টিউশন শেষে রোজ বাড়ির বিপরীত পাশের রাস্তাটা ধরে বাড়ি ফিরতাম।দশ মিনিটের রাস্তা রেখে এক ঘন্টা অতিবাহিত হওয়া রাস্তা দিয়ে চলাচল করতাম।
খুব একটা স্মার্ট বা দেখতে সুন্দর ছিলাম না।সাদামাটা চালচলন ছিলো।সালোয়ার কামিজ আর সাথে একটা ওড়না মাথায় দিয়ে হাঁটতাম।বেশিরভাগ সময় কালো ওড়নাটাই ব্যবহার করতাম।বরাবরই কালো রঙের প্রতি দুর্বলতা একটু বেশি।
তবে বাড়ির বিপরীত পাশের রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে আসার একটাই কারণ ছিলো। বাড়ি ফেরার পথে ঐ রাস্তার পাশে একটা একতলা বাড়ির বেলকোণিতে রোজ একটা ছেলেকে দেখতাম। হাতে একটা চায়ের কাপ বা পত্রিকা থাকতো প্রায়। মাঝেমধ্যে রাস্তায় হাঁটতেও দেখতাম।
কিন্তু কখনো সাহস করে ছেলেটার সামনে গিয়ে কথা বলিনি।ভয় হতো,যদি ইগনোর করে ! এত সুন্দর একটা ছেলে কি আর আমার মত একটা মেয়ের সাথে কথা বলবে ? ঘোমটার আড়ালে আড়চোখে ই ছেলেটাকে দেখতাম। এই দেখার যেন কোনো শেষ নেই ! ছেলেটার মুখভর্তি চাপদাড়ি ছিলো । চোখে ছিলো অসম্ভব মায়া ! ভাললাগার জন্য কি এতটুকুই যথেষ্ট নয় ? হয়তো না ! কিন্তু কেন জানি রোজ একটু একটু করে ভাললাগার ব্যাপারটা, ভালো লাগাতেই সীমাবদ্ধ ছিলো না।রুপ নিলো ভালবাসায় !
ছেলেটার একটা বিষয় রোজ আমায় আকর্ষন করতো।আর সেটা হলো পাঞ্জাবি। প্রায় বছরখানেক হলো ছেলেটাকে আমি দেখছি, কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ পাঞ্জাবি পরিধানে।অন্য কোনো ড্রেস এই ছেলেটা পরে কিনা আমি জানিনা।তবে পাঞ্জাবিতে অসম্ভব সুন্দর লাগে ছেলেটাকে!
আজ প্রায় মাসখানেক হলো ছেলেটাকে দেখছিনা।রোজ এক কিলো ঠিকই হাঁটি কিন্তু ছেলেটার সাথে আর দেখা হয় না।প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো অসুস্থ, কিন্তু একমাস কেউ অসুস্থ থাকে ! সাহস করে কখনো খোঁজও করিনি।হুট করে খোঁজ কিভাবে করবো ?আবার কি বা ভেবে বসে এই ভেবে আর খোঁজ করা হয় নাই। তারপর থেকে আর ছেলেটার সাথে দেখা হয় নি।এই দূরত্বের শেষ কোথায় আমি জানিনা তবে এক নজর দেখার সাধ আমার কখনো মিটবে না । কখনো জানানোর সুযোগটাও হয়তো আমি আর পাবো না। সেদিন রাস্তায় আপন মনে হাঁটছিলাম।হঠাৎ পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম।
–এই যে, শুনুন ।
কথাটা শুনে পেছনে তাকাতেই থমকে গেলাম।সেই চাপদাড়ি, সেই চোখ, সেই ছেলেটি ! বেশ অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দিলাম,
–জ্বি, বলুন।
— এত দূর পর্যন্ত হাঁটতে আপনার কষ্ট হয় না ? মৃদু হেসে ছেলেটা বললো।
–কষ্ট কেন হবে ? নিচের দিকে তাকিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে উত্তরটা দিলাম।
–দশ মিনিটের রাস্তা রেখে ষাট মিনিটের রাস্তায় পথ চলেন তো, তাই বললাম।
–ইয়ে মানে আপনি কি করে জানলেন ? অনেকটা ইতস্তত হয়ে প্রশ্নটা করলাম।
–বেশ কিছুদিন আগে মা আমাকে একটা ছবি দিয়েছিলো।ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারে ছিলো।কিন্তু হেলায় ছবিটা আর দেখা হয়নি। এরই মধ্যে টের পেলাম কেউ একজন রোজ আড়চোখে আমাকে দেখে। তারপর থেকে আমিও সেই আড়চোখে তাকানো ব্যক্তিটির জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।সে আড়াল হয়ে যাওয়ার পর প্রায় লুকিয়ে তাকে অনুসরণ করি। একটা পর্যায় কেন জানিনা এই অপেক্ষা করাটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়।
–এত দূর পর্যন্ত ! অথচ আমি টের পাইনি ! সে যাই হোক , তারপর কি হলো ?
–এতদিন কোথায় ছিলাম, জানতে চাইবেন না ? ছেলেটা হাতঘড়ির চেইনটা লাগিয়ে নিতে নিতে বললো।
–কোথায় ছিলেন ? পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির সাথে জুতার সন্ধি ঘটিয়ে প্রশ্নটা করলাম।
–আসলে খালার বাড়িতে গিয়েছিলাম।কিন্তু জানিনা কখন, মা মানিব্যাগে সেই মেয়েটার ছবি রেখে দেয় !
–মেয়েটা দেখতে কি খুব সুন্দর ? আকাশের নীল রঙটা পুরো আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে।দেখতে বেশ লাগছে।সেই নীল রঙে রাঙানো আকাশটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলাম।
–অসম্ভব সুন্দর !জানেন, আপনি দেখলে চোখ ফেরাতে পারবেন না।
–বিয়ে তাহলে কবে করছেন ? মনমরা হয়ে প্রশ্নটা করলাম।
–আচ্ছা, ছেলে হিসেবে আমি কেমন বলুন তো ? আমাকে কি বিয়ে করা যায় ?
–মানে ?
–আসলে আমি ভীষণ কনফিউজড ! পাত্রীর আমাকে পছন্দ হবে কিনা সেটা ভেবে ।
–আপনি অসম্ভব না, কিছুনা । আচ্ছা যাই আমি।
–যাবেন ? কিন্তু আমি আসলে কনফিউজড !
–দুঃখিত ।আমাকে এসব কেন বলছেন, বুঝতেছি না।
–আসলে, পাত্রী যদি পাত্রকে ইগনোর করে তাহলে কি বলতে হয় আমি ঠিক জানিনা।
–কে পাত্রী ? আর কে বা পাত্র ?
–কেন, আপনি।কারণ মায়ের দেওয়া ছবিটাতে আর কেউ না।পাত্রী হিসেবে আপনি ছিলেন । এই কথা বলে ছেলেটা মানিব্যাগ থেকে একটা ছবি বের করলো।যেই ছবিটাতে সত্যি আমি ছিলাম।
–আমি অবাক হয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছি।কিন্তু কিছুই বলছি না।
–কিছু বলবেন না ? ছেলেটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমায় দেখছে।
–এক কিলো হাঁটার অবসান হবে। কি বলেন ? মৃদু হেসে উত্তর দিলাম।
–আড়চোখে তাকানোটাও বন্ধ হবে।
এই কথা বলে ছেলেটা হাসতে শুরু করলো।আর আমি লজ্জা পেয়ে, মাথার ঘোমটা টেনে, ঐ জায়গা থেকে সামনের দিকে পা বাড়ালাম, বাড়িতে ফেরার উদ্দেশ্যে।