স্কুলে পড়াবস্থায় ফিটফাটভাবে চলতে খুব পছন্দ করতাম। কিন্তু ঝামেলা বাঝতো আমার চুলগুলো নিয়ে। ঘুম থেকে উঠার পর শজারুর মত খাড়া হয়ে থাকতো চুলগুলো। আর তনিমা তা দেখে মুখ টিপে টিপে হাসতো আর বলত
– কিরে? সকালে তোর ঘুম হয়নি?
– হয়েছে তো কেন?
– ওয়াশ রুমে গিয়েছিলি?
– হাঁ, কেনো?
– তাহলে তোর চুল খাড়া কেনো?
বলেই হিহিহি করে হাসতো। তনিমা আমাকে দেখে হাসছে তাতে আমার রাগ নেই। কিন্তু অন্য মেয়ে গুলো হাসবে কেন? স্যার বলতো সকাল বেলা বাথরুম না হলে চুল খাড়া হয়ে থাকে। তাই বলে সবার ক্ষেত্রে হবে নাকি !! আমি বহু কষ্টে চুল সাইজ করে পারফিউম মেখে হাটা ধরতাম। রাস্তায় হাঁটার পথে কত কি যে ভাবনায় আসতো। পিটিতে দাঁড়ানোর পর সবার চোখ সামনে থাকলেও আমার চোখ কাউকে খুঁজত। শেষ লাইনে নারিকেল গাছের নিচে দাঁড়াত তনিমা। আড় চোখে তাকাতাম বারবার। চোখাচোখি হলেই তনিমা ভেংচি কেটে হাসতো। আর আমি সে হাসি দেখেই বারবার প্রেমে পড়তাম। একবার প্রেমে পড়তে গিয়ে ধরা খেয়ে গেলাম হ্যাডস্যারের কাছে
– এই ছেলে এই দিকে এসো
– জ্বি স্যার
– পিটির সময় ডান বাম তাকানো নিষেধ জানো?
– জ্বি স্যার
– অমনোযোগী ছিলে কেন?
আমি চুপ চাপ দাঁড়িয়েছিলাম। স্যার দাড়িয়ে খান্ত হন নি। হাতে থাকা বেতের কয়েক চাপড় বসিয়ে দিয়েছিলেন গায়ে। আমি তবুও আড় চোখে খুঁজছিলাম তনিমাকে। হাসতে থাকা মেয়েটার চেহারা কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিলো
– তুই পিটিতে দাড়িয়ে এসব পাগলামো করিস কেন?
– কি করেছি আমি?
– আমার সাথে ঢং দেখাবি না। আমার অসজ্জ লাগে।
তনিমার হাসির চেয়েও তার রাগ সুন্দর। রাগলে তার লম্বা নাক লাল হয়ে যায়। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। আমি দুষ্টুমির ছলে পকেটে গুজে রাখা রুমাল তনিমার দিকে বাড়িয়ে দিলেই ফিক করে হেসে দিতো ও।
– কোথায় লেগেছে দেখি? বলেই শার্টে আশপাশ দেখতো ।
– ব্যাথা পেয়েছিস খুব?
– হুমমম
– এখনো আছে?
– একটু
– আবার পাগলামো করলে দেখিস তুই তনিমার কথায় আমি হাসতাম শুধু। আমার হাসি দেখে তনিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকাত। তনিমা জানে এই কাজ আমি রোজ করবো।
– এমন করিস কেন?
– জানি না
আমার কথায় তনিমা চুপ করে তাকিয়ে থাকতো আর আমি হাসার ভান ধরে পরিস্থিতি সাম্লে নিতাম। এর চেয়ে বেশি কিছু করার ছিলো না আমার কিংবা আমাদের।
সেই ভোর ছয়টায় বেড়িয়ে পড়তাম কোচিং এ। শীতকাল এলেই বাহিরে কুয়াশা, হাড় কাপানো শীতে গায়ে চাদর থাকতো। ক্লাস শুরু হতো ৭টায়। কিন্তু আমার মাথায় চিন্তা থাকত আগে আমাকেই যেতে হবে। তা না হয় তনিমার পাশের সিট টা আমি পাব না। মাঝে মাঝে আমি যাওয়ার আগেই দেখতাম তনিমা দাড়িয়ে রয়েছে গেইটে। তনিমার দেওয়া বেলি ফুল গুলো গুজে রাখতাম পকেটে। মাঝে মাঝে ক্লাসের ফাঁকে পকেট থেকে আলতো ভাবে বের করে উকি মেরে দেখতাম। আমার কান্ড দেখে হাসতো তনিমা। আর আমি আমার সেকালে করা পাগলামোগুলো ভেবে এখনো হাসি। একবার স্কুল ছুটির পর ঝুম বৃষ্টি। আমার পাগলামো গুলো তনিমার মাথায় ভর করলো।
– আমি আইসক্রিম খাবো
– এই বৃষ্টিতে? তনিমা এক গাল হেসে হাটা ধরলো। পিছু পিছু ছুটলাম আমি।
– তনিমা , ছাতি মাথায় ধর।
তুই অসুস্থ তনিমা বাড়িয়ে দেওয়া ছাতি ছুড়ে ফেললো। আমারা দুজন বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেছি। দোকান থেকে আইসক্রিম নিয়ে খেতে খেতে হাঁটছি। বৃষ্টি তখনো পরছে।
রাস্তায় দাড়িয়ে থাকা মানুষগুলো বৃষ্টির দিনে দুই পাগলের আইসক্রিম খাওয়া দেখে হাসছিল । সেইবার বাড়ি ফিরেছিলাম সন্ধায়। ফিরার আগে তনিমাকে দেওয়া কদম ফুল বহুবার দেখেছি আমি তার ডায়রিতে।কখনো কারণ জিজ্ঞেস করা হয়নি। স্কুলে বিদায়ের দিন মনে হচ্ছিল কিছু একটা যেন হারিয়ে ফেলছি। তনিমাকে বলার ছিলো অনেক কিছু। বলা হয়নি। শুধু তার পাশে বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদা দেখছিলাম। আমার পকেটে গুজে রাখা সাদা রুমাল বাড়িয়ে দিয়েছিলাম তনিমার হাতে। তনিমার চোখের পানি আর চোখের কাজল মিলে মিশে একাকার। আমার বাড়িয়ে দেওয়া রুমালে তনিমার লেপ্টে থাকা কাজল আর পানি দাগ কেটে গেছে।
রুমালে তনিমার চোখের পানি মুছে গিয়েছিল বহু আগে। লেপ্টে থাকা কাজল ইতিহাস হয়ে রয়ে গেছে। আমি এখনো সে ইতিহাস পকেটে নিয়ে ঘুরি। তনিমার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো বহু বছর আগে। হুট করেই নিউ মার্কেটের সামনে দেখা। আমি তাকিয়ে আছি দেখে ভুরু কুচকে তাকালো তনিমা। নাকের ডগায় চশমা ঝুলছে তার। চোখে দুষ্ট দুষ্ট ভাব ভেসে বেড়ানো মেয়েটি চশমা পরে আড়াল করে দিয়েছে সব কিছু। চেহারায় সিরিয়াস ভাব এসে পড়েছে। এইতো সেদিন বেশ অনেক বছর পর তনিমার সাথে দেখা। দেখি রিকশায় করে কোথাও যাচ্ছে। আমাকে দেখেই থমকে দাড়ায় সাথে বুঝি কিছুটা চমকেও যায়। বেশ কিছুক্ষন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে রিকশায় উঠতে বলতেই উঠে পড়লাম। তনিমা সাইড কেটে বসল। ওটুকুতেই আমার বুঝা হয়ে গেল আমাদের দূরুত্ব তৈরী হয়ে গেছে এত দিনে
– তুই আগে থেকে অনেক শুখিয়ে গিয়েছিস
– বহু দিন ধরেই এমন
– আগে তো এমন ছিলি না
– সময় বদলেছে
– ও
– তুইও বদলে গেছিস অনেক
– কিরকম?
– নাকের ডগায় চশমা ঝুলছে।
– হুম আমাদের মাঝে কিছুক্ষণ নিরবতা। আকাশ কালো হয়ে আসছে। বৃষ্টি নামতে পারে।
– তনিমা!
– হুম
– আইসক্রিম খাবি? বৃষ্টি নামবে তনিমা আমার দিকে তাকালো। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে
– না, আমি অসুস্থ। সর্দি বাঁধালে আকাশ রাগ করবে
– আকাশ কে?
– আমার হাজবেন্ড তনিমার কথা শুনে চুপ করে ছিলাম। তনিমা বলল
– স্কুল থেকে বিদায় নেওয়ার পর আজ দেখা হল আমাদের
– হুম
– খোঁজ নেস নি আমার
– ভেবেছিলাম তুই হয়তো….
– আমি অপেক্ষায় ছিলাম দিহান কান্না থামানোর চেষ্টা করে বলল তনিমা । আমি মাথা নিচু করে শুনছি
– দিহান!
– হুম
– তুই নাম, আমাকে যেতে হবে
– হু
– একটা কথা রাখবি?
– বল
– এর পর কখনো আমার সামনে আসিস না তনিমার কথা শুনে চুপ হয়ে ছিলাম। শুধু বল্লাম
– একটা কথা ছিলো
– বল
– এত বছর পর তোর চশমার ফ্রেমে লুকিয়ে রাখা চোখে আমার প্রতি ভালোবাসা দেখে ভালো লাগছে। এটার অপেক্ষাতেই ছিলাম আমি
– তুই নাম দিহান রিকশা থেকে নেমে দাড়িয়ে আছি।
তমিমা রিকশায় বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। অনেক কিছু বলার ছিলো সেই দিনটির মত, বলা হয়নি। কিছু কথা না বলাই থেকে যায়। দীর্ঘশ্বাস বাড়তে থাকে। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। আমি পকেটে গুজে রাখা রুমাল শক্ত করে ধরলাম। ওটা ভিজতে দেওয়া যাবে না। তনিমার চোখের কাজল স্মৃতি হয়ে আছে ওতে। আচ্ছা, সেই দিনের দেওয়া কদম ফুল তানিয়া কি এখনো রেখেছে? খুব জানতে ইচ্ছে করছে আজ …..