বন্ধুদের সাথে আড্ডায় প্রায় আত্মহারা হয়ে পড়লাম।আড্ডার একপর্যায় দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বাবার চোখে চোখ পড়তেই থমকে গেলাম।মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলাম,আল্লাহ্, বাবা যেন এখানে না আসে।তাহলে মানসম্মান আর কিছুই বাকি থাকবেনা।দোয়া করার মধ্যে দিয়ে লক্ষ্য করলাম,বাবা আমাকে দেখিয়ে গাছের পাশেই কিছু একটা রেখেছেন।
বাবার পরনে ছিলো দেড়বছর আগে, পাশের বাড়ির রহিম চাচার, যাকাত হিসেবে দেওয়া একটা শার্ট আর বেশ পুরোনো একটা প্যান্ট।পায়ে ছিল মাস ছয়েক আগের কিনা দুই বেল্টের একজোড়া স্যান্ডেল! স্যান্ডেলের মধ্যে অনেকটা জোড়াও ছিলো।বাবা দিনদিন বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলছে কিনা, কে জানে ? নতুবা এসব পরে আমার ভার্সিটি উনার আসার কোনো মানে হয় !
আজব !
অনেক কষ্টের পর প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি।এইখানে বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে বেশ বড়লোকের সন্তান। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা সবসময় করি।নিজের কি আছে সেটা কখনো বন্ধুমহলে প্রকাশ করিনি।স্ট্যাটাস বলেওতো একটা কথা আছে নাকি ? এতদিনে যা নাম ডাক হয়েছে, এখন যদি বাবা এখানে আসে তাহলে সব চূর্ণ হয়ে যাবে।
কিছুক্ষণ পর আড়চোখে বাবার দাঁড়িয়ে থাকা জায়গাটাতে তাকালাম,বাবা এখনো দাঁড়িয়ে আছে কিনা সেটা দেখার জন্য । কিন্তু নাহ্, বাবা চলে গেছে ! যাক, বাঁচা গেলো।একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মাতিয়ে উঠলাম।কিছুক্ষণ পর বাবার দাঁড়িয়ে থাকা জায়গাটাতে গিয়ে দেখি, উনি গাছের পাশে আমার জন্য পঞ্চাশ টাকা রেখে গেছে।ভার্সিটেতে পড়ুয়া একটা ছেলের জন্য পঞ্চাশ টাকা নেহাত্ হাস্যকর বটে।
এভাবে প্রায় বাবা এসে দূর থেকে আমাকে দেখে পঞ্চাশ টাকা রেখে চলে যেতেন।আমি মাঝেমধ্যে বাবাকে দেখেও না দেখার ভান করে বসে থাকতাম।কেন জানিনা ভুল করেও বাবা ভার্সিটিতে আমার সামনে আসতেন না ! বাবা হয়তো আমার উদ্বিগ্ন চেহারা আর চাহনি দেখে বুঝে যেতেন যে,আমি চাইনা তিনি আমার সামনে আসুক বা আমার বন্ধুদের সামনে আসুক।কিন্তু কখনো বাবা বাড়ি এসে আমাকে কিছু বলতেন না।
এভাবে অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেল।ধীরে ধীরে বাবারও বয়স বাড়তে লাগলো !সেদিন দেখলাম, বাবার মাথার বেশিরভাগ চুল সাদা হয়ে গেছে। আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের চুলগুলো দেখছিলেন বাবা ।
আমাকে দেখে মৃদু হেসে বললেন,
–কিরে বাবা, অফিস যাচ্ছিস ?
–হ্যাঁ বাবা। আমি অফিসে যাচ্ছি।
–ঠিক আছে।সাবধানে যাস।
এই কথা বলে বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।বাবার হাত বুলিয়ে দেওয়াটাই যেন, এগিয়ে যাওয়ার ভরসা। এই হাত দুটো অদৃশ্যভাবে যেন বলছে, ভয় কিসের, আমি আছি তোর সাথে।
বাবা আজও সেই ভার্সিটির মতই আমার অফিসের পাশে গিয়ে প্রায় দাঁড়িয়ে থাকে।আজও আমি বাবাকে একবারের জন্যও অফিসে নিয়ে আসতে পারিনি।আমার কলিগদের সাথে পরিচয় করাতে পারিনি।কেবল ভার্সিটির মত দূর থেকেই তাকিয়ে দেখি। আমার অফিসটা সাততলা ভবনে অবস্থিত। কাজের চাপ বা ব্যস্ততা, সময়ের অভাবে, বাবাকে অফিসে নিয়ে আসা হয় না।
লেখাপড়া শেষ করে, অনেক চেষ্টার পর, খুব ভালো একটা চাকরী পাই।প্রথম অবস্থায় বেতনও খুব ভালো ধরেছে।আজ নিয়ে প্রায় ৩০ দিন হলো অফিসে যাচ্ছি।এখনও একমাস শেষ হয়নি।আজ একমাস শেষ হবে।
জীবনের প্রথম উপার্জনের টাকা পেলাম আজ। সেই টাকা দিয়ে বাবার জন্য একজোড়া নতুন কালো জুতা কিনলাম।কালো রঙ ছাড়া বাবা জুতা পরেনা।বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি আর একটা পায়জামাও কিনলাম।
বাবার ঐ পুরোনো স্যান্ডেলটা এখনও উনি জোড়া দিয়ে পরেন।মায়ের জন্য বাদামি রঙের একটা জামদানি শাড়ি কিনলাম।
বেশ হাসিমুখে জিনিসগুলো নিয়ে বাসায় ফিরলাম।বাড়িতে এসে স্তব্ধ হয়ে গেলাম।সব কেমন থমথমে হয়ে আছে ! বাড়িভর্তি মানুষ ! বিষয়টা কি, কিছুই বুঝতে পারছি না। অজানা একটা ভয় ঘিরে ধরেছে চারপাশ থেকে।নানান চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
হঠাৎ শুনতে পেলাম বাবা নাকি স্ট্রোক করেছেন ! উনাকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়েছে। অথচ, সকাল বেলাও উনি কত সুস্থ ছিলেন।আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন !
পরবর্তীতে হাসপাতালে গিয়ে উপস্থিত হই।জানতে পারি বাবার প্যারালাইজড হয়ে গেছে । উনার শরীরের বাম অংশটা অকেজো হয়ে পড়েছে । আমার বাবার জন্য নিয়ে আসা জুতাজোড়া পরে উনি হাঁটতে পারবেন না ! আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বাবা আর নিজের পাকা চুল দেখতে পারবেন না ! বাবা আর আমার অফিসের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে না !
তিনদিন বাবাকে হসপিটালে রাখার পর উনি মারা যান।কে জানতো, আমার বাবা এত তাড়াতাড়ি দুনিয়া থেকে বিদায় নিবেন ?ভাবতেও পারিনি, আমার জীবনের প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে আমার বাবার জীবনের শেষ কাপড়টা কিনতে হবে !
বাবাকে বেশ যত্নে খাটিয়ায় তুলে নিলাম।দরজার পাশে বাবার সেই কালো রঙের, জোড়া দেওয়া জুতাটা পড়ে আছে। আমার বাবা আজ আর হেঁটে যাচ্ছেন না। বাবার আজও ভাড়া লাগছে না। মনে হচ্ছে,বাবা আজও ভাড়া বাঁচিয়ে আমাকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে যাচ্ছেন !
বাবার জন্য নিয়ে আসা সেই পাঞ্জাবি,পায়জামা আর কালো রঙের জুতাটা নিয়ে বসে আছি।নতুন জিনিস কিন্তু আমার বাবার পরার সৌভাগ্য হলো না ! সারাজীবন বাবা পুরোনো জিনিস দিয়ে সময় অতিবাহিত করে গেছেন । বাবার সেই পুরোনো শার্ট প্যান্ট আর কালো রঙের ছেঁড়াস্যান্ডেলটা আজ আমার কাছে খুব দামী মনে হচ্ছে।অথচ, কোনো একসময় বাবার এই ড্রেস আর এই স্যান্ডেলটা আমার অপছন্দের তালিকায় প্রথমে অবস্থান করেছিলো।
আজও ভার্সিটির সেই জায়গা, অফিসের সেই জায়গা,যেখানে বাবা প্রায় আমাকে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতেন, বাবার খাটের সেই জায়গা যেখানে বাবা ঘুমাতেন, বাবার সেই পুরোনো ড্রেস, এসবের মাঝে বাবার গায়ের গন্ধ খুঁজি।বাবার হাতের স্পর্শ খুঁজি।বাবার সেই অদৃশ্য ভরসা, ভয় কিসের ? আমি আছি তোর পাশে, কথাটার অস্তিত্ব খুঁজি।
সেই কালো রঙের ছেঁড়াজুতার মাঝে বাবাকে খুঁজি।খুব মনে পড়ে বাবা তোমায় ! বাবা , তুমি হলে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার একটা জ্বলন্ত উদাহরণ !
বিঃদ্রঃ জীবনের একটা সময়, মা বাবা অনেক কষ্টে, আল্লাহর রহমতে লালন পালন করে আমাদের ঠিকই প্রতিষ্ঠিত করেন।কিন্তু আমরা বেশিরভাগ সন্তানেরা, মা বাবাকে লালন পালনের সুযোগটা সবসময় পাইনা।সুখ জিনিসটা কি তা স্পর্শ করার আগেই বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারের মা বাবারা জীবনযুদ্ধে লড়াই করতে করতে একটা সময় নিস্তেজ হয়ে যান।সুখের আশায় থাকতে থাকতে তাদের জীবনের সমাপ্তি ঘটে।কিন্তু সুখটা আর হয়তো স্পর্শ করা হয় না।তারপরেও আমরা দোয়া করি, সকল মা বাবা যেন ভালো থাকেন। এপারে বা ওপারে, সুখ জিনিসটার স্পর্শ যেন সকল বাবা মা পেয়ে থাকেন।