ইচ্ছে ঘুড়ি

ইচ্ছে ঘুড়ি

-হ্যালো,তনু! তুমি কি আজ সন্ধ্যায় ফ্রি আছ?
–কেন বল তো?
–আজ অফিসে তেমন কোন কাজ নেই।

ভাবছি,তোমাকে নিয়ে একটু বের হব।আজকের আবহাওয়াটাও চমৎকার।
তনু ফোন কানে ধরে বারান্দার গ্রিল ভেদ করে বাইরে তাকালো।বাড়ির পেছনে অনেকখানি জমি।জমিটা ঘন জঙ্গল আর গাছগাছালিতে ছেয়ে আছে।একটু দূর থেকে বাড়িটার দিকে তাকালে জঙ্গলমহল মনে হয়।তনুর দাদা শ্বশুর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এক হিন্দু ভদ্রলোকের কাছ থেকে জমিটা পানির দরে কিনে নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তনুর শ্বশুর জমির অর্ধেক অংশে তিনতলা এই বাড়িটা করেন।আর পেছনের গাছগাছালি, জঙ্গলটাকে আগের মতোই রেখে দেন। বাড়ির পেছনের এই দিকটা তনুর ভীষণ প্রিয়।

এদিকটাতে তাকালে ইট কাঠের দমবন্ধ করা জীবন থেকে তার একটু হলেও ছুটি মেলে।গাছপালা, জঙ্গল, পাখির কিচিরমিচির এসবই তার ভালো লাগে।বারান্দা ঘেষে বিশাল একটা পুরনো আমগাছ।আমগাছে মুকুল এসেছে।ফাল্গুনের মাঝামাঝি। আবহাওয়াটা সত্যিই আরামদায়ক তবে এসময়ে বাতাসে ধূলার পরিমাণ একটু বেশি থাকে। একটুও অভিমান প্রকাশ না করে তনু খুব স্বাভাবিক গলায় বলল– না,আবিদ। আজ সম্ভব না।আজ সন্ধ্যায় টি.এস.সি তে সর্মি,তুলনদের কবিতা পাঠের আসর বসবে।ওরা আমাকে সেখানে যেতে অনেক অনুরোধ করেছে।ওদের অনুরোধটা আমাকে রাখতে হবে। আবিদ একটু হতাশ হলো কিন্তু তা প্রকাশ করলো না।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও তা নিয়ন্ত্রণ করলো।শান্ত গলায় বলল– ও কে, যাও তাহলে। তনু নির্লিপ্ত গলায় বলল– আর কিছু বলবে?

–নাহ! ফোন রাখছি।
–বাই।

ফোন রেখে আপনমনেই হাসলো তনু।সে জানে তার কাছ থেকে না শুনে বা অবহেলা পেয়ে অভ্যস্ত না আবিদ।তনুর পক্ষ থেকে আজকের যেই অবহেলার ধাক্কাটা এলো তা হজম করতে আবিদের কষ্ট হবে।আবিদের মনটা নিশ্চয়ই বিগড়ে গেছে।

তনু বারান্দা থেকে শোবার ঘরে প্রবেশ করলো।বিছানার চাদরটা টান টান করলো,ঘরটা একটু গুছিয়ে নিল।সে জানে কিঞ্চিৎ অগোছালো ঘর আবিদকে বিরক্ত করবে।ওদের তিন বছরের বিবাহিত জীবনে এমন কাজ তনু কখনোই করেনি যা আবিদকে বিরক্ত করে।সে সবসময় স্বামীর মন জুগিয়ে চলতেই প্রস্তুত ছিল।তবুও আবিদ কারণে অকারণে তাকে এড়িয়ে চলেছে।হয়তো ঘর-গৃহস্থালি সামলে চলা টাইপ তনুতে তার মন ভরতো না।সাদামাটা স্বামী নির্ভরশীল তনু হয়তো আবিদের মনে বিরক্তি ঘটাত। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তনু জানালার গ্লাস আটকে পর্দা টেনে দিল।বিকেলের রোদটা পরে এসেছে।একটু পরই টুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসবে। কবিতা পাঠের আসর শুরু হতে এখনো কিছুটা সময় বাকি আছে।টি.এস. সি র মাঠের সবুজ ঘাসে বসে তনু,সর্মি,তুলন গল্প করছে। তনু ভালো মানুষের মত করে কিভাবে আজ আবিদকে রিজেক্ট করে দিল সে গল্পটা শুনে সর্মি আর তুলন হেসে গড়িয়ে পরছে।

তুলন বলল– একেবারে ঠিক কাজ করেছিস ব্যাটাকে রিজেক্ট করে।যেন একটা ভাবকুমার!সারাক্ষণ ভাবের সাগরে ডুবে থাকে। সর্মি বলল– এই পুরুষ মানুষগুলোকে আমি ঠিক বুঝি না।এরা একটু সাফল্য সম্পদের মুখ দেখলে নিজেকে যে কি ভাবতে শুরু করে!!অহঙ্কারে যেন এদের মাটিতে পা পরে না! তনু বলল– বিয়ের পর থেকে এই তিনটা বছর আমার কি যে এক দমবন্ধকরা অস্থিরতায় কেটেছে!আবিদ কখন দয়া করে আমাকে একটু সময় দেবে, একটু বাইরের খোলা বাতাসে নিয়ে যাবে সে আশায় আমি তৃষনার্ত হয়ে বসে থেকেছি। সর্মি বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে বলল– তুই এখনো সেই ন্যাকা তৃষনার্ত বালিকাই রয়ে গেছিস। তনু অবাক হয়ে বলল– আমি আবার কখন ন্যাকামি করলাম?

–এই যে একটু পরপর চোরাচোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিস,তা কার জন্য আমরা কি বুঝি না?তুই ভীড়ের মধ্যে আবিদকেই খুঁজছিস। তোর উইশফুল থিংকিং হচ্ছে,আবিদ যেন দয়া করে অফিস থেকে এখানে তোর কাছে চলে আসে। তনু অপ্রস্তুত হাসি দিল। তুলন বলল– তোকে কতবার বলেছি নিজের একটা জগৎ তৈরি করে নে।এত বেশি এক্সপেক্ট করবি না ঐ ভাবকুমারের কাছে।যতো বেশি এক্সপেক্ট করবি নিজেকে তোর ততো বেশি বঞ্চিত মনে হবে এবং তোর কষ্ট ততোই বাড়বে।

তনু মনে মনে ভাবলো, হ্যাঁ,এই কথাটাই আবিদ তাকে বারবার বোঝাতে চেয়েছে।কিন্তু আবিদের বলার ধরণটা ছিল তিক্ষ্ম, তীব্র বিদ্রুপে ভরা যা তাকে আহত করেছে। আবিদ তাকে বলেছে, “স্বামীর কাছ থেকে মনোযোগ চাওয়া,একটু যত্ন আর ভালোবাসা চাওয়া নাকি মিডল ক্লাস ফ্যামিলির মনস্তত্ত্ব। ”

আবিদের কথায় তনু হোঁচট খেয়েছে, দিশেহারা হয়েছে।কখনো কখনো আবিদের অঅবহেলা তনুর শরীরে গরম খুন্তির ছ্যাঁকার মত জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে।কত ঘুমহীন রাত সে কাটিয়েছে কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে!তার নির্ঘুম রাত কোনদিন আবিদকে স্পর্শ করেনি।

টি.এস.সি থেকে বাসায় ফেরার পথে আবিদ উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করলো তনুকে। এতটুকুতেই তনুর মন ভিজে ওঠে।খুব বেশি তো সে কোনদিনও আশা করেনি।অফিস থেকে সারাদিনে দু’একবার ফোন করে খবরাখবর নেয়া, বাড়ি ফিরে মুখোমুখি বসে গল্প করা আর সপ্তাহের ছুটির দিনে একটু কোথাও বেড়াতে বের হওয়া।সেটা হতে পারে পাড়ার অলিতে গলিতে হুডফেলা রিক্সায় ঘুরে বেড়ানো। নাহ! তনুর ইচ্ছা-অনিচ্ছা,ভালোলাগা -মন্দলাগাকে দাম দিয়ে চলার মানসিকতাই আবিদের ছিল না।

— তনু! তুমি এখন কোথায়? আরো দেরি হবে?আমি কি আসবো তোমাকে এগিয়ে নিতে?
–এই তো চলে এসেছি, আর পাঁচ মিনিট।
–ঠিক আছে,তুমি এলে আমরা একসাথে রাতের খাবার খাবো।

তনুর ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসির রেখা ফুটে উঠলো। সে মনে মনে ভাবলো,যে মানুষটা নিজের খাওয়া,কেনাকাটা, ঘুরে বেড়ানো, আড্ডা,আনন্দ নিজের মতো করে আদায় করে নিতে ব্যস্ত থেকেছে সে কিনা আজ রাতের খাবার বৌ এর সাথে খাবে বলে বসে আছে!তনু বুঝতে পারছে তার জীবনের অনেককিছুই এখন বদলে যাচ্ছে।

রাতে ঘুমাতে যাবার আগে শুয়ে শুয়ে ম্যাগাজিনের পাতা উল্টানো আবিদের পুরনো অভ্যাস।কাজটা না করতে পারলে তার ঘুম আসে না।তনু কতদিন ঐ সময়টাতে ছটফট করেছে আবিদের সাথে মন খুলে একটু গল্প করবে বলে।সারাদিন তো স্বামীকে তার পাওয়া হয় না।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই তাকে রান্নাঘরের দিকে ছুটে যেতে হয়।শাশুড়ির সাথে রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকতে হয়।সকালের চা,নাস্তা বানানো, শ্বশুড়ের ঐষধ আরর পানি এগিয়ে দেয়া,দুপুরের রান্নার যোগাড়যন্ত্র, বাজারের লিস্ট তৈরি,ভার্সিটিপড়ুয়া ননদের লাঞ্চবক্স প্রস্তুত করা নিয়ে ব্যস্ততা তার জীবনের একঘেয়েমিবোধটা আরো তীব্রতর করে দেয়।সকালগুলো তার জীবনে কোনো নতুনত্ব এনে দিতে পারে না।তারপর আবিদ অফিসে চলে যায়,শ্বশুর অফিসে চলে যান,একমাত্র ননদ রিমি ভার্সিটিতে চলে যায় সারাদিনের জন্য। শাশুড়ি তার নামাজ,বিশ্রাম আর টিভি সিরিয়াল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।সারাদিনের সীমাহীন নিঃসঙ্গতা তনুকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ওর দম বন্ধ করে দিতে চায়।যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে সে অফিস থেকে আবিদের ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকে।কিন্তু তনুর দিকে সেভাবে ফিরে তাকাবার সময় যে আবিদের হাতে ছিল না।বন্ধুদের সাথে আড্ডা,অফিস,টিভি দেখা, ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টানোতেই তার যতো ব্যস্ততা।

তনু মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠতো।স্বামী আর শ্বশুর, শাশুড়ির অনাগ্রহে বিয়ের পর লেখাপড়াটাও সে চালিয়ে নিতে পারলো না।গতবছর অনার্স থার্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষাতেও সে অংশগ্রহণ করতে পারলো না।তনুর কেবলই মনে হতে থাকে ঘরের চার দেয়াল যেন তাকে চারদিক থেকে চেপে ধরতে চায়।তার দম বন্ধ হয়ে আসে। একটু সুস্থ নিঃশ্বাসে বাঁচার জন্য সে কাগজ-কলম হাতে তুলে নিল।তার আগে থেকেই ডায়েরি লেখার অভ্যাস।সেই অভ্যাসের সূত্র ধরে তনু লেখালেখি আরম্ভ করেছে কয়েকমাস যাবৎ।

তার নিজেরই অব্যক্ত কথার উৎস থেকে সে গল্প দাঁড় করায়।কাল্পনিক তনু আর আবিদের ছোট ছোট গল্প তৈরি করে সে।তার গল্পের চরিত্রগুলোকে সে ভিন্ন নামে সাজায়,কল্পনার রং মাখায়।একাজে তার মন ভালো হয়ে যায়।কল্পনার রাজ্যটা যে অনেক বড়!সে রাজ্যে সে স্বাধীনভাবে বিচরণ করে।

ছোটগল্প লিখে তনু এখানে ওখানে পাঠাচ্ছে।আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে তার প্রতিটা গল্প বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।তারমানে সে খুব খারাপ লিখছে না।যতবারই তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে ততবার সে নতুন উদ্যমে নতুন কিছু লিখেছে।সে বেপরোয়া হয়ে লিখেছে।সারাদিনের খাওয়া, গোসল, বিশ্রামের কথাও কখনো কখনো সে ভুলে গেছে।
ম্যাগাজিনের পাতা উল্টানোর ফাঁকে ফাঁকে আজ আবিদ আড়চোখে তনুকে দেখছে।তনু ড্রেসিংটেবিল এর সামনে বসে সময় নিয়ে চুল আচড়াচ্ছে,হাত পায়ে লোশন মাখছে,মুখে নাইটক্রিম লাগাচ্ছে,আবার গুন গুন করে আপনমনে গানও গাইছে। আবিদ অবাক হলো। তনুর আজকাল হয়েছে কী? বিয়ের পর থেকে এভাবে সে কখনো তনুকে দেখেনি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে।আবিদ ম্যাগাজিনটা ভাজ করে একপাশে রেখে নরম গলায় বলল– তনু! এদিকে এসো।

–ওখান থেকেই বলো,শুনছি।

আবিদ একটু আহত হলো।তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল– আজ কবিতা পাঠের আসর কেমন হলো?
তনু এক কথায় উত্তর দিল — ভালো।

–আহা,এদিকে এসো না,কথা আছে।

আবিদের আহবানে সাড়া না দিয়ে ভাবলেশহীন কন্ঠে তনু বলল– আজ গল্প করতে ভালো লাগছে না, ঘুমাবো।
আবিদের চোখমুখ থমথমে আর গম্ভীর হয়ে উঠলো। আবিদের গাম্ভীর্য আর নিজের চারপাশে দুর্ভেদ্য বলয় তৈরি করে রাখাটা একসময় তনুর কাছে চরম নিষ্ঠুরতা মনে হয়েছে।ঐ নিষ্ঠুরতার সামনে দাঁড়ানোর সাহস তনুর কোনদিনও হয়নি।বিয়ের পর প্রথম প্রথম সে মানুষটাকে ভয়ই পেত কিন্তু মানুষটাকে সে ভালোবাসতো। তার বিশ/একুশ বছর বয়সের জমে ওঠা সমস্ত ভালবাসা দিয়েই সে আবিদকে ভালোবেসেছে।এখন আর যাই হোক সে মানুষটাকে ভয় পায় না।নিজের নির্বাক আচরণের মাধ্যমে সে দৃঢ়তা প্রকাশ করতে পারে।মানুষটার অবহেলার জবাবে সেও অবহেলা ফিরিয়ে দিতে পারে।

তনু বোকার মতো কতদিন কথা বন্ধ রেখেছে,না খেয়ে থেকেছে,না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে মানুষটার কাছ থেকে একটু মনোযোগ পাবার আশায়।মানুষটা তাকে অনেক শিখিয়েছে। মানুষটা তাকে তীব্র অবহেলার মাধ্যমে শিখিয়েছে কিভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, নিজেই নিজেকে ভালোবাসতে হয়,নিজের বন্ধু হতে হয়। এখন আর সে কাঙ্গালের মতো আবিদের অপেক্ষায় বসে থাকে না।এখন আর সে বোকার মতো বাথরুমে দরজা বন্ধ করে বসে বসে কাঁদে না।সংসারের কাজের শেষে দুপুর আর রাতের অবসর সময়গুলো তার ভরে উঠেছে নতুন ব্যস্ততায়। দৈনন্দিন জীবনের সাদামাটা রুটিন থেকে তার মুক্তি মিলেছে। তার শরীর, মন আর অপমান, অবষাদে ছেঁয়ে থাকে না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবিদ বলল– সকাল থেকেই আমার কেমন যেন জ্বর জ্বর লাগছে।

–তাই! বলোনি তো?
–বলবো কখন? আমার কথা শোনার সময় তোমার আছে?
–মানে?
–সারাদিন তোমার যা ব্যস্ততা!
–তোমাদের সবার প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে ব্যস্ত তো আমাকে একটু থাকতেই হয়।কার কী লাগবে সেসব আমাকেই খেয়াল রাখতে হয় কিনা।

–আর তোমার লেখালেখি?
–আমার লেখালেখির সাথে তোমার বিরোধ হবার কথা না।সংসারের কাজের কোনো ত্রুটি রেখে আমি লিখি না।তোমার কোনো চাহিদাও আমি অপূর্ণ রাখছি না।রাতের প্রয়োজনেও আমাকে তুমি পাশে পাও।
–তারপরও…..
–তারপরও কী?
–তোমার কি মনে হয় না লেখালেখি নিয়ে তুমি একটু বেশিই ব্যস্ত হয়ে পরেছো?

তনু ভীষণ শান্ত স্বরে বলল– না,আমার তেমনটা মনে হয় না।আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় সংসারের কাজ ছাড়া আমার আর কিছুই করার থাকতে পারে না?

-আমি ঠিক তা বলতে চাইনি। নিজেকে নিয়ে তোমার আজকাল অনেক বেশি ব্যস্ততা।
–তুমি কি চাও একজন ফুলটাইম গৃহিণী হওয়া ছাড়া আর কোনো স্বত্তা থাকবে না আমার?
–আমার কথার ভুল ব্যাক্ষা দাঁড় করাচ্ছ কেন?আজ সন্ধ্যায় যখন টি.এস.সি তে গেলে আমাকেও তো সাথে যেতে বলতে পারতে?

–আমার বলার অপেক্ষায় কেন তুমি বসে থাকবে?আর তোমাকে সাথে না নিয়ে গেলেই বা কী?একটা সময় তোমার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলাম আমি।সেজন্য তুমি আমার ওপর বিরক্ত হতে।আবার এখন নির্ভরশীলতা কমে গেছে বলে বিরক্ত হচ্ছ।আশ্চর্য! একথায় আবিদ অপ্রস্তুত হলো।কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে চুপ হয়ে গেল। আবিদ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।তনুর আজ কিছুতেই ঘুম আসছে না।মাথার মধ্যে শব্দেরা ঘোরাঘুরি করে এক একটা লাইন হয়ে বের হয়ে আসতে চাইছে। খাতা-কলম নিয়ে বসার জন্য তার মনটা ছটফট করছে।তনু উঠে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে কাগজ-কলম নিয়ে বসলো। কাগজ-কলম নিয়ে বসলেই তার সারাদিনের সব ক্লান্তি কোথায় হারিয়ে যায়! তনু মাথা থেকে লাইনগুলো সাজিয়ে নিচ্ছে খাতায়।

সাদা কাগজের সামনে বসলে সে হারিয়ে যাওয়া নিজেকে ফিরে পায় একটু একটু করে।এই শব্দ,বাক্যগুলো তার দিনগুলোকে বদলে দিচ্ছে।তার মস্তিষ্কের অতল থেকে, বুকের গহীন থেকে কত শব্দ যে উঠে আসতে চায়! শব্দগুলো সুশৃঙখলভাবে একে অপরের পাশে বসে যায়।তনু একটানা লিখে যায়।কতটা সময় কেটে যায় কোনো হিসাব থাকে না তার।কখনো কখনো লেখা থামিয়ে সদ্য লেখা লাইনগুলো সে বিড়বিড় করে পড়ে শোনায় অদৃশ্য কাউকে।পড়তে পড়তে গল্পের চরিত্রের সাথে একাকার হয়ে মিশে যায় সে।চরিত্রগুলো যেন জীবন্ত হয়ে তার সামনে দাঁড়ায়।তাদের কষ্টে সেও কষ্ট পায়,ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।কখনো আবার সে আপনমনে হাসে।

সকালে যথাসময়ে ঘুম থেকে উঠে তনুকে পুরনো আর একঘেয়ে রুটিনে ফিরে যেতে হয়।সংসারের রুটিনবাঁধা জীবনটা তার কাছে খুব বেশি যে নিরানন্দ আর একঘেয়ে লাগে তা না। সংসারের জীবনেও ভীষণ আনন্দ আর বৈচিত্র্য আছে।তবে আনন্দটা খুঁজে নিতে হয়।কবে কি রাঁধতে হবে,রান্নাটা ভালো না খারাপ হবে, ড্রইংরুমটা কিভাবে সাজাতে হবে,বেডরুমের কোন আসবাবটা বদলাতে হবে এসব কাজ সামলানোও কম চ্যালেঞ্জিং না।আর তনুর শ্বশুর, শ্বাশুড়ি আর ননদও অন্যসব ক্রিটিকাল ননদ,শ্বশুর, শ্বাশুড়ির মত না।তারা তনুকে যথেষ্ট বোঝে এবং ছাড় দিয়েই চলে।মোটকথা তাদের সাথে তনুর বোঝাপড়াটা ভালোই বলা চলে।তারপরও কোথায় একটা ছন্দপতন, কোথাও একটা শুন্যতা।আর এই শূন্যতার জন্য যে আবিদই দায়ী তা তনু ভালো করেই বোঝে।আবিদও হয়তো একটু একটু করে ব্যাপারটা বুঝতে পারছে। আজও যথারীতি আবিদ অফিস থেকে তনুকে ফোন দিল।

-হ্যালো তনু! কী করছো?
–কিছু না।
–কিছু না মানে? কিছু একটা তো করছোই।
–শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছি।
-তোমার বিশ্রাম মানেই তো লেখালেখি। তার মানে তুমি লিখছো।
–হতে পারে।
–আজ বিকেলে কি ফ্রি আছো?
-কেন?
–তোমাকে নিয়ে এক যায়গায় যাবো।
–তোমার অফিস নেই?

–অফিস থেকে একটু আর্লি বের হবো।গতকাল মারুফ অষ্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে ছুটিতে।মারুফের নিকুঞ্জের ফ্ল্যাটে বন্ধুদের একটা গেট টুগেদার হবে।
–আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে তোমার অস্বস্তি হবে না?
–কেন?
–আমি হচ্ছি মিডল ক্লাস বাঙ্গালি। আমার মতো মফস্বলে বেড়ে ওঠা একটা সাদামাটা মেয়েকে তোমার বন্ধুরা এবং তাদের স্ত্রীরা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারবে না। আবিদ অপ্রস্তুত গলায় বলল–আমি কি তোমাকে কখনো সেরকম কিছু বলেছি?

–বলনি তবে আচরণে বুঝিয়েছ।
— বাদ দাও সেসব কথা।ওরা তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে।আমার ফ্রেন্ডদের প্রোগ্রামে তোমার খুব বেশি তো যাওয়া হয়নি।
–তুমি চাওনি বলে যাওয়া হয়নি।

তনুকে সহজ করার জন্য আবিদ বলল– তোমার পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলো ওরা নিয়মিত পড়ে।তোমাকে ওরা কনগ্রাচুলেট করতে চায়,তোমার সাথে আলাপ করতে চায়।

তনু তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল– তারমানে তুমি বলতে চাচ্ছো আমার স্ট্যাটাস একটু বেড়েছে।মিডল ক্লাস থেকে আমি আপার ক্লাসে পৌঁছতে পেরেছি।তোমার আপার গ্রেডের বন্ধুরা আমার সাথে আলাপ করতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। আবিদ বিরক্তি নিয়ে বললো– বাজে কথা বাদ দেবে প্লিজ? ঝগড়া করতে চাচ্ছি না আমি।তুমি কি যাবে আমার সাথে?

— আমার লেখাটা আর একটু বাকি আছে।কাল সকালের মধ্যে শেষ করে জমা দিতে হবে।গতকাল রাতে তোমার সামনেই তো পত্রিকা অফিস থেকে ফোন এলো। আবিদ অসন্তুষ্ট গলায় বলল– প্লিজ তনু!স্টপ ইট।সারাদিন তোমার এই ভীষণ ব্যস্ত থাকাটা না আমার আর ভালো লাগছে না।

–আশ্চর্য! তুমিই তো আমাকে বলেছো নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে।
–তাই বলে তোমার আজ এই বন্ধুর ট্রিট তো কাল ঐ কাজিনের জন্মদিনে অ্যাটেন্ড করে বেড়ানো চলতে থাকবে অথচ আমার বন্ধুর বাসায় তুমি যেতে পারবে না এটা কেমন কথা?

–আমার অনেক ফ্যামিলি বা ফ্রেন্ডের প্রোগ্রামেই তো তুমি অ্যাটেন্ড করতে পারো না তোমার ব্যস্ততার কারণে।তাছাড়া যে সময়টা তুমি অফিসে থাকো সে সময়টা আমি আমার প্রয়োজনে ব্যয় করি।আর আমি তোমার সংসারের কোনো কাজই অসম্পূর্ণ রাখি না।সংসারের টুকিটাকি কাজগুলোর কথাও আমি কখনো ভুলে যাই না।তুমি তো এমনটাই এক্সপেক্ট কর আমার কাছে।অফিস থেকে ফিরে সবই তুমি হাতের কাছে পাও।তোমার সন্ধ্যার নাস্তা,ঘুমাতে যাবার আগে লেবু চা,সবসময় আমি রেডি রাখি।

একথার জবাবে কি বলবে আবিদ জানে না।তীব্র এক বিতৃষনাবোধ ওর মনটাকে তিক্ত করে ফেললো। সে ফোন রেখে দিল। তনুর একটু একটু অপরাধবোধ হতে লাগলো।আবিদকে একটু বেশিই অবহেলা দেখানো হয়ে যাচ্ছে না?এতটা করা কি ঠিক হচ্ছে?আসলে তনুকে প্রতিশোধের নেশায় পেয়ে বসেছে।সে আবিদকে কিছু একটা উপলব্ধি করাতে চায়।সে অহঙ্কারি মানুষটার সব অহঙ্কার চূর্ণ করতে চায়। সে বন্ধু আবিদকে পাশে পেতে চায়।

সন্ধ্যায় আবিদ একাই বন্ধুদের গেট টুগেদারে উপস্থিত হলো।আজ সে কিছুতেই বন্ধুদের আড্ডাটা উপভোগ করতে পারছে না।আজ তার মনটা তনুময় হয়ে আছে।কেন আজ তার এমন বোধ হচ্ছে সে উত্তর সে কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না।তনুকে ছাড়া এই তিন বছরে সে কত কত পার্টি,আড্ডা,গেট টুগেদারে মেতেছে কিন্তু কোনদিন তার এমনবোধ হয়নি।তার বুকের ভেতরকার অস্বস্তিটা আরো বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে যখন কেউ তাকে জিজ্ঞেস করছে– ‘বউকে আনোনি?’ ‘কি ব্যাপার,তনু কোথায়?’ ‘তোমার সেলিব্রিটি বউকে বাসায় লুকিয়ে রেখেছো?’ ‘তোমার বউয়ের লেখা আমি নিয়মিত পড়ি,অসাধারণ লেখে।এত জিনিয়াস বউকে পাশে নিয়ে তোমার রাতের ঘুম ঠিকমতো হয় তো!’
আবিদ অসুস্থতার অজুহাতে আড্ডা ফেলে বাসায় চলে এল।বাসায় ঢুকেই সে দেখলো তনু যথারীতি লিখছে।তার মাথায় দপ করে যেন আগুন জ্বলে উঠলো।

আবিদ চিৎকার করে বললো–তুমি বন্ধ করবে এসব?অফিস থেকে ফেরার পর কোথায় আমার পাশে একটু বসবে তা না আজ তোমার এই পত্রিকা থেকে ফোন আসে তো কাল ঐ প্রকাশনী থেকে তনুও জ্বলে উঠে বলল–যে সময়টা তুমি টক শো দেখে,ম্যাগাজিন পড়ে,নাক ডেকে ঘুমিয়ে কাটাও,যে সময়টা আর দশটা হাউজওয়াইফ জি বাংলা,ষ্টার জলসা দেখে কাটায় সে সময়টাতে আমি যদি লিখি তাতে তোমার সমস্যা কোথায়? নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে আবিদ শান্ত স্বরে বলল–প্লিজ তনু! লেখালেখিটা তুমি ছেড়ে দাও। তনু অবাক হওয়া গলায় বলল–তুমি আমার লেখনী শক্তিটাকে গলাটিপে মেরে ফেলতে চাইছো?

–আসলে আমি বলতে চাচ্ছি…..
–কি বলতে চাচ্ছো তুমি?তুমি জানো পাঠক,সম্পাদক, প্রকাশকদের একটা এক্সপেকটেশন গড়ে উঠেছে আমার লেখার প্রতি।পাঠক আমার লেখা পড়তে চায়।তাছাড়া লিখতে আমার ভালোলাগে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তনু বলল–দেখ আবিদ,তোমার পুরনো মানসিকতার বাবা-মাও আমার লেখালেখিতে উৎসাহ দেন,তারা আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করেন।আর তুমি?আধুনিকতার খোলসে এ আমি কাকে দেখছি?
আবিদ অসহায় ভঙ্গিতে বলল–কিন্তু তোমার ব্যস্ততা…

–তোমরা ছেলেরা ভীষণ অদ্ভুত। একটা সময় আমি পাগল হয়ে তোমার পেছনে ছুটেছি,তোমার সময় হয়নি পেছন ফিরে আমাকে দেখার।এমনকি অফিসে বসে সারাদিনে আমাকে একটা ফোন দেবার সময় তোমার হয়ে ওঠেনি।আজ আমার ব্যস্ততাতেও তোমার সমস্যা।মেয়েদের কাছে আসলে কী চাও তোমরা? কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আবিদ বলল–আই অ্যাম সরি তনু।

–তুমি কেন সরি হবে?
–বিশ্বাস কর আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।

তনু বিদ্রুপের সুরে বলল–তাই? আবিদ অপরাধীর ভঙ্গিতে বলল–দেরিতে হলেও আমি বুঝেছি।বেটার লেট দ্যান নেভার। তনু চুপ করে বসে আছে। আবিদ দুহাত দিয়ে টেনে তনুকে মুখোমুখি বসালো।তারপর তনুর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল– আমাকে ক্ষমা করা যায় না?ক্ষমার মতো মহৎ জিনিস কিন্তু নেই। কথাটা বলে আবিদ হাসলো।হেসে পরিবেশটা হাল্কা করতে চাইলো। তনুও সহজ হলো।বললো– ওকে যাও, করলাম ক্ষমা।এখন আমাকে কী করতে হবে? লেখা ছেড়ে দিতে হবে?

–আসলে আমি ওভাবে কথাগুলো বলতে চাইনি। তোমার লেখালেখির সাথে আমার কোনো বিরোধ নেই। বরং তুমি লিখলে আমার ভালোই লাগে। শুধু এই অধমের দিকে একটু তাকিয়ো, একটু সময়-টময় দিও।

আবিদের এই উপলব্ধি আর স্বীকারোক্তিতে তনু যেন বিশ্বজয়ের আনন্দ পেলো। এটাই তো এতদিন সে চেয়েছে।স্বামীর একটু মনোযোগ আর একটু ভালোবাসার চেয়ে আর কিছুই তার কাছে বড় না। তনু মুচকি হেসে আবিদের মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল– ঠিক আছে যাও,আজ থেকে লিখবো তবে তোমাকে ভুলে গিয়ে লিখবো না।খুশি? আবিদ হেসে তনুকে কাছে টানলো।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত