মায়া

মায়া

ঘুম থেকে উঠেই মেজাজ চূড়ান্ত খারাপ হয়ে গেল। কারন ব্রাশ হাতে বেরুতেই আবীর ভাইয়ার সামনে পরেছি।এখন টানা খানিকক্ষণ লেকচার দেবে।

-তুই এত দেরী করে ঘুম থেকে উঠলি?
-হুম
-জানিস না কত কাজ পরে আছে?
-হুম
-তবুও লেট করলি?
-হুম
-কেন?
-জানি তো, আপনি আছেন।

বলে আবীর ভাইয়াকে হা করিয়ে রেখে রুমে চলে আসলাম। অবশ্য সে খুব সহজে হা হয় না। বড়দা ভাইয়ের বিয়ে। আবীর ভাইয়া মেজদা ভাইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড। আমরা তিন ভাইবোন।

তারমধ্যে আমি ছোট।আগামী সাতদিন আবীর ভাইয়া আমার চোখের সামনে ঘুরে বেড়াবে, আর আমায় সেটা মুখ বুজে দেখতে হবে। ভাবতেই কান্না পাচ্ছে।কারন এই মানুষটিকে আমি ভীষন পছন্দ করি। আই থিংক ভালোওবাসি। আর সে সবসময় গম্ভীর মুখে আমাকে উপদেশ দিবে। অসহ্য! অনেকক্ষন ধরে ছাদে বসে আছি। শীতের মরা রোদে পা মেলে গল্পের বই পড়ছি। গ্রীনের দ্যি কমেডিয়ানস। বইটা ভীষন ভাল। হিম হিম ঠান্ডা বাতাসে আমারও ভাল লাগছে। ভীড় আমার কখনোই ভাল লাগে না। তাই বিয়ে বাড়ির ঝামেলা থেকে দূরে আছি।বইয়ের উপর কারো ছায়া পরতে পিছনে তাকালাম।
আবীর ভাইয়া।

-তুই এখানে কেন?
-কেন?
-আশ্চর্য! কেন সেটা তুই বলবি।
-বই পড়ছি
-সেটা রুমে বসেও পড়া যায়। ঠান্ডায় বসে পড়ার দরকার কি?
-এখানে ঠান্ডা কোথায়?আমার এখানেই ভাল লাগছে।
-আর বিয়ে বাড়ি। হেল্প করলেওতো পারিস ।
-আমি হেল্প না করলে বিয়ে আটকে থাকবে না। আর আমি ছাড়াই কাজকর্ম খুব ভাল এগুচ্ছে । এখন তুমি যেতে পারো ।

বলে বইয়ের দিকে মুখ ফিরালাম।মনে মনে চাচ্ছি আবীর ভাইয়া যেন না যায়।খানিকক্ষন ইতস্ততভাবে দাঁড়িয়ে থেকে নেমে গেল। আমার ভীষন কান্না পেল। বড়দা ভাইয়ের বিয়ে কাল।আত্মীয়-স্বজন যে যেখানে ছিল এসেছে। ভুল হলো । আনানো হয়েছে । বাবা যাই করুক। সবাইকে নিয়েই সেটা করবে। রুমে বসে আছি। মেজদা ভাই হন্তদন্ত হয়ে এলো,

-এই তিতির
-বলো
-বাসর কি ফুল দিয়ে সাজানো হলে ভাল হবে রে?
-ডেকোরেশনের লোকজন আসে নি?
-হ্যা। ওরা বলেছে গোলাপ আর রজনীগন্ধা। আবীরের সেটা পছন্দ না।
-তাকেই গিয়ে জিজ্ঞেস করো না কেন।
-আহ! বল তাড়াতাড়ি।
-কাঁঠালচাঁপা, বেলি, আর জুঁই। যেমন হন্তদন্ত হয়ে এসেছিল,সেভাবেই চলে গেল মেজদা ভাই। আমি ইয়ারফোন নিয়ে ছাদে যাওয়ার জন্য বের হতেই মা ডাকলো,
-তিতি
-হ্যা মা
-দেখতো কাল কি শাড়িটা পরবো।

মাকে শাড়ি বেছে দিয়ে ছাদে এলাম। প্রতিদিন একবার অন্তত আমার ছাদে আসা চাই। সবাই ঘুমিয়ে গেলে যখন সমস্ত চরাচর স্তব্ধ হয়ে যায়। আমি ছাদে আসি।গায়ে চাদর টেনে হিম শীতে দাঁড়িয়ে থাকি। অটুট নিস্তব্ধতা মাঝে মাঝে বুকের ভেতর কাঁপন তোলে। শিশির পরার শব্দ শুনতে পাই স্পষ্ট। আমার ভাল লাগে হিমে দাঁড়াতে। মাঝে মাঝে আবীর ভাইয়ার কথাও ভাবি। তারপর যখন ঠান্ডায় দাঁতে দাঁত ঠকঠক করে। তখন ধীর পায়ে ঘরে চলে যাই।

বড়দা ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আবীর ভাইয়া অনেকদিন আমাদের বাসায় আসে না। মাঝে মাঝে মেজদা ভাইকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে আবীর ভাইয়া কেন আসে না। নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করিনা। বাড়ির বাইরেও যাওয়া হয়না খুব একটা। ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরে এসে রুমে ঢুকি। আর রাতে ছাদে। শীত চলে গেছে। বসন্তও যাই যাই করছে। মেজদা ভাইকে একদিন মাকে বলতে শুনলাম, ‘মা, আমি আর আবীর একই কোম্পানিতে জব পেয়েছি ‘।বাড়িতে ভীষন হৈচৈ হলো। ভাবীর সাথে আমার খুব মিল হয়েছে। বিকেলে দুজনই ছাদে বসি। কোনকোনদিন মাও যোগ দেয় আমাদের সাথে। কোন কালেই আমার কোনো বন্ধু ছিল না।

তাই ভাবীই হয়ে উঠলো আমার বন্ধুর মতো। কথায় কথায় তাকে আবীর ভাইয়ের কথাও বলেছিলাম। ব্যস! বাড়ি থেকে সবাই উঠে পড়ে লাগলো আমার বিয়ে দেয়ার জন্য। ভাবী ইদানীং খুব গম্ভীর হয়ে থাকে।শুধু ভাবী না, বাড়ির সবাই। কেমন আড়চোখে তাকায়, ফিসফিসিয়ে কথা বলে আমায় দেখে। ব্যাপারটা ভাল না লাগলেও কৌতুহল দেখাই না।আবীর ভাইকে যে আমি পাবো না বুঝে গেছি। তাই অপেক্ষা করছি। বাড়ি থেকে যে গরু, ছাগল, ভেড়ার সাথে দেবে। সেটার সাথেই ঝুলে যাব। ভার্সিটি থেকে ফিরতেই ভাবী রুমে এলো। চাপা গলায় বললো,

-গোসল দিয়ে চুল শুকিয়ে নে
-আচ্ছা

ভাবী অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকালো। হয়তো ভাবেনি আমি এত সহজে কোনো প্রশ্ন না করে মেনে নিব।ভাবী নিজ গরজেই বললো,

-আজ তোকে দেখতে আসবে
-আচ্ছা

ভাবী অবাক হয়ে চলে গেল। আমি গোসল সেরে খুব সুন্দর দেখে সাদাখোলের বালুচরি শাড়ি বের করলাম।সাদা শাড়িতে শ্যামলা মেয়েদের সুন্দর লাগে। চোখে গাঢ় করে কাজল দিলাম।চুলগুলো খোঁপা করে ফেললাম। ভাবী ডাকতেই দরজা খুলে দিলাম। ভাবী তাকিয়ে আছে। ডাকলাম, বললো চল।

ছেলের বাবা মা কে সালাম দিয়ে বসলাম। ছেলের বাবা শুধু বললো, ‘মা, আমাদের কোনো মেয়ে নেই। তুমি আমাদের মেয়ে হবে ‘। ভাবী বললো, ‘ছেলে মেয়ে একটু কথা বলুক ‘। সবাই সম্মতি দিতেই ভাবী আমাকে টেনে ছাদে নিয়ে এলো।লোকটির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছি। ভাবী চলে গেছে। আমি ওনার দিকে তাকাতে পারছি না। শাল গাছের ওপাড়ে ডুবে যাওয়া সূর্যটাকে দেখছি। লাল রঙ ছড়িয়েছে। আচমকা আমার খোঁপা কাটা টান দিয়ে খুলে বললো, ‘তোকে চুল বেঁধে পেত্নী পেত্নী লাগে ‘। আমি চমকে তাকালাম। আবীর ভাই!

-কি রে?কতসময় ধরে পাশে দাঁড়িয়ে আছি। কথা বলিস না কেন?
-ততত তুমি মানে
-হুম। কেন?
-তুমি এখানে কেন?
-তো কে থাকবে?
-আমি কিছুই বুঝতে পারছি না
-বুঝতে হবে কেন?
-হবে না?
-না
-আমি বুঝতে চাচ্ছি ব্যাপারটা কি?
-বলতেই হবে?
-হ্যা
-আচ্ছা শোন। রোজ গোধূলির সামনে দাঁড়িয়ে তোর গুচ্ছখোঁপা যদি খুলে না দিতে পারি আফসোস থাকবে।

শীতের রোদে পা মেলে চুল ছড়িয়ে আঁচল বিছিয়ে বই পড়িস,সেটা দেখতে না পেলে আফসোস থাকবে। চোখে গাঁঢ় কাজল দিয়ে যখন সামনে দিয়ে ঘুরিস। সেটা না দেখলে আফসোস লাগবে। আরো অনেককিছু না দেখতে পেলে, তোকে না পেলে আফসোস থাকবে। তাই এত আফসোস নিয়ে মরে ভূত হতে চাই না। এই জীবনেই সব চাই। তোকে চাই। কেনরে গাধা!বুঝিস নাই ভালবাসি? আমার চোখে লোনাপানি টলটল করছে। আবীর বলছে,

-তুই তো দেখি পুরাই ইমোশনের ডিব্বা। এবার সত্যি কেঁদে দিলাম। আবীর বিব্রত হয়ে বলে চলেছে,
-কাঁদিস না। বোকা মেয়ে। সবাই আমাকে বকবে।

আচমকা আবীর আমার হাতে হাত রাখলো। আমি অবাক হয়ে চাইলাম ওর দিকে। ও ফিক করে হেসে বললো, ‘লেপ্টে যাওয়া কাজলে তোমাকে দারুণ লাগে ‘। হয়তো কাজলের আড়ালেই ঝুপ করে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল।।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত