মধ্যরাতে চ্যাটিং শেষ করার আগমূহূর্তে মেয়েটা বললো- ভাইয়া, আয়াতুল কুরসী পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে ঘুমান প্লিজ।।
আমি একটু থতমত খেলাম, কারণ আমি আয়াতুল কুরসী পারি না।। আমি মেয়েটাকে বললাম- নিপা, আমি আয়াতুল কুরসী পারি না তো।। পরে শিখে নিবো।। নিপা বললো- আচ্ছা, আমি লিখে দিচ্ছি, একবার পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।। খানিক বাদে নিপা পুরো আয়াতুল কুরসী লিখে দিলো ইনবক্সে।। আমি বিড়বিড় করে পড়ে নিলাম, বুকে ফুঁ দিয়ে, তারপর নিপাকে বললাম- ধন্যবাদ আপনাকে, আজকের মত ঘুমাই।। নিপা বললো- আচ্ছা, শুভ রাত্রি!!
আজ নিপা মেয়েটার সাথে প্রথমবার চ্যাট হলো।। সেই আনুমানিক রাত ১২ টা থেকে টানা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত আমরা চ্যাট করে গেলাম- কি অদ্ভুত এক ব্যাপার!! সাধারণত বেশি চ্যাট করতে গেলে আমার হাত ব্যাথা হয়, তবে আজ কেনো যেনো হাত ব্যাথার চেয়ে আনন্দই বেশি লাগলো।। রাত অনেক হয়ে গেছে, ঘুমিয়ে পড়া দরকার!! আসলে মাসখানেক আগে আমার এক্স গার্লফ্রেন্ডের সাথে আমার ব্রেকাপ হয়ে গেছে।। ওর নাম ছিলো ইভা, ইভাকে আজও ভুলতে পারি নি।। মেয়েটা জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির ছিলো।। কি নিয়ে ব্রেকাপ সেটা আর নাই বলি- শুধু বলি- এক হাতে তালি বাজে না।। আমারও কম বেশি ভুল ছিলো।। ইভা চলে যাবার পর, আজ এই নিপার সাথেই প্রথম এত কথা হলো চ্যাটিংয়ে।।
গত জন্মদিনে ইভা আমাকে একটা, ট্রিমার গিফট করেছিলো।। ট্রিমারটা ভালোই কাজে দিচ্ছে।। এখন আর দাঁড়ি কাটতে সেলুনে যেতে হয় না।। নিজের ট্রিমার দিয়েই ইচ্ছামত দাঁড়ি স্ট্যাইল করতে পারি।। ফিলিপস ব্যান্ডের দামী ট্রিমার, খুব শখের বস্তু হয়ে গেছে এটা আমার।। আজ একটু আগে, রুমে হঠাৎ করে তমালের আগমন।। তমাল আমার ব্যাচেলর বাসার হোমমেট।। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তমাল আমাকে বললো- ভাই আপনার ট্রিমারটা একটু দিবেন!! বাসার প্রায় সব সদস্যরা আমার কাছ থেকে মাঝে মাঝেই সাবান, শ্যাম্পু, টুটপেস্ট নিয়ে নিয়ে ব্যবহার করে। একজন অসহায় ব্যাচেলর হিসেবে আমি মেনে নিয়েছি এই অত্যাচার।। কিন্তু, কেউ আমার শখের ট্রিমার চাইবে- এটা ভাবি নাই।। আমি বিরক্তি নিয়েই বললাম- ট্রিমারে চার্জ নাই, তমাল।। তমাল আমার কথাকে অগ্রাহ্য করেই বলে- ভাই দেন, আমি চার্জ দিয়ে নিতেছি।।
আমি বিছানায় আধা শোয়া হয়ে ছিলাম।। হাত দিয়ে টেবিলের উপর নির্দেশ করলাম।। তমাল খুশি মনে, চার্জার সহ ট্রিমারের পুরো সেট নিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো।। আমার খানিকটা মন খারাপ হলো বটে, আবার ভাবলাম থাক ছোট ভাই, একদিন শখ করে ট্রিমার দিয়ে দাঁড়ি কাটবে, কাটুক।। বেশ কিছুক্ষণ পর আমার মাথায় অন্য একটা চিন্তা আসলো।। আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে তমালের রুমে গেলাম, গিয়ে দেখি তমাল রুমে নেই।। রুমের সাথে লাগোয়া বন্ধ বাথরুম থেকে কলের পানির আওয়াজ আসছে।। টেবিলে রাখা ট্রিমারের চার্জার, অথচ ট্রিমার নেই।। তমাল হয়তো ট্রিমার নিয়েই বাথরুমে ঢুকে গেছে।।
আমি মোবাইল বের করে গতকাল বিকেলে আমার আর তমালের তোলা সেলফিটা চেক করলাম- ছেলেটার গাল কি মসৃণ, একটা দাঁড়িও ঠিকমত জ্বালায় নাই মুখে।। ট্রিমারটা সোজা ফি সা বি নি ল্লা হ! নিপার আইডি আজ কয়েকদিন ধরে ম্যাসেঞ্জার সহ ডিএক্টিভেট।। ওই একদিনি ওর সাথে চ্যাট হয়েছিলো।। কিন্তু, একদিনের দীর্ঘ চ্যাটিংয়েই, নিপাকে নিয়ে মনের মধ্যে শত শত লাড্ডু ফুটেছিলো।। অথচ নিপার আইডিটা ফেসবুক থেকে বেমালুম গায়েব।। এদিকে চ্যাট করে টাইম পাস করার নেশা ধরে গেছে।।
হঠাৎ নীলান্তি নামে একজনের সাথে চ্যাটিং জমে গেলো।। বিগত কয়েক দিন ধরে ফেসবুকে নীলান্তির সাথে ধুমাইয়া চ্যাট হচ্ছে।। মেয়েটা চ্যাটিংয়ে এত সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে, প্রেমে না পড়ে উপায় নেই।। কিন্তু, আমার মত লোক শুধু কারো সাথে চ্যাটিং করেই প্রেমে পড়া টা বড্ড বেমানান।। ব্রেকাপের পর এখন কাউকে সত্যিই ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে।। ধীরে ধীরে ম্যাসেঞ্জারে সবার সাথে আলাপ বাদ দিয়ে নীলান্তিময় হয়ে গেলাম।। রাতের পর রাত পার হচ্ছে ওর সাথে চ্যাটিংয়ে কথা বলে। কথার পিঠে কথা, কথার ভাজে কথা, কথার পর কথা চলতেই আছে।। আজ কয়েকদিন হলো, আমাদের মধ্যেকার কথার গভীরতা একদম খাদের কিনারায়- যে কোন সময় আমি খাদে পড়ে, মরে টরে যেতে পারি।।
একদিন, নীলান্তি আমাকে বললো- আচ্ছা, শোভন তুমি কি স্মোক করো?? আমি বললাম- বছর দেড়েক ধরে করি।। নীলান্তি বললো- কেন করো শোভন?? ছেড়ে দাও, এটা আমার পছন্দ না।। আমি ওর এইসব আবদার মাখা কথা শুনতে শুনতে মনে মনে অনেক খুশি হই।। ওকে লিখলাম- সিগারেট ছেড়ে দিবো নীলান্তি, তবে আমার অদ্ভুত একটা ইচ্ছা পূরণ হলে।। নীলান্তি বললো- কি ইচ্ছা, বলো না।। আমি লাজুক ভংগিতে লিখে গেলাম- যে দিন কোন একজন আমার এই নিকোটিনে পোড়া কালো ঠোঁটে চুম্বনের উষ্ণতা দিবে, সেদিন থেকে এই ঠোঁটে আর জলন্ত সিগারেটের ঠাঁই হবে না।।
নীলান্তি চুপ হয়ে আছে, ম্যাসেজ সিন করে রেখে দিয়েছে।। আমি উত্তেজনায় কাঁপছি- কি না কি জবাব দেয়।। নীলান্তি কিছুক্ষণ পর ম্যাসেজের রিপ্লাই দিলো-এই যে কবি মার্কা লেখক ভাই শুনেন, আপনে দয়া কইরা ভারত চইলা যান- অইখানে নতুন আইন হইছে।। পোলায় পোলায় কিসাকিসি সম্ভব, বাংলাদেশে এইডা সম্ভব না।। কারণ,আমি স্রেফ একটা ফেক আইডি।। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমাকে দিয়ে আর প্রেম পিরিতি হবে না।। আমার একটু রিফ্রেশমেন্ট দরকার।। ভাবলাম এই সুযোগে একা একা বগুড়া ঘুরে আসি।। মহাস্থানগড় দেখবো, আর বগুড়ার বিখ্যাত দই খাবো।। যেই ভাবা সেই কাজ।। বগুড়া চলে গেলাম কাউকে না জানিয়েই।। বগুড়া চারমাথা নেমে শুরুতে গেলাম সেঞ্চুরি মোটেলে, এক দুই রাত থাকার জন্যে।। কিন্তু ভুলে ভোটার আইডি কার্ড আনি নি, আইডি কার্ডের ফটোকপি ছাড়া নাকি এখন লোক রাখেই না।। কি বিপদ!!
সেখান থেকে ব্যর্থ হয়ে সস্তা এক হোটেলে গেলাম।। কোনরকম এক দুইরাত কাটাতে পারলেই হয়।। হোটেলে নাম রেজিস্ট্রেশন করার পর ম্যানেজার আমাকে আস্তে করে কানের কাছে মুখ রেখে বলে- ভাইজান দেশি বিদেশি কচি যা লাগবে বইলেন?? রুমে চলে যাবে।। এই কথা শুনে ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো আমার।। এসব কাজের ধারে কাছেও নাই আমি।। ভয় আড়াল করতে উল্টা ম্যানেজারকে ধমক দিয়ে বললাম- আমাকে দেখে কি এমন মনে হয়, ফারদার আমাকে এসব বলবেন না।৷ আপনাদের হোটেলে এখন থাকতেই ইচ্ছে হচ্ছে না।। ম্যানেজার অনুরোধ করে মাফ চাইলো।৷ আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।।
রাত ৯ টার দিকে হোটেল থেকে বেরুচ্ছি, ডিনার করার জন্যে।। ম্যানেজার জিজ্ঞেস করে- ভাই কই যান?? আমি বললাম- কিছু খেয়ে আসি বাইরে থেকে।। ম্যানেজার খানিক ভেবে বললো- কি খাবেন আপনি, টাকা দেন আমি লোক দিয়ে আনিয়ে আপনার রুমে পাঠাই দেই।। আপনি রুমে গিয়ে আরাম করেন।। আমি ম্যানেজারের ব্যবহারে খুব খুশি, ব্যাটা আমার ধমকে সেই ভয় পাইছে নিশ্চিত।। আমি ১০০ টাকা দিয়ে বললাম- তেল ছাড়া তিনটা পরোটা, ডিম মামলেট, সবজি মিক্স আর এক লিটার পানি আনতে পাঠান।।
রুমে বসে আছি, রুমবয় দরজায় টোকা দিলো।। দরজা চাপানোই ছিলো, ভিতরে ঢুকে বলে- স্যার এই যে আপনার পানি, সবজি, ডিম আর পরোটা।। আমি খুশি হয়ে গেছি ওদের ব্যবহারে।। রুমবয় খুচরা টাকা ফেরত দিতে যাবে, আমি বললাম- রেখে দাও।। দিতে হবে না।। রুমবয় আমাকে বললো- স্যার আমার নাম্বার রেখে দেন।। রাতে যে কোন দরকারে কল দিয়েন!! রাতে খাবারগুলো খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।। কাল সকালে উঠে মহাস্থানগড় যাবো।। আগে কোনদিন যাই নি।।
হঠাৎ, শরীর খারাপ লাগছে।। অদ্ভুত এক অনুভূতিযুক্ত খারাপ।। আমি যে বগুড়ায় আছি- এটা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না।। ভয় লাগছে মরে টরে গেলে কেমন হবে।। আমি রীতিমত হাঁসফাস করছি।। হৃদকম্পন বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে।। বিছানায় ছটফট করছি, সমানে এপাশ ওপাশ করছি।। কেমন যেনো শরীর ঝিম ঝিম করে কাঁপছে।। এমন শরীর খারাপ লাগা আগে হয় নি।। আমি সোজা বাথরুমে চলে গেলাম- কল ছেড়ে মাথায় পানি দিলাম।।
সকালে হোটেল থেকে বের হচ্ছি।। ম্যানেজার আর অই রুমবয় আমার দিকে তাকিয়ে কি যেনো পর্যবেক্ষণ করছে।।
আমি রুমের চাবি জমা দিয়ে মহাস্থানগড়ের দিকে যাবো ভাবলাম।। দই টই খেয়ে ঘুরে ফিরে রাতে হোটেলে ব্যাক করবো।।
বাইরে বেরিয়েই হঠাৎ মনে হলো, রুমে মানিব্যাগ ফেলে এসেছি।। হোটেলে ঢুকতে যাবো কেন যেনো মনে হলো- আমাকে নিয়ে ম্যানেজার আর হোটেলবয়ের মধ্যে হাসাহাসি হচ্ছে।। আমি আড়াল থেকে স্পস্ট শুনতে পাচ্ছি, হোটেল বয় বলছে-স্যার ৩০৪ নাম্বার ঘরের অই ছোড়ার সবজিত ভায়াগ্রো মিশানু তাও শালা ক্যানকারে সহ্য কোরা আছলো?? ম্যানেজার অট্টোহাসি দিয়ে বিদ্রুপের সুরে বললো- ছোড়াডা মনকয় হিজল্যা!! বগুড়া থেকে ফিরে সোজা জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে গেলাম।। ইভা লাইফ থেকে চলে যাবার পর থেকেই একটার পর একটা ঝামেলা চলছেই।। ভাবলাম হাতে পায়ে ধরে ব্রেকাপের সমাধান করি।। ও ফিরে এলেই আমার সব ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে।।
ইভাকে নিয়ে জাবি ক্যাম্পাসের শুকনা সুইমিংপুলের ওখানে বসে আছি।। অনুনয় বিনিনয় করে, ইভাকে বললাম- আমি তোমাকে ফেরত পেতে চাই।। আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ, আমি আর পারছি না তোমাকে ছাড়া চলতে।। আর হ্যাঁ, ক’দিন পরেই আমার জন্মদিন, বলো বাবু এইবার আমাকে কি গিফট দিবা- আগের ট্রিমারটা না হঠাৎ নস্ট হয়ে গেছে।
ইভা আমার চোখে চোখ রেখে বললো- নীলান্তির কাছে চাও জন্মদিনের গিফট, আমাকে বলো কেনো।। আর, আয়াতুল কুরসী মুখস্ত করে আসো আগে, পরে আমাকে ফেরত চাইতে আইসো।।