুরু করে দিল । স্কুলে সবার বাবা আসে ওর বাবা কেন আসে না । বাবা কই ? বাবা কই ? এই নিয়েই সারাদিন কান্নাকাটি চলত । তাই ওকে প্রমিজ করেছিলাম যে সামনের জন্মদিনে তোমার বাবাকে এনে দিবো । আমি কিছু বললাম না । শশীর দিকে তাকিয়ে রইলাম । কি শান্ত ভঙ্গিতেই না ও আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে । জয়িতা আবার বলল

-আমি ভেবেছিলাম ওর হয়তো মনে থাকবে না । কিন্তু শশী ওর বাবার কথা ভুলে যাই নি । এই বার আর কিছুতেই ওকে সামলাতে পারছিল না । তোমার মেয়ে না ? তোমার মতই হয়েছে । একবার কিছুতে হ্যা বললে আর না বলার উপায় নাই । আমি শশীকে কোলে নিয়েই বসে রইলাম অনেকক্ষন । কোন কথা বললাম না । কেবল বসেই রইলাম । খুব ইচ্ছা করছিল শশীর সাথে কথা বলি কিন্তু কোথা থেকে যেন একটা বাঁধা আসছিল বারেবার । যখন আমার ফেরার সময় হল শশীকে কোল থেকে নামালাম । শশী বলল

-তুমি কি এখন চলে যাবে ?

আমি কথাটার জবাব দিতে পারলাম না । কেন জানি মনে হচ্ছিল এখনই আমার চোখে পানি চলে আসবে । পকেটে যা টাকা ছিল প্রায় সবটুকু শশীর হাতে তুলে দিলাম । ওকে বললাম

-মামনি তোমার যা ইচ্ছে কিনে নিও । জয়িতা বলল
-কেউ কিছু দিলে থ্যাঙ্কিউ দিতে হয় !
-থ্যাঙ্কিউ । মা মেয়ে দুজনেই একদম নীচ পর্যন্ত এল আমাকে এগিয়ে দিতে । যাবার আগে জয়িতা আমাকে বলল

-আবীর তুমি মনে কখনও যেন কোন অপরাধ বোধ রেখো না । কেমন ! হয়তো তোমার সাথে থাকলে আমি আরো একটু ভাল থাকতাম । তবে এখন কিন্তু আমি খারাপ নেই । বরং অনেক ভাল আছি । তুমিও ভাল থেকো কেমন ।
আমি রিক্সায় উঠে পড়লাম । শশীকে বললাম

-ভাল থেকো মামনি ।
-তুমিও ।

মিষ্টি একটু হাসল । শশীর ঐ হাসিটুকু দেখে সত্যি বুকের মধ্যে কেমন যেন এক অজানা শূন্যতার সৃষ্টি হল । জয়িতা যখন আমাকে ছেড়ে গেছিল তখন যেমন ওর প্রয়োজনীতা অনুভব করতাম । আজও ওর অভাব অনুভুত হচ্ছে । ওদের দুজনের অভাব !

-ছার আপনে কানছেন ক্যান ?
-হুম কি বললে ? রিক্সায়ালার কথায় বাস্তবে ফিরে এলাম । চোখে হাত দিয়ে দেখলাম সত্যিই আমার পানি পরছে ।
-না ঠিক কাঁদছি না । চোখের মধ্যে কি যেন এসে পরেছে তাই পানি পরছে ।

রিক্সা এগিয়ে চলছে টুংটাং শব্দ করে । আমিও এগিয়ে চলেছি এক জীবনকে পিছনে ফেলে অন্য এক জীবনের কাছে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত