পার্লারের মেয়েটা যখন তার দক্ষ হাত দুটো দিয়ে আমার মুখে তৃতীয়বারের মত ম্যাসেজিং ক্রিম টা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ম্যাসাজ করে দিচ্ছিলো, আমার তখন মনে হচ্ছিলো আমার মুখের উপরের চামড়া টা এক্ষুণি খসে পড়ে যাবে। বান্ধবীদের মুখে শুনেছি, পার্লারে ফেসিয়াল করার সময় নাকি ঘুম চলে আসে। কিন্তু আমি তো চামড়া হারানোর ভয়েই ঘুমোতে পারছি না।
আর মুখটাও কেমন যেন কুটকুট করছে। সেই কখন থেকে ডলে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। পাক্কা ১ ঘন্টা ঘষামাজার পর ফেসিয়াল পর্ব শেষ হল। অনেক আশা নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা টা ভাল করে দেখে খুব হতাশ হলাম। ভেবেছিলাম অরেঞ্জ ফেসিয়াল করে একদিনেই আলতা সুন্দরী হয়ে যাব। কিন্তু আমার শ্যাম বর্ণের চামড়ায় আহামরি কোনো পরিবর্তন চোখে পড়লো না। একা থাকলে পার্লারের মেয়েগুলো কে বোকা বোকা প্রশ্ন করে জ্বালাতে পারতাম কিন্তু এখন সাথে ছোট খালামণি আছেন তাই এই দুঃসাহস দেখানো যাবে না। পার্লারের কাজ শেষ করে স্কুল পড়ুয়া গ্যাঁদা বাচ্চাদের ন্যায় ছোট খালামণির হাত ধরে বাসায় চলে আসলাম। খালামণির ভাষ্যমতে, বিয়ের আগে নাকি মেয়েদের একবারের জন্যে হলেও পার্লারে ঢুঁ মেরে আসা লাগে। তাই নিতান্ত বাধ্য হয়েই আমাকে পার্লারে ফেসিয়াল করতে যেতে হয়েছিলো। আগে অবশ্য দু একবার ভ্রু প্লাক করেছি,তবে ফেসিয়ালের অভিজ্ঞতা ছিল না।
যাই হোক আসল কথায় আসা যাক, আর মাত্র সাতদিন পর আমার শুভ বিবাহ। অবশ্য শুভ নাকি অশুভ তা এখনি বলা যাচ্ছে না। কারণ যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে তাকে আমি একদমই চিনি না। এমনকি বাস্তবে এখন পর্যন্ত দেখিও নি। শুধু ছবি তে দেখেছি। আর শুনেছি ৫’১০” হাইটের সুগঠিত দেহের উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারার সুদর্শন পুরুষ একজন। ১০০% পিউর এরেঞ্জ ম্যারেজ করতে যাচ্ছি। তাই আনন্দের চেয়ে ভয়ের মাত্রা টা বেশি। সম্পূর্ণ অচেনা অজানা একটা লোক বিয়ের প্রথম রাতেই আমার শরীরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে,ব্যাপার টা মনে হলেই গা ঘিনঘিন করে উঠে আমার। আমার মধ্যে এমন কিছু নেই যা দিয়ে আমি আমার স্বামী কে মুগ্ধ করতে পারবো। না আছে আহামরি রূপ, না আছে কোনো গুণ। অতি সাধারণ বলা চলে। তাই শরীর ছাড়া স্বামী কে দেয়ার মত কিছুই নেই আমার।
আমার হবু স্বামীর নাম প্রত্যয়। ভদ্রলোক একটা প্রাইভেট কোম্পানি তে জব করছেন। আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি নেই, একটা ননদ আর দেবর আছে। নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার বলা যায়। আমি যেমন মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি, প্রত্যয়ও তেমন মধ্যবিত্ত পরিবারের ই ছেলে। তাই শ্বশুরবাড়ি তে মানিয়ে নেয়ার ঝামেলা খুব একটা হবে না বলে আশা করা যায়। পারিবারিকভাবে মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত তাদের থেকে আরেকটু উঁচু বংশের ছেলে দেখা হয়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যাপার টা তেমন হয় নি। সমানে সমানে ঠিক করা হয়েছে। প্রত্যয় কে বাবার খুব পছন্দ হয়েছে। এতটা পছন্দের কারণ বাবা আমাদের কাউকে বলেন নি বা বলার প্রয়োজন মনে করেন নি হয়তো। তাছাড়া প্রত্যয় দেখতে শুনতেও খারাপ না। আমার মত এত সাধারণ একটা মেয়ের জন্য এর থেকে বেশি কিছু আশা করা বোকামি।
জারিফের ভূত আমার মাথা থেকে পুরোপুরি নামে নি এখনো। আমিও এই ভূত নামানোর কোনো বৃথা চেষ্টা করি নি। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে আমি নিজেকে সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নিয়েছি। অতিরিক্ত আবেগগুলো কে মাটিচাপা দিয়ে দিয়েছি। রূঢ় বাস্তবতা কে আঁকড়ে ধরেছি। জারিফের সাথে আমার কিন্তু কোনো গল্প নেই,তবে কৌতুক আছে। এই যেমন আমার মনের কথা খোলাসা করে বলার পর জারিফ আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো, এটা তো এক ধরনের কৌতুক ই, তাই না? আবার যেমন, ফিরিয়ে দেয়ার সময় বলেছিলো, “দেখো তানহা, আমি তোমাকে এতদিন বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু ভেবে এসেছি ঠিকই কিন্তু প্রেমিকা হিসেবে কখনো ভাবতে পারি নি। তোমার সংগ আমার ভাল লাগে কিন্তু তোমাকে সংগী হিসেবে চাই নি। তোমার হাসি আমার খুব ভাল লাগে কিন্তু কখনো তোমার হাসির কারণ হওয়ার ইচ্ছে জাগে নি। তোমাকে আমার অনেক ভাল লাগে কিন্তু কখনো ভালবাসি নি।”
এটাও কি কৌতুকের চেয়ে কোনো অংশে কম? জারিফের সরল স্বীকারোক্তি আমার পবিত্র অনুভূতিগুলো কে অবমূল্যায়ন করেছে ঠিকই কিন্তু আমার মনে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে নি। আমি জানি, জারিফের প্রত্যাখানের পেছনে আসল কারণ টা হচ্ছে “আমার মোটামুটি রকমের চেহারা”। আমি বুঝতে পারতাম, জারিফের মন আমার কাছে পড়ে থাকলেও তার নজর কাড়তো ভার্সিটির সেই মাখন সুন্দরীগুলো। আসলে আমার মত মোটামুটি চেহারার মেয়েদের কোনো গল্প থাকে না। গল্প তো থাকে মাখন সুন্দরীদের। কবিদের কাল্পনিক কবিতায় ই যেখানে আমাদের ঠাঁই হয় না, সেখানে বাস্তবে কারো কল্পনায় ঠাঁই পাওয়ার আশা করাটা নিতান্তই বোকামি।
জারিফ ছিল আমার তিন ব্যাচ সিনিয়র। টানা তিন বছর আমাদের তথাকথিত “বন্ধুত্বের চেয়ে একটু বেশি” সম্পর্ক ছিল। মাত্র দু’মাস হল জারিফের সাথে আমার যোগাযোগ বন্ধ হয়েছে। এত তাড়াতাড়ি জারিফের নেশা কাটানো সম্ভব না। দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো আর আমার টেনশন বাড়তে লাগলো। ফুলসজ্জার কথা মনে হলেই আমার কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়তে থাকে। “স্বামী” শব্দ টি এতদিনে আমার কাছে একটা আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। আমার কাছে মনে হয় স্বামী মানেই হচ্ছে, জৈবিক চাহিদা নিবারণ আর বংশবৃদ্ধি করা। মাঝে মাঝে ভাবি, স্বামী ছাড়া সংসার করা যায় না কেন? একদিন বিকেলবেলা মা আমার চুলে তেল লাগিয়ে দিতে দিতে বলছিলেন,
– জামাই বাবা তোর সাথে কথা কইতে চায় একবার। ফোন দিবার পারে, ঠিক কইরা কথা কইস।
প্রতিউত্তরে আমি শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়েছিলাম। পরদিন সন্ধ্যে বেলা মাগরিবের নামাজের পর একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসে আমার মোবাইলে। রিসিভ করে আমি “হ্যালো” বলার পর ওপাশ থেকে কেউ একজন সালাম জানালেন,
– আসসালামু আলাইকুম, আমি প্রত্যয় বলছিলাম।
– ওয়ালাইকুম সালাম, জ্বী বলুন।
– কেমন আছেন?
– ভালো, আপনি?
– আলহামদুলিল্লাহ্, আমি শুধু একটা কথা জানার জন্য আপনাকে কল করেছি।
– কি কথা?
– আপনার কি এই বিয়েতে সম্মতি আছে?
– হুম।
মনের অজান্তেই মুখ দিয়ে “হুম” শব্দ টি বের হয়ে গিয়েছিলো। অবশ্য এছাড়া আর কি ই বা বলার ছিল আমার! বিয়ের আগে এই এতটুকুই কথা হয়েছিলো আমাদের।
যেদিন বিয়ে তার এক সপ্তাহ পর বৌভাতের তারিখ ঠিক করা হল। আমার শ্বশুরবাড়ি তে নাকি এটাই রেওয়াজ, বিয়ের এক সপ্তাহ পর বৌভাত করে। বিয়ের আয়োজন ওত জাঁকজমকভাবে করা হচ্ছে না। আমার বাবার এসব পছন্দ না। কম খরচের বিয়েতে বরকত বেশি থাকে, তাই বাবা খুব সাদাসিধেভাবে বিয়ের আয়োজন করেছেন। আমার অবশ্য এতে বিন্দুমাত্র কোনো আক্ষেপ নেই। কারণ এই বিয়ে তে তো আমি মন থেকেই সায় দিতে পারছি না। বিয়ের দিন পার্লার থেকে লোক আনানো হল আমাকে সাজিয়ে দেয়ার জন্য। আমাদের বাসার ছাদের উপরে প্যান্ডেল টাঙিয়ে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হল। দুপুরের দিকে বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলে খাওয়াদাওয়া শেষ করে বিকেলের মধ্যে বরযাত্রী আমাকে নিয়ে বিদায় হয়ে গেল। বিদায়ের বেলায় আমার কান্না যেন থামছিলোই না। মা, বাবা আর ছোট বোন টা কে ছেড়ে চলে আসার সময় আমার বুক টা ফেটে যাচ্ছিলো।
শ্বশুরবাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিলো। নিয়মকানুন সেরে ননদদের সাথে সময় কাটাতে কাটাতে রাত ১০ টা বেজে যায়। সময় যত যাচ্ছে আমার আতঙ্ক যেন আরো বাড়ছে। রুম থেকে সবাই চলে যাওয়ার পর আমি বিছানা ছেড়ে উঠে শাড়ি পালটে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। মেকআপ উঠিয়ে প্রায় ১ ঘন্টা লাগিয়ে শাওয়ার নিলাম। আমার চাচী শ্বাশুড়ি গরম পানি দিয়ে গোসল করতে বলেছিলেন কিন্তু আমি “না” করে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম লাগবে না। কিন্তু গোসল করে বের হওয়ার পর শরীরে কাঁপুনি উঠে গেল। টাওয়াল দিয়ে চুলগুলো কোনোরকম মুছে বিছানায় গিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। তারপর আর কিছু মনে নেই আমার। সকালে ঘুম ভাঙলো কপালে কারো হাতের কোমল স্পর্শ পেয়ে। চোখ মেলে তাকিয়ে প্রত্যয় কে আমার উপর ঝুঁকে থাকতে দেখে আমি হুড়মুড় করে উঠে বসলাম। তা দেখে প্রত্যয় বললেন,
– আরে কি করছেন? শুয়ে থাকুন, আপনার জ্বর এখনো সারে নি। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
– জ্বর মানে? প্রত্যয় মুচকি হাসলেন,
– শীতের রাতে এতক্ষণ সময় নিয়ে গোসল করে আপনি জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছেন। খাওয়ার জন্য আপনাকে এত করে ডাকলাম, আপনি উঠলেন ই না। তাই মেডিসিনও খাওয়াতে পারি নি।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে প্রত্যয় নাস্তা আনার কথা বলে চলে গেলেন। আমি মনে করতে চেষ্টা করলাম,রাতে আমার সাথে কিছু হয়েছিল কি না। কিন্তু কিছুই মনে পড়ছে না। অনুমানিক ধারণা নেয়ার জন্য কাপড়চোপড় ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিলাম। নাহ, সব ঠিকই আছে। এর মধ্যে প্রত্যয় নাস্তা নিয়ে চলে এলেন,
– নিজের হাতে খেতে পারবেন তো?
– পারবো।
নাস্তার প্লেট টা আমার হাতে দিয়ে একটা চেয়ার টেনে তিনি আমার পাশে বসে রইলেন। একটার অর্ধেক পরোটা খাওয়ার পর আমি আর খেতে পারলাম না। তেঁতো স্বাদ মুখে লেগে আছে। প্রত্যয় তা বুঝতে পেরে আমাকে আর জোর করলেন না। আমার এঁটো করা বাকি নাস্তাটুকু অনায়াসে খেয়ে নিলেন। আমি অবুঝের মত জিজ্ঞেস করে বসলাম,
– আপনার অফিস নেই? খেতে খেতে তিনি উত্তর দিলেন,
– ১০ দিনের ছুটি নিয়েছি।
নাস্তা করে মেডিসিন খাওয়ার পর জ্বর অনেকটা কমে গেল। সারাদিনে প্রত্যাশার সাথে খুব ভাব জমে গেল আমার। প্রত্যাশা আমার ননদ। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। খুব মিষ্টি আর লক্ষ্মী মেয়ে। সকালের পর প্রত্যয় কে আর আশেপাশে কোথাও দেখতে পাই নি। বাসায় মানুষজনও তেমন ছিল না। দুই ফুফু শ্বাশুড়ি আর আমার দেবর ননদ শুধু। বাকি মেহমান সব কাল রাতেই চলে গিয়েছে। নতুন বউ আমি তাই রুম থেকে খুব একটা বের হই নি। দুপুরে খাওয়ার সময় প্রত্যাশা কে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করেছিলাম “ওর ভাইয়্যা কোথায়”। ফুফু শ্বাশুড়ি এটা বুঝতে পেরে বলেছিলেন,
– প্রত্যয়ের লাইগ্যা বইয়্যা থাইক্যা লাভ নাই। তারে রাইতের আগে আর পাওন যাইবো না। বন্ধু গো লগে আড্ডায় মইজা আছে। তোমার খাওন তুমি খাও। জামাইয়ের লগে একসাথে খাওনের সময় এহনো শেষ হইয়্যা যায় নাই।
ফুফুর কথা শুনে সবাই মুখ টিপে হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছিলো। খুব লজ্জা পেয়েছিলাম আমি তখন।
সন্ধ্যের পর প্রত্যয় বাসায় আসলেন। তাকে দেখে আবার আতঙ্ক কাজ করতে শুরু করলো আমার মনের ভেতর। রাত হতে তো বেশি দেরী নেই! খুব করে চাচ্ছিলাম, রাতে যেন আমার আবার জ্বর আসে। ঠিকই রাতে আমার জ্বর বেড়ে গেল। খাওয়াদাওয়া শেষ করে প্রত্যয় রুমে আসার আগেই আমি কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কখন ঘুমিয়েছি মনে নেই।
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে পাশ ফিরে দেখলাম, প্রত্যয় আমার পাশে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছেন। বেশ কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে ছিলাম প্রত্যয়ের ঘুমন্ত মুখটার দিকে। বিয়ের পর এই প্রথম আমি আমার স্বামী কে এত মনোযোগ দিয়ে দেখছি। চাপ দাড়ি, উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারাটায় মায়া যেন ঠিকরে পড়ছে। প্রত্যয় কে নড়তে দেখে আমি আবার চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে রইলাম। কিছুক্ষণ পর টের পেলাম, প্রত্যয় আমার কপালে হাত দিয়ে জ্বর আছে কিনা দেখে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিচ্ছে। এই স্পর্শ পাওয়ার সাথে সাথে আমার প্রতিটি শিরা উপশিরার ভেতর দিয়ে কেমন যেন একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। আমি অনুভব করতে পারছিলাম, এ এক পবিত্র অনুভূতি। সকালে প্রত্যয়ের চোখ লাল দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
– আপনার চোখ লাল কেন? প্রত্যয় শুধু বলেছিলেন,
– ও কিছু না। ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিলাম, তখন প্রত্যাশা এসে বললো,
– জ্বর কমেছে ভাবী?
– হ্যাঁ।
– কমবে না! ভাইয়্যা দুই রাত ধরে যা সেবা দিচ্ছে! প্রত্যাশার মুচকি হাসি দেখে আমার সন্দেহ হল। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
– সেবা দিচ্ছে মানে?
– গত দুই দিন তুমি ঘুমিয়ে যাওয়ার পর ভাইয়্যা অনেক রাত পর্যন্ত তোমার কপালে জলপটি দিয়ে দিয়েছিলো।
তোমার মাথার কাছে বসে বসে ঝিমিয়েছেও বেশ কিছুক্ষণ। নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছিলো আমার। ছিঃ একটু আগে এসব কি ভাবছিলাম! বিকেল বেলা প্রত্যয় জোর করে আমাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে গেলেন। চেকআপ করে ডক্টর বললেন, ভাইরাস জ্বর। ভয়ের কিছু নেই। আর শরীরে দূর্বলতা আছে। ডক্টর দেখিয়ে বের হয়ে রিক্সা নেয়ার সময় রাস্তার ওপাশে দাঁড়ানো ফুচকাওয়ালার দিকে চোখ গেল আমার। প্রত্যয় আমাকে নিয়ে রাস্তা পার হলেন। রাস্তা পার হওয়ার সময় খুব যত্ন নিয়ে আমার বামহাত টা আগলে ধরলেন। তারপর ফুচকাওয়ালার কাছে গিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
– এক প্লেটে চলবে?
আমি শুধু হা হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমি তো উনাকে বলি নি আমার ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছে! ফুচকা খাওয়ানোর পর আমাকে অনেকগুলো কাঁচের চুড়িও কিনে দিলেন। কাঁচের চুড়ি আমার খুব পছন্দ, এটাই বা উনি কি করে জানলেন! সেদিন আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। এভাবে ধীরে ধীরে প্রত্যয়ের সাথে আমার সম্পর্ক টা স্বাভাবিক হতে লাগলো। আর “স্বামী” নামটার প্রতি ভয়টাও আস্তে আস্তে কাটতে শুরু করলো। একবার কথায় কথায় প্রত্যয় বলছিলেন,
– আপনি চোখে কাজল পড়েন না? চোখে কাজল পড়লে আপনাকে কিন্তু খুব সুন্দর দেখাবে।
এতটা দরদ নিয়ে কেউ আগে কখনো আমাকে বলে নি যে,চোখে কাজল পড়লে আমাকে সুন্দর দেখাবে। এমনকি জারিফও না। প্রতিদিন সকালে আমি ঘুমিয়ে আছি ভেবে আমার কপালে চুমু দেয়া, এখানে আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা, আমার কিছু লাগবে কিনা নিয়মিত তদারকি করা, প্রত্যয়ের এই ছোট ছোট ব্যাপারগুলো আমাকে ঘায়েল করে দিচ্ছিলো দিনে দিনে। এক রাতে আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলাম। প্রত্যয় কখন রুমে এসেছে খেয়াল করি নি। আনমনে বই পড়তে পড়তে যখন খেয়াল করলাম, প্রত্যয় আমার কাছে এগিয়ে আসছে, আমি খুব অস্বস্তি বোধ করে সরে যেতে নিলাম। প্রত্যয় আমার ভুল ভেঙে দিয়ে আমার পাশে পড়ে থাকা ল্যাপটপ টা হাতে নিয়ে বললেন,
– এটা নিতে এসেছিলাম। ভয় পাবেন না, আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি কিছু করবো না। এটা বলে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আবার পেছনে ফিরলেন,
– কিন্তু তাই বলে আবার ভেবে বসবেন না “আমি অক্ষম”। যেদিন সম্মতি পাবো, সেদিন আপনাকে স্বর্গ দেখিয়ে দিবো। প্রত্যয়ের শেষ কথাটা আমার বুকের বাম পাশে গিয়ে বিঁধলো একদম। বৌভাতের দু’দিন আগে সকালবেলা মীনা কল দিলো। মীনা আমার ক্লাসমেট। আমি কল রিসিভ করলাম,
– হ্যালো মীনা।
– কেমন আছিস তানহা?
– ভালো আছি। তুই হঠাৎ কি মনে করে?
– তোর নতুন সংসারের খবর নিতে ইচ্ছে করলো তাই কল দিলাম।
– আর খবর। বিয়ের দিন রাতেই জ্বর বাঁধিয়ে ফেললাম।
– আল্লাহ্ কি বলিস! এখন কেমন আছিস?
– এখন জ্বর নেই। ঠিক আছি। তোর কথা বল।
– আমার তো নতুন কোনো কথা নেই তবে নতুন একটা খবর আছে।
– কি খবর?
– জারিফ মীরার সাথে চুটিয়ে প্রেম করছে। আমরা সবাই খুব অবাক হয়েছি, জারিফের মত ছেলে মীরা কে কিভাবে চুজ করলো! জারিফের রুচি এমন, সত্যি আমাদের জানা ছিল না।
মীনার সাথে কথা শেষ করে আমি ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। মীনার কথাগুলো কানে বাজছে তখনো। ভার্সিটির মধ্যে সুন্দরীদের শীর্ষে মীরার নাম রয়েছে। সবাই তার রূপের যতটা প্রশংসা করে, তার চেয়েও বেশি নিন্দা করে তার চরিত্রের। মাসে মাসে বয়ফ্রেন্ড চেঞ্জ করার সুনাম রয়েছে মীরার। আমি ভাবতে পারছিলাম না, জারিফ কিভাবে মীরা কে পছন্দ করলো! সেদিন সারাদিন আমার খুব মন খারাপ ছিল। না, এই মন খারাপ জারিফের জন্যে না। ভুল মানুষের পেছনে আমার মূল্যবান অনুভূতিগুলো নষ্ট করার আক্ষেপে। আমার মন খারাপ বুঝতে পেরে প্রত্যয় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
– আপনার মন খারাপ? আমি প্রত্যয়ের দিকে ঘুরে বসে পালটা প্রশ্ন করলাম,
– কখনো কাউকে ভালবেসেছেন আপনি? প্রত্যয় খানিকক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলেন,
– আসলে ভালবাসা জিনিস টা খুব পবিত্র। বিয়ের আগে কাউকে ভালবেসে আমি সেই পবিত্রতা নষ্ট করতে চাই নি। আর এ যুগের ভালবাসা মানেই অবাধ মেলামেশা। যদিও দুই একটা ব্যতিক্রম পাওয়া যাবে। তবে মিথ্যে বলবো না, ভাল না বাসলেও, ভার্সিটি তে একজন কে আমার খুব ভাল লাগতো। তার গানের গলা ছিল খুব সুন্দর। মূলত আমি তার গানের প্রেমে পড়েছিলাম।
– প্রপোজ করেছিলেন? প্রত্যয় এবার প্রশস্ত হাসি দিলেন,
– ভাল লাগতো, ভাল তো বাসতাম না। তাই প্রপোজ করার কথা মাথায় আসে নি কখনো। তাছাড়া আমাকে দিয়ে আর যাই হোক, প্রেম হবে না। গার্লফ্রেন্ডের প্যানপ্যানানি সহ্য করার মত আদর্শ বয়ফ্রেন্ড আমি কখনো হতে পারবো না। আর এমনিতেও কেউ আমার প্রেমে পড়বে না। তাছাড়া আমার বউয়ের জন্যে আমার সব ভালবাসা জমিয়ে রেখেছি আমি। ওকে আমি আমার সব কিছু উজার করে দিবো। কথা শেষ করে আমার চোখে চোখ পড়তেই প্রত্যয় কি যেন একটা অজুহাত দেখিয়ে আমার সামনে থেকে চলে গেলেন। প্রত্যয় চলে যাওয়ার পর আমি জারিফ আর প্রত্যয় কে পাশাপাশি রেখে হিসেব মিলাতে শুরু করলাম, একজন সুন্দরের পূজারী আর অন্যজন পবিত্রতার!
এই ক’দিনে আমি নিজের অজান্তে একটু একটু করে প্রত্যয় কে আবিষ্কার করেছি। কিছু কিছু মানুষদের দূর থেকে দেখে প্রেমে পড়া যায় না, কিন্তু তার সান্নিধ্যে কিছু সময় জড়িয়ে থাকলে প্রেমে পড়তে বাধ্য হতে হয়। প্রত্যয় হচ্ছে তেমনি একজন মানুষ। আজকাল প্রত্যয় একটু চোখের আড়াল হলেই আমার অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়। প্রত্যয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য মরিয়া হয়ে থাকি সবসময়। ওর মধ্যে আমি কখনো কোনো ভণিতা বা ছলনা খুঁজে পাই নি। এই মানুষ টা কে আমার কাছে খুব স্বচ্ছ মনে হয়। মানুষটার সংস্পর্শে যতক্ষণ থাকি,ততক্ষণ নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ লাগে।
আগে ভাবতাম পারিবারিকভাবে বিয়ে হওয়া মানে নিজের শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে সারাজীবন আরেকজনের দাসত্ব করে যাওয়া।
কিন্তু এখন বুঝতে পারছি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে আর প্রত্যয়ের মত এমন একজন জীবনসঙ্গী পেলে এরেঞ্জ ম্যারেজেও সুখী হওয়া সম্ভব। আবার জারিফের মত প্রেমিক হলে লাভ ম্যারেজেও জীবনটা কে নিজ দায়িত্বে তেজপাতা করে দেয়া যায়। এই পৃথিবী তে জারিফদের সংখ্যা বেশি হলেও, প্রত্যয়দের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। নয়তো “ভালবাসা” নামক শব্দটার কোনো অস্তিত্ব থাকতো না। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর আমি কাপড় ভাঁজ করছিলাম আর প্রত্যয় ল্যাপটপে কাজ করছিলেন। আমি প্রত্যয়ের সামনে গিয়ে খুব কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলাম,
– আমাকে আপনার কেমন লাগে? আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে প্রত্যয় চোখ তুলে তাকালেন কিন্তু ঘাবড়ালেন না। খুব স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলেন,
– শারীরিকভাবে মায়াবতী লাগে আর মানসিকভাবে আমার অর্ধাংগিনী। তারপর ল্যাপটপ বন্ধ করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। আর আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। অর্ধাংগিনী শব্দ টা তে প্রচণ্ড ঘোর লেগে গেল আমার। আজ আমার বৌভাত। পার্লারে না সেজে বাসায় নিজে নিজে সাজতে ইচ্ছে করলো। এ কথা প্রত্যয় জানার পর ঘরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
– আপনি নাকি পার্লারে যাবেন না? আমি শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে বললাম,
– হুম। যাব না। একা একাই সাজবো। চোখে গাঁঢ় করে কাজল টেনে দিবো।
– আপনাকে কেউ কিছু বলেছে?
– না তো। আমি নিজের ইচ্ছায় ই পার্লারে যাচ্ছি না। কেন, সাদাসিধে সাজে আপনার পোষাবে না বুঝি? কিছু একটা ভেবে প্রত্যয় আবদার করে বসলেন,
– আমি যদি আপনার সামনে বসে থাকি তাহলে কি আপনার সাজতে অসুবিধে হবে? মুচকি হেসে বললাম আমি,
– না, অসুবিধে হবে না। প্রত্যয় দরজা টা লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় গিয়ে আয়েশ করে বসলেন। আমি সাজতে শুরু করলে আচমকা প্রত্যয় আমাকে থামিয়ে দিলেন,
– এই ওয়েট ওয়েট। একটা সিগারেট ধরাতে পারি? আসলে কাঙ্ক্ষিত কিছু দেখতে বসলে আমার সিগারেট টানতে হয়। নয়তো মজা পাই না। এমনিতে আমি খুব একটা সিগারেট খাই না। আমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। কাজল টা হাতে নিয়ে শুধু বললাম,
– সিগারেটের গন্ধে আমার কোনো এলার্জি নেই।
তারপর নিশ্চিন্তে প্রত্যয় একটা সিগারেট ধরালেন। যতক্ষণ আমি সাজছিলাম,ততক্ষণ প্রত্যয় আমার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলেন আর সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছিলেন। সাজ কমপ্লিট হয়ে যাওয়ার পর প্রত্যয় এসে আমার পেছনে দাঁড়ালেন। আয়নায় প্রত্যয় কে দেখে আমি যেন থমকে গেলাম। ক্ষণে ক্ষণে হার্টবিট মিস করতে লাগলাম। আমার কাঁধে হাত রেখে প্রত্যয় বললেন,
– অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগছে আপনাকে। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে লজ্জায় চোখ বন্ধ করে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে শুধু এতটুকু বলতে পারলাম,
– ভালবাসি। আর প্রত্যয় বোকার মত প্রশ্ন করলেন,
– আমি কি আপনার হাত টা ধরতে পারি? আমি চোখ খুলে দুষ্ট হাসি হেসে প্রত্যয়ের শার্টের কলার খামচে ধরে প্রত্যয় কে আরো কাছে টেনে নিয়ে আসলাম। চোখে চোখ রেখে ফিসফিস করে বললাম,
– ভালবাসি’র প্রতিউত্তরে ভালবাসি’ই বলতে হয়, অনুমতি প্রার্থনা নয়।
এর মধ্যে দরজায় কড়া নেড়ে প্রত্যাশা তাড়া দিতে শুরু করলো,কমিউনিটি সেন্টারে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
স্টেজে বসে থেকে আমি শুধু প্রত্যয় কে দেখছিলাম বারবার। ব্লাক কালার ব্লেজার আর ব্লু কালার শার্টে আজ খুব ম্যানলি লাগছে ওকে। আমন্রিত অতিথিদের সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে প্রত্যয় তার দুষ্ট চাহনি দিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, “আজ রাতে সত্যিই আমাকে স্বর্গ দেখিয়ে দিবেন”