ভালোবাসার গল্প

ভালোবাসার গল্প

এর আগে আমার সাথে এতো খারাপ ব্যবহার কেউ কখনো করেনি। বস যখন বললেন, কি হলো মুখে কি কুলুপ দিয়ে রেখেছেন। কথা বলছেন না কেন? প্রথমত আমি বুঝতে পারছিলাম না কি বলবো। দ্বিতীয়ত যখন কিছু বলার জন্য মুখ খুললাম তখন মুখ দিয়ে কোন কথা বের হলোনা। অপমানে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম। বস চলে যাওয়ার পরে অনেকেই বুঝানোর চেষ্টা করলো যাতে এসব কানে না নেই। অথচ কথাগুলো যেন আমার কানে বাজছে। দুপুরে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম চাকরি করবোনা। কিছুক্ষন পরে মা ফোন করে বললেন, বাবা বেতন পেয়েছিস? ফোনটা রাখার পরে মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কাজে মনোযোগ দিলাম। দুপুরে কিছুই খেলাম না।

এক লোকমা ভাত ও গলা দিয়ে নিচে নামলোনা। বিকালে অফিস শেষে ফেরার পথে বাসের জানালার কাঁচে মাথা দিয়ে ভাবছিলাম, বাকি জীবনটা কি এভাবেই কাটবে তাহলে। সকাল থেকে বিকাল অফিস। বসের তিক্ত কথার অপমান। বেতনের অপেক্ষায় টানা পোড়নে মাসের তারিখ গোনা। যদি এভাবেই কাটে তাহলে এ জীবনের অর্থ কি। এই যে এতো সুন্দর পৃথিবী কখনো ঘুরে দেখা হবেনা। অলস বিকেলে বৃষ্টি দেখতে দেখতে আর কবিতা লেখা হবেনা। প্রিয় বইগুলো হাতে নিয়ে কল্পনায় হারিয়ে যাবার সময় হবেনা। বন্ধুদের সাথে রোজ চায়ের দোকানের আড্ডায় বসা হবেনা। তবে কি জীবনের সুন্দর দিনগুলো শেষ। কেন যে শেষ হলো। ব্যাট বল হাতে নিয়ে মাঠে বিকেল কাটানোর দিনগুলো কতোই না ভালো ছিলো। হারিকেনের আলোয় সন্ধ্যার সেই পড়ার টেবিলটা কতোনা আপন ছিলো। এখন সব অতিত।

এসব ভাবতে ভাবতে যখন গন্তব্যে পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। সচরাচর বাস থেকে নেমে হেঁটেই মেসে ফিরি। এতে দশ টাকা রিকশা ভাড়া বেঁচে যায়। কিন্তু আজ রিকশা নিলাম কারন ক্ষুধায় পেট মোচড় দিচ্ছে। রিকশায় বসে ভাবছি মেসে পৌঁছে গোসল সেরেই গরম ভাত নিয়ে বসবো। বুয়া সন্ধ্যার আগেই রাতের জন্য রান্না করে দিয়ে যায়। গরম ভাত খেয়ে শুয়ে একটা ঘুম দিবো। আকাশে প্রচন্ড মেঘ করেছে। যদি বৃষ্টি হয় তাহলে ঘুমটা আরো ভালো হবে। অথবা শুয়ে শুয়ে অনেকদিন পর টিনের চালে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনবো। এসব ভাবতে ভাবতে অফিসের ঘটনার কারনে মন খারাপ ভাবটা অনেকটা কেটে গেলো। রিকশা থেকে নামতেই সামনের দোতলা বাসার সবুজ গেইটটা থেকে শিমুকে বের হতে দেখলাম। গোলাপি রঙের এই জামাটা হয়তো শিমুর অনেক পছন্দের। তাকে যতোবার দেখেছি প্রতিবার এই গোলাপি জামাটাতেই দেখেছি। এতোবার দেখেছি তাকে তবুও যেন মনে হয় প্রতিবার নতুন করে দেখছি। শিমুকে প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছিলো কতো যে আপন সে আমার। যেন বহু দিনের পরিচয়।

শিমু আমাকে দেখেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। কি নিষ্ঠুর তার আচরন। আমি তাকে যতো আপন ভাবতে চাই সে ততো দূরে সরিয়ে দিতে চায়। সে কেন বুঝতে চায়না তার ওই শ্যামলা মায়াবী মুখটায় আমি থমকে গেছি। অফিসের নতুন রূপবতী মেয়েটা যার রূপের প্রশংসায় অফিসের অন্য পুরুষরা ক্লান্ত হয়না, শিমুকে প্রথম দেখার পরে সেই মেয়েটাকে আমার আর রূপবতী মনে হয়না। মনে হয় সৃষ্টিকর্তা সকল রূপ ঢেলে দিয়েছেন শিমু নামের মায়াবী চেহারার শ্যামলা মেয়েটার মাঝে।

গত একমাস ধরে শিমুকে দেখছি। অফিস থেকে ফেরার সময় মাঝে মাঝেই দেখা হয়ে যায়। কখনো কখনো অফিস থেকে ফিরে সবুজ গেইটটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। শিমু বের হলেই চোখাচোখি হয়ে যায়। দুদিন আগে শিমুকে ডেকে বলেছিলাম, শিমু শোন তোমাকে কিছু বলার ছিলো। শিমু আমার কথা শুনে দ্রুত পায়ে চলে গিয়েছিলো।

নাহ্ এভাবে আর কতোদিন। আজ শিমুকে ভালোবাসার কথাটা বলেই ফেলি। শিমু মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছিলো আমি তার নাম ধরে ডাকতেই থমকে দাঁড়ালো। আমি শিমুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। শিমুর দৃষ্টি নিচের দিকে। আমি শিমুর দিকে তাকিয়ে বললাম,

-শিমু আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার কথা শুনে শিমু মুখ তুলে তাকালো। শিমু অনুরোধের স্বরে বললো,

–আমাকে এভাবে বিরক্ত করবেন না প্লিজ।

লক্ষ্য করলাম শিমুর হাত থরথর করে কাঁপছে। সাথে সাথে নিজেকে প্রশ্ন করলাম, শিমু কি আমাকে ভয় পাচ্ছে!
শিমু আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। হালকা বাতাস বইছে। মনে হচ্ছে কিছুক্ষনের মধ্যে বৃষ্টি নামবে। শিমুর সাথে তো ছাতা নেই। বৃষ্টি নামলে তো মেয়েটা ভিজে যাবে। গেইটটা এখনো খোলা। গেইটে ছয় সাত বছরের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। এই ছেলেটাকে পড়ানোর জন্যই শিমু

এই বাসায় আসে। শিমুর নামটাও আমি এই বাচ্চাটার কাছেই জেনেছি। মেসে ফিরে কাপড় পাল্টাতে গিয়ে দেখি আমার সাদা শার্টটা নেই। পাশের বিছানায় শুয়ে জাফর ভাই ফোন চাপছেন। জাফর ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম,

-ভাই আমার শার্টটা দেখেছেন?
–কোন শার্টটা?
-আমার সাদা শার্টটা।
–না দেখিনি।

খুঁজে দেখার মতো রুমে তেমন কিছু নেই। একটা পুরোনো ট্রাঙ্ক আর কাঠের আলনা। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও শার্টটা কোথাও পেলাম না। বিরক্তি বাড়ার সাথে সাথে সারাদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো মনে পড়তে শুরু করলো। অফিসে বসের করা অপমান, শিমুর প্রত্যাখ্যান মাথায় ঘুরছে। এদিকে প্রচন্ড ক্ষুধাও পেয়েছে। ভাবলাম আগে পেটকে শান্ত করি তারপর অন্যকিছু। টেবিলের উপর রাখা গামলার ঢাকনা সরিয়ে দেখলাম খালি গামলা আর প্লেট চকচক করছে। জাফর ভাইকে বললাম,

-ভাই মেল কই?
–মেল নাই। বুয়া বিকালে আসেনি।
-বিকালে আসেনি মানে?
–সকালে এসে দুপুরের রান্না করে দিয়ে গেছে। রাতের রান্না তো বিকালে এসে করে। বিকালে আর আসেনি।
-আসেনি এ কেমন কথা? তার হিসাবে চলবে নাকি সবকিছু। আমরা রাতে কি খাবো?
–আমি তো চিড়া গুড় খেয়ে রাত কাটিয়ে দিতে পারবো। আপনি বাইরে থেকে খেয়ে আসুন।
-মগের মুল্লুক? এই কাজ চোর বুয়া রাখবোনা মেসে। আর আমার মনে হচ্ছে আমার শার্টটা ওই বুয়াই চুরি করেছে। আগেরবার আমার স্যান্ডেল জোড়া নিয়ে গেলো না।
–আপনার স্যান্ডেল তো ছিঁড়ে গেছিলো। তাই গরিব মানুষ জোড়া তালি দিয়ে পরার জন্য নিয়ে গেছে। ভেবেছে আপনি হয়তো আর ব্যবহার করবেন না।
-স্যান্ডেল, শার্ট এসব কিনার টাকা বুয়ার বেতনের টাকা এসব কোথা থেকে আসে? আমার টাকা কি গাছে ধরে। একটা টাকা উপার্জনের পেছনে কি পরিমান পরিশ্রম যায় জানেন? কতো কথা হজম করতে হয় বুঝেন?
–আপনি এতো রেগে যাচ্ছেন কেন?
-রাগবোনা মানে। আপনি বুয়ার বাসার ঠিকানা দেন। এখুনি গিয়ে বলে আসবো কালকে থেকে যেন না আসে।
–আপনি সত্যি যাবেন?
-জাফর ভাই আমি মজা করছিনা। আপনি ঠিকানা দেন।

জাফর ভাইয়ের কাছে ঠিকানা নিয়ে মেস থেকে বের হলাম। এই মুহূর্তে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে আমার। দাঁতে দাঁত চেপে রেখেছি। রাগ কমানোর জন্য কাউকে বকাবকি করতে হবে। বস্তির ভেতর বুয়ার বাসা খুঁজতে খুঁজতে টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। বুয়ার বাসা খুঁজে পেলাম ঠিকই কিন্তু ততোক্ষনে আমি কাকভেজা হয়ে গেছি। দরজা কয়েকবার ধাক্কানোর পরে দশ বারো বছরের একটা ছেলে দরজা খুলে দিলো। ছেলেটা আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলো,

–কাকে খুঁজেন?
-সুলতানা বুয়ার বাসা না এটা?
–জ্বি…
-তোমার কি হয়?
–আম্মা…
-তিনি বাসায় আছেন?
–জ্বি… ভিতরে আসেন।

দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে বুঝতে পারলাম এটা একটা বেডরুম। বড়লোকদের মতো এদের বাসার আলাদা গেইট তারপরে বসার রুম থাকেনা। কারো শোবার ঘরে ঢুকে পরা ভদ্রতার নিয়মে পরেনা। তবে স্বস্তির বিষয় হলো এটা নিয়ে বস্তির মানুষদের তেমন মাথা ব্যাথা থাকেনা। আমাকে দেখে বুয়া বেশ অবাক হলেন। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

–উনাকে একটা চেয়ার দে।

ছেলেটা মনে হয় এ ঘরেই পড়তে বসেছিলো। টেবিলে বই খাতা এলোমেলো ভাবে রাখা। ছেলেটা নিজের চেয়ারটা এগিয়ে দিলো। বুয়া ছেলের দিকে তাকিয়ে আবারো বললেন,

–গামছাটা এনে দে।

ছেলেটা পাশের ঘরে গামছা আনতে গেলো। বুয়া অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি হয়তো বুঝতে পারছেন না এ সময়ে কেন আমি এখানে। বুয়ার সাথে কখনো আমার তেমন কথা হয়নি। তার সাথে ছুটির দিন ছাড়া দেখা হয়না। আর ছুটির দিন আমি ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেই। কথা হওয়ার সুযোগ ছিলোনা। ছেলেটা গামছাটা এগিয়ে দিলো। আমি গামছাটা নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ঘরের দিকে তাকালাম। বিছানায় কঙ্কালসার একজন লোক শুয়ে আছেন যার শরিরে আমার সাদা শার্টটা। আমার মতো পাতলা মানুষের শার্ট ওই লোকটার শরিরে যথেষ্ঠ ঢোলা মনে হচ্ছে।

লোকটার বালিশের পাশে একটা পাতিল রাখা। টিনের ফুটো দিয়ে পাতিলে টপটপ করে পানি পরছে। কেন যেন ছেলেটার পায়ের দিকে লক্ষ্য করলাম। হুম আমার ধারণা সঠিক ছেলেটার পায়ে আমার ছেঁড়া স্যান্ডেল জোড়া। শেলাই করে পরেছে। হুট করে মনে হলো অভাব তুমি বড়ই নির্দয়।

ভেবেছিলাম এখানে এসে খুব রাগারাগি করবো কিন্তু বুঝতে পারলাম আমার মাঝে এই মুহূর্তে রাগের ছিঁটেফোটাও নেই। বুয়ার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাচ্ছেন। হয়তো বুঝতে পারছেন না আমাকে কি বলে সম্বোধন করবেন। বাবা নাকি ভাই নাকি স্যার কোনটা। আমি তার সমস্যাটা দূর করে দিলাম। তার দিকে তাকিয়ে বললাম,

-চাচি চাচা অসুস্থ্য নাকি? সুলতানা বুয়া এবার কথা বললেন,

–জ্বি বাবা। তিন বছর ধইরা বিছানায় শোয়া। এতো টাকার অষুধ যায় মানুষটা ঠিক হয়না। দিন দিন অবস্থা খারাপ হয়।
-চাচার সমস্যাটা কি?
–এগুলান পাপের ফল বাবা। জোয়ান বয়সে মদ খাইয়া ফুর্তি করছে অখন বুঝতাছে।

আমার কি বলা উচিত বুঝতে পারছিনা। সান্তনা দিয়ে লাভ নেই। এমন মানুষের সান্তনার প্রয়োজন হয়না। এটা সারাজীবন নিজেদের সান্তনা দিয়ে এসেছে একদিন সব ঠিক হবে। কিন্তু তাদের সেই একদিন কখনো আসেনা। বরং সান্তনার হাজারটা কথার চেয়ে একশত টাকার একটা নোট এদের কাছে বেশি মূল্যবান। বুয়া এবার আমার আসার কারন জিজ্ঞাসা করলেন,

–বাবা হঠাৎ করে গরিবের বাসায় কি মনে কইরা?
-আসলে একটা কাজে এসেছিলাম। এপাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। বৃষ্টি শুরু হলো, ভাবলাম আপনার বাসায় একটু বসি।
–ভালো করছেন বাবা। বসেন চা বানাই। চা খান।

বৃষ্টিতে ভিজে একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিলো। চা পেলে মন্দ হয়না। আমি চুপচাপ বসে বিছানায় রাখা পাতিলের দিকে তাকিয়ে আছি। পাতিলটা পানিতে প্রায় ভরে গেছে।

–চা নিন…

কণ্ঠটা শুনে আমি যেন চমকে উঠলাম। কানে ভুল শুনছিনা তো। মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলাম শিমু দাঁড়িয়ে আছে। শিমুকে দেখে আমি যতোটা না অবাক হয়েছি মনে হচ্ছে শিমু আমাকে দেখে তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছে। সুলতানা বুয়া ঘরে ঢুকে বললেন,

–বাবা চা নেন।

আমি শিমুর হাত থেকে চায়ের কাপটা নিলাম। শিমু রুম থেকে বের হচ্ছিলো সুলতানা বুয়া শিমুকে ডেকে বললেন,

–কোথায় যাচ্ছিস বস এখানে।

শিমু মায়ের কথা মতো বিছানার একপাশে বসলো। শিমুর দৃষ্টি প্রতিবারের মতো মাটির দিকে। সুলতানা বুয়া কথা বলতে শুরু করলেন,

–আমি যেই মেসে রান্না করি ইনি সেই মেসে থাকেন। বড় ভালো মানুষ। তোর আব্বার জন্য যেই শার্টটা আনছি ওইটা উনার শার্ট।

শার্টের প্রসঙ্গ আসাতে বুঝতে পারলাম শার্টটা জাফর ভাই বুয়াকে দিয়েছেন। আমার রাগ দেখে হয়তো স্বীকার করেননি। শিমুর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছি মায়ের কথা শুনে সে বিব্রত বোধ করছে। কিছু মানুষ আছে যারা যতোই কষ্টে থাকুক নিজের দুর্বলতা অন্যকে দেখাতে পছন্দ করেন না। এই মানুষগুলো খুব কঠিন হয়। না খেয়ে থাকবে তবুও হাত পাতবেনা। শিমুও হয়তো তাদের মধ্যে একজন। সুলতানা বুয়া এবার মেয়ের প্রশংসা শুরু করলেন,
–মেয়েটা অনেক কষ্ট করছে বাবা। এইবার ইন্টার পাশ করছে। আমরা টাকা দিতে পারিনাই। মাইন্সের বাড়ি গিয়া প্রাইভেট পড়াইয়া নিজের খরচ চালাইছে।

সুলতানা বেগমের কথা শেষ হবার আগেই শিমু উঠে পাশের ঘরে চলে গেলো। আমিও বাসা থেকে বের হলাম। বাসা থেকে বের হয়ে দেখি বৃষ্টি থেমে গেছে। ভিজে যাওয়ার কারনে বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। হেঁটে হেঁটে মেসে ফিরছি আর শিমুর কথা ভাবছি। এই মেয়েটা এতো কষ্টের মাঝে থেকে লড়াই করছে অথচ তাকে রাস্তায় থামিয়ে আমি প্রেম নিবেদন করছি। নিজের অজান্তে মেয়েটাকে হয়তো অনেক বিরক্ত করে ফেলেছি। নিজের কাছে নিজের আচরনের জন্য লজ্জা লাগছে।

রাতে মেসে ফিরে জ্বর আসলো। জ্বরের ঘোরে শিমুর কথা ভাবতে ভালো লাগছে। আচ্ছা আমি যদি শিমুকে বিয়ে করি তাহলে সে তো ভালোই থাকবে। অন্তত বস্তির সেই জীবনের চেয়ে ভালো। ভাবনার এক পর্যায়ে মনে হলো আমার কি এসব ভাবা ঠিক হচ্ছে? মেয়েটা গরিব বলে আমাকে কেন তার বিয়ে করতে হবে। সে তো আমাকে পছন্দ করেনা। আমাকে ভয় পায়। আমাকে দেখলে বিরক্ত হয়। নাহ্ এমনিতে তার জীবনে অনেক সমস্যা আমি নতুন করে সমস্যার কারন হতে চাইনা। শরিরে জ্বর নিয়েই তিনদিন অফিস গেলাম। লাল চোখ শুষ্ক ঠোট দেখে বস বললেন,

–আলিফ আপনি কি অসুস্থ্য? অসুস্থ্যতা নিয়ে অফিস আসতে হবেনা। দুদিনের ছুটি নিয়ে বাসায় রেস্ট নিন। সুস্থ্য হয়ে তারপর অফিস আসুন।

এই তিনদিনে অফিস থেকে ফেরার সময় দুবার শিমুর সাথে রাস্তায় দেখা হয়েছিলো। আমি মাথা নিচু করে চলে এসেছি। ইচ্ছে করছিলো একবার তাকিয়ে শিমুর মুখটা দেখি, শুধু একবার। শরিরে কাঁথা জরিয়ে শুয়ে আছি। জ্বরটা বড্ড কষ্ট দিচ্ছে। এই মুহূর্তে মায়ের কোলটার অভাব যেন আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। মনে হচ্ছে যদি উড়ে মায়ের কাছে যেতে পারতাম। মা যদি তার কোলে আমার মাথাটা রেখে একবার হাত বুলিয়ে বলতো, বাবা এখন জ্বর কেমন? জ্বরটা যেন সাথে সাথে সেরে যেতো।

–এই যে শুনছেন? আপনি কি ঘুমাচ্ছেন?

পরিচিত নারী কণ্ঠ শুনে অবাক হলাম। মেসে মেয়ে আসলো কোথা থেকে। মুখের উপর থেকে কাঁথা সরাতেই শিমুকে দেখলাম। মনে হচ্ছে জ্বরের ঘোরে শিমুকে দেখছি। কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকার পরে মনে হলো। নাহ্ এটা স্বপ্ন, ঘোর বা কল্পনা নয়। সত্যি সত্যি শিমু বিছানার পাশের চেয়ারটায় বসে আছে। শিমু বললো,

–মায়ের কাছে শুনলাম আপনি নাকি অসুস্থ্য।
-জ্বি… একটু। কিন্তু আপনি এখানে?
–এখানে এসে কি অন্যায় করেছি। সরি কাজের বুয়ার মেয়ে হয়ে এখানে আসা উচিত হয়নি। মাফ করবেন।
-তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?
–আমি বুয়ার মেয়ে জানার পর থেকে আপনি আমাকে দেখেই মাথা নিচু করে হেঁটে চলে যান। আমি জানতাম সত্যটা জানার পরে আমার প্রতি আপনার ভালোবাসা হারিয়ে যাবে। তাই সেদিন আপনাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে আমি ভুল ছিলাম না। কিন্তু কারো প্রতি এতোটা টান, ভালোবাসা দেখিয়ে হুট করে বদলে যাবেন না। মানুষ এটাতে কষ্ট পেতে পারে। আমি লক্ষ্য করলাম শিমুর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। আমি কেন যেন তার কষ্টটা মেনে নিতে পারছিনা। আমারো যে কষ্ট হচ্ছে। আমি শিমুর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,

-আমি তোমার থেকে দূরে যাচ্ছিলাম কারন আমি চাইনি তোমার বিরক্তির কারন হতে। এটা জানতাম না আমার অনুপস্থিতি তোমাকে কাঁদাতে পারে। জানলে কখনোই যেতাম না। আমি এখনো তোমাকে আগের মতোই ভালোবাসি।

আমি নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে শিমুর হাত ধরে রেখেছি। শিমু তার হাত ছাড়ানোর কোন চেষ্টা করছেনা। যেন মুহূর্তেই আমি নিজেকে ভালোবাসার সমুদ্রে আবিষ্কার করলাম। যেন এক মুহূর্তেই ভালোবাসা তার অসীমতা দিয়ে আমাকে আবদ্ধ করে ফেলেছে।।এর আগে আমার সাথে এতো খারাপ ব্যবহার কেউ কখনো করেনি। বস যখন বললেন, কি হলো মুখে কি কুলুপ দিয়ে রেখেছেন। কথা বলছেন না কেন? প্রথমত আমি বুঝতে পারছিলাম না কি বলবো। দ্বিতীয়ত যখন কিছু বলার জন্য মুখ খুললাম তখন মুখ দিয়ে কোন কথা বের হলোনা। অপমানে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম। বস চলে যাওয়ার পরে অনেকেই বুঝানোর চেষ্টা করলো যাতে এসব কানে না নেই। অথচ কথাগুলো যেন আমার কানে বাজছে। দুপুরে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম চাকরি করবোনা। কিছুক্ষন পরে মা ফোন করে বললেন, বাবা বেতন পেয়েছিস? ফোনটা রাখার পরে মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কাজে মনোযোগ দিলাম।

দুপুরে কিছুই খেলাম না। এক লোকমা ভাত ও গলা দিয়ে নিচে নামলোনা। বিকালে অফিস শেষে ফেরার পথে বাসের জানালার কাঁচে মাথা দিয়ে ভাবছিলাম, বাকি জীবনটা কি এভাবেই কাটবে তাহলে। সকাল থেকে বিকাল অফিস। বসের তিক্ত কথার অপমান। বেতনের অপেক্ষায় টানা পোড়নে মাসের তারিখ গোনা। যদি এভাবেই কাটে তাহলে এ জীবনের অর্থ কি। এই যে এতো সুন্দর পৃথিবী কখনো ঘুরে দেখা হবেনা। অলস বিকেলে বৃষ্টি দেখতে দেখতে আর কবিতা লেখা হবেনা। প্রিয় বইগুলো হাতে নিয়ে কল্পনায় হারিয়ে যাবার সময় হবেনা। বন্ধুদের সাথে রোজ চায়ের দোকানের আড্ডায় বসা হবেনা। তবে কি জীবনের সুন্দর দিনগুলো শেষ। কেন যে শেষ হলো। ব্যাট বল হাতে নিয়ে মাঠে বিকেল কাটানোর দিনগুলো কতোই না ভালো ছিলো। হারিকেনের আলোয় সন্ধ্যার সেই পড়ার টেবিলটা কতোনা আপন ছিলো। এখন সব অতিত।

এসব ভাবতে ভাবতে যখন গন্তব্যে পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। সচরাচর বাস থেকে নেমে হেঁটেই মেসে ফিরি। এতে দশ টাকা রিকশা ভাড়া বেঁচে যায়। কিন্তু আজ রিকশা নিলাম কারন ক্ষুধায় পেট মোচড় দিচ্ছে। রিকশায় বসে ভাবছি মেসে পৌঁছে গোসল সেরেই গরম ভাত নিয়ে বসবো। বুয়া সন্ধ্যার আগেই রাতের জন্য রান্না করে দিয়ে যায়। গরম ভাত খেয়ে শুয়ে একটা ঘুম দিবো। আকাশে প্রচন্ড মেঘ করেছে। যদি বৃষ্টি হয় তাহলে ঘুমটা আরো ভালো হবে। অথবা শুয়ে শুয়ে অনেকদিন পর টিনের চালে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনবো। এসব ভাবতে ভাবতে অফিসের ঘটনার কারনে মন খারাপ ভাবটা অনেকটা কেটে গেলো। রিকশা থেকে নামতেই সামনের দোতলা বাসার সবুজ গেইটটা থেকে শিমুকে বের হতে দেখলাম। গোলাপি রঙের এই জামাটা হয়তো শিমুর অনেক পছন্দের। তাকে যতোবার দেখেছি প্রতিবার এই গোলাপি জামাটাতেই দেখেছি। এতোবার দেখেছি তাকে তবুও যেন মনে হয় প্রতিবার নতুন করে দেখছি। শিমুকে প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছিলো কতো যে আপন সে আমার। যেন বহু দিনের পরিচয়।

শিমু আমাকে দেখেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। কি নিষ্ঠুর তার আচরন। আমি তাকে যতো আপন ভাবতে চাই সে ততো দূরে সরিয়ে দিতে চায়। সে কেন বুঝতে চায়না তার ওই শ্যামলা মায়াবী মুখটায় আমি থমকে গেছি। অফিসের নতুন রূপবতী মেয়েটা যার রূপের প্রশংসায় অফিসের অন্য পুরুষরা ক্লান্ত হয়না, শিমুকে প্রথম দেখার পরে সেই মেয়েটাকে আমার আর রূপবতী মনে হয়না। মনে হয় সৃষ্টিকর্তা সকল রূপ ঢেলে দিয়েছেন শিমু নামের মায়াবী চেহারার শ্যামলা মেয়েটার মাঝে।

গত একমাস ধরে শিমুকে দেখছি। অফিস থেকে ফেরার সময় মাঝে মাঝেই দেখা হয়ে যায়। কখনো কখনো অফিস থেকে ফিরে সবুজ গেইটটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। শিমু বের হলেই চোখাচোখি হয়ে যায়। দুদিন আগে শিমুকে ডেকে বলেছিলাম, শিমু শোন তোমাকে কিছু বলার ছিলো। শিমু আমার কথা শুনে দ্রুত পায়ে চলে গিয়েছিলো। নাহ্ এভাবে আর কতোদিন। আজ শিমুকে ভালোবাসার কথাটা বলেই ফেলি। শিমু মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছিলো আমি তার নাম ধরে ডাকতেই থমকে দাঁড়ালো। আমি শিমুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। শিমুর দৃষ্টি নিচের দিকে। আমি শিমুর দিকে তাকিয়ে বললাম,

-শিমু আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার কথা শুনে শিমু মুখ তুলে তাকালো। শিমু অনুরোধের স্বরে বললো,

–আমাকে এভাবে বিরক্ত করবেন না প্লিজ।

লক্ষ্য করলাম শিমুর হাত থরথর করে কাঁপছে। সাথে সাথে নিজেকে প্রশ্ন করলাম, শিমু কি আমাকে ভয় পাচ্ছে!
শিমু আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। হালকা বাতাস বইছে। মনে হচ্ছে কিছুক্ষনের মধ্যে বৃষ্টি নামবে। শিমুর সাথে তো ছাতা নেই। বৃষ্টি নামলে তো মেয়েটা ভিজে যাবে।

গেইটটা এখনো খোলা। গেইটে ছয় সাত বছরের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। এই ছেলেটাকে পড়ানোর জন্যই শিমু এই বাসায় আসে। শিমুর নামটাও আমি এই বাচ্চাটার কাছেই জেনেছি। মেসে ফিরে কাপড় পাল্টাতে গিয়ে দেখি আমার সাদা শার্টটা নেই। পাশের বিছানায় শুয়ে জাফর ভাই ফোন চাপছেন। জাফর ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম,

-ভাই আমার শার্টটা দেখেছেন?
–কোন শার্টটা?
-আমার সাদা শার্টটা।
–না দেখিনি।

খুঁজে দেখার মতো রুমে তেমন কিছু নেই। একটা পুরোনো ট্রাঙ্ক আর কাঠের আলনা। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও শার্টটা কোথাও পেলাম না। বিরক্তি বাড়ার সাথে সাথে সারাদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো মনে পড়তে শুরু করলো। অফিসে বসের করা অপমান, শিমুর প্রত্যাখ্যান মাথায় ঘুরছে। এদিকে প্রচন্ড ক্ষুধাও পেয়েছে। ভাবলাম আগে পেটকে শান্ত করি তারপর অন্যকিছু। টেবিলের উপর রাখা গামলার ঢাকনা সরিয়ে দেখলাম খালি গামলা আর প্লেট চকচক করছে। জাফর ভাইকে বললাম,

-ভাই মেল কই?
–মেল নাই। বুয়া বিকালে আসেনি।
-বিকালে আসেনি মানে?
–সকালে এসে দুপুরের রান্না করে দিয়ে গেছে। রাতের রান্না তো বিকালে এসে করে। বিকালে আর আসেনি।
-আসেনি এ কেমন কথা? তার হিসাবে চলবে নাকি সবকিছু। আমরা রাতে কি খাবো?
–আমি তো চিড়া গুড় খেয়ে রাত কাটিয়ে দিতে পারবো। আপনি বাইরে থেকে খেয়ে আসুন।
-মগের মুল্লুক? এই কাজ চোর বুয়া রাখবোনা মেসে। আর আমার মনে হচ্ছে আমার শার্টটা ওই বুয়াই চুরি করেছে। আগেরবার আমার স্যান্ডেল জোড়া নিয়ে গেলো না।
–আপনার স্যান্ডেল তো ছিঁড়ে গেছিলো। তাই গরিব মানুষ জোড়া তালি দিয়ে পরার জন্য নিয়ে গেছে। ভেবেছে আপনি হয়তো আর ব্যবহার করবেন না।
-স্যান্ডেল, শার্ট এসব কিনার টাকা বুয়ার বেতনের টাকা এসব কোথা থেকে আসে? আমার টাকা কি গাছে ধরে। একটা টাকা উপার্জনের পেছনে কি পরিমান পরিশ্রম যায় জানেন? কতো কথা হজম করতে হয় বুঝেন?

–আপনি এতো রেগে যাচ্ছেন কেন?
-রাগবোনা মানে। আপনি বুয়ার বাসার ঠিকানা দেন। এখুনি গিয়ে বলে আসবো কালকে থেকে যেন না আসে।
–আপনি সত্যি যাবেন?
-জাফর ভাই আমি মজা করছিনা। আপনি ঠিকানা দেন।

জাফর ভাইয়ের কাছে ঠিকানা নিয়ে মেস থেকে বের হলাম। এই মুহূর্তে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে আমার। দাঁতে দাঁত চেপে রেখেছি। রাগ কমানোর জন্য কাউকে বকাবকি করতে হবে। বস্তির ভেতর বুয়ার বাসা খুঁজতে খুঁজতে টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। বুয়ার বাসা খুঁজে পেলাম ঠিকই কিন্তু ততোক্ষনে আমি কাকভেজা হয়ে গেছি। দরজা কয়েকবার ধাক্কানোর পরে দশ বারো বছরের একটা ছেলে দরজা খুলে দিলো। ছেলেটা আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলো,

–কাকে খুঁজেন?
-সুলতানা বুয়ার বাসা না এটা?
–জ্বি…
-তোমার কি হয়?
–আম্মা…
-তিনি বাসায় আছেন?
–জ্বি… ভিতরে আসেন।

দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে বুঝতে পারলাম এটা একটা বেডরুম। বড়লোকদের মতো এদের বাসার আলাদা গেইট তারপরে বসার রুম থাকেনা। কারো শোবার ঘরে ঢুকে পরা ভদ্রতার নিয়মে পরেনা। তবে স্বস্তির বিষয় হলো এটা নিয়ে বস্তির মানুষদের তেমন মাথা ব্যাথা থাকেনা। আমাকে দেখে বুয়া বেশ অবাক হলেন। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

–উনাকে একটা চেয়ার দে।

ছেলেটা মনে হয় এ ঘরেই পড়তে বসেছিলো। টেবিলে বই খাতা এলোমেলো ভাবে রাখা। ছেলেটা নিজের চেয়ারটা এগিয়ে দিলো। বুয়া ছেলের দিকে তাকিয়ে আবারো বললেন,

–গামছাটা এনে দে।

ছেলেটা পাশের ঘরে গামছা আনতে গেলো। বুয়া অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি হয়তো বুঝতে পারছেন না এ সময়ে কেন আমি এখানে। বুয়ার সাথে কখনো আমার তেমন কথা হয়নি। তার সাথে ছুটির দিন ছাড়া দেখা হয়না। আর ছুটির দিন আমি ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেই। কথা হওয়ার সুযোগ ছিলোনা। ছেলেটা গামছাটা এগিয়ে দিলো। আমি গামছাটা নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ঘরের দিকে তাকালাম। বিছানায় কঙ্কালসার একজন লোক শুয়ে আছেন যার শরিরে আমার সাদা শার্টটা। আমার মতো পাতলা মানুষের শার্ট ওই লোকটার শরিরে যথেষ্ঠ ঢোলা মনে হচ্ছে।

লোকটার বালিশের পাশে একটা পাতিল রাখা। টিনের ফুটো দিয়ে পাতিলে টপটপ করে পানি পরছে। কেন যেন ছেলেটার পায়ের দিকে লক্ষ্য করলাম। হুম আমার ধারণা সঠিক ছেলেটার পায়ে আমার ছেঁড়া স্যান্ডেল জোড়া। শেলাই করে পরেছে। হুট করে মনে হলো অভাব তুমি বড়ই নির্দয়। ভেবেছিলাম এখানে এসে খুব রাগারাগি করবো কিন্তু বুঝতে পারলাম আমার মাঝে এই মুহূর্তে রাগের ছিঁটেফোটাও নেই। বুয়ার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাচ্ছেন। হয়তো বুঝতে পারছেন না আমাকে কি বলে সম্বোধন করবেন। বাবা নাকি ভাই নাকি স্যার কোনটা। আমি তার সমস্যাটা দূর করে দিলাম। তার দিকে তাকিয়ে বললাম,

-চাচি চাচা অসুস্থ্য নাকি? সুলতানা বুয়া এবার কথা বললেন,

–জ্বি বাবা। তিন বছর ধইরা বিছানায় শোয়া। এতো টাকার অষুধ যায় মানুষটা ঠিক হয়না। দিন দিন অবস্থা খারাপ হয়।
-চাচার সমস্যাটা কি?
–এগুলান পাপের ফল বাবা। জোয়ান বয়সে মদ খাইয়া ফুর্তি করছে অখন বুঝতাছে।

আমার কি বলা উচিত বুঝতে পারছিনা। সান্তনা দিয়ে লাভ নেই। এমন মানুষের সান্তনার প্রয়োজন হয়না। এটা সারাজীবন নিজেদের সান্তনা দিয়ে এসেছে একদিন সব ঠিক হবে। কিন্তু তাদের সেই একদিন কখনো আসেনা। বরং সান্তনার হাজারটা কথার চেয়ে একশত টাকার একটা নোট এদের কাছে বেশি মূল্যবান। বুয়া এবার আমার আসার কারন জিজ্ঞাসা করলেন,

–বাবা হঠাৎ করে গরিবের বাসায় কি মনে কইরা?
-আসলে একটা কাজে এসেছিলাম। এপাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। বৃষ্টি শুরু হলো, ভাবলাম আপনার বাসায় একটু বসি।
–ভালো করছেন বাবা। বসেন চা বানাই। চা খান।

বৃষ্টিতে ভিজে একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিলো। চা পেলে মন্দ হয়না। আমি চুপচাপ বসে বিছানায় রাখা পাতিলের দিকে তাকিয়ে আছি। পাতিলটা পানিতে প্রায় ভরে গেছে।

–চা নিন…

কণ্ঠটা শুনে আমি যেন চমকে উঠলাম। কানে ভুল শুনছিনা তো। মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলাম শিমু দাঁড়িয়ে আছে। শিমুকে দেখে আমি যতোটা না অবাক হয়েছি মনে হচ্ছে শিমু আমাকে দেখে তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছে। সুলতানা বুয়া ঘরে ঢুকে বললেন,

–বাবা চা নেন।

আমি শিমুর হাত থেকে চায়ের কাপটা নিলাম। শিমু রুম থেকে বের হচ্ছিলো সুলতানা বুয়া শিমুকে ডেকে বললেন,

–কোথায় যাচ্ছিস বস এখানে।

শিমু মায়ের কথা মতো বিছানার একপাশে বসলো। শিমুর দৃষ্টি প্রতিবারের মতো মাটির দিকে। সুলতানা বুয়া কথা বলতে শুরু করলেন,

–আমি যেই মেসে রান্না করি ইনি সেই মেসে থাকেন। বড় ভালো মানুষ। তোর আব্বার জন্য যেই শার্টটা আনছি ওইটা উনার শার্ট।

শার্টের প্রসঙ্গ আসাতে বুঝতে পারলাম শার্টটা জাফর ভাই বুয়াকে দিয়েছেন। আমার রাগ দেখে হয়তো স্বীকার করেননি। শিমুর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছি মায়ের কথা শুনে সে বিব্রত বোধ করছে। কিছু মানুষ আছে যারা যতোই কষ্টে থাকুক নিজের দুর্বলতা অন্যকে দেখাতে পছন্দ করেন না। এই মানুষগুলো খুব কঠিন হয়। না খেয়ে থাকবে তবুও হাত পাতবেনা। শিমুও হয়তো তাদের মধ্যে একজন। সুলতানা বুয়া এবার মেয়ের প্রশংসা শুরু করলেন,

–মেয়েটা অনেক কষ্ট করছে বাবা। এইবার ইন্টার পাশ করছে। আমরা টাকা দিতে পারিনাই। মাইন্সের বাড়ি গিয়া প্রাইভেট পড়াইয়া নিজের খরচ চালাইছে।

সুলতানা বেগমের কথা শেষ হবার আগেই শিমু উঠে পাশের ঘরে চলে গেলো। আমিও বাসা থেকে বের হলাম। বাসা থেকে বের হয়ে দেখি বৃষ্টি থেমে গেছে। ভিজে যাওয়ার কারনে বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। হেঁটে হেঁটে মেসে ফিরছি আর শিমুর কথা ভাবছি। এই মেয়েটা এতো কষ্টের মাঝে থেকে লড়াই করছে অথচ তাকে রাস্তায় থামিয়ে আমি প্রেম নিবেদন করছি। নিজের অজান্তে মেয়েটাকে হয়তো অনেক বিরক্ত করে ফেলেছি। নিজের কাছে নিজের আচরনের জন্য লজ্জা লাগছে।

রাতে মেসে ফিরে জ্বর আসলো। জ্বরের ঘোরে শিমুর কথা ভাবতে ভালো লাগছে। আচ্ছা আমি যদি শিমুকে বিয়ে করি তাহলে সে তো ভালোই থাকবে। অন্তত বস্তির সেই জীবনের চেয়ে ভালো। ভাবনার এক পর্যায়ে মনে হলো আমার কি এসব ভাবা ঠিক হচ্ছে? মেয়েটা গরিব বলে আমাকে কেন তার বিয়ে করতে হবে। সে তো আমাকে পছন্দ করেনা। আমাকে ভয় পায়। আমাকে দেখলে বিরক্ত হয়। নাহ্ এমনিতে তার জীবনে অনেক সমস্যা আমি নতুন করে সমস্যার কারন হতে চাইনা। শরিরে জ্বর নিয়েই তিনদিন অফিস গেলাম। লাল চোখ শুষ্ক ঠোট দেখে বস বললেন,

–আলিফ আপনি কি অসুস্থ্য? অসুস্থ্যতা নিয়ে অফিস আসতে হবেনা। দুদিনের ছুটি নিয়ে বাসায় রেস্ট নিন। সুস্থ্য হয়ে তারপর অফিস আসুন।

এই তিনদিনে অফিস থেকে ফেরার সময় দুবার শিমুর সাথে রাস্তায় দেখা হয়েছিলো। আমি মাথা নিচু করে চলে এসেছি। ইচ্ছে করছিলো একবার তাকিয়ে শিমুর মুখটা দেখি, শুধু একবার। শরিরে কাঁথা জরিয়ে শুয়ে আছি। জ্বরটা বড্ড কষ্ট দিচ্ছে। এই মুহূর্তে মায়ের কোলটার অভাব যেন আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। মনে হচ্ছে যদি উড়ে মায়ের কাছে যেতে পারতাম। মা যদি তার কোলে আমার মাথাটা রেখে একবার হাত বুলিয়ে বলতো, বাবা এখন জ্বর কেমন? জ্বরটা যেন সাথে সাথে সেরে যেতো।

–এই যে শুনছেন? আপনি কি ঘুমাচ্ছেন?

পরিচিত নারী কণ্ঠ শুনে অবাক হলাম। মেসে মেয়ে আসলো কোথা থেকে। মুখের উপর থেকে কাঁথা সরাতেই শিমুকে দেখলাম। মনে হচ্ছে জ্বরের ঘোরে শিমুকে দেখছি। কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকার পরে মনে হলো। নাহ্ এটা স্বপ্ন, ঘোর বা কল্পনা নয়। সত্যি সত্যি শিমু বিছানার পাশের চেয়ারটায় বসে আছে। শিমু বললো,

–মায়ের কাছে শুনলাম আপনি নাকি অসুস্থ্য।
-জ্বি… একটু। কিন্তু আপনি এখানে?
–এখানে এসে কি অন্যায় করেছি। সরি কাজের বুয়ার মেয়ে হয়ে এখানে আসা উচিত হয়নি। মাফ করবেন।
-তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?

–আমি বুয়ার মেয়ে জানার পর থেকে আপনি আমাকে দেখেই মাথা নিচু করে হেঁটে চলে যান। আমি জানতাম সত্যটা জানার পরে আমার প্রতি আপনার ভালোবাসা হারিয়ে যাবে। তাই সেদিন আপনাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে আমি ভুল ছিলাম না। কিন্তু কারো প্রতি এতোটা টান, ভালোবাসা দেখিয়ে হুট করে বদলে যাবেন না। মানুষ এটাতে কষ্ট পেতে পারে।

আমি লক্ষ্য করলাম শিমুর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। আমি কেন যেন তার কষ্টটা মেনে নিতে পারছিনা। আমারো যে কষ্ট হচ্ছে। আমি শিমুর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,

-আমি তোমার থেকে দূরে যাচ্ছিলাম কারন আমি চাইনি তোমার বিরক্তির কারন হতে। এটা জানতাম না আমার অনুপস্থিতি তোমাকে কাঁদাতে পারে। জানলে কখনোই যেতাম না। আমি এখনো তোমাকে আগের মতোই ভালোবাসি।

আমি নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে শিমুর হাত ধরে রেখেছি। শিমু তার হাত ছাড়ানোর কোন চেষ্টা করছেনা। যেন মুহূর্তেই আমি নিজেকে ভালোবাসার সমুদ্রে আবিষ্কার করলাম। যেন এক মুহূর্তেই ভালোবাসা তার অসীমতা দিয়ে আমাকে আবদ্ধ করে ফেলেছে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত