ভালোবাসি তোমায়

ভালোবাসি তোমায়

তবুও উঠবে পাহাড়ে? হু। দেখলে তো ছেলেটাকে সাপে কামড়েছে৷ ওর তো অনেকগুলো বন্ধু আছে পাহাড় থেকে নামিয়ে হাসপাতালে নেবার জন্য কিন্তু তোমাকে কে নামাবে কয়েক হাজার ফুট এই উঁচু পাহাড় থেকে? তুমি আছো তো। না,আমি নেই।আর তোমাকে কোলে করে নামাবার মত অধিকার আমার নেই। তাছাড়া তোমাকে কোলে করে এই এত উঁচু পাহাড় থেকে নামাবার মত জোর আমার গায়ে নেই। তবে ফিরে যাবো? সে কথা বলিনি৷ সাবধান করলাম। চলো যাওয়া যাক, বাঁশের লাঠিটা হাত থেকে ফেলোনা। পা টিপেটিপে হাটবে,পাথরের ওপর শ্যাওলা জমে বেশ পিচ্ছিল হয়ে আছে রাস্তা।

সানজিয়া আর আমার সম্পর্কটা কি সে কথা জিজ্ঞেস করলে সোজাসাপ্টা উত্তর দিব, জানিনা। দুজন দুজনকে তুমি সম্বোধনে ডাকি। কোন ন্যাকামি নেই, নেই কোন অভিযোগ কিংবা অবাধ্য আবেগ৷ মেয়েটার বাড়ি চাটগাঁয়ে, আর আমার বেনাপোলে।বলা চলে দেশের দু মাথার দুজন মানুষ আমরা। সানজিয়া শ্যাম বর্ণের বাচাল স্বভাবের মেয়ে। আমার চেহারাটা কয়েক মাস না মাজা হাড়ির তলদেশের মত কালো। ফেসবুকের কমেন্ট বক্স থেকে জানাশোনা দুজন দুজনকে।পাক্কা তিনবছর কথোপকথন,আর আজ খয়াছড়ার এই বিশাল পাহাড়ের দিকে পা গুনে গুনে দুজনের একসাথে পা বাড়ানো।

তুমি চাটগাঁয়ের মেয়ে, বাড়ির ধারেই বিশাল পাহাড় রেখে একদিনও আসলে না! মা, একা বের হতে দেয়না যে৷ মা একা বের হতে দেয়না তাই তিন চারটে প্রেম হয়ে গেছে, বের হতে দিলে কি হত। হা হা হা। সানজিয়া প্রত্যুত্তরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল৷ পিছলে রাস্তাতে যে সানজিয়া হাঁটতে গিয়ে একটুর জন্য বার কয়েকে পড়তে যেয়েও পড়েনি সেই সানজিয়াই এখন নির্বিকার হেঁটে চলেছে৷ এই খয়াছড়া পাহাড়টা বেশ উপভোগ্য লাগছে৷ ঝর্ণা মাড়িয়ে পাহাড়ে উঠতে হচ্ছে। ঝর্ণার হিমশীতল পানিতে মুখটা ধুয়ে পা বাড়িয়ে সানজিয়ার পাশাপাশি চলে এলাম৷ উঁহু! আরেকটু হলে পড়ছিলে। হাতটা না ধরলে কয়েকশ ফুট নিচে চলে যেতে। একটু সাবধানে চল। সানজিয়া চোয়াল শক্ত করে বলল,কথার বাণে একটু আগেই হাজার ফুট নিচে ফেলে দিয়েছো।নতুন করে পড়ার কি আছে!

আমার কথায় সানজিয়ার বেশ লেগেছে।ঠাট্টাচ্ছলে তাকে এভাবে আঘাত করা হয়ে যাবে বুঝতেই পারিনি। আসলে সানজিয়া আজ অবধি দুটো সম্পর্কে জড়িয়েছিল। প্রথমটা ক্লাস টেনে থাকতে, সে সম্পর্কর বয়স মোটে ছয়দিন ছিল৷ মায়ের কাছে ধরা খেয়ে সে সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছিল। অনার্সে উঠে আবার সম্পর্কে জড়ায়, ছেলেটা ছিল ধান্দাবাজ। কদিন পরপরই শরীরের আবদার নিয়ে সামনে দাঁড়াতো।এক পর্যায়ে ত্যক্ত হয়ে, ঘৃণা নিয়ে সেখান থেকেও নিজেকে সরিয়ে নেয়।ওখানে সানজিয়ার কোন দোষ ছিল না।

ভালোবাসার কাঙাল যারা তাদের কপালে ভালোবাসা সয় না।এই বাক্যর কাছেই হয়ত পরাজিত সে। সানজিয়ার খয়েরি রঙের কয়টা জামা আছে,ইকোনমিকসের কোন চ্যাপ্টারে দুর্বলতা আছে,শেষ কবে সর্দি জ্বরে ভুগেছিল সবটাই আমার জানা । তবুও কেন সবটা যেনে এমন বাজে ঠাট্টা করে ওকে কষ্ট দিলাম? কাছের মানুষগুলো কষ্ট দেবার অদ্ভুত ক্ষমতা রাখে হয়তো সেই সূত্রেই অবচেতন মন এমন ঠাট্টা করল। তোমার ওজন কত? নাম না জানা গাছের লম্বা শেকড় ধরে উপরে উঠতে উঠতে সানজিয়া রোবট কণ্ঠে বলল, সাতান্ন কেজি। কৃত্রিম কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কারের ভাণ করে বললাম,বাই এনি চান্স তোমাকে সাপে কাটলে কোলে নেবার যেটুকু সম্ভাবনা ছিল সেটাও ভেস্তে গেল।

সানজিয়া মোটামুটি সমতল জায়গা দাঁড়িয়ে আমার নিচ থেকে উপরে উঠে আসা দেখতে দেখতে বলল,মেয়ে মানুষের মত এত ঢং কর কেন? তখন তো বললে সাপে কাটলে কোলে নিয়ে হাসপাতালে দৌঁড়াতে পারবেনা।
হাতটা সানজিয়ার দিকে বাড়াতেই টেনে তুলল আমায়।সানজিয়া আমার পেটের দিকে তাকিয়ে বলল,ভুড়ি তো বেশ বানিয়েছ। কোথায় তুমি আমাকে টেনে তুলবে তা না আমাকেই তোমায় টেনে তুলতে হচ্ছে। এটাকে পেট বলে,ভুড়ি না।পেটটা একটু ঝুলে গেছে এই যা। সানজিয়া আমার কথা কানে না নিয়ে ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে বলল, এই ঝর্ণার ডিঙিয়ে উপরে উঠাটা খুব রিস্ক হয়ে যাবে। তার উপর ঝর্ণার নিচের পাথরগুলোর আশেপাশে কোন গাছের শেকড় নেই৷ পাথর বেয়ে বেয়ে ওঠার ফল বেশ মর্মান্তিক হতে পারে কিন্তু।

এই প্রথমবারের মত সানজিয়ার পিটপিটে চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, এখান থেকে পড়লে মাথাটা ফেটে যাবে,হাড় ভেঙে যাবে,আমার লাশটা হয়তো শেয়াল জন্তুতে খাবে কিন্তু আজ যদি এই পাহাড়ের চূড়ায় না উঠি তবে যতদিন বেঁচে থাকব ততদিনই মনে মনে হাজারবার মরব।সানজিয়া বেশিক্ষণ আমার চোখের দিকে থাকতে পারল না। পুরুষের সর্বগ্রাসী যন্ত্র হল এই চোখ। একটা নারী একজন পুরুষের সমস্ত অঙ্গের দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকতে পারে কয়েক মহাকাল কিন্তু একজন পুরুষের চোখের দিকে ভালোবাসার দৃষ্টি নিয়ে একজন নারী কয়েক মুহূর্তও তাকিয়ে থাকতে পারেনা। এই নিয়মের অনিয়ম করতে গেলেই নারীর নিজেকে সঁপে দিতে হয়,সে কথা বুঝি সানজিয়ার অজানা নয়।কি ভয়ংকর এক যন্ত্র এই চোখ! সানজিয়া ঘাসে আচ্ছাদিত মাটিতে বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে গর্ত করে লুকিয়ে যেতে চাইছে।মাথা নিচু করে মাটি খুড়তে খুড়তে বলল,এমন করে তাকাও কেন? কেমন যেন লাগে। আমি মাথা নিচু করে সানজিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,কেমন লাগে?

সানজিয়া মাথা উঁচু করে ঠোঁট টিপে হেসে বলল,এই তুমি আমাকে খুব উস্কে দিয়েছিলে এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে।ফোনে এত বর্ণনা দিয়েছিলে যে একসময় আমিই পাগল হয়ে উঠি এখানে আসতে। এখানে আসার পর তুমি প্রথমে বারণ করেছিলে আবার এখন তুমিই বলছো এই পাহাড়ের চূড়ায় না উঠলে তুমি নাকি প্রতিদিন মরবে। ঘটনা কি বলো তো? শোন, তুমি পা টিপেটিপে আগে ওঠো তারপর আমি উঠছি । এই ঝর্ণা পেরিয়েই একটু ঘাসের ঝোপ, তারপর ই দেখা যাচ্ছে চূড়া।চলো ওঠা যাক। সানজিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল,আমার কথার উত্তর দিলে না যে। সানজিয়ার ঘাড় বেয়ে চুলে ওঠা নীল রঙা পোকাটা টোকা দিয়ে ফেলে দিয়ে বললাম,তুমিও উত্তর দাওনি চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে তোমার কেমন লাগে।আমিও দিলাম না,কাটাকাটি।

সানজিয়া ওর মুখটা আমার মুখের কাছে এনে বলল,দুটো মানুষ যখন বুঝতে পারে দুজনই মধুর কিছু লুকোচ্ছে সেই মুহূর্তটা পূবের ঐ আগুন রঙা মেঘের মত সুন্দর হয় তাই না? সানজিয়ার ইশারা করা আঙুল বরাবর তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই লালচে আগুন রঙা মেঘ।আগুন রঙা মেঘ মাথার ওপর রেখে হিমশীতল ঝর্ণার পানি ডিঙি খুব সাবধানে ঘাসের ঝোপের কাছে চলে এলাম।এবার মিনিট তিনেক হেঁটে উপরে উঠলেই খয়াছড়ার পাহাড়ের চূড়া!

উপরে উঠতেই টের পেলাম বুনো গন্ধ, কোন জন্তু থাকে এদিকটায় সে বেশ বোঝা যাচ্ছে।সানজিয়া আমার আগে থাকায় সে-ই চূড়ায় উঠে চিৎকার দিয়ে বলল,পৃথিবী তুমি খুব সুন্দর। সানজিয়া বাচ্চাদের মত লাফাচ্ছে।একজন পরিণত নারীর ভেতর থেকে বাচ্চামি বের করে আনাটা যেনতেন ব্যাপার না।খুব যত্নে তার ভেতর লুকিয়ে থাকা বাচ্চাটার মাথায় নিয়ম করে হাত বোলাতে হয় তবেই সে বাইরে বেরিয়ে আসে।আর এই বাচ্চাটা একবার বের করতে পারলেই নারীর পুরো দুনিয়া একজন পুরুষের দখলে চলে যায়,এই কথা অনেক পুরুষেররা আমৃত্যু জানতেও পারেনা।আমি তিলতিল করে সানজিয়ার ভেতরে থাকা মৃত বাচ্চাটাকে আবার প্রাণ দিয়েছি,রোজ তার যত্ন নিয়েছি শুধু একটু কাছে এসে কিছু বলতে। যেখান থেকে সানজিয়ার আমাকে ফিরিয়ে দেবার সাধ্য হবেনা। তানভীর! দেখো কত্ত সুন্দর দেখাচ্ছে।এত উঁচুতে উঠে নিজেকে বিশাল মনে হচ্ছে।

নিশ্বাস দ্রুত ওঠানামা করছে,হাঁপাতে হাঁপাতে সানজিয়ার খুব কাছে গিয়ে সানজিয়ার হাত দুটো বুকের কাছে নিয়ে এলাম।সানজিয়া বেশ অবাক হয়ে মুখটা কিঞ্চিৎ হা করে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করার আগেই হাতদুটো হ্যাচকা টানে বুকের সাথে মিশিয়ে বললাম, তুমি সত্যিই খুব বিশাল।তাইতো তোমাকে ভেতরে ধারণ করতে সমান একটা হাজার দিন লেগে গেল।অন্যকে ভালোবেসে তোমার ঠকে যাওয়ার দগদগে ঘা আমার ভেতরেও বেড়ে উঠেছে।উপশম হিসেবে, তোমায় যত্ন করে আগলে রাখতে,অধিকার খাটিয়ে হাতদুটো এই ভাবেই শক্ত করে ধরে রাখতে চাই। দিবে? সানজিয়া চোখ নিচু করে বলল,আমিও খুব করে চাইতাম তুমি এইভাবে শক্ত করে এই হাত দুটো ধরো।তবে একটাই ভয় হত, পেছনের কথা টেনে পাছে যদি তুমি আমায় খারাপ ভাবো। তুমি যদি ভাবো আমি বেহায়া সেই ভয়ে তোমার দিকে হাত না বাড়িয়েই নিজের ভেতরেও একটা তানভীর পুষেছি এতদিন।

সানজিয়া মাথা গুঁজেই রয়েছে।বুক পকেট থেকে কাগজে মোড়ানো ছোট্ট নাকফুলটা ডান হাতের তালুর মধ্য বরাবর রেখে সানজিয়ার দিকে বাড়িয়ে বললাম,এই নাকফুলটা আরো বছরখানেক আগে কিনেছিলাম তোমায় দেব বলে।
সানজিয়া চিলের মত ছোঁ মেরে নাকফুলটা ওর হাতের মুঠোয় নিয়ে মাথা উঁচু করে বলল,এই একটা মুহূর্তের জন্য হাজারটা ঝড়-ঝাপটার পরেও তোমার হাতটা খুব শক্তে ধরে রইব।

সানজিয়া নাকফুলটা নাকে পরতে পরতে বলল,একটু পানি দিবে? ব্যাগ থেকে মিনারেল ওয়াটের বোতল বের করেই আমি এক নিশ্বাসে অর্ধেকটা শেষ করে ফেললাম।সানজিয়া চোখমুখ খিঁচিয়ে বলল,এ্যাহ! মুখ লাগিয়ে খেলে কেন। সূর্যের চিকন আলো এসে আমার সানজিয়ার ছোট্ট নাকফুলের উপর আছড়ে পরেছে। কি অসহ্য সুন্দর লাগছে তাকে।সানজিয়া মুখটা পানসে করে বলল,জানো তো আমার এ ব্যাপারে খুব শুচিবাই আছে। সানজিয়ার হাতে বোতল দিয়ে বললাম আমার হাতের আঁজলায় পানি ঢালতে। সানজিয়া মুচকি হেসে আমার হাতের আঁজলায় পানি ঢেলে দিয়ে মাথা নিচু করে এক নিশ্বাসে আঁজলা ভরা সবটা পানি শুষে নিল। সানজিয়ার চোখেমুখে অদ্ভুত আলোর বিচ্ছুরণ।

হ্যাচকা টানে সানজিয়াকে বুকের কাছে টেনে এনে তার নাকের ডগায় আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলাম।আগুন রঙা আকাশ লজ্জায় যেন আরো লাল হয়ে এলো,ডালে বসা হলদে পাখিটা আদুরে গলায় বার কয়েক ডেকে উঠলো আর আমার সানজিয়া নিজেকে হারিয়ে আমায় আঁকড়ে ধরল। হ্যালো! স্টেশন পৌঁছেছ তুমি? হ্যাঁ,পৌঁছেছি। একটু পরেই ট্রেন। আমাকে খুব মনে পড়লে একদম কাঁদবেনা। আমার স্পর্শ, কয়েকশ দিন আমার বুক পকেটে থাকা নাকফুলটা তোমার কাছে দিয়ে এসেছি। আমার ভেতরের আমিটাকে তো খয়াছড়ার পাহাড়েই বেচে দিয়ে এলাম তোমার কাছে।এগুলো খুব দামী জিনিস,যত্নে আগলে রেখো।রোজ দেখা হবেনা,আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে হাঁটা হবেনা তবে রোজ ফিসফিসিয়ে কথা হবে।,চোখ বুজেই মুখোমুখি বসে গল্প করা হবে,আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে অনেকদূর হাঁটা হবে।

চোখ মেলতেই ভয় হবে দুজনের।এই ভয়টা দিনদিন বাড়তেই থাকবে, আর এই ভয়ের নামই ভালোবাসা। মাস ছয়েক পর আবার আসব তোমার শহরে।সস্তা হোটেল খুঁজে মুখে তুলে ভর্তা ভাত খাইয়ে দিব, একপাতা কালো টিপ কিনে তোমার ভ্যানাটিতে পুরে দিব,ফুটপাত ধরে আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে গোটা শহর ঘুরে বেড়াবো। এই অপেক্ষা দিন দিন যত তীব্র হবে ততটা দুজন দুজনার কাছে আসব।দূরত্বের ভালোবাসায় যতটা কাছে আসা যায় কাছে থেকেও ততটা কাছে আসা যায়না।মনে থাকবে তো এই অপেক্ষার দাম যে অনেক? সানজিয়া ভেজা গলায় বলল,হু থাকবে। আচ্ছা এখন রাখছি,ট্রেন এসেছে। সানজিয়া দ্রুত গলায় বলল,শোন। হু ভালোবাসি তোমায়,খুব ভালোবাসি।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত