মায়াপরী

মায়াপরী

সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস সেন্টারে আসলাম, একটা পার্সেল আছে আমার নামে। একটা মানুষই ছিলো যে এটা সেটা মাঝে মাঝে কুরিয়ার করে পাঠাতো। সে রুশা। রুশার সাথে আমার সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয় আজকে এক মাস তের দিন এগারো ঘন্টা চৌদ্দ সেকেন্ড। মিনিট সেকেন্ডের ব্যাপারটা প্রবলতার ইন্ডিক্যাট। যেনো আমি প্রতিটি সেকেন্ড রুশাকে ফিল করছি। প্রতিটা সেকেন্ড জুড়ে রুশা আমার মস্তিষ্কে।

আমাদের সম্পর্কটা ছিলো চার বছরের। আমিই সম্পর্কের ইতি টেনে ছিলাম। আমি অনেক চেষ্টা করেও সম্পর্কটা আর পাঁচটা সম্পর্কের ন্যায় রান করতে পারিনি। ওকে আমি শুরু থেকেই বুঝতে পারতামনা। একেক সময় একেক রকম লাগতো। যাইহোক, পার্সেলে কোন ঠিকানা নেই। বাসায় নিয়ে আসলাম। জানি রুশা পাঠিয়েছে, আগে আগে সে খামের উপর লিখতো “স্পর্শের আম্মু”। এখন লিখেনা। হয়তো আজকাল স্পর্শকে সে মা হতে অধিকারচ্যুত করে নিয়েছে। তা না হলে নিজেকে স্পর্শ হতে। আগে বাচ্চাদের মত স্পর্শের নামে বিভিন্ন বায়না ধরতো। রাতে ঘুম আসলে পেটের উপর ফোন রেখে বলতো এই স্পর্শ কান্না করতেছে তোমার সাথে কথা বলতে চায়। কথা বলো, আমি ঘুমাইলাম। আমার ভালোই লাগতো। রুশা কখনো কখনো বাচ্চার চাইতেও বাচ্চা আবার কখনো কখনো মেচুরিটি লেভেল ক্রস করে ফেলতো। ব্যাপারটা এমন হতো ‘আমার এক কথা এক জবান আর এটাই সত্য এটাই হবে’ এমন, খুব জেদি। আমি নিরবে সব মেনে নিতাম। এই দেড় মাসে আমি ওরে কম চেষ্টা করিনি যোগাযোগ করতে, সে সমস্ত কন্ট্যাক্ট ওয়ে বন্ধ করে দিয়েছে।

খামটা খুললাম, ভেতরে একটা বিয়ের কার্ড আর একটা ছোট্ট চিঠি। বিয়ের কার্ডটা কোন ভাবেই খুলতে পারছিনা আমি, আমার সমস্ত শরীর কাঁপছে। আর চিঠিটাও খুলতে পারছিনা। কোনটা আগে খুলা উচিৎ আমি জানিনা। দু’দ্বিধায় পরে গেলাম, যেনো কঠিন একটা পরীক্ষায় বসলাম। কার্ডটা খুললাম, একদম নিচে তাকিয়ে দেখি লিখা কণে, “রুশা হাওলাদার”।

আমি যেন খুব তাড়াতাড়ি অজ্ঞান হয়ে যাবো। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতেছে। এমনটা রুশা করতেই পারেনা। ও জানে এই পৃথিবীতে আমিই ওরে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি তারপরও এটা কিভাবে করলো?
চিঠিটা খুললাম; “প্রিয় রবিন, আগামী চব্বিশ তারিখ আমার বিয়ে। আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি এতোদিন, আমাকে ক্ষমা করে দিও। এই অসহ্যটা আর তোমাকে কোনদিন কষ্ট দিবেনা। ভালো থেকো।”

আজকে বাইশ তারিখ। রাত হয়ে গেছে গাড়ি পাবোনা এখন। ভোরে উঠেই রওনা হবো মাদারিপুর। আমার রুশাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার আছে। এমনিতেই ও আমাকে ছেড়ে ছুড়ে ফেলে যাবে? নো ওয়ে। সারারাত ঘুমাই নাই। প্রতিটা স্মৃতি আজকে আমাকে রুশার প্রয়োজন বর্গ করে দিচ্ছে। ভোরে উঠেই ঠান্ডা বরফ পানি দিয়ে গোসল দিলাম। রেডি হয়ে গেলাম বাস স্ট্যান্ডে। ছয়টার বাসে উঠলাম। সিলেটে এমনিতেই আগাম ঠান্ডা চলে আসে, শীতে অবস্থা খারাপ। এক কাপ গরম চা খেতে পারলে বাঁচা যেতো কিন্তু মনটাকে শান্ত করতে পারছিনা। সীট গিয়ারটা ডাউন করে একটু চোখ বুঁজলাম।

রুশা আর আমার প্রথম দেখা হয়েছিল ঢাকায়। এইচএসসি শেষ করে ভার্সিটি কোচিং করতে গিয়েছিলাম। কোচিংএ প্রথমদিন পরিচয় পর্ব ছিলো। রুশা শাড়ি পরে যখন রুমে ঢুকেছিলো তখনই আমি ফিদা। পাশের ফ্রেন্ডকে বলেছিলাম ও আমার। তারপরেই দেখলাম মার্কার দিয়ে বোর্ডে খসখস করে লিখলো;- রুশা হাওলাদার, ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। কোচিং’এর ম্যাথ ইনস্ট্র্যাকটর। হালকা একটু ঝটকা লেগেছিলো, সে যে ম্যাডাম হবে এটা বুঝতে পারিনাই। ব্যাপারনা, জানতে পারলাম মাত্র গত বছর সে চান্স পেয়েছে। ভালো স্টুডেন্ট ছিল আর মেধা তালিকায় দ্বিতীয় হওয়ায় কোচিংএ রেখেছে। তাই এই বছর কোচিংএ পার্ট টাইম ক্লাস নিচ্ছে। সবার পরিচয় শেষে বুঝতে পারলাম আমিই একমাত্র সিলেট থেকে আগত। তাই আমাকে নিয়ে আলাদা করে অনেক কিছুই বললো। কে কে লন্ডন থাকে ক্যামনে কি হাবিজাবি, ইত্যাদি।

সেবার রোজার মাস ছিলো। একদিন রুশা কোচিং থেকে বের হলো একদম ইফতারের আগ মুহূর্তে। আমি ওরে দেখার জন্যই দাড়িয়ে ছিলাম। ও আমাকে দেখেই বললো, কি ব্যাপার রবিন তুমি বাসায় যাওনি? আমি খামোখাই বলেছিলাম একটা ফ্রেন্ডের কাছে বাসার চাবি। ও এখনো আসে নাই তাই দাড়িয়ে আছি। তারপর বললো, রোযা আছো? আমি বললাম আমি ক্লাস ফোর থেকে সবটা রাখি। এটা আমি সবাইকেই বলি, এটা সত্য। পরে বললো; আচ্ছা ইফতারের সময় হয়ে গেছে আসো আমরা কোথাও ইফতার করি। ঠিক এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে দিলাম। অনেক কথা হল সেদিন ওর সাথে। সিলেট ঘোরার খুব শখ আছে ওর। এটা ছিলো সেকেন্ড প্লাস পয়েন্ট। ওরে ডাইরেক্ট বললাম, আপনি এই ঈদেই সিলেট আসতেছেন ফাইনাল, সব আমি ম্যানেজ করবো।

শেষে সত্যিই ঈদের ছুটিতে একদিন ও ফোন করে জানালো সে তার ছোট ভাইকে নিয়ে সিলেট আসতেছে। সেবার তো মনে করেন আমার ডাবল ঈদ। সব ফ্রেন্ডসদের জানায় দিলাম, তদের ভাবী আসতেছে, জীবন দিয়ে দিবি সাথেসাথ, প্রস্তুত থাক। সবাই খুব প্রস্তুত। কোথায় কোথায় যাওয়া লাগবে, গাড়ীর জন্য ড্রাইভারের নাম্বার কালেকশন ইত্যাদি ইত্যাদি। মনে করেন সিলেটে পয়দা হলেও আমি নিজেই অনেক জায়গায় এখন পর্যন্ত যাইনি, এসব সম্পর্কে আগাম তথ্য সংগ্রহ, লোকেশন ইনকুয়েরী ইত্যাদি, সব ঠিকঠাক। বাড়িতে বলে দিলাম একটা ম্যাডাম আসবে। সবকিছু ঠিকঠাক যেনো থাকে। আপু বলছিলো তর সবকিছু ঠিকঠাক হলেই হয়, গরু একটা। যাক এসব কানে নিলাম না, রুশা এসেছিলো। যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে বেশি সবাই মাথায় তুলে রেখেছিলো। ও এতো খুশি হয়েছিলো সেটা তার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। চা বাগান, জলপ্রপাত, নদী, পাহাড় সব কিছুই ওরে নিয়ে ঘুরেছিলাম। সাহস করে তুমিতে নেমে এসেছিলাম আপনি থেকে। ছাদে বসে চা খাওয়া, গল্প করা কত কি। যেবার ও বাড়ি থেকে চলে যায় সেবার গেঁদা থেকে বুড়ো সবাই খুব কষ্ট পেয়েছিলো। রুশা তো কেঁদে টেদে অস্থির অবস্থা। আম্মারও খুব পছন্দ হয়ে যায় ওকে।

বাস ঢাকায় আসলো, সকাল দশটা বাজে। এখন গাবতলী হয়ে ঈগল পরিবহনে উঠলাম। এর মধ্যে একবারো কিছু খাইনি খাওয়ার ইচ্ছেও হয়নি। সাথে পানি ছিলো কিছু খেয়ে আর চোখে মুখে ছিটিয়ে আবার উঠে বসলাম। আমি অনেকবার ওকে মাদারিপুর নিয়ে গেছি আবার নিয়ে আসছি। বাড়িতে খুব কম থাকতো। আমি ওরে প্রপোজ করার আগেই ও বুঝে ফেলেছিলো আমি ওরে ভালোবাসি। তাই ঘটা করে আমাদের রিলেশনটা হয়নি। ও আমায় শর্ত দিয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয় চান্স পেতে হবে। ও নিজেও জানতোনা আমার বিশ্ববিদ্যালয় সে নিজেই হয়ে গিয়েছিল। ওর ক্লাসে আমি নিজেকে কিং ফিল করতাম, ও আমাকে পুরো ক্লাস দাঁড় করিয়ে রাখতো। মাঝে মাঝে বের করে দিতো ক্লাস থেকে। পরে আবার তুলে খাইয়ে দিতো রেস্টুরেন্টে। নাহ্ তারপরে আর কোথাও চান্স হয়নি আমার। রুশা আমায় খুব ভরসা দিয়েছিলো। বলছিলো ব্যাপারনা, তুমি কোন একটা কলেজে এডমিট হয়ে যাও। তুমি ঢাকা থেকে কোথাও যেতে পারবানা। সব কিছুই ভালো চলতেছিলো কিন্তু হঠাৎ করেই সে আমাকে সহ্য করতে পারছিলোনা। যদিও আমি খুবই ইরেস্পনসিবল একটা ছেলে, তার এই রিএক্ট হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু না, ও নিজেকে নিয়ে ক্যান জানি খুব অহমিকা করা শুরু করলো।

আমি কারো দিকে তাকালে সন্দেহ! কথা বললে সন্দেহ! এটা করলে ভুল ওটা করলে ভুল! মানে একটা বছর টানা পাঁচ মিনিট আমাদের আর ভালো কোন কথা হয়নি ঝগড়া ছাড়া। মাঝে মাঝে আমাকে শুনাতো নতুন ফ্যাকাল্টি ওকে পছন্দ করে। সিনিয়র একজন পছন্দ করে ইত্যাদি। আমার সহ্য হতোনা কিন্তু আমি কিছু বলতামনা। আর এখন তার সিনিয়র জুনিয়র নিয়ে আমাকে বিচার করা শুরু করছে। ও সিনিয়র ও ভালো বুঝে। আমি খুব এলোমেলো, আমাকে দ্বারা হবেনা। আমি একটা কলেজে পড়ি সে ভার্সিটিতে, সমাজে মানাবে নাকি যত্যসব ইলজিক্যাল কথাবার্তা, আমার সাথে নাকি ওর যায়না। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমার এটলিস্ট মনে হতো ব্রিলিয়ান্ট মেয়েরা একটু অন্যরকম কিন্তু বিশ্বাস করুন দুনিয়ার সব মেয়েরা মেয়েই। তাদের সব কিছুই একটা বৃত্তে আবর্তিত হয়। নো ডিফরেন্স এনিথিং। আমি সেবার বলেই দিছিলাম তুমি একটা অসহ্য, সাইকো। আমি এবার মুক্তি চাই। যাও চলে যাও আমার লাইফ থেকে। বলেই সব কিছু ভেঙ্গে দেই। কিন্তু এটা অল্প একটা সময়ের জন্য, রাগের মাথায়। রুশা সিরিয়াস সব কিছু সমাপ্তি দিয়ে বাড়ি চলে যায়।

আর কিছুক্ষণ পর নামবো, জ্যামে আটকে বিকেল হয়ে গেছে। যেতে যেতে সন্ধ্যা হবে। গাড়ি থেকে নেমে একটা ভ্যান নিলাম। গ্রামের অনেক ভিতরে। গৌরনদী পার হয়ে ওপারে যেতে যেতে রাত আটটা বেজে গেছে। নদীর ওপার মাদারিপুরের অংশে পরেছে আর এপার হলো গৌরনদী। মাদারিপুর শহর হয়ে ঘুরে আসতে সময় লাগে তাই গৌরনদী নেমে গেলাম। ওদের বাড়িটা আমি চিনি, চলে আসলাম। খুব গর্জিয়াস ডেকোরেটেড না। কিছু ঝিলমিল বাতি, একটা গেট আর ভেতরে নিজেদের মানুষরাই। বিয়ে টিয়ে আমাদের সিলেটের ওদিকে খুব ধুমধাম আমেজ থাকে। এখানে উল্টো। স্কয়ার বাসাটা মধ্যে একটা স্পেস উঠোনের মতো ওখানে একটা সোফায় হলুদ শাড়ি পরে রুশা বসে আছে। একটা ফটোগ্রাফার নানান পোজ দেখিয়ে দিচ্ছে। আমি সামনে একটা চেয়ারে বসে দেখতেছি। ঠান্ডা লেগে গেছে আমার। ক্যানো জানি আমাকে ওরে ত্যাগ করতেই হবে এটা মনে হচ্ছে কিন্তু মানা হচ্ছেনা। মনটা মানতেছে না। কান্না আসতেছে নাকি তাও বুঝতে পারছি না। তবে বুকে কিছু একটা আটকে আছে ফিল হচ্ছে। আমি এমনটা কখনো কল্পনাও করিনি। হঠাৎ রুশা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে! ও বিশ্বাস করতে পারছেনা আমি আসছি। বলতেছে,

“তুমি এখানে কেন? আমি বললাম; তুমিই তো দাওয়াত করলা। ও বললো; মোটেও আমি দাওয়াত করিনি। আমাকে জ্বালাতে এখানে আসছো বুঝতে পারছি। এই ঠান্ডায় এসব কি পরছো? সোয়েটার নাই? গলায় কিছু পেছানো গেলো না? খাইছো কিছু? জানি খাওনি, চেহারা দেখেই বুঝতেছি।

আমি কিছু না বলে বললাম ছাদে যাওয়ার রাস্তাটা কোনটা? ও দেখিয়ে দিয়ে বললো তুমি যাও আমি খাবার পাঠাচ্ছি। ক্যান জানি এসব আদিখ্যেতা মনে হচ্ছে আজকে। রুশা আমার খুব যত্ন নিতো কিন্তু আজকে বিশ্বাস হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে ওসব স্বাভাবিক, মানুষ মানুষকে করে।

অনেক্ষণ পর রুশা নিজেই একটা প্লেটে করে খাবার নিয়ে আসলো। আমি হাতে নিয়ে খেয়ে নিলাম। পেট আর মানছিলোনা। সাথে ক্লান্তি অনেক ভর করেছে। আমি রুশাকে বললাম, আমি কয়েকটা প্রশ্ন করে চলে যাবো, উত্তর না দিলেও চলবে। তুমি সুখে থাকো এটাই চাই। আমি জানিনা কতটা আঘাত আমি তোমাকে দিয়েছিলাম। তবে আমি তোমাকে আমার নিজের চাইতেও বেশি ভালোবেসেছিলাম, তুমি আমার সাথে এমনটা ক্যান করছো রুশা? তুমি জানতানা তোমার সাথে আমার একটা কথা না হলে আমি পাগলের মতো হয়ে যেতাম? আমি এই দুই মাসে কতবার সিলেট থেকে এই বাড়ির সামনে এসে তোমার অপেক্ষা করছি জানো তুমি? একটাবারের জন্য তোমায় পাইনি আমি। কোন পাগলে এমনটা করতো বলো? ক্যান জানি এটাতেই শান্তি পেতাম আমি তোমার বাড়ির আশেপাশে মানে তোমার আশেপাশে। এটা ফিল করতাম। আমি এতটাই অপদার্থ হয়ে গেছিলাম রুশা? একটু আগে এটা বুঝাতে পারলানা? চারটা বছর পর ক্যানো এই দিনটা তৈরি করলা তুমি? অকে ফাইন! ভালো থেকো। আরো কি কি বলার ইচ্ছা ছিলো ভুলে গেছি। আমি আমার কষ্ট কাউকে এক্সেক বুঝাতে পারিনা।

রুশা অনেক্ষণ পর আমাকে কেঁদে বলতে শুরু করলো;  রবিন তুমি জানো এই পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে আপন একমাত্র তুমিই ছিলে? আমার আর কেউ নাই রবিন। আমার মা বাবার ডিভোর্স হয় আমি যখন চার বছর তখন। দয়ায় পরে আমার মা আমাকে উনার সাথে রেখেছিলো দুই বছর। তারপর সে অন্য আরেকজনকে বিয়ে করে জানো? আমি আমার নানুর কাছে বড় হই। শেষে ক্লাস সিক্সে থাকতে নানুও মারা যায়। মামা তারা কিছুদিন আমার ভরণপোষণ চালায় পরে বাবার বাড়ি আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমি ওখানে গিয়ে সৎ মা পাই। চাচা আর বাবাদের মাঝে একটা দন্ড লেগে যায়। ভাবছে আমাকে সম্পত্তির ভাগ দেয়ার উদ্দেশ্যে নাকি আনা হয়। সম্পত্তি ছিলো সব যৌথ। ওখান থেকে আমার দাদুভাই আমার নামে কিছু কাগজ করে ফেলেছিলো। তুমি জানোনা রবিন আমি কতটা অসহায় ছিলাম আমি এখানে। কতটা অবহেলায় আমার দিন কেটেছে। আমি জীবনে যতটুকু পড়েছি সব আমার যোগ্যতায়। যেবার ভার্সিটিতে চান্স পাই সেবার চাচ্চুরা বলেছিলো সব সরকারে দিবেনা খরচ টরচ? আমাদের দিতে হবে নাতো।

যাক বাবা তাহলে ঠিক আছে। আমি খুব কেঁদে ছিলাম রবিন খুব। আমার মা একদিনও আমার খুঁজ নেয়নি আর। বাবার তো আরো সন্তান আছে আমি খুব মুখ্য ছিলামনা। একমাত্র তোমাকে পেয়েছিলাম যে সমস্ত কিছু দিয়ে আমায় ভালোবাসে। আমার একটা সময় অসহ্য লাগতো, ক্যান তুমি আমাকে ভালোবাসবা? আমার আপনরাই তো আমার আপন না। তুমি জানো আমি রাগ করে আসার পর আমি নিজেও জানিনা কখন বিয়ে ঠিক হয়েছে। কার সাথে হচ্ছে তাও জানিনা। শুধু শুনেছি চাচ্চু কাকে জানি বলতেছে বুড়ো মেয়েকে উনি বিয়ে করতে রাজি হয়েছে এটাই আমাদের জন্য অনেক। এলাকায় এই বয়সের মেয়েদের বাচ্চা কাচ্চা বড় হয়ে গেছে। রুশা খুব কাঁদতেছে আর বলতেছে আমি কি করবো বলো রবিন? আমি মরে গেলে আমায় ক্ষমা করে দিও প্লিজ। তোমার পরিবারটা একটা সুখের বাগান, যেখানে আমার সুখ আমি দেখেছিলাম। আমি জীবনে এই স্বর্গ ঘোরার সুখ কোনদিন ভুলবো না। আমি তোমার যোগ্য না রবিন। চলে যাও!

কি ভেবে আসছিলাম আর কি শুনলাম কোন কিছুই মাথায় ধরেনি। আমি রুশার হাতটা শক্ত করে ধরলাম, নিচে কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। সবাই ঘরে। ওকে বললাম ভালো করে চাদর মুড়িয়ে নাও। একদম রাস্তায় এনে একটা চিপা গলি দিয়ে ঢুকে দৌড়ে বাইপাস সড়কে উঠলাম। রুশা হয়তো এখনো বুঝতেছেনা কি হচ্ছে। নদীর এপার থেকে বরিশাল যাওয়া যায়। আমরা বরিশাল হয়ে লঞ্চে ঢাকা যাবো। একটা লোকাল বাসে উঠে পরলাম। রুশা একবার বললো এদিকে কোথায় যাচ্ছি রবিন? আমি বললাম তোমার শ্বশুর বাড়ি। ও বললো সিলেট তো এদিকেনা। এবার বুঝলাম মেয়েটার মাথায় বুদ্ধি আছে। বুঝে গেছে আমরা সিলেট যাচ্ছি। আমি বললাম; লঞ্চে গেলে আমাদের কেউ ধরতে পারবেনা।

লঞ্চের ছাদে এসে দাঁড়ালাম। রুশা আমার বাহু জড়িয়ে আছে। আপাতত আমি পৃথিবীর কর্মা ছেলেদের একজন। আমাকে কেউ রুখতে পারবেনা। আকাশে পরিষ্কার চাঁদ ঝলমল করছে। ঠান্ডা বাতাসে চাদরটা ভাগাভাগি করে জড়িয়ে নিয়েছি দুজনে। এই গল্পে যতই তুফান আসুক হ্যাপি এন্ডিং থাকবেই।

আবার ফ্রেন্ডসদের ফোন দিলাম। বললাম, তদের ভাবি আসতেছে পারমান্যান্টলি এবার জীবন দিয়ে দিবি সাথেসাথ। অনেক কাজ আছে, প্রস্তুত থাক। রুশা আমার বাহুতে শুয়ে আছে। ঘুমন্ত আর হলুদ শাড়িতে তাকে মায়াপরী লাগছে। আগলে ধরে আছি মায়াপরীটাকে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত