“পথ আগলে রাখছেন কেন? সামনে থেকে সরেন। আমি বাড়ির গেট থেকে সাইকেলটা বের করলাম। ভার্সিটিতে যাব। আমি ভার্সিটিতে সাইকেলে করেই যাই। অত টাকা খরচ করে রিক্সা বা সিএনজিতে করে ভার্সিটিতে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। সে কারনেই টাকা বাচানোর জন্যই সাইকেলে করে ভার্সিটিতে যাই তবে মাঝে মধ্যে বাসে করে যাই যখন শরীর আর মন ভাল না থাকে।
আমি সাইকেলটা গেট থেকে বের করে সাইকেলের চেইনটা ঠিক করে যেই সোজা হয়ে দাড়াঁলাম তখন জেনিয়া কোমড়ে হাত দিয়ে আমাকে কথাটা বলল। আমি খানিকটা অবাক হয়ে কিছুকক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আমার আশে পাশে দেখলাম। আমার পাশে তো বিরাট জায়গা। এত জায়গা থাকতে ওখান দিয়ে না যেয়ে উল্টো আমাকে বলে… আমি পথ আগলে রাখছি কেন? এই মেয়ে দেখি একটা ফাযিল, দিন দিন এই মেয়েটার আচরণ আমার কাছে কেমন যেন লাগছে। ধমক দিয়ে একটা ঝাড়ি দিব সেটাও করতে পারি না, বাড়িওলার মেয়ে বলে কথা। আমি কিছু বলতে যাব তখন জেনিয়া আবার বললো “মেয়েদের পথ আগলে রাখতে ভীষন মজা পান তাই না? এইভাবে আর কতজন মেয়ের পথ আগলে রাখেন হু? শুনেন মিঃ সুবন সাহেব এই জেনিয়া এইসব পাত্তা দেয় না।
আরে এই মেয়ে বলে কি? কি সব উল্টা পাল্টা কথা বলে। আমি এতটাই অবাক হলাম কি বলব ভেবে পাচ্ছি না। আমি জানি এই মেয়ের সাথে কথা বললেই এখন রেডিওর মত গড় গড় করে প্যাচাল পারবে আমার সাথে। অবশ্য এই মেয়েকে রেডিও বললে ভুল হবে না। একটু বেশি ঘন কথা বলে। তবে আমি যতটুকু জেনেছি এই মেয়ে এত বেশি কথা বলে না। কিন্তু আমার সাথে এইরকম কথা বলে কেন? আমি কিছু না বলে একটা হাসি দিলাম “হে হে হে আমার হাসিটা দেখে জেনিয়া ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থেকে বলল “আজিব এটা কেমন হাসি আবার? কেমন একটা ক্ষ্যাত মার্কা হাসি এটা। একটু মিষ্টি করে হাসতে পারেন না, আমার মত। এইভাবে হি হি হি। দেখছেন আমার হাসিটা কত্ত মিষ্টি। এই রকম মিষ্টি করে হাসতে আর কাউকে দেখেছেন? আমি কথাটার পাশ কেটে বললাম “তুমি কোথায় যাবে যাও। এই যে দেখো রাস্তার কত পথ ফাকা আছে সেখান দিয়েও যেতে পারো। আর যদি এটাই তোমার যাওয়ার পথ হয় তাহলে এই দেখো আমি সরে গেছি এবার যাও।
আমার কথা শুনে জেনিয়া একটু চুপ হয়ে গেল। যেন আমার কথার কি জবাব দেয়া যায় তা নিয়ে একটু ভাবতে লাগল। আমি সাইকেলে উঠে বসলাম আর যেই সাইকেলটা টান দিয়ে চলে যাব জেনিয়া বলল “আমি কোথায় যাব কি যাব না, আপনাকে বলব কেন? আমি এখানেই দাড়িয়ে থাকব কোন সমস্যা? আমি কিছু না বলে একটা হাসি দিয়ে সোজা সাইকেলটা চালিয়ে যেতে লাগলাম আর জেনিয়া একটু জোরে জোরে পিছন থেকে বলতে লাগল…
“আমার পথ আগলে রেখেছেন আমি না হয় কিছু বলি নি। যদি অন্যজন হত তাহলে আপনার মন্ডু ফাটায় দিত।
আমি একবার পিছনে ফিরে তাকালাম জেনিয়া একটু একটু পিল পিল করে হেটে এসে থেমে গেল। মেয়েটা এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আস্তে আস্তে সাইকেল চালাতে চালাতে ওর চোখের আড়ালে হয়ে গেলাম। জেনিয়ার এই রকম ন্যাকামো ন্যাকামো কান্ড গুলা অদ্ভুত মনে হয় আমার কাছে। কেন এইরকম করে আমি তা জানি না।
ওদের বাড়িতে আমরা বাড়াটিয়া হিসেবে এসেছি ৭ মাস হয়ে গেছে। ওদের বাড়িটা চারতলা পর্যন্ত। আমরা তিন তলায় আর ওরা ২য় তলায়। সিড়ি দিয়ে যখন বিল্ডিং এ উঠা নামা করি মাঝে মাঝে ওদের রুম থেকে কাচের জিনিসপত্র ভাঙার শব্দ পেতাম। কেমন একটা ভুতুড়ে বাড়ি মনে হত আমার কাছে। চুপচাপ থাকত জেনিয়া কারো সাথে তেমন কথা বলত না। এমনকি ওর বাবা আর ভাইয়ের সাথে না। জেনিয়ার মা নেই। আমি যখন সাইকেল নিয়ে ভার্সিটিতে থেকে বাসায় ফিরতাম তখন বারান্দার গ্রিল ধরে বসে থাকা অবস্হায় দেখতাম। মাঝে মাঝে দেখতাম চুল গুলা আঙুল দিয়ে পেচিয়ে পেচিয়ে গ্রিলের ফাক দিয়ে তাকিয়ে থাকত। কেমন একটা ধ্যান মগ্ন হয়ে আমার দিকেও তাকিয়ে থাকত। আমার মাঝে মাঝে মনে হত এই মেয়ের সাইকোলজি প্রবলেম আছে। আমি ভয়েও এই মেয়েটার সাথে কথা বলতাম না। কখন কি বলে ফেলে তা ঠিক নেই।
এই তো কয়েক মাস আগের কথা। কি যেন একটা ব্যাপার নিয়ে ওর বাবার সাথে ও চিত্কার চেচামেচি করছিল। আমার এখনো মনে আছে তখন ঠিক সন্ধ্যা বেলা। আমি একটু বাহিরে বের হচ্ছিলাম দু তলায় আসতেই দেখি চিত্কারের আওয়াজ। ওদের দরজাটা একটু খোলা ছিল। আমি দেখব না দেখব করতে করতে দরজাটা আরেকটু ফাক করে মাথাটা একটু উকি দিয়ে দেখতে লাগলাম জেনিয়া ওর বাবার সাথে উচু গলায় কথা বলছে….
“তুমি আমার ডায়েরী ধরছো কেন? কেন ধরছো আমার ডায়েরী। তোমাকে বলছিনা আমার কোন কিছুই ধরবে না।
“এবারের মত ক্ষমা করে দে মা। আর এমন হবে না। এই দেখ কানে ধরেছি।
“না তুমি প্রত্যেকবার এই রকম করো। তোমাকে বার বার বলি তবুও তুমি এইগুলা করো।
এই বলে জেনিয়ার হাতে থাকা একটা কাচের গ্লাস মেঝেতে আচাড় মেরে ভেঙে ফেলে। ওর বাবা চুপ করেই দাড়িয়েছিল। আমি খানিকটা ভয় পেলাম। কি সাংগাতিক মেয়েরে বাবা। এদিক ওদিক তাকিয়ে ছটফট করে আরেকটা গ্লাস যেই আচাড় মেরে ভাঙতে যাবে ঠিক তকনি আমাকে দেখে ফেলে। ওর তাকানো দেখে আমি ভয়ে একটু ঢুগ গিললাম। আমি আংকেলের দিকে একটু তাকিয়ে থেকে ভয়ে ভয়ে বললাম “আংকেল আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল। তাই চলে এলাম। আপনি নাকি দাবা খেলা খুব ভাল পারেন। ভাবলাম আপনার সাথে দাবা খেলব আর গল্প করব। দরজাটা খুলাই ছিল তাই ঢুকে গেছি।
আমার কথাটা শুনে আংকেল একটু অবাক চোখে তাকায়। আমি এক দমে কথা গুলা বলে থামলাম। যদিও কথাগুলা মিথ্যে। কেমন করে কথা গুলা বললাম আমি নিজেও জানি না। ভয়ে নাকি মানুষ গড় গড় করে উল্টা পাল্টা বলে ফেলে। আমি ও বলেছি। কেননা এই গুলা না বললে কপালে কি থাকত এক আল্লাহ জানত। কারন অন্যজনের ঘরে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা এটা একটু অন্যরকম দেখায়। তারপর জেনিয়া হাতের গ্লাসটা না ভেঙে আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে ভিতরের রুমে চলে যায়। আর আমিও আংকেলকে বললাম… আংকেল আপনার সাথে পরে গল্প করব এখন যাই। এই বলে চলে আসলাম “স্যরি। আর এমন হবে না।
রাতের দিকে আমি একটু ছাদে এসে পায়চারি করি। অবশ্য আগে আসতাম না। তবে এই দুই তিন মাস ধরে ছাদে এসে খোলা আকাশের নিচে নিশ্চুপ রাতে হাটা হাটি করি। আর যখন হাটছিলাম দেখলাম জেনিয়া ছাদে আগে থেকেই এসে ছাদের কোনায় আকাশের দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমি ওর একটু পাশে গিয়ে যখন দাড়াই তখনো ও আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। খানিকক্ষন পর আমার দিকে না তাকিয়েই আমাকে স্যরি বলল। আমি জানি ও কেন স্যরি বলেছে। তারপরও জিজ্ঞাসা করলাম…
“হঠাত্ স্যরি কেন?
“সকালে আপনার সাথে আমার এই রকম আচরণ করা ঠিক হয় নি।
আমি একটু চুপ করে রইলাম। জেনিয়াও আরো একটু নিরবতা পালন করতে লাগল। ও আমার সাথে যত বার এই রকম আচরণ করেছে ততবার স্যরি বলেছে। এই তো দশ বারো দিন আগের কথা ঐদিন আমি ভার্সিটিতে রিক্সায় করে গিয়েছিলাম যদিও আমার রিক্সা করে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। তবে শরীরে হালকা জ্বর ছিল তাই রিক্সায় করে গিয়েছিলাম আর আসার সময় সাদিকার গাড়িতে করে আসসাল। আমি আসতে চাই নি। সাদিকা আমার ক্লাসমেট। ও যখন বুঝতে পারল আমি সাইকেল ছাড়াই ভার্সিটিতে গিয়েছি তখন একটা কিছু হয়েছে এটা ও আন্দাজ করতে পেরেছে।
“সুবন তোমার কি শরীর খারাপ?
“কই নাতো।
“তাইলে আজকে সাইকেল ছাড়া ভার্সিটিতে আসলা যে?
“এমনি ইচ্ছে হয় নি।
“এমনি তো নয়। তুমি তো কখনো সাইকেল ছাড়া আসো না। তারপর আজকে আবার রিক্সা করে আসছো।
এই বলে আমার কপালে সাদিকা একটু হাত দিয়ে দেখলো। আর বুঝলো আমার শরীরটা হালকা গরম। আর এই জন্যই ক্লাস করার পর সাদিকা আমাকে ওর গাড়িতে করে যেতে বলে। আমি বলছিলাম চলে যাব একটা রিক্সা ঠিক করে। কিন্তু ও কয়েকবার বলাতে আর নিষেধ করতে পারি নি। আর সাদিকা যখন বাড়ির গেট পর্যন্ত আমায় পৌছে দেয় সেটা জেনিয়া দেখতে পায়। সাদিকা গাড়ি থেকে নেমে আমাকে বলে… কয়েকদিন বিশ্রাম নেও। ভার্সিটিতে দু এক দিন পরে গেলও কিছু হবে না… এই বলে সাদিকা গাড়িতে ঢুকে আবার চলে যায়। আর আমি যখন গেট দিয়ে ঢুকলাম জেনিয়া আমার সামনে এসে বলে…
“মেয়েটি কে?
“কোন মেয়ে?
“এখন কিছু জানেন না? যার সাথে এতকক্ষন পাশাপাশি হয়ে বসে এসেছেন।
এমনিতে শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল। তারউপর জেনিয়ার কথা বার্তায় মেজাজটা একটু খারাপ হলো। এই মেয়ের সাথে এখন রাগ দেখানো যাবে না। আমি একটু ইতস্তত করে বললাম “ও আমার ক্লাস মেট। আজকে শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল তাই ও ওর গাড়িতে করে পৌছে দিছে। জেনিয়া চুপ হয়ে গেল। তারপর নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল “আর কোন মেয়ের পাশে বসবেন না। পাশাপাশি হয়ে চলাফেরা করবেন না। দরকার হলে আমাকে বলবেন। আমি আপনাকে নিয়ে আসব। আমার পাশে বসে আসবেন। আমি একটু অবাক হলাম। এই মেয়ে কি বলেরে এইগুলা। একবার ভাবলাম বলি… তুমিও তো একটা মেয়ে। তাছাড়া তোমাকেই বা কেন বলব? কথা গুলা বলি নি। আমি আর কিছু না বলে চলে আসব এমন সময় বলল… স্যরি আমি তো জানি না, আপনার যে শরীর খারাপ। ….. আমার সাথে সব সময় এই রকম করবে তারপর স্যরি বলবে।
“আমি আপনাকে জ্বালাতন করি তাই না? জেনিয়া আকাশের দিক থেকে মুখ সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো। আমি ওর কথায় বাস্তবে ফিরলাম। “আমার কাছে কখনো মনে হয় নি তুমি আমায় জ্বালাতন করো। তবে তোমার এই আচরণ গুলা একটু বাচ্চামি টাইপের। এই রকম করো কেন তুমি? “কি আমি বাচ্চা? আরেকবার বলেন তো। বাচ্চামির কি দেখছেন আপনি হু? আমি বুঝতে পারলাম ও রেগে যাচ্ছে। ওর রাগটা আমার একটু ভয় লাগে। একটা হাসি দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বললাম “হা হা হা আমি কিন্তু এইটা বলি নাই। “আপনি কি বলেছেন আর কি বলেন নাই সেটা আমাকে বোঝাতে হবে না। আমি বাচ্চা না যে আমাকে বুঝাতে হবে। আমি আর কখনো আপনার সাথে কথা বলব না, কখনোই না, আপনার সাথে আড়ি আড়ি আড়ি হু।
এই বলে একটা ভেংছি দেখিয়ে আমার সামনে থেকে চলে গেল। আমি জানি ও যতই ভেংছি কাটুক ঠিকি আমার সাথে আবার এই রকম করবে আমি যখন উকি দিয়ে দেখলাম জেনিয়া তার বাবার সাথে হৈ চৈ করে গ্লাস ভাংছে আর কি যেন ডায়েরী নিয়ে কথা বলছিল এটা নিয়ে একটু চিন্তা করতে লাগলাম। ডায়েরীতে কি আছে? জেনিয়া একটা কথা বলেছিল আমার এখনো মনে আছে… তুমি প্রত্যেকবার এই কাজটা করো… তার মানে জেনিয়ার বাবা ডায়েরীটা সব সময় লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে। আমি ঐ ঘটনাটা দেখে চলে আসার চার দিন পর সকালে দেখলাম জেনিয়ার বাবা বিল্ডিং এর নিচের খোলা মেলা জায়গাটাতে বসে পেপাড় পড়ছে।
জেনিয়াদের বিল্ডিং এর নিচের জায়গাটা একটু খোলামেলা। এক পাশে অনেক গুলা ফুল গাছ আছে। অবশ্যই এই গুলা জেনিয়াই পরিচর্যা করে। কেউ ভুলেও এই ফুল গাছে হাত দেওয়ার সাহস পায় না। আমি আংকেলের কাছে গিয়ে একটু ইতস্তত করে বললাম “আংকেল খেলার পাতাটা একটু দেন তো পড়ি। আমার কথাটা শুনে আংকেল চোখের চশমাটা নাকের ঢগায় এনে আমার দিকে কিছুকক্ষন তাকিয়ে থেকে কিছু না বলে খেলার পাতাটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে উনি পেপাড় পড়াতে আবার মনোযোগ দিলেন। আমি দাড়িয়ে থেকে খেলার পাতাটা দেখছিলাম আংকেল পেপাড়ের দিকে তাকিয়ে আমায় বললো “তোমাকে কে বলছে আমি দাবা খেলা পারি?
আমি বুঝতে পারলাম আংকেল কি বলতে চাচ্ছে। আমি একটু চুপ করে রইলাম আংকেল আরেকটু সময় নিয়ে আবার বলল “আমি জানি তুমি কি ভাবছো। আর যা ভাবছো আমার মেয়ে কিন্তু মোটেও এই রকম না। যেহেতু আংকেল নিজ থেকে এই বিষয় নিয়ে কথা বলা শুরু করেছে আমি একটু সাহস পেয়ে বললাম “আপনার মেয়ে কি স্বাভাবিক নয়? আই মিন ও কি অসুস্হ? ওর কি কোন প্রবলেম আছে? আমার কথাটা শুনে আংকেল আমার দিকে তাকায়। তারপর চোখ থেকে বাম হাত দিয়ে চশমাটা খুলে আমায় বলল “আমার মেয়েটার আচরণে তুমি হয়ত মনে করছো আমার মেয়ে আমাকে ঘৃনা করে। না আমার মেয়ে আমাকে অনেক ভালোবাসে। ওর যখন পাচঁ বছর ওর মা তখন মারা যায়।
কথাটা বলেই আংকেল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। “স্যরি আংকেল আমি মনে হয় আপনাকে ইমোশনালে ফেলে দিলাম। “না ঠিক আছে। জেনিয়ার মাকে সামান্য একটা জ্বরের উছিলা দিয়ে উপর ওয়ালা ওকে উপরে ডেকে নেয়। ওর মা মারা যাওয়ার পর জেনিয়া খুব একা হয়ে পড়ে। আমি ব্যবসার কারনে আমার ছেলে আর মেয়েটাকে তেমন সময় দিতে পারতাম না। আমার বড় ছেলে মিরাজ যদিও বন্ধুদের সাথে সময় কাটাত কিন্তু জেনিয়া পারত না। সারাদিন বাসায় একা থাকত , টেলিভিশন দেখত, ভুয়ার সাথে যতটুকু পারত খেলত। আমি যখন রাতে বাসায় ফিরতাম তখন জেনিয়া ঘুমিয়ে পড়ত। আসলে ওর বড় হওয়াটা একা একাই চুপচাপ থাকা অবস্হায় কেটেছে। আর এটা অভ্যাসে পরিনিত হয়ে গেছে।
“কিন্তু আংকেল ঐ দিন ডায়েরী নিয়ে এই রকম করলো কেন? “ওর ডায়েরীতে সব কিছু লিখে রাখে। এই রকম ওর অনেক ডায়েরী আছে। ও যখন আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল ও একাকীত্ব অনুভব করত। আর এই গুলা ওর ডায়েরীতে লিখে রাখত। ওর মার কাছে নালিশ করে ডায়েরীতে লিখে রাখে। ডায়েরীতে কি লিখতো জানো? লিখত জানো আম্মু,, বাবা একদমই আমাকে সময় দেয় না। আস্ত একটা গদ্ধব। গদ্ধবটাকে আমি ইচ্ছে মত বকা দেই তবুও এই গদ্ধবটা একটুও বুঝে না। আম্মু তুমি রাগ করছো না তো তোমার স্বামীটাকে গদ্ধব বলেছি এই জন্য। কিন্তু গদ্ধবটাকে অনেক ভালোবাসি। আর তোমার ছেলে মিঃ মিরাজ সাহেব সারাদিন টো টো করে বাহিরে ঘুরবে।
কথা গুলা বলেই আংকেল একটু কাদঁলো আর হাসলো। কেন জানি আংকেলের কথা গুলা শুনে আমারো একটু খারাপ লাগল। আসলেই ঠিক একটা মানুষ যখন এই রকম চারদেয়ালের মধ্যে বড় হয় তখন তার মনে একটা অনুভুতি তৈরি হয় আর সেটা হলো একাকীত্বের অনুভুতি। এই অনুভূতি শেয়ার করার জন্য ওরা কাউকে না কাউকে মনে মনে খুঁজে থাকে। তারউপর জেনিয়া একটা মেয়ে। আংকেল চোখের পানি টুকু মুছে আবার বলতে লাগল…
“সারাদিন কি করছে বা আমি করেছি ওর ভাই কি করেছে এই সব অনুভুতি গুলা জেনিয়া ডায়েরীতে লিখে রাখে। আর আমি এই গুলা পড়ি। পড়ব না কেন, আমাকে নিয়ে কি লিখছে সেই গুলা জানতে আমার ইচ্ছে হয়। আমার মেয়েটা চুপচাপ থাকে ঠিকি কিন্তু কথা বলতে শুরু করলে একাধারে কথা বলতে থাকে। ওর ডায়েরীতে আমি নতুন কিছু পেয়েছি শুনবে? “হ্যাঁ বলেন। “ও ডায়েরীতে লিখছে একটা সাইকেল ওয়ালা ছেলে নাকি গেট দিয়ে ঢুকার সময় ওর বারান্দায় ওর দিকে নাকি তাকিয়ে থাকে। হা হা হা
আংকেলের কথা শুনে একটু অবাক হলাম। আংকেল বলে কি এই গুলা। এরপর আমি খেলার পাতাটা আংকেলকে দিয়ে একটু লজ্জা পেয়ে সোজা হাটা দিলাম “আমাকে শাড়ি পড়া অবস্হায় কেমন লাগছে দেখুন তো? আমি জানতাম জেনিয়া আমার সাথে কথা বলবেই। সেদিন রাতে ছাদে অভিমান করে সামনে থেকে চলে গেছিল। বলছে কথা বলবে না। আর সকাল না হতেই এই কথা। ভার্সিটিতে যাব বলে যখন সিড়ি দিয়ে নামছিলাম তখন ওকে শাড়ি পড়া অবস্হায় দেখতে পাই। সত্যি বলতে কি এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতার আভা ছড়াচ্ছিল জেনিয়া। ওর বাবার কাছ থেকে সব শুনে জেনিয়াকে কেন যেন অসহায় অসহায় মনে হত। ওর প্রতি আমার যে ভয়ের কাজটা বিরাজ করত সেটা কেটে গেল। একদিন দেখলাম ও ওর ফুল গাছে পানি দিচ্ছিল আমিও কি মনে করে যেন ওর ফুল গাছে ওর সাথে পানি দিতে লাগলাম। প্রথমে একটু অবাক হয়েছিল আমি ভাবছিলাম আমায় ধমক দিবে কিন্তু কিছু বলে নি। এই ভাবে আমি রোজ ওর সাথে ফুল গাছে পানি দেই। ও শুধু চুপচাপ দেখে যেত আমার তামাশা গুলা কিন্তু কিছুই বলতো না। তবে ওর চেহারার আভা দেখে বুঝতে পারতাম ও খুশি হয়েছে।
একদিন রাতে আর্টসেলের কনসার্টে গিয়েছিলাম। আমি আবার আর্টসেলের ভক্ত। কনসার্ট দেখে আসতে অনেক রাত হওয়াতে সকালে তেমন ঘুম থেকে উঠতে পারি নি। আর সেদিনই জেনিয়া আমাদের দরজার কলিং বেল এমন ভাবে বাজাতে লাগল যেন এটম বোমা এখন আমাদের ঘরে ফাটবে। আম্মা আমাকে ডাক দিয়ে বলে “এই সুবন উঠ তোরে জেনিয়া কি জন্য যেন ডাকতেছে। আমি চোখ একটু একটু খোলে বললাম…”কে ডাকে আমায়? “জেনিযা ডাকে। আমি একটু অবাক হলাম জেনিয়া তো কখনো আমাদের বাসায় আসে নি। হঠাত্ আমায় ডাকে কেন? আমি চোখ কচলাতে কচলাতে ওর সামনে গিয়ে দাড়াতেই জেনিয়া বলল…
“কি ব্যাপার এত কিসের ঘুম আপনার? আমি কতকক্ষন ওয়েট করব? ফুল গাছে পানি দিবেন না? আমি কথাটা শুনে এতটাই অবাক হলাম কি বলব ভেবে পাচ্ছি না। এরপর ওর সাথে ফুল গাছে পানি দিতে গেলাম… “কি হলো চুপ করে আছেন কেন? বলেন না কেমন লাগছে? আমি জেনিয়ার কথা শুনে ভাবান্ত থেকে সজগে এলাম। তারপর ওর দিকে বেশ কিছুকক্ষন তাকিয়ে থেকে বললাম… “অন্য রকম পরী লাগছে। অনেক সুন্দর। “শুধুই সুন্দর লাগছে? আর কিছু লাগছে না? হট লাগছে না আমায়? হি হি হি। আমিও ওর কথাটা শুনে একটু হাসলাম। মনে মনে ভাবলাম এই মেয়ের মাথার তার ছিড়ে গেছে। “আমি এখন আপনার সাইকেলে চড়ব আপনার সাথে। আমি কথাটা শুনে একটু হা করে তাকিয়ে থেকে বললাম… “মাথা খারাপ? কি বলতেছো তুমি একবার ভেবে দেখছো? তোমার বাবা আমায় আস্ত রাখবে না। “শুনেন আমি যাই বলি তাই করি। আমি এখন আপনার সাইকেলে চড়ব চড়ব চড়ব।
আমি আর কিছু না বলে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলাম। জেনিয়ার কথা গুলা আমার কাছে কেমন যেন লাগল। আসলে আমি ওর সাথে একটু কথা বলতাম ফুল গাছে পানি দিতাম, গল্প করতাম হয়ত এই কারনেই আমার প্রতি ওর একটা ভাল লাগা কাজ শুরু করেছে। হয়ত এই রকম ওকে কেউ সময় দেই নি তাই। আসলে মানুষ যখন না পাওয়ার মাঝে যখন হুট করে মায়া মমতা বা গল্প করার জন্য কাউকে পেয়ে থাকে সেই মানুষটার প্রতি একটা মায়া ভালবাসা তৈরি হয় যেটা জেনিয়ার মাঝে বিরাজ করেছে….
আমি সাইকেলে উঠতে যাব জেনিয়া আমার সাইকেলের সামনে উঠে বসল। আমি কি বলব বুঝতে পারছি না। শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। “কি হলো চালান “মানুষ দেখলে কি বলবে? তাছাড়া আমি ভার্সিটিতে যাচ্ছি। “আজ ভার্সিটিতে যেতে হবে না। “না তা হয় না। “কেন হয় না? অন্য মেয়েরা তো বললে ঠিকি পাশাপাশি হয়ে গাড়িতে চড়ে আসতে পারেন। আমার বেলা কেন নয়? আমি গেট টা খুলে দিয়ে আর কিছু না বলে গেট দিয়ে জেনিয়াকে নিয়ে সাইকেল চালিয়ে বের হলাম। আসলে কি বলব ভেবে পাচ্ছি না। আমি সামনের দিকে তাকিয়ে সাইকেল চালাচ্ছি আর জেনিয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে এক অপলক দৃষ্টিতে। হঠাত্ ও বললো “সারাজীবন আমার পাশে থেকে আমার সাথে ফুল গাছে পানি দিবেন তো?
কথাটা শুনেই আমি সাইকেলটা একটু থামালাম। ওর প্রপোজ করার স্টাইলটা আমার কাছে বেশ ভাল লাগল। আমি শুধু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। জেনিয়াও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর আশে পাশের লোকজন ও হয়ত আমাদের দেখছে। আমি সাইকেলটা আবার চালাতে লাগলাম। আমি জানি জেনিয়া আমাকে কখনো হারাতে দিবে না। আমিও ওকে বলব… হ্যাঁ তোমার পাশে থেকে সারাজীবন একসাথে ফুল গাছে পানি দিব। তবে এখন বলব না। একটু স্পেশাল ভাবে বলব। স্পেশাল কথা গুলা একটু স্পেশাল ভাবেই বলতে হয়। না আমাকে একটু ভাবতে হবে কিভাবে স্পেশাল ভাবে বলা যায়। এখন ওকে নিয়ে একটু ঘোরা যাক…