ঘুম ভাঙ্গার পর দেখি মুখের বাঁ পাশটা বেয়ে লালা গড়িয়ে পড়ে মায়ের বালিশটা ভিজে গেছে। খুব সাধারণত আমি দুপুরে ঘরে থাকি না। ঘরে থাকলেও ঘুমাই না। আজকে মায়ের পাশে শুয়ে মোবাইলে একটা নতুন মেয়ের সাথে মেসেজিং করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, নিজেও জানি না!
মেয়েটা পিচ্চি। স্কুলে পড়ে। ইদানিং স্কুলে পড়া বাচ্চা মেয়েরা খুব নক দিচ্ছে। ইদানিংকালের এ বয়েসি বাচ্চা মেয়েরা খুব বাচ্চা বাচ্চা হয়। ওরা শুরুতে সৌজন্যতার খাতিরেও ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করে না। তুমি বলে-ই ডাকে। এ ডাকটায় এতটা মায়া থাকে যে আপনার শুরুতেই ওর সাথে প্রেম করতে ইচ্ছে করবে। ইচ্ছে করবে ওর সাথে খোলা রাস্তায় হেঁটে হেঁটে বাদাম খেতে। ৫ টাকার ঝালমুড়ি কিনে ওর হাতে দিতে। ও একটু করে নিজে খাবে, আর বেশি করে খাইয়ে দেবে। কখনও স্কুলের হোমওয়ার্কের কথা বলবে। কখনও উপপাদ্য বুঝিয়ে দিতে বলবে।
“হ্যালো ভাইয়া।”
“হাই।”
“কেমন আছো ভাইয়া?”
“ভালো। তুমি?”
“খুব ভালো। আমি না তোমার লেখার অনেক ফ্যান। কি করে লিখো?”
“কি জানি!”
“তুমি কি ভাইয়া ডাকায় রাগ করলে?”
“কেন রাগ করবো?”
“ভাইয়া ডাকলে সবাই রাগ করে তো, তাই।”
“ওরা জানে না, মেয়েরা প্রেমিকের সাথে প্রথমে ভাইয়া সম্বোধন করে-ই কথা শুরু করে।”
“ভাইয়া।”
“হুম”
“তুমি না গতপরশুদিন আমার বান্ধবীকেও একই কথা বলেছিলে!”এরপর কি রিপ্লাই দেবো তা ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি।
টিশার্ট দিয়ে মুখ আর বালিশের লালা মুছে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি, মেয়েটা অনেক অ্যাপোলজিমূলক মেসেজ পাঠাতে পাঠাতে, আর সরি লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। ওর ধারণা আমি ওর উপর রাগ করে রিপ্লাই করছি না। আমার রাগ ভাঙ্গানোর প্রচেষ্টা করতে করতে মেয়েটা নিজে-ই রাগ করে ফেলেছে। মেয়েটাকে আর রিপ্লাই দিলাম না। ভবিষ্যতে কখনো কথা হলে মেয়েটার রাগ ভাঙ্গাবো। স্কুলে পড়া মেয়েদের রাগ ভাঙ্গানো একটা খুব বিপদজনক আর্ট। তাই সবসময় এটা ট্রাই না করা-ই ভালো।
সৌরভ এতক্ষণে বেশ কয়েকবার নক করেছে। একটা ফুড কার্টে অফার দিয়েছে, চিকেন মাসালা ৬০ টাকার এক প্লেট, সাথে আনলিমিটেড লুচি ফ্রি। শীত আসি আসি করছে বলে স্নান করতে আলসেমি ধরে যাচ্ছে। সকালে ভাবি বিকালে স্নান করবো, বিকালে ভাবি রাতে। আর রাতের বেলায় ভাত খেয়ে কুলকুচিও এমনভাবে করতে হয়, যেন ঠোঁটে জল না লাগে!আজও ভেবেছিলাম দুপুরে স্নান করবো। পরে দুপুরে ভাবলাম ভাতটা খেয়ে নিই। ভাত খেয়ে তো ঘুমিয়ে-ই গেলাম। এখন সৌরভের লুচির অফার স্নান করতে দিলো না।
পৃথিবীতে যুগে যুগে হাতে গোণা কয়েকজন মহাপুরুষ জন্মায়। সেসব মহাপুরুষদের গায়ে কখনো গন্ধ হয় না। ওরা টয়লেটে গেলেও গন্ধ হয় না। এমনকি এদের পাঁদেও কোন গন্ধ থাকে না। বগলে নিভিয়া ম্যানের ডিওডোরেন্ট ভালো করে মেখে জিন্স আর টিশার্ট পরে বের হয়ে গেলাম। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মোবাইলের ডাটা অন করতেই দেখি গতপরশু নক দেয়া স্কুলের মেয়েটা আবার নক দিয়েছে।”এই ভাইয়া এই” “বলো” “তুমি না দেখতে একটা বিড়ালের ছানার মতন” “কে বলেছে?””কে বলবে? দেখি না আমি?” “তো আমি কি করতে পারি?” “যাও, একটা আয়নার সামনে যাও। গিয়ে বিড়ালের মতন করো।
বলো, ম্যাও ম্যাও ম্যাও… আমি একটা বিড়াল। আমি সারাদিন ঘুরি, নাচি, চুরি করে বেড়াই। তাই মানুষ আমাকে পিটায়। পিটানি খেয়েও লাভ হয় না, পরদিন আমি আবার চুরি করি।””আর?” “আমি ভাত, মাছ আর কাঁটা খাই। মাঝে মাঝে বিস্কিট খাই। তাও আমার পেট ভরে না। ঘরে ঘরে চুরি করি।” “তোমার হয়তো খুব পিটানি খাবার সময় হয়েছে মেয়ে।” “তুমি আরো বলবা। কি বলবা জানো? আমার শীত খুব বেশী। শুধু আমি না, সব বিড়ালের শীত বেশী। আমরা দুই তিন দিনেও স্নান করি না।” আমি একমুহূর্তের জন্য থমকে গেলাম!এ মেয়ে কি করে জানলো আমি গত কয়েকদিন স্নান করি নি! অদ্ভুত তো!
আমার বোধহয় মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি মোবাইলের ডাটা কানেকশন অফ করে দিয়ে ৬ নম্বর বাসে উঠলাম। বাসের সিটে বসার জায়গা নেই। দাঁড়িয়ে কানে হেডফোন গুজে দিয়েছি। কোন গান বাজছে না। তবুও কানে হেডফোন লাগানো থাকলে কোন যাত্রা তেমন লম্বা মনে হয় না।
সৌরভকে একটা কল দিলাম। ও আগ্রাবাদে দাঁড়িয়ে আছে। আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কল রাখতে-ই সামনের মেয়েদের সিটের দিকে চোখ পড়লো। একটা বেশ সুন্দরী মেয়ে বেশ উঁকিঝুকি দিচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার দিকে-ই দেখছে। হয়তো আমায় ওর চেনা কেউ-ই মনে হচ্ছে। আমি ওদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। কোন সুন্দরী মেয়ের দিকে আপনি বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারবেন না। চোখ কেমন যেন করবে। বুক কেমন যেন করবে। মন কেমন যেন করবে।
আর মেয়েটি যদি আপনার দিকে তাকিয়ে থাকে তখন আপনি এক সেকেন্ডও ওর দিকে তাকাতে পারবেন না। আপনার সারা শরীর কেমন যেন করবে! আগ্রাবাদ আখতারুজ্জামান সেন্টারের সামনে নেমে গেলাম। সৌরভ দাঁড়িয়ে আছে। সৌরভের সাথে কর্পোরেট হ্যান্ডসেক করে লুচি মাংসের ফুড কার্টের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে ডাটা কানেকশন অন করে দেখি বেশ কয়েকটা নতুন মেসেজ এসেছে। একটা ফুলের ছবির প্রোফাইল পিকচারওয়ালা আইডি থেকে মেসেজ এসেছে, “ভাইয়া? আপনি কি আগ্রাবাদের বাসে দাঁড়িয়ে আছেন?
এটা কি আপনি?” সৌরভ আর আমার জন্য দু’প্লেট চিকেন মাসালা আর লুচি অর্ডার দিলাম। ফুড কার্টের ছেলেটা হাসি হাসি মুখ করে বললো, “ভাইয়া, আগে রিভিউটা যদি… ইয়ে মানে..” সৌরভ বললো, “ওকে ব্রো! নো প্রবলেম!” আমি ফুড মনস্টারে রিভিউ দিতে দিতে সৌরভ পাঁচটা লুচি খেয়ে ফেললো। তখনও আমি ঠিকভাবে শুরু করি নি। আমি শুরু করলাম। আমি খাচ্ছি আর ফুডকার্টওয়ালা লুচি দিচ্ছে। প্রথমে দুইটা করে করে দিচ্ছিলো। তারপর দেখি একটা করে করে দিতে শুরু করলো। বললাম, “ভাই! শুধু একটা করে লুচি দিচ্ছেন?”
বেচারা বিরক্ত হয়ে তিনটা লুচি দিয়ে দিলো। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছে ও খুব চায় আমার এ মুহুর্তে ডায়রিয়া শুরু হোক। সৌরভ ৭ টা খেয়ে-ই থেকে আছে। আমার এখনও থামার ইচ্ছে নেই। কিন্তু সৌরভ খুব বিরক্ত হচ্ছে। বিরক্ত হয়ে বলে-ই দিলো, “এবার বন্ধ কর। চল গিয়ে চা আর বিড়ি খাই।”
সিগারেটের একটা আশ্চর্যজনক বিষয় আছে। এর কথা আপনি যতক্ষণ ভুলে থাকবেন, ততক্ষণ আপনি সুখে থাকবেন। মনে পড়লে-ই একে আপনার সে মুহূর্তে-ই লাগবে। অন্য আর কিছু-ই ভালো লাগবে না। বিখ্যাত প্রেমতত্ত্ববিদ অ্যাভান্টোস ডেভনাটো তার “Love at first Cigarette” বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় লিখেছিলেন, “তুমি হয়তো প্রেমিকাকে চুমো খেতে খেতে হাঁপিয়ে পড়বে, কিন্তু সিগারেট চুষতে চুষতে কখনও টায়ার্ডনেস আসবে না।”
মাত্র দশটা লুচি খেয়ে যখন ফুডকার্টওয়ালার কাছে টিস্যু চাইলাম, ওর মুখে যে প্রশান্তির ছোঁয়া দেখলাম, তা হয়তোবা বহুদিন আমাশয়ে জর্জরিত বুড়োটা হঠাৎ প্রশান্তির একগাঁদা টয়লেট করেও মুখে আনতে পারে না!
আই মিন প্রশান্তির ছোঁয়া টা।
ও হয়তো বিশ্বাসই করতে পারছিলো না, আমি এত দ্রুত থেমে গেছি! আমার পেটটা নরমাল-ই আছে। সৌরভের টা যুদ্ধবিধ্বস্ত কোন অঞ্চলের ক্ষুধায় জর্জরিত কৃমি আক্রান্ত শিশুটার পেটের মতন ফুলে আছে। প্রতিবার সিগারেটের টান দেবার সাথে সাথে ওটা ফুলে উঠে, আবার ধোয়া ছাড়ার সাথে সাথে নেমে যাচ্ছে। খেয়াল করলাম, সৌরভও আমার পেটের উঠা নামা দেখছে। মানুষ কখনও নিজের পেট বড় হলে তা বুঝতে পারে না। সৌরভের চোখে হয়তো মনে হচ্ছে আমার পেট ফুলে উঠেছে, ওর নিজের টা ফ্ল্যাট মনে করছে।
বাসে উঠে বাসায় ফিরে আসছি। ডাটা কানেকশন অন করে দেখি দুপুরের সেই মেয়েটা আবার নক দিয়েছে। “ভাইয়া। এবার যদি তুমি রিপ্লাই না দাও, তাইলে আমি তোমার সব পোস্টে হা হা রিয়েকশন দেবো।”
আমি ওকে রিপ্লাইয়ে একটা লাভ ইমোজি পাঠিয়ে দিলাম। বুদবুদের মতন শব্দ করে মোবাইলের ডিসপ্লে জুড়ে হৃদপিন্ড উড়ে চলে গেলো। মেয়েটা হয়তো উড়ে যাওয়া হৃদপিন্ডগুলো থেকে একটাকে ধরে রেখেছে। ধরে রাখার-ই কথা। এ বয়েসি বাচ্চা মেয়েরা খুব বাচ্চা হয়।