মরিচিকা

মরিচিকা

অর্ঘ্য এবং তনু দুজন দুপাশে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কেউ প্রথমে কথা বলতে রাজি নয়। হয়তো মনের মাঝে জমে আছে চাপা রাগ।তবে প্রকাশ না করে কতক্ষণ?ফলস্বরূপ তনু একপর্যায়ে বলে ফেললো,

– যা বলার তাড়াতাড়ি বল।
– হুম!
– কেন ডাকছিস?
– এমনি।আজ কত তারিখ যেন?
– ১৭।
– ২০ তারিখে ঢাকা যাচ্ছি।
– ভালো।
– ইচ্ছা ছিলো সামনে মাসে তোর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দিবো।
– হুম।
– তোকে বউ করে ঘরে তুলবো।ছোট্ট একটা সংসার হবে।সংসারে চুলা থাকবে,হাড়ি পাতিল থাকবে,আলনা থাকবে,টিভি থাকবে,সাথে বাড়ির সামনে পুকুর তো মাস্ট।আর এগুলোর মালিক থাকবি তুই।
– ফানি!প্লাস ভালো স্বপ্ন।আফসোস!আমি রান্না পারিনা,জামা কাপড় গোছাই না,আবার টিভিও দেখি না।তাছাড়া পুকুর একদম অসহ্য লাগে।
– আমি জানি সেটা।কিন্তু তোর বান্ধবী অর্পা এগুলো খুব পছন্দ করে।

– হুম,ত…ত..তো?
– ওকে প্রস্তাব দিয়ে দেখি।
– দরকার নাই।ঢাকা থাকবি কোথায়?
– নবীনগর বা গাবতলির আশেপাশে।
– কার বাসায়?
– গিয়ে খুঁজতে হবে।
– এক কাজ কর।
– কি?
– সাভার থাক।আমাদের সাথে।
– মানে!কেন?
– আমার ইচ্ছা।
– তোর ইচ্ছা হলে হলো?সবকিছুর একটা ব্যাপার আছে।এটা সম্ভব না।
– কেন সম্ভব না?
– তোর ফ্যামিলি মানবে না।তাছাড়া বিষয়টা কেমন যেন দেখায়।

– আমার ফ্যামিলি মানবে।আব্বু এমনিতে তোকে খুব ভালো জানে।যদি জানতে পারে তুই ঢাকা সাভারের আশেপাশে থাকবি তো তোকে ঘাড় ধরে আমাদের বাসায় নিয়ে আসবে।
– বুঝলাম না।
– বুঝতে হবে না।ঢাকা যাচ্ছিস কেন?
– চাকরি হয়েছে।
– হোয়াট?ও..ও..ওয়াও।তুই বলিসনি কেন?ছাগল!সত্যি কিছু বলার নাই তোকে।
– পঁচিশ হাজার টাকা স্যালারি।
– উমম চলবে।শোন দশ হাজারের মধ্যে মোটামুটি একটা ফ্লাট নিবো।বাকি দশ হাজার টাকা দিয়ে সংসার চালাবো।

আর পাঁচ হাজার টাকা সেভিং করবো।যখন বাবু হবে দেখবি সেভিং করা টাকা গুলো কাজে দিছে।আর প্রথম প্রথম দুজনকে বিলাসিতা কম করে চলতে হবে। কথা গুলো বলে তনু নিজে বোকা হয়ে গেলো।অর্ঘ্যর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।এক হ্রাস লজ্জা ঘিরে ধরেছে তাকে। অর্ঘ্য নিশ্চুপ। তাঁর জানা ছিলো মেয়েরা এডভান্স চিন্তা করে।কিন্তু এতটা এডভান্স কিভাবে সম্ভব? এর মধ্যে তনু লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা না পেয়ে অর্ঘ্যকে জড়িয়ে ধরেলো। বাস আপন গতিতে চলছে। পাশাপাশি বসে আছে অর্ঘ্য ও তনু। পেছনের সিটে তনুর বাবা-মা। কিছুক্ষণ পর তনু অর্ঘ্যর হাত চেপে ধরলো।অর্ঘ্য অবাক হয়ে তনুর দিকে তাকাতে তনু মিষ্টি করে একটা হাসি দিলো। এরপর দুজন ডুবে গেলো অতীতে। ৫ বছর আগে..অর্ঘ্যদের পাশের বাসায় মেহমান আসছে। অর্ঘ্যর অবশ্য এই নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই।সে নিশ্চিন্তে পুকুরপাড় বসে আছে। ঝামেলা শুরু হলো তনুর উপস্থিতিতে।

– এই ভাইয়া আপনাদের এখানে দোকান কোথায়?
– কিসের দোকান?
– কিসের আবার!ফ্লেক্সিলোডের।
– জানিনা।
– জানেন না মানে?মজা করেন?
– আপনি আমার বিয়াই না বউ?

আপনার সাথে মজা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই।আজকালকার মেয়েরা একটু বেশি আপডেট হয়ে গেছে।সারাদিন ফ্লেক্সিলোডে আর ফোন নিয়ে পড়ে থাকবে।অবশ্য দশ পনেরোটা বিএফ থাকলে এটা স্বাভাবিক।[বিড়বিড় করে]

– এইযে মিস্টার,আমার কোন বিএফ নাই ওকে।
– আপনার বাসা কোথায় যেন?
– ঢাকা।
– ওহ্।হুম এটা স্বাভাবিক।বিএফ নাই,তো ঢাকার মেয়েদের জাতীয় বাক্য।
– মানে?কি বলতে চাচ্ছেন আপনি!সব মেয়ে এক না।
– আহা!দ্বিতীয় জাতীয় বাক্য শুনলাম।তৃতীয়টা বলবেন প্লিজ।
– ফালতু।
– একদম মিলে গেছে।চতুর্থ বাক্য প্লিজ।
– ধ্যাত।আজাইরা যত্যসব।

বলে তনু চলে গেলো। অর্ঘ্য হেসে কুপোকাত।সকাল সকাল এমন বিনোদন না পেলে নয়। এর কিছুক্ষণ পর অর্ঘ্যর ডাক পড়লো।কমল সাহেবের ডাকে বালক হতভম্ব।মনে কাজ করতে শুরু করলো,অজানা ভয়।

তবে ভয় কাটিয়ে সে সামনে গিয়ে বললো “ডেকেছেন স্যার?” কমল সাহেব অর্ঘ্যর কাঁধে হাত রেখে বললেন “ইয়েস ইয়াং ম্যান।”তারপর কয়েক সেকেন্ড থেমে সবার উদ্দেশ্য করে বললেন “ও অর্ঘ্য।আমার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র।প্রাইমারীতে ইংলিশে শিক্ষকতা করা কালীন পড়ার প্রতি ওর মনযোগানো আমার মন জয় করে নিয়েছিলো।শুধু যে পড়ার প্রতি,তা বললে ভুল হবে।ওর শান্তশিষ্ট স্বভাব এবং বন্ধু সুলভ আচরণ এর কারণে ওকে সবসময় আলাদা ভাবে ভাললেগেছে।পুরো নিখুঁত একটা…” এর মাঝে তনু পেছন থেকে এসে বললো “আব্বু..আব্বু!” কমল সাহেব পেছনে তাকিয়ে বললেন “বলো মামনি।” তনু কিছু বলতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে অর্ঘ্য ঘুরে তাকালো।অর্ঘ্যর মুখ দেখে তনু রাগে ফুসফুস করছে। “আব্বু এই ছেলে কে?” কমল সাহেব হাসিমুখে বললেন “অর্ঘ্য নামে আমার যে এক ছাত্রর কথা বলেছিলাম,ও সে।”

তনু অর্ঘ্যর পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকিয়ে বললো “তোমার মুখে শোনা ছাত্রের সাথে এই ছেলের কোন মিল খুঁজে পাচ্ছি না।” অর্ঘ্য নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো। কমল সাহেব তনুর দিকে চোখ গরম করে বললেন “মিল খুঁজতে হবে না।যাও,দাদীর রুমে যাও।” তনু জবাব না দিয়ে চলে গেলো। বসন্তের প্রায় শেষ। শীতল মিষ্টি হাওয়া বইছে।বাতাসে নানান ফুলের ঘ্রাণ।গাছে নতুন পাতা গজিয়েছে। ধান ক্ষেত সবুজ বর্ণ ধারণ করেছে।কিছুদিন গেলে পেকে হলুদ হবে।চারিপাশে একবার চোখ বুলালে যেন মন জুড়িয়ে যায়। এমন পরিবেশে অর্ঘ্য গাছের ডালে বসে ছবি আঁকছে। ছবি আকার একপর্যায়ে চোখ গেলো পুকুরপাড়ে।সেখানে তানু বাচ্চাদের মতন পানি নিয়ে খেলা করছে।অদ্ভুত দৃশ্য। অর্ঘ্য চোখ ফেরাতে না পেরে একভাবে তাকিয়ে রইলো। এরপর ঘটলো দুর্ঘটনা। তনু পানিতে পড়ে গেছে।

অর্ঘ্য অবশ্য প্রথমে ভেবেছিলো মেয়েটা গোসল করার জন্য নেমেছে।কিন্তু বালিকার ঝাপাঝাপিতে পরে বোঝা গেলো সে নাকানিচোবানি খাচ্ছে। এবার অর্ঘ্য কোন উপায় না পেয়ে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো পুকুরে।তারপর কোনভাবে জড়িয়ে ধরে ওপরে তুলে আনলো তনুকে।ভাগ্যক্রমে সমস্যা ঘটলো অন্য জায়গায়। মেয়েদের শরীরে কোন এক চৌম্বকীয় বল থাকে।যা ছেলেদের অল্পতে আকর্ষণ করে।তবে শুধু আকর্ষণ করলে আলাদা কথা।মনের মাঝে এমন এক ভাললাগা তৈরী করে দেয়।যা একজন ছেলেকে মেয়েটাকে নিয়ে হাজার বার ভাবাতে বাধ্য করে। তনু অর্ঘ্যর দিকে হা করে তাকিয়ে থেকে আচমকা বললো “আপনি আমায় টাচ করলেন কোন সাহসে?” অর্ঘ্য হতভম্ব।বালিকা বলে কি?”আমি আপনাকে টাচ না করলে মরে ভুত হয়ে যাইতেন।”

– হলে হতাম।কিন্তু আপনি আমাকে টাচ করলেন কেন?এখন আমি আমার স্বামীকে কি জবাব দিবো?
– আপনি বিবাহিত!ওহ্ গড।দেখে তো বোঝাই যায় না।
– স্টুপিড।ভবিষ্যতে স্বামী যখন জিজ্ঞাসা করবে তোমাকে কেউ টাচ করেছে কি না,তখন আমি কি জবাব দিবো?
– আমি কি জানি?
– কি জানেন মানে?
– বাঁচিয়ে কি পাপ করলাম?
– পাপ পূণ্য বুঝিনা।এখন আমাকে বিয়ে করতে হবে।
– মানে?
– জ্বি হ্যা।আপনি আমাকে টাচ করেছেন,এখন বিয়ে করবেন।
– টাচ করলে বিয়ে করতে হবে?
– হুম।
– তাহলে কোন রিক্সাওয়ালা যদি টাচ করে তাকেও বিয়ে করবেন?
– সাট আপ।আপনি আমার কত গোপন জায়গায় টাচ করেছেন জানেন?ছিঃ ছিঃ ছিঃ,ভাবতে পারছিনা আমি।

অর্ঘ্য মাথায় হাত দিলো।মেয়েটা যেভাবে বলছে,যেন তাকে রেপ করে ফেলেছে।পানি থেকে তুলতে গেলে সামান্য স্পর্শ তো লাগবেই। কিন্তু এখন সমস্যা হচ্ছে,মেয়েটাকে না থামালে যে কেউ অন্যকিছু ভেবে নিবে।এবং পরে সেটা কঠিন রূপ ধারণ করবে।

– আচ্ছা বাদ দেন।বিয়ে কখন করতে হবে?
– জানিনা।কিচ্ছু জানিনা আমি।আব্বুকে বলে দিবো সব।এরপর আব্বু যা ডিসিশন নেওয়ার নিবে। তনুর কথা শুনে অর্ঘ্য ভয়ে কাঁপছে।মেয়ে বলে কি?অবশেষে কি তাহলে জেলের ভাত কপালে ছিলো।

– এই শুনেন।একটু শুনেন আমার কথা।
– কি?
– নাম কি যেন আপনার।
– তনু।
– তো তনু,আমরা এখন অনেক ছোট।আগে বড় হই।চাকরি করি।তারপর আপনার আব্বুকে বলে বিয়ের জন্য রাজি করাবো।তার আগে আপনার আব্বু যেন কিছু জানতে না পারে।প্লিজ এতটুকু করবেন আমার জন্য?
– আপনি তো আমার হবু স্বামী?
– হুম।
– ওকে।কিন্তু ততদিন কি আমরা প্রেম করবো?
– আপনি রাজি থাকলে করবো।
– আমি রাজি।স্বামীর সাথে প্রেম করবো না তো কার সাথে করবো?

অতীত ভাবতে ভাবতে দুজন একসাথে হেসে উঠলো।তারপর দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আবার হাসি।
সত্যি ভালবাসা পাগলামির একটা অংশ।পাগল পাগলী ছাড়া কখনো ভালবাসা টিকে না। ভালবাসা আচমকা হয়ে,তিলে তিলে বৃদ্ধি পায়। এবং অবহেলায় হারিয়ে যায়।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত