—এই কি হচ্ছে কী??? দেখছেন না রান্না করছি, আবার দুষ্টুমি করা হচ্ছে না???
—আরে আমার বউকেই তো আদর করছি অন্য কারো বউয়ের সাথে তো দুষ্টুমি করছি না।
—সব সমই তো করেন, মন ভরেনা????
—মন কী ভরার জিনিস????
—তা ভরবে কেন, এখন যান রান্না শেষ করে নিই।
—তুমি রান্না কর আমি আমার কাজ করি।
—আপনার কাজ মানেই তো খালি দুষ্টুমি…
—তাই বুঝি??? ঠিক আছে গেলাম আমি…
—-ওলে বাবা, বাবু দেখছি রাগ করছে, আর গাল ফোলাতে হবে না, টেবিলে যান নাশতা দিচ্ছি ।
আর কিছু না বলে টেবিলে এসে চেয়ার টেনে বসলাম, কিছুখন মোবাইলে গেম খেললাম। একটু পরে জান্নত রুটি আর ডিম ভাজি নিয়ে এলো। দুজনে বসলাম পাশাপাশি, জান্নাত নিজে হাতে করে খাইয়ে দিতে লাগল, আর নিজে খেতে লাগল। আর আমি শুধু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছি, মুখের উপর আসা চুল গুলো ফু দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছি, এতে জান্নাতের মুখে ফু লাগতেই সে চোখ বন্ধ করে নিচ্ছে। আর সেই মায়াবি দৃশ্যটি দেখছি দুচোখ ভরে, যেন হাজার বছর দেখতে চাই ঐ দৃশ্য, তাতেও চোখ জুরোবে না…..
—ঐ হা করে কি দেখছেন হুম, নিন খেয়ে নিন। না হলে অফিসে লেটেন তো।
—আমার বউকে দেখতে সুন্দর সে। উম, দাও।
আসেন এই ফাকে পরিচয় পর্ব শেষ করি, আমি রাশেদুর ইসলাম । আর ও আমার বউ জান্নাত। আমি একটা কম্পানিতে চাকুরি করি। চাকরি সূত্রে এই শহরেই থাকি। খাইওয়া শেষ করে রেডি হতে এলাম, বিছানার উপর শার্ট, প্যান্ট, বেল্ট, ঘড়ি, মানিব্যাগ সব সুন্দর করে সাজানো রয়েছে। পাশেই জান্নাতের পোশাক গুলোও। বউটা আমার সেই ভাল, সবকিছু গুছিয়ে রাখে সবসময়। আমার কখন কী দরকার আমার চেয়ে ও বেশি জানে বুঝে দুজনে রেডি হয়ে রওনা হলাম। আমি অফিসে আর জান্নাত কলেজে যাবে।
—উঠো।
—হুম উঠছি মসাই, চলেন যায়।
—শক্ত করে ধরবে, না হলে পড়ে যাবে কিন্ত ।
—সব বুঝি, ব্রেক কষার ধান্ধা…..
—বোঝই যখন জরিয়ে ধরলেই তো হল।
—হয়েছে হয়েছে চলেন। গন্তব্য একই পথে হওয়ার এই সুবিধা, প্রথমে জান্নাতকে ওর কলেজে নামিয়ে দিয়ে আমি অফিসে যায়।
—এই আস্তে চালান এত জোরে চালাচ্ছেন কেন বাইক???
—আমাকে জোরে ধরে রাখ, ভরসা আছে না আমার উপর????
—হুম আছেই তো, না হলে কি আপনাকে ভালবাসতাম???? প্রাই ২০মিনিট পরেই ওর কলেজে নামিয়ে দিলাম।
—হাই দুলাভাই… কেমন আছেন বলেন।(জান্নাতের বান্ধবীরা)
—হাই শালীকারা…. আমি ভাল আছি.তোমরা কেমন আছ বল।(আমি)
—আপনি তো ভাল থাকবেনই, আমাদের এত ভাল ও সুন্দরী বান্ধবীকে যে পটিয়ে নিলেন। আমরাও ভাল আছি…..
—এই তোরা কী শুরু করলি।(জান্নাত)
—তুই চুপ থাক, আমাদের দুলাভায়ের সাথে আমরা মজা করছি, তোর কি??? তুই তো সব সময় সাথে থাকিস যা ইচ্ছা করিস। তখন কী আমরা বলতে যায়????? তা দুলাভাই আজ আমরা একটু ঘুরতে যাব আমাদের বান্ধবীকে কি ছাড়া যাবে?? সন্ধার আগেই পৌছে যাবে….
—আরে তোমরা ঘুরতে যাবা তো সমস্যা কোথায়???? আমাকে নিবানা, চাইলে আমিও জয়েন করতে পারি।
—সত্যি??? আপনি যাবেন না অন্য ধান্ধা আছে??? সবাই অবাক হয়ে।
—হুম। অন্য ধান্ধা কিসের????
—না বউকে ছেড়ে মন টানছে না???
—আরে না, ঠিক আছে যেও, অফিসে দেরি হচ্ছে আমি আসি। বলেই আগাতে লাগলাম অফিসের দিকে।
—দুলাভাই বিকাল পাঁচটার সময় এখানেই দেখা করবেন অপেক্ষা করব আমরা চেচিয়ে বলল জান্নাতের এক বান্ধবী । আমি কিছু না বলে চলে এলাম। অফিসে পৌছে জান্নাতকে “টেক্সট” করে জানিয়ে দিলাম। এখন ক্লাসে আছে ফোন করা যাবে না। ফ্রি হলে সে নিজেই ফোন করবে। ঠিক এক ঘন্টা পর কল এলো জান্নাতের।
—হুম বলো..
—ঠিক মতন পৌছাইছেন???
—হুম পৌছাইছি। ক্লাস শেষ???
—এক ক্লাসের বিরতি চলছে।
—কি কর???
—পাজী গুলোর সাথে বসে আছি।
—কী বললি আমরা পাজী??? এখন বরের কাছে ভাল সাজা হচ্ছে না। নিজে যখন ছেলেদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোড়াতে তখন কী হুম???? (পাশ থেকে জান্নাতের কোন এক বান্ধবী) ফোনের ভেতর থেকেই শোনা যাচ্ছে সব।
—ঠিক আছে সাবধানে থেকো। বলেই রেখে দিলাম।
আর কথা বাড়ালাম না, জানি ওরা এখন ঝগরা করবে দুপুরে আবার কল দিবে। তাই কাজে মন দিলাম, অনেক কাজ জমা আছে, সেগুলো শেষ করতে হবে। কাজ করতে করতে দুপুর হয়ে গেছে খেয়ালই করিনি। জান্নাতের কলে খেয়াল হল।
—হ্যা বলো।
—কি করছেন।
—এই তো যা কাজ আরকি, একটা ফাইল দেখছি….
—দুপুরে খাইছেন আপনি???
—আরে মনেই নেই, যাচ্ছি খেয়ে নিচ্ছি । তুমি খাইছ।
—না খাইনি, এখন ক্লাস শেষ হল ক্যান্টিনে যাব সবাই মিলে। পুরটা খেয়ে শেষ করবেন কিন্ত ।
—হুম মহারাণী সবটাই খাবনে, আপনিও যেয়ে খেয়ে নিন বান্ধবীদের সাথে।
—আচ্ছা যাচ্ছি বিকেলে চলে আসবেন কিন্ত ঘুরতে যাব সবাই।
—আরে আমি তো মজা করে বলছি তখন।
—সবাই আসতে বলছে তো।
—আচ্ছা। দেখি
—দুলাভাই আসতেই হবে (পাশ থেকে)
খেয়ে এসে নিজের কেবিনে বসলাম। বউ প্রতিদিন নিজ হাতে তৈরি করে দেই খাবার। বাইরের খাবার নিষেধ।
কি করা বউ এত যত্ন নিয়ে তৈরি করে দেয়। বউটা আমাকে একটু বেশিই ভালবাসে। একটু না অনেকটা বেশি ভালবাসে। না হলে আমার মত একজনকে কেন বালবাসবে সে, তাঁর তো আমার চেয়ে অনেক ভাল ছেলে পাওয়ার কথা। কোথাই সে আর কোথায় আমি???? চাকরি সূত্রে আমি জান্নাতদের ভারাটিয়া। একটা ফ্যামেলির সাথে সাবলেট থাকতাম। ব্যাচেলর তো ভারা পাওয়া যায় না, ম্যাসেও থাকতে ইচ্ছা করে না। অফিসের এক কলিগ+আঙ্কেলের সাথে থাকি আমি জানতামই না যে এই বাড়িওলার কোন মেয়ে আছে, যদি না সে দিন জান্নাতের বাবা মানে আমার শ্বশুর তাঁর মেয়েকে পড়াতে বলত।
জান্নাতের বাবার সাথে মাঝে মাঝেই ছাদে জমপেশ আড্ডা হত, বেশ সরল সোজা মানুষ উনি, মেয়েটাও তেমনি।
আড্ডার ছলেই তিনি আমার খুটি নাটি সব কিছু জেনে যান, আমিও সরল মনে সব বলে দেই। একমাত্র এনার সাথেই সন্ধার আগের সময় টা কাটাতে পারি। খুবই ভাল মানুষ তিনি ঐ বাড়িতে ওঠার দু বছর পরে একদিন তিনি তাঁর মেয়েকে পড়াতে বলেন। সে দিন আমি খুব অবাক হয়, তাঁর মেয়ে আছে শুনে। আড্ডার ছলে সব কথা হলেও তাঁর যে মেয়ে আছে কখনো বলেনি। একটি ছেলে আছে জানি। আরো অবাক হলাম যখন শুনলাম যে তাঁর মেয়ের নাম জান্নাত সে অনার্স পড়ুয়া। তাঁর এত বড় মেয়ে আছে অথচ কখন দেখলামও না। বেশ কয়েকবার তো তাদের বাড়িতে গেছি। উনার ছেলে উনি আর উনার স্ত্রী ছাড়া তো কাওকেই দেখিনি কৌতুহলী হয়েই জিগেস করলাম
—আপনার মেয়ে আছে কখনো বলেন নি তো????
—তুমিও তো আমার ফ্যামেলি সম্পর্কে কখনো জানতে চাওনি।
—তা ঠিক, কিন্ত আমি এত দিন আছি জানার কথা ছিল না।
—তা ঠিক, কিন্ত সে তেমন বাইরে বেরোই না, কলেজ আর মাঝে মাঝে আমারা ঘুরতে যাই এই আরকি।
—এইজন্যই হয়ত….
—তা কালথেকে বাসায় চলে আসো।
—আসলে অনেকদিন প্যাক্টিস নেই সেই কবে টিউশনি করছি।
—শোন যে পারে সবসময়ই পারে, কদিন পরে এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। আর কোন কথা নয় কাল থেকেই আসছ এটাই ফাইনাল।শুরু কর কদিন পরে সব ঠিক হয়ে যাবে আর আমি বাইরের কাওকে আনতে চাচ্ছি না বলেই তোমাকে বললাম এখন কাজ গুলো সেরে নিই, আজ একটু আগেই বেরতে হবে। ৪:৩0 বাজতেই জান্নাতের ফোন এসে হাজির।
—এই আপনি কখন আসবেন, আমরা রেডি তো।
—এই তো বের হব। একটু অপেক্ষা কর আসছি।
—হুম, সাবধানে আসবেন।
—ঠিক আছে। বাইক অফিসে রেখেই বেড়িয়ে পরলাম, ওরা অনেকে আছে তাই। ২৫মিনিট পরে জান্নাতের কলেজ গেটে পৌছালাম। ওরা তো গাড়ি নিয়ে রেডি। আমি আসতেই
—বাব্বাহ, বউয়ের প্রতি কত টান। সময়ে ৫মিনিট আগেই চলে আসছে।
—আরে না, রাস্তা ফাকাছিল তাই।
—আর বলতে হবে না, আমরা বুঝি। চলেন যায়।
—হুম চলো।
আমি ড্রাইভারের সাথে সামনে, আর জান্নাত আর ওর বান্ধবীরা পেছনে বসে মজা করছে। আমি লুকিং গ্লাসে দেখছি সব। এই প্রথম এমন মজা করতে দেখছি জান্নাতকে, খুব ভাল লাগছে…… কত প্রান চঞ্চল একটা মানুষ জান্নাত লুকিং গ্লাসের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হল। সাথে সাথে সে চোখ নামিয়ে নিল। এইটা দেখে ওর বান্ধবীরা মুখে কিছু না বললেও মুখ টিপে হাসছিল। বেশ লজ্জাই পরে গেলাম আমরা দুজনে। এরপর এক নদীর পাড়ে এসে আমাদের গাড়ি থামল। সবাই নেমে মজা করতে লাগল। জান্নাতও তাদের সাথে মজা করছে। আমি এক পাশে নদীর পাড়ে বসে নদীর দিকে এক মনে চেয়ে রয়েছি। কিছুখন পরে জান্নাত এসে আমার পাশে বসল।
—কী মন খারাপ করছেন??? আসলে অনেকদিন পরে আসছি তো তাই।
—আরে না, আমারো অনেক ভাল লাগছে, কত দিন পরে এরকম পরিবেশে আসলাম। শহরের পরিবেশে হাপিয়ে উঠেছিলাম। অনেক সুন্দর ও মনোরম পরিবেশ। জান্নাত আর কিছু না বলে আমার বাম হাত জরিয়ে ধরল, আর কাঁধে মাথা দিল। আমিও এক হাত দিয়ে জরিয়ে নিলাম শক্ত করে। সাথে কপালে একটা চুমু একে দিলাম। সন্ধার লাল সূর্য অস্ত যাওয়ার অপেক্ষায়, দুজনে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছি ভুলেই গেছি আমরা এখানে একা না আরো অনেকে আছে। একে অপরের মাঝে এতটাই হাড়িয়ে গেছি যে ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক । পেছনে কারো কাশির শব্দে ঘোর কাটল আমার আর জান্নাতের ।
—কি রোমিও জুলিয়েট এখানে এভাবে বসেই থাকবেন না বাড়ি ফিরতে হবে????
—হুম ফিরতেই তো হবে। আসলে…
—-থাক আর বলতে হবে না… সব বুঝি। এখন আসবেন না আমরাই ফিরে যাব।
—আরে আসছি তো।
বলেই উঠে পরলাম, জান্নাত মনে হয় এরকম কান্ডে লজ্জাই পড়ে গেছে। একটা কথাও বলছে না। এরপর বাসার দিকে চললাম। কলেজ গেটে আসতেই সন্ধা পার। আমাদের নামিয়ে দেয়া হল, কারন ওরা এখন অন্য দিকে যাবে। ওদের বাড়ি আমাদের বাড়ি ভিন্ন পথে তাই। জান্নাতকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। এখন বাসাই ফিরে ও রান্না করবে কি দরকার, আজ বাইরেই খাই। অনেক দিন বাইরে খাওয়া হয় নি যদিও জান্নাত না করছিল অনেক। ওর কথা বাইরের খাবার অসাস্থকর। বাসাই ফিরে ফ্রেশ হয়ে টিভি দেখতে লাগলাম, রোমান্টিক একটা সীন আসতেই জান্নাত অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল লজ্জাই ।
সেটা লক্ষ করে জান্নাতকে আমার দিকে টেনে নিয়ে ওর ঠোটের মাঝে আমার ঠোট জোরা ডুবিয়ে দিলাম।
দুজনের ঠোট আলাদা করতেই আমার বুকে মুখ লুকালো। টিভি অফ করে দিলাম। বাইরে পূর্ন জোস্না। জানালা দিয়ে জোস্নার আলো ঘরে আসছে। জান্নাতকে কোলে করে ছাদের দিকে পা বাড়ালাম। ওকে কোলে নিতেই আমার গলা জড়িয়ে ধরে থাকল। মুখে অবাক আর লজ্জা মিশ্রিত এক আভা ফুটে উঠেছে।যার কোন বর্ননা করার সাধ্য আমার নেই ছাদে গিয়ে ওকে দোলনাই বসিয়ে দিলাম। ছাদে অনেক রকমের ফুলের গাছ আছে। তাদের সুবাসে ছাদ একদম মুখরিত হয়ে আছে। হাসনাহেনার সৌরভের রাজত্ব যেন একটু বেশিই দোলনাই জান্নাতকে বসিয়ে ওর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পরলাম।
জান্নাত আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর আনমনে কত কথা যে বলছে তার কোন হিসাব নেই। তার ইচ্ছা, ভবিষ্যত নিয়ে পরিকল্পনা। আরো কত কি। আমি শুধু মাঝে মাঝে হ্যা না উওর দিচ্ছি আর ওর মুখের দিকে চেয়ে আছি। জান্নাতের মুখে এখন কথার খই ফুটছে। আমি একজন ভাল শ্রতার মতন শুনছি শুধু জোস্নার আলো যেন ওর সৌন্দর্য শত গুন বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই সৌন্দর্য বাসর রাতে দেখেছিলাম, জীবনের প্রথম যখন বাসর রাতে ওকে দেখেছিলাম, যেন অপার কোন সৌন্দর্যের মায়ায় বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলাম আমি। আল্লাহ সৃষ্টি যে এত সুন্দর ও মায়াময়ী তা নতুন করে বুঝেছিলাম সেদিন আজো যেন সেই মায়ায় টানছে আমাকে, মন চাইছে না এই মায়ামাখা মুখখানি থেকে চোখ ফেরাতে যেন সারাজীবন এভাবেই তাকিয়ে থাকি হাড়িয়ে যায় ঐ মায়ায়… ভুলে যায় সব বাঁধা…
সমাপ্ত