মেঘের অনেক রং

মেঘের অনেক রং

হঠাৎ বৃষ্টি আসায় দৌড়ে ছাদে গেলাম। কাপড়গুলো নিয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখি সম্রাট শাহজাহান কাঁথা বালিশ বগল দাবা করে ছুটছেন। মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি! এই বৃষ্টির মধ্যে ও কাঁথাবালিশ নিয়ে যাচ্ছে টা কোথায়!

– কি পাগলামো শুরু করলে? বাইরে বৃষ্টি আসছে। বৃষ্টির মধ্যে যাচ্ছো কই?
– ছাদে যাবো। ছাদে গিয়ে ঘুমাবো।
– বৃষ্টির মধ্যে কেউ কি করে ঘুমোতে পারে! তুমি কি সত্যি পাগল হয়ে গেলে। অবশেষে আমায় পাগলের বউ হতে হবে।
– পাগলামি কই করলাম জাস্ট একটু শান্তিতে ঘুমোতে যাচ্ছি।
– ঠিক আছে ছাদে গিয়ে বৃষ্টির মধ্যে শান্তির ঘুম ঘুমাও। আমার কাঁথা বালিশ রেখে যাও। এগুলো ভিজলে আমি শুকোতে পারবো না।
– তোমার আমার চেয়ে কাঁথা বালিশের বেশি দরদ। নাও ধর। লাগবে না তোমার কাঁথা বালিশ।

আমার হাতে কাঁথা বালিশ গুঁজে দিয়ে হনহনিয়ে তিনি ছাদে চলে গেলেন। আর আমি হা করে তাকিয়ে আছি তার যাওয়ার দিকে। কি পাগলের পাল্লায় পড়লাম! অবশ্য ভার্সিটিতে থাকতে এমন পাগলামিটা সবসময় আমি করতাম। খুব করে চাইতাম আন্দালিবও আমার পাগলামিতে সায় দিক। কিন্তু সে সবসময় করতো তার উল্টোটা। ভার্সিটিতে সেদিন শ্রাবণ ধারা অনুষ্ঠান ছিল। পুরো আয়োজন ছিল বৃষ্টি নিয়ে। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় টুপটাপ বৃষ্টি। আমার খুব ইচ্ছে করছিল বৃষ্টিতে ভিজতে। আন্দালিবের হাত ধরে টেনে ওকে ক্যাম্পাসের রাস্তায় নিয়ে আসি ভিজবো বলে। কিন্তু আমার সে আশায় গুড়ে বালি।

– আমার কাছে ছাতা আছে তো। আমি বৃষ্টিতে ভিজছি কেন? বলেই ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে মেলে ধরলো।
– তুই ভিজতে চাইলে ভিজ। আমি ভিজবো না।
– ভিজতে হবে না তোকে। আমি একাই ভিজবো।
– তোর যা ইচ্ছে।

আশ্চর্য একটা বারের জন্যও বলে নি ছাতার নিচে যেতে কিংবা ছাতাটা আমার মাথার উপর বাড়িয়ে ধরে নি। আমারও রাগ উঠে গেল। ভার্সিটির ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে রিকশায় উঠার আগ পর্যন্ত ভিজলাম। রিকশায় যখন উঠলাম তখন পুরো গোসল করে ফেলেছি অবস্থা। ও তখনও নির্লিপ্তভাবে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলো। বাই বলার প্রয়োজনটাও মনে করলো না। রাগে সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছিল। এদিকে বাসায় পৌঁছার আগেই হাঁচি শুরু হয়ে গেল। একসাথে ৯-১০ টা করে চলতে লাগলো। নাক দিয়ে ঝরণার মতো অঝোর ধারায় ঝরতে শুরু করলো জল। বাসায় ঢুকতেই শুরু হয়ে গেল মায়ের জেরা,

– কিরে এত ভিজলি কিভাবে?
– ভুল করে ছাতাটা রেখে গিয়েছিলাম। বলার সাথে সাথেই শুরু করলাম হাঁচির সিরিজ।
– কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বৃষ্টিটা কমলে পড়ে আসতি।
– রাস্তা দিয়ে আসতে আসতে ভিজে গেছি। ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার সময় এত বৃষ্টি ছিল না।

পুরো মিথ্যে বললাম মাকে। এরই মাঝে হাঁচি মশাইয়ের থামার কোনো নামই নেই। চলছে তো চলছেই। অনুভব করতে পারছি হাত পা ব্যথা করতে শুরু করে দিয়েছে। তার মানে জ্বর বাবাজিও আসি আসি করছে। হাঁচির ফাঁকে ফাঁকে অনেক কষ্টে মাকে বললাম এক কাপ আদা চা দিতে।

রুমে গিয়ে জামা কাপড় পাল্টে টিস্যু বক্সটা সাথে খাটে গিয়ে বসলাম। জলধারা অঝোর ধারায় ঝরছে নাক দিয়ে।
কিছুক্ষণ পর মা এসে আদা চা দিয়ে গেল। মাথাটাও কেমন জানি করছে। অন্যসময় চা খেলেই মাথা ফ্রেশ হয়ে যেত। কিন্তু আজ হচ্ছে না। মাথাটা আরো বেশি ভারী হয়ে উঠছে। বসে থাকতে পারছি না। কম্বলটা টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। কখন ঘুমিয়ে গেছি খেয়াল নেই।

– এই সানবি উঠ। কিছু একটা খেয়ে ওষুধটা খেয়ে নে। জ্বরে তো গা পুড়ে যাচ্ছে।
– আমি কিছু খাবো না। ঘুমুতে দাও।
– কিছু না খেলে ওষুধটা কি করে খাবি!
– ওষুধ খেতে হবে না। ঘুমুতে দাও। মাথাটা ভীষণ যন্ত্রণা করছে।
– ঠিক আছে। একটু ওঠে বস। হাত পাগুলো মুছিয়ে দেই। তাপটা কমে যাবে।

আমি উঠতে না চাইলেও মা নিজেই জোর করে উঠিয়ে মুখ হাত পা মুছিয়ে দিল। প্রথম প্রথম একটু শীত শীত লাগলেও এখন ভালো লাগছে ।

– দু মিনিট শুয়ে থাক। ম্যাগী করে আনছি। ওটা খেয়ে ওষুধ খাবি।

ম্যাগী নুডলস আমার খুব প্রিয়। কিছু খেতে ইচ্ছে না করলেও এটা দেখলে আমি কখনো লোভ সামলাতে পারি না।
মা ম্যাগী নিয়ে এসে খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে তারপর গেলেন। আমিও আরেকটু ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।

সকালে উঠে বেশ ঝরঝরে লাগছে। মাথার যন্ত্রণাটা নেই । জ্বরও কমে গেছে। । সারাদিন আর ঘর থেকে বের হলাম না। শুয়ে বসেই কাটিয়ে দিলাম।এরই মাঝে আন্দালিব অনেকবার ফোন করেছিল। ইচ্ছে করেই ধরিনি। ফোন সাইলেন্ট করে রেখে দিয়েছি। ওর নামটা দেখলেই রাগ উঠে যাচ্ছিলো। পরদিন সকালে মা এসে ডাকতে লাগলো। আন্দালিব এসেছে। ড্রয়িংরুমে বসে আছে। আমার কাছ থেকে নোটস নিতে এসেছে। কি নোটস সে নিতে এসেছে তা আমার ভালো করেই জানা আছে।

– কিরে কাল ভার্সিটিতে গেলি না কেন? আর আমার ফোনই বা ধরছিলি না কেন?
– বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর উঠে গিয়েছিল।
– জ্বরের সাথে ফোন না ধরার সম্পর্ক কি!
– কোনো সম্পর্ক নাই। কি নোটস লাগবে বল। নোটস নিয়ে ভাগ।
– কোনো নোটস লাগবে না। এটা রাখ। আমি যাই।

আন্দালিব চলে যাওয়ার পর দেখলাম প্যাকেটটাতে লাল সাদা টসটসে কতগুলো জামরুল। আমার প্রিয়। এক নিমিষেই জামরুল গুলো সাবাড় করে দিলাম।

পরদিন সকাল বেলা ভার্সিটিতে গিয়ে দেখি আন্দালিব আর আবীর একটা কাগজের কার্টন নিয়ে টাকা উঠাচ্ছে। ওদের কাছে গিয়ে জানতে পারলাম ভার্সিটির পাশেই জমির চাচার যে চালাঘরটা আছে সেটা কালকের ঝড় বৃষ্টিতে পুরো বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। খোলা আকাশের নিচে থাকতে হচ্ছে ওনাদের। পুরোটা সকাল টাকা উঠিয়ে দুপুরেই ঘর বানানোর কাজে লেগে গেল আন্দালিব আর আবীর। ওদের সাথে যোগ দিল আরো কয়েকজন। সন্ধ্যার আগে আগে যখন জমির চাচা নতুন বাঁধা ঘরে ঢুকলেন আনন্দ আর কৃতজ্ঞতায় তার দুচোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছিল।

সেদিন গোধূলিবেলায় আন্দালিবের সাথে ছাতা মাথায় নদীর পাড় ধরে অনেকক্ষণ হেঁটেছিলাম। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছিলো তখন। নদীর বাতাসে প্রায়ই ছাতা উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলো। সেদিনই আন্দালিব আমায় প্রথম শুনিয়েছিল ওর গলার মিষ্টি কন্ঠটা, “আজি ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে.. জানি নে জানি নে কিছু তে কেন যে মন লাগে না ” হঠাৎই বাজের শব্দে বাস্তবে ফিরে এলাম। বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। আর আন্দালিব এই বৃষ্টির মধ্যে কি না ছাদে শুয়ে থাকবে! আর পারি না ওকে নিয়ে। সময়ের সাথে সাথে আমার পাগলামো গুলো ওর উপর ভর করেছে।কাঁথা বালিশ হাত থেকে রেখে ছাদে চললাম ওকে কি করছে দেখতে। ছাদে গিয়ে দেখি কোথাও নেই আন্দালিব। একটু আগেই তো এলো। এখনই কোথায় গেলো! হঠাৎই পেছন থেকে শুনতে পেলাম, বর্ষার বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে কিংবা কদমের মাতাল গন্ধে আকাশে চমকানো বিজলিতে সবসময় পাই আমি তোমায় খুঁজে। অঝোর ধারার ফোটায় ফোটায় গন্ধহীন রঙ্গনের ছোঁয়ায় ছোঁয়ায় চায় বাসতে ভালো মন তোমায়। পেছনে তাকিয়ে দেখি হাতে একগুচ্ছ কদম হাতে আন্দালিব দাঁড়িয়ে।

– কেমন লাগলো, আমার বৃষ্টিভেজা সারপ্রাইজ?
– তুমি এমন কেন! এত ভালো কেন বাসো আমায়!
– কারণ আমার অস্তিত্বের সবটুকু জুড়ে আছো তুমি। সত্যি আর কিছু বলতে পারছিলাম না। দুচোখের বাঁধ ভেঙ্গে উপচে পড়ছে জল।

– আরে এই বোকা মেয়ে কাঁদছো কেন? দেখো কত কষ্ট করে তোমার জন্য কদম গুলো গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে এসেছি। দেখো কদমগুলো কি সুন্দর তোমার দিকে তাকিয়ে আছে তোমার গ্রহণের অপেক্ষায়। এবার একটু হাসো।
কান্না কিছুতেই থামাতে পারছিলাম না। প্রিয় কদমগুলো একহাতে নিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ওকে। বৃষ্টি যেন মধুর পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিলো আমাদের দুজনের উপর।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত