– সানভীর, তুই এখন আর ইরাদের বাসায় যাস না? ডাইনিং টেবিলে বসে সকালের নাস্তা সারছিলাম তখনইবাবা কথাটা জিজ্ঞাসা করল। আমি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
– কেন বাবা? আজ হঠাৎ এই কথা জিজ্ঞাসা করছ, মা কি তোমায় কিছু বলেছে?
– না রে, কেউ কিছু বলেনি। তোকে দেখেই বলছি। আমি যদি ভুল না হই তাহলে আগে তো তাড়াতাড়ি বার হয়ে প্রথমে ওদের বাসায় যেতিস? আমি নিরবে মাথা ঝাঁকালাম, বাবা আবার বলল
– এখন তো আর সেই তাড়াতাড়ি যাস না, সোজা অফিসের জন্যে বার হইয়ে যাস তাই দেখেই জিজ্ঞাসা করলাম আর কি । আমি কিছু বললাম না চুপচাপ নাস্তা শেষ করতে শুরু করলাম,সত্যি ই আগে অফিস টাইমের অনেক আগেই আমি বাসা থেকে বার হতাম ইরার সাথে দেখা করে তারপর অফিসে যেতাম কিন্তু সেদিনের
– কিরে বাবা কিছু বলছিস না যে?
– না বাবা আসলে তেমন কিছুই না, আমার অফিসের জন্যে দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমি আসি।
আমি জানি বাবা এই একই কথা আবার জিজ্ঞাসা করবে কারন কিছু না বলেই বার হয়ে এসেছি, আসলে এই বিষয়ে আমার কথা বলতে একদম ই ইচ্ছা করছিল না ইরা, আমার সব থেকের কাছের একজন মানুষ যাকে ঘিরে আমার সব ভালোলাগা অবশ্য এই সব কিছুই এক তরফা.. আমার মায়ের বান্ধবীর মেয়ে ইরা, সেই সুবাদে তার সাথে পরিচয়। ইরা দের বাসা আমাদের বাসার থেকে মাত্র ৩ টা বাসা দূরে আর আমরা প্রায় সমবয়সী হওয়ায় এক সাথেই বড় হয়ে ওঠা। ইরা ছোটবেলার থেকেই ভিষন চটপটে আর হাসি খুশি। ছোটবেলার খেলাধুলা, মারামারি, রাগারাগির মধ্যে কবে যে ওকে নিজের মনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ন জায়গা টা দিয়েফেলেছি তা টের পায়নি ইরা কে আমি অসম্ভব পছন্দ করি কিন্তু ওকে কখনো বলা হয়ে উঠিনি, পারিনি বলেত কখন ও। এমনকি ওকে যখন রাকিব ভাই এর সাথে ক্লোজ হতে দেখি তখন ও না। দূর থেকেই খালি কষ্ট পেয়ে গেছি। ওর খুব ভাল ফ্রেন্ড হওয়ার কারনে ওর সব কিছু ও আমার সাথে শেয়ার করত, রাকিব ভাইয়ের সাথে হওয়া কথার খুঁটিনাটি বিষয় গুলাও। আমি চুপচাপ শুনতাম, বাইরে থেকে শান্ত থাকলেও আমার ভেতর টা যেন দুমড়েমুচড়ে যেত…
-কি সানভীর সাহেব, এত মন দিয়ে কি ভাবছেন?
সারার কথায় যেন আমি বাস্তবে ফিরলাম, দেখি সারা আমার সামনে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সারা আমার কলিগ, অনেক ভাল আর মিশুক একটা মেয়ে. আমাদের সহজ একটা সম্পর্ক, তুমি করেই সম্বোধন করি একে উপরকে।আর কিছু দিন বাদেই মেয়েটার বিয়ে আমিও একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম,
– নাহ তেমন কিছু না একটা কাজ নিয়ে ভাবছিলাম
– ওহ কাজ নিয়ে! আচ্ছা, তাহলে ঠিক আছে। কথাটা বলে ও সারা চলে গেল না, আমার মনে হল ও আরো কিছু বলতে চাই, আমি নিজ থেকেই জিজ্ঞাসা করলাম
– আর কিছু বলবে? সারা একটু ইতস্তত করে বলল,
– আসলে সানভীর যেই এলাকায় তুমি থাক তার একটু সামনেই একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আছে.. চেনো কি স্টোর টা?
– আপনি কি ফারুক ডিপার্টমেন্টাল স্টোর এর কথা বলছ?
– হ্যাঁ, একদম সঠিক। আসলে ঐ স্টোর থেকে আমার উড বি এর জন্যে একটা কিছু গিফট কিনতে চাই কিন্তু ওই এলাকা টা আমার ওতো টা পরিচিত না, তাই আর কি যদি কিছু মনে না কর তাহলে আজ আমার সাথে একটু ঐ জায়গায় যাবে? আসলে তুমি গেলে আমার খুব হেল্প হত!
– আরে না এতোটুকু বিষয়ে কিছু মনে করার কি আছে.. অবশ্যই যাবো।
– ওহ! অনেক অনেক ধন্যবাদ।
– কোন ব্যাপার না..
ঐ দিন অফিস শেষে দুজনা রিকশাহ করে গেলাম। স্টোর টায় ঢুকলাম, অনেক দিন পর আবার আসা স্টোরটাতে, সারা ঘুরে ঘুরে জিনিস দেখছে… আমার পুরানো স্মৃতি আবার আমায় ধরা দিল, এই স্টোরটা আমাদের খুব পরিচিত। আমি আর ইরা প্রায় সময় এই জায়গা টা থেকেই সব কিনতাম, ইরার তো আরও বেশি। রাকিব ভাই এর জন্য যাবতীয় যা কেনার সব সে এই স্টোর টা থেকেই নিত। রাকিব ভাই আমাদের ২ ইয়ার সিনিয়র ছিলেন, ক্লাস টপার। আমরা জানতাম রেজাল্ট দেওয়ার সাথে সাথেই রাকিব ভাই জব পেয়ে যাবে, হলোও তাই।
রাকিব ভাই কে দেখে আমার নিজের প্রতি একটা ক্ষোপ তৈরি হয়েছিল কারন ছেলেটা সব দিক থেকেই আমার থেকে ভাল যে কোন মেয়েই তাকে পছন্দ করবে.. আর সে ইরার জন্যে আমার থেকে বেশি যোগ্য, তাই সেই ক্ষোপ আর কষ্ট থেকেই আমি নিজের উপর কাজ করতে শুরু করি, পড়াশোনায় তারপর থেকে আমি খুব ভাল হয়ে গেলাম ততদিনে ইরা আর রাকিব ভাইয়ের সম্পর্ক টা আরো মজবুত হয়ে গেছে, তাদের বিষয় সম্পর্কে তাদের বাড়ির সবাইও যেনে গিয়েছিল কেউ আপত্তি করেনি আর করার কথাও না। তাদের বিয়ের কথা প্রায় পাকাপাকি হয়ে গেছিল কথা ছিল ইরার পড়াশোনা শেষ হলেই তারা বিয়ে করবে… আমি ততদিনে নিজেকে কিছুটা সামলে উঠতে পেরেছি, মেনে নিয়েছিলাম সব কিছু। আমাদের শেষ পরীক্ষার কথা, ইরা আমাকে এই স্টোরটা টে নিয়ে এসেছিল আমি জানতাম সে রাকিব ভাই এরজন্যে কিছু কিনবে কিন্তু সেদিন কিছুটা ব্যাতিক্রম হল, সে দুইটা ঘড়ি কিনল।। কিনেহাসি মুখে বলল,
-এই দুইটা ঘড়ি আমার জীবনের খুব কাছের দুইটা মাসুষের জন্যে তারপর একটু হেসে আমার হাতের পুরানো ঘড়ি খুলে নতুনঘড়িটা পড়িয়ে দিল।
আমার কেন জানি সেদিন খুব আনন্দ হয়েছিল, ভালবাসার মানুষ না হলেও ওর কাছের মানুষ এটা জানতে পেরেই আমি খুশি হয়েছিলাম , অনেকদিন পর একটা শান্তি অনুভবকরেছিলাম। সেদিন সারাদিন ও আমার সাথে ছিল মেয়েটা সেদিন যে ভীষণ খুশি ছিল তা ওর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল অদ্ভুত একটা আভা ছড়াচ্ছিল ওর চেহারা যা আমার মন কেও ভীষণ আনন্দিত করে তুলছিল সেদিন আমি বুঝেছিলাম ভালবাসা্র মানুষ টা কে শুধু পাওয়ার মধ্যে ভালবাসা সীমাবদ্ধ না, ভালবাসার মানুষ টাকে খুশী দেখার মাঝে নিজের খুশি টুকু খুঁজে নেওয়াহচ্ছে ভালোবাসা। আমিও সেদিন খুব খুশি ছিলাম, ইরা কে বাসায় ছেড়ে আমি নিজের বাসায় চলে আসি বার বার ওর হাস্যোজ্জল চেহারা মনে পড়তে লাগল। সত্যি বলতে আমি তখন ও জানি না ইরার হাস্যোজ্জল চেহারা আমি শেষ বারের মত দেখছি…
– সানভীর? সারার ডাকে আমার ঘোর কাটল, আমি ওর দিকে ফিরেচাইলাম। সারা আবার বলল,
– একটু এদিকে আসবে? আজ এই স্টোরটাই ভীষণ ভিড় আমি ভিড় ঠেলে সারার পাশে যেয়ে কেবল দাড়িয়েছি এই সময় আমার চোখ গেল স্টোর এর এনট্রেন্স এর দিকে, দেখি ইরা দরজা দিয়ে ঢুকছে।।
আমি বেশ খানিকটা অবাক হলাম, ওর তো এখানে আসার কথা না সেদিনের পর থেকে তো আর না, সেদিনের পরে যেন সব বদলে গেল, তারপরের দিনের কথা সন্ধ্যাবেলা টিউশনি থেকে বাসায় ফিরেছি ঠিক তখন মা এসে খবরটা দিল, ইরার উড বি মানে রাকিব ভাইয়ের একটা সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়ে গেছে একদম স্পট ডেড, খবর টা শুনে যেন আমি আকাশ থেকে পড়লাম মা এর পর কি বলল বাকি কোন কিছু আমার মাথায় যাচ্ছিল না খালি ইরার কথা ঘুরপাকখাচ্ছিল, মেয়েটার কি অবস্থা আমি দৌড়ে যেয়ে ইরার বাড়ি হাজির হলাম আন্টি দরজাখুলল, আন্টির কাছে শুনলাম, আন্টি আমাকে সব খুলে বললেন এসব ঘটেছে গত দিন রাতে, তারা খবর পেয়েছে আজ সকালে আমি আন্টির কাছে ইরার কথা জিজ্ঞাসা করলাম তিনি বললেন খবর টা পাওয়ার পর থেকে ইরা যেন একদম চুপ হয়ে গেছে কিছু বলছে না কিচ্ছু খাচ্ছে না, সে রুম এর মধ্যে রয়েছে সকাল থেকে, তিনি আমায় বললেন
-যাও বাবা তুমি একটু ওর কাছে যেয়ে বস, আমার মেয়েটা আন্টি কথা শেষ করতে পারলেন না তার আগেই কান্না শুরুকরেদিলেন, আমি আন্টি কে কোন ভাবে সামাল দিলাম বললাম
-আপনারা যদি এইভাবে কান্না করেন তাহলে ইরা কে সামলাবে কে..?
আন্টি কান্না থামালেন। আমি ইরার রুম এর দিকে এগিয়ে গেলাম , আমি আসলে জানতাম না ওকে কি বলে সামাল দিব কালও মেয়েটা কত খুশি ছিল!! আল্লাহ্! আমি ইরার রুম এ যেয়ে দেখি ইরা ওর বিছানায় বসে ওরব্যাল্কনির দিকে তাকিয়ে আছে এক মনে, আমি যেয়ে ওর পাশে বসলাম। আমি যেয়ে ওর পাশে বসেছি সেটা ও খেয়াল ই করিনি ঐ এক নজরে আগের দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি ওর হাতের ওপর আমার হাত রাখলাম ও একটু কেঁপে উঠে আমার দিকে তাকাল আমি ওর দিকে চেয়ে দেখি ওর চোখে কেমন একটা হয়ে আছে নির্জীব, অনুভুতিহীন আমি জানি অনেক কষ্টে মানুষ একদমচুপচাপ হয়ে যায় আর ইরাও সেই পর্যায়ে চলে যাক সেটা আমি একদম চাই না আমি ইরার দুই গালে হাত রেখে ওর চোখের দিকে তাকালাম ততক্ষনে আমার নিজের চোখ ভরে এসেছে.. আমি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ইরাকে বললাম,
– ইরা তোকে বলার মত আমার কিচ্ছু নাই কিন্তু প্লিজ এমন হয়ে থাকিস না, আমি জানি তোর ভেতর টা.. এই বলে আমি কিছুক্ষন থামলাম আসলে আমিও যেন কথা বলতে পারছিলাম না, নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বললাম,
– নিজেকে ছেড়ে দে, এইভাবে ধরে রাখিস না কষ্টগুলা জমে অনেক ভারি হয়ে যাবে…” ইরা এইবার বলে উঠল,
– দেখ সানভী, কী দিয়ে কি হয়ে গেল!!
ওর কণ্ঠে আকূল বেদনা.. কথাটা বলে যেন ও আর নিজেকে আটকে রাখতে চাইল না, আমাকে হাত দুইটা ধরে ও হাউমাউ করে কেঁদে উঠল… আমি ওকে থামানোর চেষ্টা করলাম না, জানি মেয়েটার এখন কান্নার প্রয়োজন রয়েছে।
– এটা কেমন? সারা জিজ্ঞাসা করল, আমি এতক্ষন ইরার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, ইরা আমায় খেয়াল করেনি ভীড় থাকার কারনে আমি সারার দিকে তাকিয়ে বললাম,
– কি? সারা আবার বলল,
– জিজ্ঞাসা করলাম যে এটা কেমন? আমি জিনিস টার দিকে একবার তাকালাম বেশ সুন্দর জিনিস টা আমি ওকে বললাম,
– অনেক সুন্দর জিনিসটায় তাকে খুব ভাল লাগবে, এইটানাও।
– শীওর ভাল লাগবে তো?
– হ্যাঁ, নিশ্চিন্তে থাক ।
সারা একটা হাসি দিল, আমি একটু তাড়াহুড়োই করেই বার হয়ে আসলাম কারন ঐখানে থাকতে আর আমার একদম ই ভাল লাগছিল না, সারা কে রিকশাই উঠিয়ে আমি বাড়ি চলে আসলাম, আজকে কেন জানি কিছুই ভাল লাগছে না.. রাতে তাড়াতড়ি শুয়ে পড়লাম। শুয়ে তো পরলাম কিন্তু কেন জানি ঘুম আসছে না, বার বার সেদিনের কথা মনে পড়ছে… ইরার বলা কথা গুলা মনে পড়ছে সেদিনের পর থেকে আমি আর ইরা কে একা থাকতে দেইনি, প্রতিদিন ই ওর বাসায় যেতাম।
ও বলত এভাবে প্রতিদিন আসার প্রয়োজন নাই, ও ঠিক আছে কিন্তু আমি জানতাম ও ঠিক নাই কারন ওকে আমি ছোটবেলার থেকে চিনি এতটুকু তো জানি ওর বিষয়ে ওর যখন অনেক মন খারাপ হয় তখন কারো না কারো প্রয়োজন হয় ই এর জন্যে ই ওর মানা করার পরও আমি ওর বাসায় যেতাম ওর সাথে কথা বলতাম, ওকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতাম। কারন আমি জানতাম ওকে এই পরিস্থিতি থেকে কেবল মাত্র আমি ই বার করতে পারতাম, মাঝে মাঝে বাইরে নিয়েযেতাম, ঘুরতাম কিন্তু আমাদের বেশীরভাগ সময় কাটত ওদের ছাদে… ছাঁদে দাঁড়িয়ে থাকার সময় যখন বাতাসে ওর খোলা চুল গুলা উড়ত তখন আমি চুপচাপ চেয়ে চেয়ে মুগ্ধের মত দেখতাম, আমার কাছে ঐটায় সব থেকে মনোরম দৃশ্য মনে হতও যখন বুঝতে পারত আমি তাকিয়ে আছি তখন আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচু করে ইশারায় জিজ্ঞাসা করত ‘কি?’ আমিও খালি ইশারা করে বুঝাতাম যে “কিছু না…” আবার একদিন আমি ঐ ভাবেই যখন তাকিয়ে ছিলাম তখন ও আমাকে সরাসরি ই জিজ্ঞাসা করল,
– সানভী, একটা কথা বলবি? আমি ওর দিকে আগের মতো তাকিয়ে থেকেই বললাম,,
– কি?
– তুই এভাবে তাকিয়ে থাকিস কেন? কি দেখিস? আমি ওর প্রশ্নের বিনিময়ে শুধু একটু হাসলাম, তারপারঅন্যদিকে তাকালাম। কিছুক্ষন অপেক্ষা করেও ও যখন উত্তরপেল না তখন আবার জিজ্ঞাসা করল,
– কি হল? উত্তর দিলি না যে..আমি ওর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে উত্তর দিলাম,
– এইটায় দেখি কিভাবে একটা জিনিস একসাথে এতো সুন্দর আরদুর্লভ হতে পারে…!!
ইরা চুপ করে কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থাকল তারপরচোখ সরিয়ে নিল.. আমিও অন্য দিকে ঘুরে তাকালাম। এইভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর রেজাল্ট দিয়ে দিল, রেজাল্টআমাদের দুজনারই ভাল হয়েছিল। তারপর থেকে আমি একটুব্যস্ত হয়ে পড়লাম চাকরীর জন্যে। আগে যতটুকু সময় দিতেপারতাম ইরা কে ততটা দিতে পারতাম না, খালি বিকেল এর সময় টুকুই আমি ওর সাথে কাটাতাম বেশ কিছুদিনের পরিশ্রমের পর আমার একটা চাকরী হল, বাবা মা ভীষণ খুশি হলেন… সেদিন বিকালে ইরাদের বাসায় যাওয়ার পর আন্টি আঙ্কেল ও আমায় কংগ্রাচুলেট করলেন,আন্টির কাছ থেকে শুনলাম ইরা ছাঁদে ই আছে। আমি ছাঁদেগেলাম যেয়ে দেখি ইরা ছাঁদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আমি ওরপাশে যেয়ে দাড়ালাম চেহারায় খানিকটা বিষন্নতার ছাপ। কিছুক্ষন বাদে ও বলে উঠল,
– শুনলাম তোর চাকরি হয়েছে? আমি খালি মাথা ঝাঁকালাম…
– জয়েন করবি কবে থেকে?
– ১ তারিখে মানে পরশুদিন..
– ওহ আচ্ছা! ও কিছুটা বিরতি নিয়ে আবার বলল ” তাহলে তো আর বিকেলবেলা এভাবে তোর আসা হবে না!!”এই বিষয় টা নিয়ে আমি নিজের মনের মধ্যে কেমন একটা হচ্ছিল,আমি কি বলব কিছু বুঝতে পারলাম না আমি শুধু ছোট করে বললাম,
– হুম।
হুম শোনার পর ইরা কেমন করে আমার দিকে তাকাল যেন ঐ কথাটা ও একদম ই শুনতে চাচ্ছিল না, ওর চোখে কেমন যেনএকটা আকুলতা আমার কিছু বুঝে ওঠার আগে ও চোখ সরিয়ে নিল কেমন একটা অদ্ভুত নিরবতা ছেয়ে গেল পুরোটা ছাঁদে..কিছুক্ষন বাদে ইরা বলল,
– কাল দুপুরে আমাদের বাসায় তোর দাওয়াত থাকল, তোর চাকরি পাওয়ার খুশিতে…
– না কাল তো সম্ভব হবেনা আসলে কাল একটু কাজ…আমার কথা শেষ করার আগেই ও বলল,
– ওহ! তুই তো আবার ব্যস্ত, নাহ থাক সমস্যা নাই আমার কিছু বলার আগেই ও ছাঁদ থেকে নেমে গেল, আমার কেনজানি মনে হল ওর সাথে আর সময় কাটানো হবে না এর জন্যেওর কিচুটা মন খারাপ হয়েছে।
এর পর থেকে আমার অফিস জীবন শুরু হল, বিকেলবেলা ওইভাবে সময় কাটানো না হলেও আমি প্রায় প্রতিদিন নিয়ম করেই ওর সাথে দেখা করে অফিস যেতাম আবার অফিস থেকে আসার সময় দেখা করে বাসায় আসতাম… মাঝে মাঝে কিছুদিন যেদিন অফিসে চাপ বেশি থাকত সেদিন দেখা করে হত না…ইরা কিছু না বললেও কেন জানি মনে হত ও আমার এমন আচরনে ও বিরক্ত হত.. একদিন অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বার হয়ে ওর বাসায় গেলাম ওর সাথে কিছুক্ষন সময় কাটাতে, কারন আগের দুইদিন ওর সাথে দেখা করতে পারিনি কাজেরচাপে ও ছাঁদেই ছিল ওকে দেখে মনে হল ওর মেজাজ খারাপ আমাকে দেখে যেন আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল..
– এই সময় এখানে কি করছিস তুই?বেশ কঠিন কণ্ঠে আমায় জিজ্ঞাসা করল , আমি অনেক শান্ত গলায় উত্তর দিলাম,
– আজ একটু তাড়াতাড়ি বার হয়েছি।
– কেন?
– তোর সাথে কিছু সময় কাটাবো বলে…
– আমার সাথে সময় কাটাতে কেন হবে তোর ? আমি কে? আর আমি কি চেয়েছি তোর সময়? আমি জানি তুই এখন অনেক ব্যস্ত প্রতিদিন এভাবে আসার কোন প্রয়োজন নাই… ইরা কিছুক্ষন থামল তারপর আবার বলল,
– হ্যাঁ আমি জানি আমার সাথে একটা ট্রাজেডি হইয়েছিল তাই বলে যে সবসময় আমাকে করুনা করতে হবে তা তো আর না।। আমি এবার ইরার মুখের দিকে তাকালাম, কি বলল ও?”করুণা!!।” আমার ভালবাসা টাকে ও করুণা বলেআখ্যায়িত করল!! কেন জানি কথাটা আমাকে খুব আঘাতকরল আমি তবুও কিছু বললাম না শুধু নিচের দিকে তাকিয়েথাকলাম।ইরা আবার বলল,
– আমি ঠিক আছি , তোকে আর এসে আমার পেছনে নিজের সময় নষ্ট করতে হবে না… যা ভাল থাকবি। বলে ইরা মুখ ফিরিয়ে নিল আমিও কিছু বললাম না শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে চলে আসলাম, তারপর থেকে আর ওদের বাসায় যায়নি।আজ ৯ দিন পরে আমি ইরার মুখ দেখলাম সময়টা খুব বেশি না কিন্তু আমার কাছে অনেক ই মনে হচ্ছে… এসব ভাবতে ভাবতে রাতে কখন ঘুমিয়েছি তা টের পায়নি।
পরেরদিনের কথা অফিসে বসে কাজ করছি এমন সময়ে পিয়ন এসে বলল, “স্যার, আপনার সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে, ওয়েটিং রুমে বসে আছে” কথাটা বলে পিয়ন চলে গেল। আমি মনে মনে ভাবলাম আমার সাথে আবার কে দেখা করতে আসতে পারে!! হাতের কাজ টা সেরে ওয়েটিং রুমের দিকে পা বাড়ালাম, যেয়ে দেখি ইরা বসে আছে মেয়েটা কে আজ অন্য রকম লাগছে হয়ত অনেকদিন দেখি না তাই নাকি!! না আসলে ইরা আজ হালকা সেজেছে, চোখে কাজল আর ঠোঁটে গোলাপি লিপ্সটিক দিয়েছে সব মিলিয়ে ওকে আজ বেশ সুন্দর লাগছে। অনেকদিন বাদে ওকে এইভাবে দেখলাম তাই একটু আলাদালাগছে। আমাকে আসতে দেখে ইরা উঠে দাড়াল কিছুক্ষণ দুজনায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর ইরা নিরবতা ভেঙ্গে বলল
– তোর অফিসের কাজের চাপ কি অনেক বেশি? আমি বললাম,
– নাহ্! আজ তেমন কাজ নাই
– তা আমার সাথে একটু বার হতে পারবি?
– কোথায়?
– এইতো একটু সামনে … পারবি?
– হ্যাঁ, অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বার হলাম, ইরা আমায় লেক পাড়ে নিয়ে গেল… আমি ইরা কে জিজ্ঞাসা করলাম
– আজ হঠাৎ এইখানে?? ইরা বলল,
– এইখানে আগে প্রায় ই আসতাম, রাকিবের সাথে ইরা রাকিব ভাইয়ের কথা বললে আমি বরাবর ই চুপ করে থাকতাম, আজও আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম… ইরাও কিছুক্ষণ চুূপ করে থেকে বলল,
– সানভী?
– হুম
– আগে যখন রাকিব এর কথা তোর কাছে এসে বলতাম তখন তোরঅনেক কষ্ট হত তাই না? আমি অনেকটা অবাক হয়ে ইরার দিকে তাকালাম কারনএসন কথা তো ইরার জানার কথা না। বলল,
– এমন কি সেদিন ও তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, ও কিছুক্ষন থামল তারপর আবার বলল,
– মানুষের মন বড়ই অদ্ভুত তাই না, যখন সারাক্ষন কাছে থাকতিস তখন কিছুই মনে হত না কিন্তু যখন একটু একটু করে দূরে সরতে শুরু করলি তখন আমার মন টা কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠল তোর জন্যে। যখন তুই সায় দিলি যে তুই আর বিকালে আর আসতে পারবি না তখন আমার ভেতরটায় কেমন জানি তোলপাঁড় শুরু হয়ে গেছিল আমি চুপচাপ শুনতে থাকলাম ওর কথা, ও অন্য দিকে তাকিয়েই কথা গুলা বলছে, ওর কন্ঠ টা কেমন কাঁপছে, মনে হচ্ছে এখন ই কেঁদে দিবে
– সেদিন ছাঁদে আমি তোকে বলতে চেয়েছিলাম, সানভী প্লিজ এমন হেঁয়ালি করিস না তোকে এখন একদিন না দেখলে ভেতরটা কেমন করে আমার…! কিন্তু দেখ কি বলতে যেয়ে কি বলেছি যার জন্যে আজ ১০ দিন তুই আমার সাথে কথা বলিস না !! নিজের কাছে কেমন জানি একটা অপরাধবোধ কাজ করতে লাগল , নাহ্ ইরার সাথে এমন টা করা একদম ই ঠিক হয়নি মেয়েটা রাগ করেই কথা গুলা বলেছে আমার একটু বোঝা উচিৎ ছিল… আমি ইরার হাত টা চেপে ধরলাম ইরা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল কিন্তু তাতে কাজ হল না চোখ থেকে টুপ করে একটু পানি নিচে গড়িয়ে পড়ল, আমি হাত দিয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিতে গেলাম তখন ও আমার হাত টা ওর গালের সাথে চেপে ধরে বলল,
– সেদিন বলতে পারিনি আজ বলছি প্লিজ আমার সাথে এমন করিস না। আমার তোকে খুব প্রয়োজন, তোর সংগের প্রয়োজন,প্লিজ আমায় একা রেখে চলে যাস না কথা শেষ করেই ও কান্না শুরু করল, আমি ওর একটু কাছেএগিয়ে গেলাম, ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে ইরাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলাম এমন ভাবে যাতে ও অ অনুভব করতে পারে যে শুধু ওর একার না আমার ও ওকে খুব প্রয়োজন…
সমাপ্ত