তৃণা

তৃণা

ইচ্ছে করে। মরে যাওয়া ব্রনের দাগগুলো মোছার জন্য মেকাপ করতে মা এসে বলে গেলো।একে তো গায়ের রঙ কালো তার উপর ব্রনের দাগগুলো চেহারার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।

হঠাৎ তৃণা(আমি তৃণা) বলে মা ডাকতে লাগলো, পাত্রপক্ষের সামনে যাওয়ার জন্য।শুনেছি ছেলেদের অনেক টাকাপয়সা আছে।ছেলে দেখতেও নাকি খুব সুন্দর ! কিন্তু ছেলের একটা সমস্যা আছে।আর সেটা হলো,ছেলে আগে একটা বিয়ে করেছে।তার জন্যই আমার মত কালো, মধ্যবিত্ত ঘরের একটা মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব রেখেছে। পাত্রপক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিতেই ছেলের মা বসতে বললো। উনারা আমাকে দেখে আংটি পরিয়ে দিয়ে গেলেন।

তেমন কোনো প্রশ্নই উনারা করেন নি।আমি উনাদের আচরণ দেখে অনেক অবাক হই ! কারণ এই পর্যন্ত অনেকের সামনে এরকম নিত্যনতুন সাজে পুতুলের মত এসে উপস্থিত হয়েছিলাম।আর তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি প্রায় বিরক্ত হয়ে যেতাম।তারপরেও বসে থাকতে হতো।কারণ আমরা মেয়েরা বরাবরই অন্যের মতে চলতে বাধ্য।

পাত্রপক্ষ আমাকে আংটি পরিয়ে দিয়ে চলে গেলো।মাসখানেকের মধ্যে বিয়ের তারিখও ঠিক হয়ে গেলো।কিন্তু আমি যার সাথে সংসার করবো তাকে আমি মুখ তুলে একটিবারও দেখতে পারিনি বা তার সম্পর্কে তেমন কিছু জানিও না। পরবর্তীতে আমাদের বিয়ে হয়ে যায়।বিয়ের আগ পর্যন্ত আমার বর নামক লোকটার সাথে আমার কোনো কথা হয় নি।

আজ আমাদের বিয়ের প্রথম রাত।ভীষণ নার্ভাস ছিলাম, অপরিচিত ব্যক্তিটাকে নিয়ে।কিন্তু নিনাদ (আমার ববর)রুমে এসে আমার সাথে কেবল তিনটি বাক্য বলেছিলেন।প্রথমত, উনার মা বলেছেন ঘরে একজন বউয়ের দরকার।আর দ্বিতীয়ত, উনার কাছ থেকে আমি অতীতের যেন কিছু না জানতে চাই এবং তৃতীয়ত স্বামীর অধিকারও যেন না চাই।

বিয়ের পর থেকেই এভাবে প্রতিটি রাত দিন অতিবাহিত হতে লাগলো।কিন্তু ব্যাপারটা বাড়ির কাউকে জানানো নিষেধ ছিলো উনার।এদিকে নিনাদ বড় জামাই হিসেবেও আমার পরিবারের প্রতি দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতো।

নিনাদের সাথে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছে আমি নিনাদের প্রতি আসক্ত হয়ে গেছি।যা আমার জন্য নিতান্তই বদঅভ্যাস ! একটা মানুষ এতটা ভালো কি করে হয় ! সত্যি আমার জানা নেই। কিন্তু নিনাদ আমার প্রতি কখনো ভালবাসা বা যত্ন দেখাতো না।তারপরেও আমার ওকে ভীষণ ভালো লাগতো। বিয়ের প্রায় বছরখানেকের মাথায়, হঠাৎ একদিন নিনাদ আমার পাশে বসে বললো,

–তৃণা , তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।

নিনাদের কথা শুনে অনেকটা আগ্রহ নিয়ে নিনাদের দিকে তাকিয়ে আছি।আমার বিশ্বাস ছিলো, ও একদিন আমাকে ঠিক বুঝবে। একদিন ঠিকই আমাদের ভালবাসা হবে।

–হ্যাঁ,বলুন।

বিছানা থেকে উঠে আধশোয়া অবস্থায় নিনাদকে বললাম।ইদানিং আমি খুব অসুস্থ। তাই প্রায় বিছানায় শুয়ে অলসতায় দিন পার করছি।

–জানিনা তুমি বিষয়টাকে কিভাবে নিবে ? কিন্তু আমাকে বলতেই হবে।আমি আর এসব সহ্য করতে পারছি না।তোমার কষ্ট আমি আর সহ্য করতে পারছিনা।

–আপনি এভাবে বলছেন কেন? সমস্যা নেই, বলুন আপনি।আমি শোনার জন্য প্রস্তুত।
খুব লজ্জা নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে নিনাদকে বললাম।

–আমার ডিভোর্স চাই।
এমন কথা শুনে আমি চোখ তুলে নিনাদের দিকে তাকালাম।নিনাদও আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

–ডিভোর্স ? ঠিক আছে।কিন্তু আমি কি কোনো দোষ করেছি?বিয়ের প্রথম রাতে আপনি যে কথাগুলো বলেছেন আমি তো সেগুলো সঠিকভাবে পালন করছি।তাহলে কেন ?

–কারণ আমি চাইনা, আমার সাথে থেকে তোমার জীবনটা নষ্ট হোক।আমি মনে করেছিলাম এক বছরে তোমার আর আমার বন্ডিংটা খুব ভালোই হবে। কিন্তু না। তোমার সাথে আমার যাচ্ছে না।কিছুই মিলছে না।বরং মনে হয়,আমি ঘরে আসলে শান্তির বদলে শাস্তি পাচ্ছি।

–ওহ্ !

ঠিক আছে । আপনি কথা আমি বরাবরই মেনে আসছি।তাহলে আজ কেন নয় ? আপনি কাগজপত্র রেডি করুন। কথাটা বলে নিনাদের পাশ থেকে বেরিয়ে আসলাম।ওয়াশরুমের পানি ছেড়ে অনবরত নিঃশব্দে চোখের পানি বিসর্জন দিচ্ছি । আমার কাঁন্না নিনাদ পর্যন্ত পৌঁছালো না। যেমনটা আমিও নিনাদ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারি নি।

কিছুদিন পর নিনাদ আর আমার ডিভোর্স হয়ে যায়।যাকে বলে মিউচুয়াল ডিভোর্স। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো।আজ অনেকদিন পর নিনাদ আবার আসলো।আমাকে দেখতে আসলো।কি অদ্ভুত নিয়তি, তাইনা? নিনাদ আমাকে হসপিটালে দেখতে আসলো।আসার কিছুক্ষণ পর ও চলে যাচ্ছিলো।ঠিক তখন বললাম,

–এখনই চলে যাবেন ?

–হ্যাঁ ।

–আগামীকাল আরেকবার আসবেন ?

–আগামীকাল ? আচ্ছা দেখি । ডাক্তার কি বললো ?

–কি আর বলবে।ক্যান্সারের লাস্ট স্টিজ এ আছি। খুব একটা সময় নেই হাতে।ভাগ্যিস, আপনি ছেড়ে দিয়েছেন।দেখুন না, নতুবা বাকিটা সময় আপনারই কষ্ট হতো।

–চুপ করুন তো ।

–আসবেন কাল একবার ? আপনাকে একটা কথা বলার ছিলো, জরুরি কথা।কাল বলবো ।

–আচ্ছা , যাই এখন , ভালো থাকুন।

কেবিন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো নিনাদ।নিনাদ চলে যাচ্ছে কিন্তু মনে হচ্ছে কাল পর্যন্ত হয়তো নিনাদকে কথাটা বলার সুযোগ হয়ে উঠবেনা।ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো।কেন শেষ হয়ে যাওয়া একটা সম্পর্কের জন্য এখনো এতটা কষ্ট হচ্ছিলো, জানিনা।কাল নিনাদ আসবে তো ? পরদিন ঠিকই নিনাদ এসেছিলো কিন্তু তৃণা তার শেষ কথাটা নিজের মুখে নিনাদকে বলতে পারিনি।তার আগেই সব কিছু ছেড়ে দিয়ে তৃণা শান্তির ঘুমে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

ছোট্ট একটা চিরকুট তৃণার ছোট বোন নিনাদের হাতে দিয়ে গেলো। তাতে তিনশব্দের একটি বাক্য ছিলো।”আপনাকে খুব ভালবাসি”! চিঠিটা পড়ে নিনাদ শেষবারের মত তৃণার কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।আকাশ কালো ঘন মেঘে ছেয়ে গেলো। ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো পুরো শহর জুড়ে।চোখের পানি মুছতে মুছতে ভীড়ের মাঝে হারিয়ে গেলো নিনাদ। এভাবেই একটি একতরফা ভালবাসার সমাপ্তি ঘটলো।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত