– আবার পিছন পিছন আসছেন?
:- পাশাপাশি আসবো?
:- আমি বলেছি আসতে?
:- তবে কাছাকাছি আসি?
:- চুপ একদম চুপ!
:- রাগলেও আপনাকে বেশ মিষ্টি লাগে! আচ্ছা আপনি কখন কখন রাগেন?
:- আপনি তো ভয়ংকরমাত্রায় বেয়াদপ!
:- আমার আম্মু ও তাই বলে!
ছেলেটা যে বড় মাপের অভদ্র সে ব্যাপারে অণিমার কোনো সন্দেহ নেই। কারণ প্রতিদিনি কোনো মেয়ের পিছন পিছন হাঁটাকোনো ভদ্রতার মধ্যে পড়ে না। অণিমার রাগ হচ্ছে, ওর ইচ্ছে হচ্ছে এখনি ফাজিলটাকে চড় দিতে, কিন্তু রাস্তায় সেটা করা ঠিক হবে না। খানিকটা রেগে অণিমা বলল,
:- আপনি জানেন আমি কে?
:- হু জানি, আপনার নাম অণিমা।
ইংরেজি বিষয় নিয়ে অনার্স করছেন। বর্তমানে ২য় বর্ষে পড়ছেন। আপনি বই পড়তে পছন্দ করেন। বিশেষ করে থ্রিলার উপন্যাস। আপনার প্রিয় লেখক ড্যান ব্রাউন। এমনিতে আপনি কবিতা ও পছন্দ করেন। প্রিয় কবি পূর্ণেন্দু পত্রী। আপনার চোখ অসম্ভব মায়াবী। হাসি ভিঞ্চির আকাঁ মোনালিসার মতো। চুল আরেকটু বড় হলে মাটি ছুঁয়ে ফেলতো। আপনার পছন্দের রং আকাশী। আপনি গান গাইতে পছন্দ করেন। চিকেন বিরিয়ানি আপনার ভীষণ পছন্দ। আপনার গায়ের রং দুধে-আলতা। ওজন খুব সম্ভবত ৫০ কেজি হবে। এই পর্যন্ত সতেরোটা প্রপোজাল পেয়েছেন একটাতেও রাজি হননি। তারপর আর মনে করতে পারছি না। অণিমা এত্তোক্ষণ হা করে ছিল। সে বুঝতে পারছে না, তার ব্যাপারে এত্তোসব খবর সে কিভাবে নিলো।তারপর সে বললো:
:- তারপর আর মনে করতে হবে না। আমি এই পর্যন্তই। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না এত্তোসব তথ্য আপনি কিভাবে সংগ্রহ করলেন।
:- ও আপনি বুঝবেন না..প্রেম করতে এরকম একটু আধটু খোঁজ খবর তো নিতেই হয়।
:- প্রেম?
:- ইয়ে..মানে। কিছু না এমনি মুখ ফসকে বেরিয়ে গ্যালো!
:- আপনি কি করেন?
:- আপনার সাথে কথা বলছি?
:- আমি বলছি কাজকর্ম কি করা হয়। জব নাকি লেখাপড়া?
:- লেখাপড়া করছি। আমিও ইংরেজি নিয়েই পড়ছি তবে প্রথম বর্ষে।
:- কি? প্রথম বর্ষে পড়ে আপনি আমার পিছনে ঘুর ঘুর করছেন? আপনার তো সাহস কম না!
:- এতে সাহসের কি হলো? আপনি ২য় বর্ষে পড়েন বলে তো আর ডোলান ট্রাম্পের গার্লফ্রেন্ড হয়ে যান নি! যে আপনারপিছন পিছন আসা যাবে না। তাছাড়া প্রেমের ক্ষেত্রে সবাই সমান.. এখানে ধনী-গরিব, ছোট-বড়, কারো-ফর্সা, লম্বা-খাটো বলে কোনো কথা নেই।
:- আবার প্রেমের কথা বলছেন?
:- ইয়ে..মানে.. আচ্ছা তবে প্রেম বাদ। আমরা তো বন্ধু হতে পারি? কি বলেন?
:- না পারি না..আমার জুনিয়র কোনো ছোট ভাইয়ের আমি বন্ধুত্ব করতে চাই না। খুব বেশি ভাই-বোন হওয়া যায়।
:- নাউযুবিল্লাহ্…দয়া করে এরকম বলবেন না। এমনিতেই আমার দুটো বোন আছে। আর কোনো বোন আমার আপাতত দরকার নেই। তাছাড়া বিশ্বাস করুন আমি কিন্তু এবার তৃতীয় বর্ষে থাকতাম। শুধু স্যারদের কারণে পাস করতে পারি নি। পরিক্ষায় ইয়া বড় বড় তিন লাইনের প্রশ্নের উত্তর আমি দুই লাইনে দিয়েছি তবু গাধারা আমায় নাম্বার দেয় নি।
:- এবার বুঝতে পেরেছি!
:- কি বুঝতে পেরেছেন?
:- আপনার মতো গাধার সাথে ভাই-বোনের সম্পর্ক কিংবা বন্ধুত্বের সম্পর্ক কোনোটাই করা যাবে না।
:- প্লিজ আপনি ও রকম বলবেন না! আপনি পাশে থাকলে আমি সবকিছু ঠিকঠাকভাবে করবো। দেখবেন এবছর আর পরিক্ষায় ফেল করবো না। প্লিজ একটা সুযোগ দিন।
:- আচ্ছা.. একটা সুযোগ দেয়া হলো..
তবে সেটা বন্ধুত্বের.. প্রেম-টেম কিছুর না। আর শর্ত হলো এবার পরিক্ষায় পাস করতে হবে, শুধু তাই নয় ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে পাস করতে হবে। কথাশুনে রাফসান বড় রকমের একটা ঢোক গিলল। পরিক্ষায় পাস করতে হবে তাও আবার ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে। সে তার সবগুলো বিষয়ের নাম পর্যন্ত ঠিকমতো বলতে পারবে না। এই কঠিন শর্তের চাইতে সাত সমুদ্র আর তেরো নদী জয় করাও অনেক সহজ ছিল। রাফসানের এই ভয় ভয় অবস্থা দেখে অনিমা বলল:-
:- কি হলো পারবেন না তো? আমি জানতাম! আপনি শুধু মেয়েদের পিছন পিছন ঘুরঘুর করতেই জানেন। কাজের কাজ কিছু জানেন না।
:- আমি পারবো.. আমি ফার্স্ট ক্লাস পেয়েই আপনাকে দেখাবো। তবে মাঝেমধ্যে পড়া নিয়ে সমস্যায় পড়লে কিন্তু আপনি আমায় সাহায্য করবেন।
:- আচ্ছা…সে দেখা যাবে!
প্রায় চার দিনের মতো হয়েছে। রাফসান কে অণিমার আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। অণিমা প্রায় প্রতিদিন কলেজ ফেরার পথে বার বার পিছনে তাকায় কিন্তু রাফসান আর আগের মতো পিছন পিছন আসে না। সাধারণত এই ঘটনায় তার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু তার মোটে খুশি লাগছে না। বরং কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে কি যেন একটা হারিয়ে গেছে।আজ তার রাফসান কে দেখতে প্রচন্ড ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার তো এরকম ইচ্ছে হওয়ার কথা না। সে তো রাফসান কে ভালোবাসে না।হতে পারে সে রাফসান কে পছন্দ করে ফেলেছে। কিন্তু পছন্দ আর ভালোবাসা কি এক? ধ্যাত! অণিমা এসব কি ভাবছে? তার এসব ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তবু ও বারবার ভাবতে হচ্ছে। রাফসান গাধাটা তার মাথার ভেতর ঢুকে গেছে। কিছুদিন পর হঠাৎ সেদিন রাফসান কে পথে দেখা গেলো। রাফসান বলল,
:- আপনি কেমন আছেন?
:- ভালো, কিন্তু আপনি এত্তোদিন ছিলেন কোথায়?
:- বাসায় ছিলাম। আজকাল ঠিকমতো পড়াশুনা করছি। আপনার দেয়া শর্ত পূরণ করতে হবে তো!
:- তখন…. বন্ধুত্ব চাই.. বন্ধুত্ব চাই… বলে মাথা খারাপ করে দিলেন। আর যখন আমি রাজি হলাম তখন আপনারপাত্তা নেই। আজব তো?
:- এই যে, পাত্তা দিতে চলে আসলাম।
:- কি জন্যে এসেছেন?
:- বলেছিলাম যে সমস্যায় পড়লে আপনার সাহায্য চাইবো…সে সাহায্য নিতে এসেছি। কয়েকটা টপিক বুঝতে পারছি না,আপনি বুঝিয়ে দিলে ভালো হতো।
:- চলুন ঐ বেঞ্চটায় গিয়ে বসি
সেদিনের পর থেকে প্রায়ই কোনো বিষয় বুঝতে না পারলে রাফসান অণিমার কাছে সেটা বুঝতে আসতো। অণিমা ও তাকে বুঝিয়ে দিতো। এভাবেই তাদের সম্পর্কটা এগিয়ে যায়। কিন্তু কোন দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সেটার দিকে কারোরি খুব বেশি খেয়াল ছিল না। আস্তে আস্তে রাফসানের পরিক্ষা চলে আসলো। সে পরিক্ষা দিল। ঠিকমতো পড়ার কারণে তার পরিক্ষাও ভালো হলো। আজ রাফসানের রেজাল্ট দেবে। প্রতিবার এই দিনটা তার কাছে অভিশাপ বলে মন হলেও। এবার সে এই দিনটির জন্য উৎসাহ দিতে অপেক্ষায় ছিল। অবশেষে যথাসময়ে তার রেজাল্ট দিল। এবং সে তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে পাস করলো। রাফসানের মা-বাবা তার রেজাল্ট নিয়ে ভীষণ খুশি হলো। সে তার মা-বাবাকে কখনোই এতোটা খুশি হতে দেখেনি। তার যেসব বন্ধুরা তাকে ছোট করে দেখতো, লেখাপড়ায় দুর্বল বলে খুব বেশি একটা মূল্য দিতো না। তারা পর্যন্ত তাকে ফোন দিয়ে তার খোঁজ-খবর নিতে লাগলো।
রাফসানের খুব আনন্দ হওয়ার কথা; কিন্তু হচ্ছে না। কারণ আজ প্রায় তিন-চার দিন যাবৎ অণিমার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। যে মানুষটার উৎসাহের কারণে আজ সে এত্তো ভালো একটা রেজাল্ট করতে পারলো, আজকের এই বিশেষ দিনে সে ই তার কাছে নেই। গত কয়েকদিন যাবৎ সে অণিমার কলেজ ক্যাম্পাস, হোস্টেল সব জায়গায় তার খোঁজ নিয়েছে। কিন্তু কেউ তার খোঁজ বলতে পারছে না। হ্যাঁ.. রাফসান মেয়েটাকে ভালোবাসতো, প্রচন্ড রকমের ভালোবাসতো। তাকে ভালোবাসতো বলেই তাকে কমপক্ষে বন্ধু হিসেবে পাওয়ার জন্য… সে এত্তো কস্ট করে ভালো রেজাল্ট করেছে। আজ সে ই নেই। আজ এতো সাফল্যের মাঝেও তার নিজেকে ব্যর্থ বলে মনে হচ্ছে। যে বেঞ্চটায় অণিমা তার পাশে বসে কঠিন বিষয়গুলো বুঝিয়ে দিতো সেখানে বসে সে কাঁদছে। তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ কেউ একজন পেছন থেকে বলল,
:- বাচ্চাদের মতো কাঁদছেন কেন? কথাটা শুনে রাফসান পিছনে ফিরলো। দেখলো অণিমা দাড়িয়ে আছে। সে যেন তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তারপর খানিকটা রেগেই সে বলল,
:- এত্তোদিন ছিলেন কোথায়? আপনি জানেন আপনাকে আমি কত্তো খুঁজেছি?
:- আমি জানি আপনি আমাকে খুঁজবেন। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিলো না। সেদিন হুট করেই মা ফোন করে বলল বাবার শরিরটা নাকি ভীষণ অসুস্থ। খবর শুনে দ্রুত বাসায় গেলাম। এ কদিন বাবাকে নিয়ে অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছি। তবে এখন বাবা সুস্থ। আপনার ফোন নাম্বার না থাকার কারণে আপনাকে কল ও করতে পারি নি। আমি দুঃখিত! অণিমার কোনো দোষ নেই সেটা রাফসান বুঝতে পারলো। তারপর রাগী চেহারা মুছে বলল,
:- আরেহ্ এতে দুঃখিত হওয়ার কি আছে? এতে তো আপনার কোনো দোষ নেই। সে যাই হোক। আমার রেজাল্ট দিয়েছে। আপনি জানেন আমি ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে পাস করেছি।
:- সত্যি! যাক্… আপনার সাথে আমার বনধুত্বের ব্যাপারটা তাহলে পাকাপোক্ত করেই ছাড়লেন! কথাটা শুনার পর রাফসান মুচকি হাসলো। তার এখন ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। হঠাৎ করেই সে অণিমার হাত ধরে বললো,
:- অনিমা, শুধু বন্ধু হিসেবে কেন? তুমি কি জীবনসঙ্গিনী হয়ে সারাটা জিবন আমার পাশে থাকতে পারো না। তুমি কি আমার জিবনের সব কঠিন বিষয়গুলোকে সহজতর করে আমাকে জিবনের প্রতিটা পরিক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পেতে সাহায্য করতে পারো না। তুমি কি আমায় একটু ভালোবেসে আমার জীবনটাকে সাফল্যে ভরিয়ে দিতে পারো না। রাফসানের কথাগুলো শুনে অণিমা মুচকি হাসলো। কারণ সে নিজেও এতোদিনে রাফসানকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছে। এ..কদিন রাফসান কে না দেখতে পেরে তার নিজেরও অনেক কস্ট হয়েছে। তার চোখেও সময়ে অসময়ে জল গড়িয়ে পড়েছে। রাফসান অণিমার হাত ধরাতে সে খানিকটা লজ্জা পেয়ে বললো,
:- হচ্ছে কি! লোকজন দেখছে তো? এভাবে কি মানুষ প্রেম করে?
:- কিভাবে করে? তুমি আমায় শিখিয়ে দাও।
তুমি শেখালে এ বিষয়েও আমি ফার্স্ট ক্লাস পাবো। রাফসানের এসব পাগলামু কথাশুনে অণিমা হাসছে। হাসছে রাফসান ও। অনেকদিন পর তাদের মুখে এত্তো সুন্দর হাসি দেখা যাচ্ছে। আহা.. কতো সুন্দর ও পূর্ণতার সেই হাসি। কতো শুদ্ধ সেই হাসির চিত্র।