আমি তখন সবে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি,মানে মনের মধ্যে বসন্ত ছাড়াই সকাল বিকাল কোকিল ডাকাডাকির সময়!অহেতুক, অনর্থক সব কারনে হেসে লুটোপুটি খাওয়ার সময়,পাশের বাসার হ্যান্ডসাম, কুল কিংবা ড্যাসিং ছেলেদের দেখে সুযোগ বুঝে একটু চোখ টিপ দেওয়ার সময়,আর যখন ছেলেটিও আমার দিকে ঘুরে তাকাবে তখন দিব্যি ভাজা মাছটি ও উল্টে খেতে পারি না লুক!তখনকার সেই আলাভোলা লুকটা দেখে যে কেউই এক বাক্যে স্বীকার করে নিবে যে আমার মতো লক্ষ্মী! অবুঝ!শান্তশিষ্ট মেয়ে বুঝি এ জগতে আর দুটি নেই।
হঠাৎ-ই একদিন বাসায় নতুন ভাড়াটিয়ার উদয় হলো,সুঠাম দেহের লম্বাচওড়া দু’টো পুরুষ মানুষ,চেহারায় কিঞ্চিৎ মিল ঝুল ও আছে মনে হচ্ছে, সম্পর্কে তাহারা আপন ভাই,এদেরমধ্যে আবার ছোটজন একটু বেশিই সুন্দর কিন্তু তারা সুন্দর হলেও আমার কোন লাভ নেই তাতে কারন তারা দুই ভাই-ই বিবাহিত।সাথে স্যুটকেসের মতো দাঁড়িয়ে দুজন সুন্দরী,রুপসী নারী!বুঝতে বাকি রইলো না যে তারা এই দুই ড্যাসিং যুবকদ্বয়ের বউ আর কি!এই হয়,যখন সামনে প্রেমে পড়ার মতো তাগড়া জোয়ান ছেলেমানুষ দাঁড়িয়ে থাকে তখন পোড়া কপালি হওয়ার দোষে তাদের জলজ্যান্ত বউগুলোও এভাবেই উপস্থিত থাকে।কথায় বলে না,বউ মাত্রই পাহারাদার! তো তারা দুই দম্পতি কি মনে করে একই ফ্লাটে উঠলেন,এবং দূর্ভাগ্যবশত সেটা আবার তিনতলায়।আর আমরা থাকি দোতলায়,মানে আমার কাছাকাছিই থাকতে হলো তাহাদের!সে যাকগে,আমি ভালো মেয়ে, পুরুষ মানুষের দিকে মোটেও নজর দি না।থাকুক তারা যেখানে খুশি।
কিন্তু সময়টা ঠিক ছিলো না কলেজ বন্ধ!অর্থাৎ আল্লাহর দুনিয়ায় আমার আর কোনো কাজবাজ নেই, আমি ফ্রি মানুষ। নিজের বাড়ি,নিজের ঘর তাই সকাল বিকাল ছয়বেলা করে ছাদে যাওয়ার অভিযান শুরু করলাম,আসতে যেতে তিনতলায় সুন্দর বিবাহিত জোড়া দম্পতিদের দেখার জন্য নিয়ম করে উঁকিঝুঁকি দেওয়াও শুরু করলাম কিন্তু কোনবেলায়ই ঠিক কাউকে দেখা যায় না!এ বড় অন্যায়, বউগুলো না হয় কাজ করে বুঝলাম কিন্তু জামাইগুলো তো একটু বাইরের হাওয়া-বাতাস খেলেও পারে,পুরুষ মানুষ এতো ঘরের ভিতর থাকবে কেন! আজব চিড়িয়া!
এর কিছুদিন পরে অবস্থার খানিকটা উন্নতি হলো,উপর ওয়ালা মনে হয় তাদের আলোবাতাসের প্রয়োজনীয়তার কথা কানেকানে বলে দিয়েছেন ইতোমধ্যেই। তা এবারে দেখা গেলো,আমার মতোই নিয়ম করে দুইভাই সকাল- সন্ধ্যা ক্যারাম খেলে,পপকন খায়,চানাচুর খায়,পাস্তা খায়, আবার দেখি ক্ষেত্রবিশেষে আমার জাতীয় খাবার বার্গার ও খায়।
খানিক বাদেবাদেই দুই বালকের জন্য অর্ডারের খাবার আসে, পার্সেল হাতে ডেলিভারি বয় লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলা ওভারটেক করে সোজা চলে যায় তিনতলায়,কী মুশকিল! আমি শুধু ঘ্রান পাই,খাওন তো পাই না।
আর এদের বউদের ও তো দেখি না।প্রেমে ছ্যাঁকা খাওয়া মেনে নেওয়া যায় কিন্তু এভাবে সকাল সন্ধ্যা অন্যের পেটের উদ্দেশ্যে যাত্রাকৃত খাবারের ঘ্রান তো মেনে নেওয়া যায় না!ঘ্রান জ্বালা বড় জ্বালা আর খাবারের ঘ্রান তো মহাজ্বালা!এ যে চূড়ান্ত বিচ্ছেদের অনুভূতিকেও হার মানাবে।
ঘ্রানে আধাপাগল হয়ে আম্মুরে বললাম আজ দয়া করে কিছু ভালো মন্দ রান্না করো,নইলে এ বাড়িতে এই আমার শেষদিন।আম্মু খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনলেন,এরপরে যত্ন করে করল্লা ভাজি করলেন।বুঝলাম আমি নিজেরে প্রিনসেন্স ডায়্যেনা মনে করলেও আম্মু আমারে পিওর ফকিন্নি মনে করে।এই না হলে আমার মা! আরো বুঝলাম আমি বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইলে আম্মুই ব্যাগপত্র গুছিয়ে দিবে নিশ্চিত!তাই আর বাড়াবাড়ি করা গেলো মা, হেলেদুলে মজামজা করে উম্ম আম্ম শব্দ করে করল্লা ভাজিই খেয়ে নিলাম। কিন্তু না এ অন্যায় মানা যায় না,করল্লার বংশধরেরা আমার পেটের মধ্যে যুদ্ধ লাগাইছে।ভাবলাম যাই চাঁদ মুখ দুটো একটু দেখে আসি সাথে তাদের চাঁদের বুড়িদের ও। হেলতে দুলতে গেলাম,হাত বাড়িয়ে নক দিলাম,ভদ্র মানুষের মতো তারা দরজা খুললো।ভিতরের দিকে একটু উঁকি ঝুঁকি দিতেই মনে হলো বউদ্বয় বোধহয় বাড়িতে নেই,আলহামদুলিল্লাহ। তবুও সৌজন্যতার খাতিরে বললাম,
–ভাবিরা কোথায়? ভাবির কথা বলতেই দুই ভাই মুচকি মুচকি হাসলেন।বললেন,
—তোমার ভাবিরা ঝগড়া করে বাপের বাড়ি গেছে গা।কয়েক দিন পরে আসবে।
ভাবলাম ভালো,আসুক নাইলে না আসুক! আমার তাতে কি! এরপরের দিন আমার অবসর জীবনের মুখে চুনকালি মেখে কলেজ নামের আমাবস্যা নেমে এলো আবার,তো খুব সকাল সকালই আমি কলেজ ড্রেস পরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বের হলাম,মনের সুখে হেলতে দুলতে হাঁটা আমার পুরোনো অভ্যাস,অভ্যাসের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে বাড়ির মেইন গেইটের কাছেই টুক করে একটা ধাক্কা খেলাম,চোখ তুলে তাকাতে দেখি, এ তো ছোটমিয়া! আহা কি সুন্দর সে পোলা। বউ আছে শুনে আগে ঠিকঠাক দেখাই হয় নি মনে হচ্ছে।
পোলা শ্যামলা,খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি,পরনে তার আবার সাদা শার্ট! অদ্ভুত তো,এই লোক কিভাবে জানলো সাদা আমার প্রিয় রঙ!নাহ আর আঁটকানো গেলো না,খেলাম এই বিবাহিত সুপুরুষটির উপরেই এক মস্ত বড় ক্রাস। ক্রাস যে চোখের পুষ্টি!চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী, চোখ না মানে ক্রাসের উপর কড়াকড়ি। এরপরে লাজুক চোখে লজ্জাবতী লতার মতো হেলে গিয়ে আবার তাকালাম! দেখলাম আরো কয়েকবার!,কিন্তু এ ছেলের তো বউ আছে,থাক এই শেষবার।আর দেখবো না!কিন্তু আমার মনযে মানে না, সন্ধ্যা হতেই হেলেদুলে আবার গেলাম তিনতলায়।
এই প্রথমবারের মতো দেখা গেলো তাহাদের বাসার দরজা দিব্যি খোলা,ভিতরে ঢুকতেই চোখ কপালে ওঠার অবস্থা!আরে এ বাসা তো পুরোদস্তুর ব্যাচেলর বাসা!অসম্ভব, কোনো মূল্যেই এ বাসা কোনো বিবাহিত ডাবল দম্পতিদের হতেই পারে না।পরে আরো এক ভয়াবহ রহস্য উদঘাটন করলাম তা হলো আমার চোখে কালসাপের মতো রুপসী সেই দুই রমনী খুব সম্ভবত এই দুই ড্যাসিং ভাইয়ের বান্ধবী হবেন।কালসাপ বলার কারন ক্রাসের উপর অধিকারিনীকে নিখাঁদ সুন্দরী,রুপসী উপাধি দেওয়া আমার এই শাশ্বত নারী সত্তা কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি।
আহাহা কি খুশি কি খুশি,,,আমার জন্যই বুঝি তবে তিনি এতোকাল ধরে কুমার রয়ে গেছেন! একদম খাঁটি প্রেম,স্যাম্পলই প্রমান।
এরপরে আর কি! তাহার আর আমার মাঝে যেহেতু এখন আর স্যুটকেস নামক বউয়ের বেড়াজাল নেই,তাই একমুহূর্তও বিলম্ব না করে তৎক্ষনাৎ ই একটা নীল রংয়ের কাগজে লিখে ফেললাম, “” তোমার প্রেমে দিশেহারা আমি” ইতি তোমার কথাকলি-এরপরে গুনেগুনে তিনদিন কেটে যায়,বহু ভাবনা চিন্তাকে ঝাড়ুপেটা করে তিনদিন পরে একবুক সাহস নিয়ে আস্তে করে চিঠিটা দরজার নিচ থেকে ভিতরে ঠেলে পাঠিয়ে দিলাম,আমি কয়েক পা আগানোর আগেই পিছন থেকে ক্রাসের বড় ভাইয়ের কন্ঠে শুনতে পেলাম,
–কথা,,আমিও যে তোমার প্রেমে দিওয়ানা!চিঠিটা আরো আগে দিলেই পারতা!দুষ্ট!
কথাটা শোনামাত্রই আমার চোখ তালের আঁটির মতো ক্রমশ আরো বড় হতে লাগলো!পাশ থেকে আমার ড্যাসিং হোয়াইট ক্রাস বলে উঠলো,
–ভাবি এবারে আমার জন্যও একটু কাউরে খুঁজে দিও,প্লিজ!
আল্লাহ! ভাবি! এই কথা শোনার আগে আমি বধির হয়ে গেলাম না কেনো!একবার বড়মিয়া,একবার ছোটমিয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে হাবার মতো আরো কয়েকবার তাকাইয়া এরপরে এক দৌড়ে আম্মার রুমে এসে বললাম,
“” আম্মা তিনতলার তারা ব্যচেলর”” ব্যাস!!আব্বা আসামাত্র সন্ধ্যায় দুই ব্যাটারে তল্পিতল্পা সমেত বাসা থেকে বাহির করে দেওয়া হলো!বের করে দেওয়ার পূর্বে আব্বা উচ্চস্বরে বলেছেন, ‘”ঘরে আমার জোয়ান মাইয়া,আর তোমরা ব্যাচেলর???, হ্যাঁ ভাগ্যিস আমার মাইয়া বইলা দিলো নইলে তো দুইদিন পরে আমার মাইয়ার উপ্রে ই লাইন মারতা!