হোম টিউটর

হোম টিউটর

সকাল আটটা বাজতেই মোবাইলের এলার্ম বেজে উঠল। বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে গেল আহনাফ। তাড়াতাড়ি করে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হল। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই রেডি হয়ে নিল। বিছানায় তখনো নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে রাফসান। রাফসান হল আহনাফের রুমমেট, বন্ধু। আহনাফ টিউশন করিয়ে নিজের পরিবার চালায়। তার পরিবার মানে গ্রামে থাকা মা, ভাই, বোন। তার বাবা বেঁচে নেই।

বাড়ির বড় সন্তান হিসেবে সংসারের হালটা তাকেই ধরতে হয়েছে। রাফসানের বাবা-মা কেউই নেই। আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ও তার তেমন ভাব নেই। তার একমাত্র আপনজন বলতে আহনাফ-ই আছে। নয়টায় আহনাফের প্রথম টিউশন। তাই আটটায় ঘুম থেকে উঠে পড়ে। রমজান মাস হওয়ায় খাবার নিয়ে তেমন কোনো বাড়তি ঝামেলা নেই বললেই চলে। রাফসানের অফিস সাড়ে নয়টায়। তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল আহনাফ।

পাবলিক বাসের ভীড় ঠেলে ছোট্ট একটি কোণায় জায়গা করে নেয় আহনাফ। পাঁচ টাকা ভাড়া দিলেই শম্পাদের বাড়ি। গরমের প্রচন্ডতা এবং মানুষের ভীড়ে আহনাফ শান্তি খুঁজে পায়না। তারপর ও পেটের দায়ে পাবলিক বাসকেই সম্বল করে নিতে হয়। শম্পা পড়ার টেবিলে বসা আছে। আহনাফ ঢুকতেই সে সালাম দিল। আহনাফ ক্লান্ত শরীরটাকে ফ্যানের নিচে এলিয়ে দিল। নিজের ক্লান্তিকে একটু দূর করে শম্পার পড়ার দিকে মনোনিবেশ করল। পড়ানোর মাঝখানে হুট করেই মোবাইলটা বেজে উঠল। রোদেলার কল। কেঁটে দিয়ে আবারো শম্পাকে পড়াতে লাগল আহনাফ। শম্পাদের বাসা থেকে বের হয়ে রোদেলাকে ফোন দিতেই সে রিসিভ করল। ‘হ্যালো, আহনাফ।’

– ‘হুম। বল।’ ‘টিউশনে ছিলা?’

– ‘হুঁ।’ ‘সেহেরী খাইছ?’

– ‘হুম। তুমি?’ ‘আমি ও খাইছি। আচ্ছা শুনো, আমার সাথে দেখা কর।’

– ‘এক্ষুনি?’ ‘হ্যাঁ, এক্ষুনি। ইম্পর্টেন্ট কথা।’

– ‘আমার টিউশন আছে। বিকাল তিনটায় আসতে পারি।’

‘আচ্ছা। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।’ কথা বলতে বলতে অনেক দূর হেঁটে এসেছে আহনাফ। সামনেই আকিফের বাসা। দ্বিতীয় টিউশনটা আকিফদের বাসায়। আকিফদের ঘরে ঢুকতেই আহনাফ লক্ষ্য করল আকিফ ঘুমুচ্ছে। একটু ডাক দিতেই জেগে উঠল সে। স্যারের সম্মুখে একমুখ লজ্জা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় আকিফ। তার বয়স এখনো পাঁর বছর। ফ্রেশ হয়ে এসে চেয়ার পেতে বসল। আহনাফের একটি দৈনিক কর্তব্য হচ্ছে আকিফের জন্য চকলের আনা। না আনলে পড়ালেখা বন্ধ। পকেটে চকলেট ছিল আগে থেকেই। বের করে আকিফের হাতে ধরিয়ে দিল। আকিফ একগাল হেঁসে বললঃ স্যার, আমি রোজা।’

– ‘ওমা! বল কি? সত্যি?’ ‘হ্যাঁ, স্যার।’

– ‘আকিফ তো বড় হয়ে গেছে। ইফতারের পর খেও।’

আকিফের মুখে আবারো লজ্জাসূচক হাঁসি। চকলেটটা নিয়ে খুশিমনে পড়তে লাগল। বিকাল তিনটা বাজতেই আহনাফ রোদেলার সাথে দেখা করার জন্য বের হয়ে গেল। রোদেলা বসে আছে ছোট্ট একটি বেঞ্চে। তার চোখ-মুখ কেমন যেন ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তার হাঁসিমুখটা খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে। আহনাফ গিয়েই তার পাশে ধপাস করে বসে পড়ল।  তারপর, রোদেলার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললঃ ‘এত জরুরী তলব কেন?’

– ‘আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।’ বলে রোদেলা একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘ছেলে কি করে?’

– ‘লন্ডনের একটি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক।’

‘বেশ ভালো। তাকেই বিয়ে করে ফেল।’ রোদেলার চিন্তিত মুখটা হঠাৎ করেই আরো বেশি চিন্তিত হয়ে উঠল। চোখ দু’টো গাঢ় লাল হয়ে উঠল। ইচ্ছে করছে আহনাফকে খুন করতে। কিন্তু তা করল না। নিজেকে সামলে নিয়ে বললঃ ‘আহনাফ, একটু বুঝার চেষ্টা কর। আমি তোমাকে ভালবাসি। ওই ছেলেকে না।’

– ‘কিন্তু, এইটা যে নিয়তি।’ ‘চল আমরা বিয়ে করে ফেলি।’ খুবই শান্ত গলায় বলল রোদেলা।

– ‘বিয়ে করে তোমাকে খাওয়াব কি?’ ‘তুমি যা খাবে। পারবে না আমার ছোট্ট আবদারগুলো পূরণ করতে?’

– ‘তুমি ভেবে বলছ তো?’ ‘হ্যাঁ। কালকেই তোমাকে বিয়ে করব।’

– ‘কোথায়?’ ‘কাল বিকাল চারটায় কাজী অফিসে যাবে। আমি থাকব।’

– ‘তোমার মনে হয় আরেকটু ভাবা উচিত।’ আমার অতশত ভাবার দরকার নেই। আমি তোমাকেই বিয়ে করব।’

– ‘আমার আরেকটি টিউশন আছে। আমি যাব।’

‘আচ্ছা। আমি ও গেলাম।’ রোদেলা উঠে চলে গেল। আহনাফের মাথায় নানা ধরণের চিন্তা এসে জট পাঁকাতে লাগল। চিন্তাভর্তী মাথা নিয়ে পুণরায় হাঁটতে লাগল সাহেদদের বাসার দিকে। সাহেদকে পড়িয়ে বাসায় চলে এল। ইফতার রেডি করতে করতে অনেক কিছু ভেবে নিল। রাফসান আসার পর দুইজন মিলে ইফতার সেরে নিল। নিরিবিলি রুম। দুইজন মানুষ বসে আছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। আহনাফ চুপিসারে বসে আছে। রাফসান পুরো দমে সিগারেট টানছে। সে আহনাফের মুখের দিকে তাকিয়ে বললঃ ‘তোর কি হয়েছে রে? এত নীরব ক্যান?’

– ‘রোদেলা বিয়ে করতে চায়।’ ‘কাকে?’

– ‘আমাকে। তার বাবা নাকি বিয়ে ঠিক করেছে। তাই, লুকিয়ে বিয়ে করতে চায়।’ ‘তাহলে, এখানে চিন্তার কি আছে? বিয়ে করে নে।’

– ‘বললেই কি সম্ভব?’ ‘হুরর বেটা। বিয়ে কবে করবে?’

– ‘কালকেই।’ ‘সত্যি?’

– ‘হুম রে।’

পরদিন সকালে যথানিয়মে ঘুম থেকে উঠে টিউশন শেষ করে বাসায় ফিরল আহনাফ। দুপুর দুইটায় অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলে এল রাফসান। দুইজন মিলে রেডি হয়ে রওনা দিল কাজী অফিসের দিকে। মাঝপথে রিক্সা থামিয়ে কিছু মিষ্টি কিনে নিল রাফসান। বিয়ে শেষ করে সবাই মিলে একসাথে ইফতার করে মিষ্টিমুখ করবে সেই আশায় মিষ্টিগুলো কেনা।

কাজী অফিসে এক ঘন্টা ধরে বসে আছে তারা। অপেক্ষা করছে। কিন্তু, অপেক্ষার প্রহর কাঁটছে না। আরো আধা ঘন্টা চলে গেল। রাফসান বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু, তা প্রকাশ করছে না। তার মুখ বেয়ে ঘাম ঝরছে। আহনাফ তখনো শান্ত-শীতলভাবেই বসে আছে। হুট করে মোবাইলে মেসেজ আসল। রোদেলার মেসেজ। সে লিখেছেঃ

‘আহনাফ, আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। কাল সারারাত আমি ভেবেছি। বুঝেছি, তোমাকে বিয়ে করে ভালবাসার জয় হবে, কিন্তু দুঃখ-দুর্সশার মাঝে সেই ভালবাসা হারিয়ে যাবে। সংসার করব। কিন্তু, কোনো শান্তি থাকবে না। ভালো থেকো। আমার থেকে ভাল কাউকে বেছে নিয়ে নিয়ে করবা। কষ্ট পেও না। আল্লাহ হাফেজ।’

মুহূর্তেই আহনাফের মুখ কালো হয়ে গেল। সে কাঁদছে, চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছেনা। বুকের ভিতরটা জ্বলছে। আচ্ছা, গার্লফ্রেন্ড হারিয়ে গেলে কি সবাই এভাবেই কষ্ট পায়? রাফসানের দিকে তাকাল আহনাফ। মাথা হেট করে বললঃ ‘রোদেলা অসুস্থ। আসবে না।’ রাফসান বুঝতে পারল। সে কিছু বলল না। উঠে দাঁড়াল। তারপর হাঁটতে শুরু করল। আহনাফ ও তার পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। নিজেকে হাসপাতালের বেডে শুয়া অবস্থায় আবিষ্কার করে আহনাফ। তার পাশে বসে আছে রাফসান। সে কাঁদছে। তার চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে। জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে সে রাফসানের দিকে তাকাল। রাফসান নিজেকে সামলে নিয়ে বললঃ ‘আজ তিনদিন পর চোখ খুললি।’

– ‘আমার কি হয়ছে?’

‘সেদিন রাতে বাসায় ফিরার পর হুট করেই তুই ফ্লোরে পড়ে যাস। তারপর, বাড়িওয়ালা আর আমি তোকে হাসপাতালে নিয়ে আসি। তিনদিন চলে গেল। তুই খুলিস নাই। আজ, আল্লাহর রহমতে’ নিমিষেই আহনাফ নিশ্চুপ হয়ে হয়ে গেল। পরদিন রাফসানই ঘুম থেকে আগে উঠল। উঠে আহনাফকে ডেকে দিল। যথারীতি শম্পাদের বাসায় চলে এল আহনাফ। প্রবেশ করতেই দেখল শম্পার মা বসে আছে। সম্মানার্থে সে সালাম দিল। মহিলা বসা থেকে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললঃ ‘কাল থেকে তোমার আর আসা লাগবে না। নতুন শিক্ষক ঠিক করেছি।’

– ‘কেন আন্টি? আমার কি কোথাও ভুল হয়েছে?’ ‘একনাগাড়ে কয়দিন আস নি?’

– ‘তিনদিন।’ ‘এই নাও তোমার গত মাসের বেতন।’ বলেই হাতে থাকা টাকাগুলো বাড়িয়ে দিল শম্পার মা।

– ‘কয় মাসের?’ ‘এক মাসেরই।’

– ‘এই মাসটা ও তো পূরণ হয়ে গেল। আর মাত্র তিনদিন।’

‘না না। এখনো তো পূরণ হয়নি। এক মাসের বেতনই নাও।’ আহনাফ কিছু বলল না। একটু ভাবল। তার মুখ দিয়ে অনেক কথা বের হতে চাচ্ছে। কিন্তু, সে কোনোভাবেই বের হতে দিচ্ছেনা। অবশেষে মুখের জড়তাকে কাঁটিয়ে সে বলে ফেললঃ

‘আন্টি, আমার এক টাকা ও লাগবে না। আমরা হোম টিউটররা মানুষ, রোবট নই। আপনাদের যেমন সুখ-অসুখ আছে তেমনি আমাদের ও আছে। আমরা ওসবের ঊর্ধে নই। রাখেন আপনার টাকা। দুই মাসের জায়গায় এক মাসের বেতন নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। বরং এই এক মাসের টাকা দিয়ে ঈদ উপলক্ষে আপনি একটা শাড়ি কিনে নিবেন। কোনোভাবে মনে করবেন না যে, টিউশনি হারিয়ে আমি এসব বলছি। আপনার যদি ভাল না লাগে, তাহলে আমাকে রাখবেন কেন? সেটা আপনার ব্যাপার। কারো কষ্টের টাকা মেরে খাবেন না। ভালো থাকবেন।’

বলেই আহনাফ পশ্চাৎদিকে হাঁটা শুরু করল। পিছু ফিরে মহিলার মুখের দিকে তাকাল। তার চেহারা অন্ধকার হলো না। ভ্রু কুঁচকাল না। ক্লান্তির ছাপ নেই তার চোখেমুখে। এই মহিলার কি সহ্যক্ষমতাটা একটু বেশিই? উনার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো স্ট্রোক করত। এসব ভাবতে ভাবতে সে হনহন করে বেরিয়ে গেল। আকিফদের বাসায় গিয়ে তাকে পড়াতে শুরু করল। হুট করেই পর্দার আড়াল থেকে মহিলার কণ্ঠে ডাক এলঃ ‘আহনাফ, তুমি কি অসুস্থ ছিলা?’

– ‘জ্বী আন্টি। তেমন বেশি না। ‘এখন সুস্থ?’

– ‘জ্বী।’ ‘ওষুধ খাচ্ছ নিয়মিত?’

– ‘জ্বী।’ ‘তিনদিন বাদেই তো ঈদ। বাসায় যাবেনা?’

– ‘যাব আন্টি।’ ‘আজকেই আকিফকে ছুটি দিয়ে দাও। বাসায় যাও, মায়ের কাছে কয়েকটা দিন থাক।’

– ‘আচ্ছা আন্টি।’

‘শুনো, তোমার এই মাসের বেতনের সাথে পাঁচশ টাকা বোনাস। আসলে, তোমার আঙ্কেল এই মাসে একটু বেশিই খরচ করে ফেলেছেন তো। তাই একটু কম হল।’

– ‘না আন্টি। সমস্যা নেই।’

মহিলা আবারো ডাক দিলেন, ‘আকিফ। এইদিকে আয় তো।’ আকিফ ভিতরে চলে গেল। ফিরে এল একটি খাম নিয়ে। যেই খামের আশায় বসে থাকে হাজারো টিউটর, হাজারো পরিবার। খামটা হাতে নিয়ে হাঁসিমুখে বেরিয়ে এল আহনাফ। আকিফের মা’কে সে কখনো দেখেনি। তবে শুনেছে তার মাতৃতূল্য ভাষা। এই মহিলার আচরণে বারবার মুগ্ধ হয় সে। বিকালে সাহেদদের বাসায় গেল। পড়ানো শেষ করে সাহেদকে বললঃ ‘সাহেদ তোমার আম্মুকে একটু ডাক তো।’ সাহেদ ভিতরে চলে গেল। একটু পর মাকে সাথে করে নিয়ে এল। আহনাফ সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ‘আরে, আহনাফ। বস বস।’

– ‘আন্টি, আসলে কথাটা বলতে একটু লজ্জা লাগছে। না মানে, এই মাসের টাকাটা কি আজকে দিতে পারবেন?’ আসলে হয়েছে কি! সাহেদের বাবা এই মাসে যা টাকা দিয়েছে সব দিয়ে শপিং করে ফেলেছি। তোমার টাকাটা আগামী মাসে দেই?’

– ‘আচ্ছা আন্টি। আমি যাই।’

বলে আহনাফ বেরিয়ে এল। সন্ধ্যাবেলা রুমে বসে আছে আহনাফ। তার মাথায় রোদেলার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। মেয়েটা এমন করল কেন? সে কি তাহলে এতদিন ভালবাসার অভিনয় করেছে? এসব ভাবতে ভাবতেই মোবাইলে মায়ের কল এল। কল কেঁটে দিয়ে সে কল ব্যাক করল।হ্যালো আম্মু, আসসালামু আলাইকুম। ‘

– ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।’ ‘কেমন আছেন আম্মু?’

– ‘ভালো। তুই?’ ‘আলহামদুলিল্লাহ।’

– ‘বাসায় কবে আসবি?’ ‘শীঘ্রই এসে যাব।’

– ‘রাকিব তোকে কি যেন বলতে চাচ্ছে। নে। কথা বল।’ ফোনের ওপাশ থেকে বলে উঠলঃ ‘ভাইয়া, আসসালামু আলাইকুম।’

– ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।’ ‘ভাইয়া, আমার জন্য একটা নীল রংয়ের পাঞ্জাবী আনবে।’

– ‘আচ্ছা। আনব। পড়ছিস তো ভাল করে?’ জ্বী।’

– ‘মাহিয়া আছে? ওকে দে তো’ ‘হ্যাঁ।’ মাহিয়া ফোন নিয়ে সালাম করল। আহনাফ সালামের উত্তর দিয়ে বললঃ কেমন আছিস?’

– ‘ভালো। তুই?’ ‘ভালো। তোর না সামনে জেএসসি পরীক্ষা? পড়ছিস কেমন?’

– ‘এইতো ভাইয়া ভালো।’ ‘রাকিব দুষ্টুমি করে?’

– ‘হ্যাঁ। তুই কবে আসবি?’ এইতো। তোর কিছু লাগবে?’

– ‘না।’ কি লাগবে বল।’

– ‘আমার আছে। লাগবে না।’ আম্মুকে দে।’ মা ফোন নিল। ‘হ্যাঁ, বাবা। বল।’

– ‘আপনার কিছু লাগবে?’ ‘না।’

– ‘কি যে বলেন?’ ‘তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়।’

– ‘আচ্ছা। আম্মু, আসসালামু আলাইকুম।’

আহনাফ জানে মা’য়ের কিছুই নেই। তারপর ও থাকার অভিনয় করছে। বোনের অনেক কিছুর প্রয়োজন আছে। তবুও মুখ ফুটে বলবে না। আচ্ছা! মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষগুলো কি এভাবেই না থেকে ও থাকার অভিনয় করতে পারে? কথা শেষ হতে না হতেই রাফসান রুমে ঢুকল। হাতে তার জ্বলন্ত সিগারেট। আহনাফকে বললঃ ‘চল তো। একটু মার্কেটে যাব।’

– ‘কেন?’ ‘আরেহ্! চল না।’

– ‘আচ্ছা। চল।’

একটি নীল রংয়ের শাড়ি, একটি নীল পাঞ্জাবী, আরেকটি নীল থ্রী-পিচ কিনে নিল রাফসান। সব কয়টা জিনিসই আহনাফের পছন্দ করা। বাসায় এসে আহনাফ বললঃ ‘দোস্ত, তুই থাক। আমি আবারো মার্কেটে যাব।’

– ‘কিজন্য?’

‘মা, ভাই, বোনের জন্য কিছু কেনাকাটা করব।’ রাফসান আর কিছু বলল না। আহনাফ রুম থেকে বের হতে যাবে এমন সময় বললঃ ‘আহনাফ, কাপড়গুলো তোর পছন্দ হয়েছে?’

– ‘কোনগুলো?’ ‘এই যে। এখন কিনে আনলাম।’

– ‘আমি পছন্দ করেই তো কিনলাম।’ নে। এইগুলো রাখ। মা, রাকিব আর মাহির জন্যে।’

– ‘কি বলিস এসব?’

‘তুই যদি কাপড়গুলো না নিস তাহলে তোকে আর কোনোদিন বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিব না।’ আহনাফ কিছুই বলতে পারল না। তার দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। রাফসানকে বুকে জড়িয়ে ধরল। ‘রাফসান তোর এই ঋণগুলো কেমনে শোধ করব?’

– ‘তোর মা’কে মা ডাকার অধিকার দিবি? তোর ভাইকে ভাই ডাকার অধিকার, বোনকে বোন ডাকার অধিকার দিবি?’

‘হ্যাঁ।’

– ‘যা। তোর ঋণ পরিশোধ।’ বলেই রাফসান হাঁসতে লাগল। আহনাফ মোবাইল বের করে মাকে ফোন দিল।

‘হ্যালো আম্মু। আমি বাসায় আসব। আজকেই আসব।’

– ‘আচ্ছা। আয়।’

‘আমি একা না। আমার সাথে আপনার আরেকটা সন্তান আসবে। যে আপনাকে মা ডাকবে। তাকে কি অধিকার দিবেন?’

– ‘হ্যাঁ। বাবা, নিয়ে আয় আমার ছেলেকে।’

‘সে কে বলেন তো।’

– ‘কে আর? রাফসান।’

‘হি হি। কেমনে বুঝলেন?’

– ‘মা’য়েরা সবই বুঝে।’

‘আচ্ছা, আম্মু। রাখি। আমরা একটু পরই গাড়িতে উঠব।

– ‘আচ্ছা। ফি-আমানিল্লাহ।’

রাফসান আর আহনাফ ব্যাগ গুছিয়ে নিল। রুম তালা মেরে অন্ধকার রাস্তা বেয়ে হাঁটতে লাগল। একটু হাঁটলেই স্টেশন। সেখান থেকে বাসে করে সোজা বাড়ি। দুজনের মুখেই আনন্দমাখা হাঁসি। অন্ধকার তাদের হাঁসিকে লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু, কোনোভাবেই তাদের মনের আনন্দকে লুকাতে পারছে না।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত