অনিচ্ছাসত্ত্বেও মানুষটির সাথে আমার বিয়ে হয়।বিয়ের দিন জানতে পারি আমার জীবন সঙ্গিনী কথা বলতে পারে না। আমার পরিবার কে জিজ্ঞেস করতেই তারা অনেক কিছু বলতে থাকে। হ্যা তারা জানতো। আমায় কেনো বলে নি জানি না। পরক্ষণে বুঝলাম, আমার স্বামীর পরিবার খুব ধনী। টাকা পয়সার অভাব নেই। তাই দেখেই তারা রাজি হলো।
পুরো ঘটনা তারা জানলেও আমায় বলেনি। এই ভাবে নিজের পরিবার আমার জীবন টা নষ্ট করতে পারলো। তা ভাবলে, চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইতো।
সব টা ভেবেই রাজি হলাম। যা ছিল কপালে তাতো হবেই।
.
খুব রাগী ভাবে কাবিনের খাতায় নিজের সাইন দিলাম। দেখলাম লোকটিও দিল। হ্যা ওর নাম হাবিব। আর আমি রিমি। সে দেখতে বেশ ভালো। নামটিও সুন্দর। নিজের মন কে নিজেই সাপোর্ট দিয়েছি। কারন সবাই জানে সে বোবা, তাই অনেক কথা আমায় শুনতে হবেই।এটাই স্বাভাবিক। খুব আশা ছিল, আমার বিয়ে টা খুব স্বাভাবিক ভাবে হবে।যা আমি মেনে নিতে পারবো। কিন্তু না, এতো অস্বাভাবিক ভাবে হয়ে গেলো। ভেবেছিলাম বাসর রাতে তার সাথে গল্প করেই কাটিয়ে দিবো। হাহ, সেই টা কপালে নেই আমার। সে তো কথাই বলতে পারে না। আবার গল্প।
.
চুপ করে ইয়া লম্বা একটা ঘোমটা টেনে বসে আছি। হাবিব এসে চুপ করে কিছুক্ষন বসলো। আমি এড়িয়ে এড়িয়ে দেখছি, সে কি করছে। হুম, দেখলাম, একটি খাতা আর কলম নিল। কি যেনো লিখছে সে,
আমার হাতে সে তুলে দেয়।তাকিয়ে দেখি, এমা, এত্তো সুন্দর হাতের লিখা।আমি তার লিখা পড়বো নাকি দেখবো। তাকিয়ে আছি লিখার দিকে।
তারপর পড়া শুরু করি,
-আমি বিশ্বাস করতে পারি নি। আপনি আমার মত বোবা ছেলেটিকে বিয়ে করতে রাজি হবেন। আমায় করুনা করে করেছেন কিনা আমি তাও জানি না। তবে আপনার কাছে আমি দুঃখিত আপনার সুন্দর একটি জীবন নষ্ট করার জন্য। আমি আমার পরিবারের চাপে পড়েই বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। আমি চাই নি বিয়ে করে কারো জীবন টা নষ্ট করতে। আপনি আপনার মতই স্বাধীন থাকুন।
কথা গুলো পড়লাম, আর চোখের কোণে কেনো জানি দুই এক ফোটা জল এসে পড়লো। আমি পড়তে পড়তে দেখি সে একটি মাদুর আর বালিস নিয়ে ফ্লোরে ঘুমিয়ে গেছে। আমি বারান্দায় যেয়ে বসে থাকি। রাত যত বাড়ছে আমার ভাবনা গুলো বেড়ে চলছে। রুমে যেয়ে দেখি ঠান্ডা আবহাওয়া তে শীত লাগছে তার। একটি চাদর তার শরীরে দিয়ে দেই। আর একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলছি। একটু সরে যেতেই চাঁদ এর আলো টা যেন তার চোখে পড়লো। খুব সুন্দর লাগছ হাবিব কে। একদম একটি নিষ্পাপ শিশুর মত দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছিল খুব ক্লান্ত সে।গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হয়তো উপর আলার ইচ্ছে ছিল এই মানুষটির সাথে আমার বিয়ে হবে।কি আর করার মেনে নিতে বাধ্য আমি।
.
দিন গুলো যত বাড়ছে তত যেন তাকে আমি নতুন ভাবে চিনছি। রান্না করতে গেলে সেও যায়, খুব সাহায্য করে আমায়। কিন্তু তার কথা গুলো বুঝতে আমার খুব অসুবিধে হতো। তারপরও তার হাতের ইশারায় বুঝে নিতাম। এখন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে দেখিয়ে অনেক প্রশংসা করে আমার রান্নার। খুব মজা করে খায়। আর আমি টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি আর হাসি। মনে হচ্ছে অনেক দিন এমন খাবার খায় নি সে।
.
হঠাৎ একদিন একটি ডায়েরী পেলাম। খুলতেই, আমায় নিয়ে অনেক লিখা। যেন শেষ হচ্ছে না। আমি কখন কি করেছি, কি রান্না করেছি সব লিখা আছে। আমি অবাক হচ্ছিলাম দেখে। মানুষটি মুখে না বলতে পারলেও লিখে তার মনের ভাব গুলো প্রকাশ করছে। যেখানে লিখা শেষ হয়েছে তখন দেখলাম,
রিমি আমি তোমায় সত্যি খুব ভালোবাসি। ছোট থেকে বড় হয়েছি এই বোবা ছেলেটি যত টা কষ্ট পেয়েছে তার চেয়ে আজ বড্ড বেশি কষ্ট হচ্ছে রিমি। আমি চিৎকার করে একটি বারের জন্য বলতে চাই, আমি আমার রিমি কে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। শুধু একটা বারের জন্য। আমার কি সেই সুযোগ আর হবে না? আমি কি পারবো না তোমায় বলতে? আমি চাই না লিখে তোমায় দেখাতে। আমি শুধু বলতে চাই।
কথা গুলো পড়ছিলাম আর চোখের জল গুলোর ফোটা যেন এক একটি অক্ষর কে ভেজাচ্ছে। আমার এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল হাবিব আমার সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছে, সে আমায় ভালোবাসে। পড়াটি শেষ করতেই আমার কাধে একজনের হাতের স্পর্শ পেলাম। ঘুরে দেখলাম হাবিব। ডায়েরী টি সাথে সাথেই লুকিয়ে ফেলি। আমার চোখ ভেজা বলে সে হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করছে আমায় কেনো কাঁদছি। আমি বললাম,
তুমি বসো। আমি চা নিয়ে আসছি।
চলে গেলাম রান্নাঘরে।
দেয়ালে ঠেকে দাঁড়িয়ে আছি। মন চাচ্ছে ইচ্ছে মত জোরে জোরে কাদি।
শুধু খোদার কাছে প্রার্থনা করছি।
একটি বারের জন্য না হয় তার মুখের জবান দিয়ে দাও। না হয় আমায় তার বিনিময়ে বোবা করে দাও। আমি শুনতে চাই, একটি বারের জন্য শুনতে চাই, আমায় ভালবাসে।
.
রুমে যেয়েই তাকে বলি চল ছাদে যাই। সে বুঝতে না পারায় তাকে লিখে দেই। বলল এতো রাতে কেনো যাব।জোড় করে নিয়ে যাই। কিছুক্ষন তার কাধে মাথা রেখে চাঁদ দেখি। আমার হাতের ইশারায় তাকে বুঝিয়ে বলি,হাবিব আমি তোকে ভালোবাসি। সে অনেক কষ্ট করে বুঝে নিয়েছে।
আমি জোড় করি তাকে বলতে। সে বলেই হাত ধরে কাঁদছে। আমি চোখ মুছিয়ে দিতে আরও কাঁদছে। তাকে জড়িয়ে ধরতে তার কান্নার আওয়াজ গুলো আমায় বলছে,
-রিমি শুনতে পাচ্ছো? আমি ভালোবাসি তোমায়। বড্ড বেশি ভালোবাসি। শুনতে পাচ্ছো তুমি?
আর আমি চিৎকার করে তাকে বলছি, হ্যা হাবিব শুনতে পাচ্ছি আমি। দেখো আমি শুনতে পাচ্ছি, তুমি খুব ভালবাসো আমায়….
.
.
যে মানুষটি বোবা, সেই একমাত্র বুঝতে পারে, তার কথা না বলতে পারা টা কত টা কষ্ট
হাবিব মতো হাজার হাবিব আমাদের আশে পাশে বাস করে,আমরা কি পারি না, রিমি মতো হাবিদের পাশে দাড়াতে, আমরা কি পারি না তাদের ভালোবাসতে।