লুকোচুরি ভালোবাসা

লুকোচুরি ভালোবাসা

বাবার কথা শুনে অামার মেজাজ চটে গেলো।
–এখনতো শুধু চিনিপান হবে রুমু! ছেলে ১০জনের মধ্যে একজন।জুনাইদের মা হজ্বের অাগে যাস্ট
তোকে একটু দোয়া করে যাবে।
–বাবা, অামিও ১০টা মেয়ের মধ্যে একটা।অামার রেজাল্ট ভালো, অামার একটা অালাদা পরিচিতি বানাতে চাই.
—রুমু, তুই যেরকমভাবে চলতে চাস, যেমন জীবন ভালোবাসিস, সেরকম জীবন মনে হয় জুনাইদ
তোকে দিতে পারবে।
অামি কেঁদে ফেললাম।বাবার মন গলে গেলো।
–অাচ্ছা, অামি ওর অফিসের ঠিকানা দিচ্ছি তুই জুনাইদের সাথে কথা বলে দেখ।তারপরও তোর ভাল না
লাগলে, অামি মানা করে দিবো।
অামার সেমিস্টার ফাইনালের ২সপ্তাহ বাকি।পড়াশোনার চাপে “মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা “!
—বাবা, অামার ফোনে ঐ লোকের ঠিকানা টেক্সট করো তো।
—তুই বারবার ওকে লোক বলছিস কেনো???
—লোককে লোক বলবো না তো,রাজা বাদশা বলবো??
বাবা, বিরক্ত মুখ করে উঠে গেলেন।
বাবা মেসেজ করে ঠিকানা পাঠালেন।সাথে ফোন নাম্বার।প্রশ্নই অাসে না, জুনাইদের অফিসে যাবার!বরং একটা টেক্সট পাঠিয়ে দিই।
সন্ধ্যার দিকে টেক্সট করলাম,
“অামি বিয়ে করতে পারবো না এখন, চাই ও না বিয়ে করতে!অামি ভীষণ ব্যস্ত, ভীষণ… অামার বিয়ে করার সময় নাই”!
জুনাইদের মা, অামার কলেজের বায়োলজির ম্যাম ছিলেন।সেই সুবাদেই তিনি বাবাকে প্রপোজালটা
দেন।বাবা, দেখছি, ভাবছি, জানাচ্ছি বলে এতদিন কাটিয়ে দিলেন।কিন্তু যেই না উনি ছেলে
দেখেছেন, উনি মুগ্ধ।যেদিন প্রথম পাত্র দেখে অাসলেন, এসে সবাইকে জানিয়ে দিলেন,
এই ছেলের সাথেই অামি অামার রুমুকে বিয়ে দিবো।যদি রুমু রাজি না হয়, বড় ভাইজানের মেয়ের কথা অালাপ দিবো।
রাতে খাবার পাতে বসে জুনাইদের গুণ শুনিয়ে উনি মায়ের কান ঝালাপালা করে ফেললেন।বললেন,
–অামি অামার পুরো চাকরি জীবনের ক্যারিয়ারে এমন
ছেলে দেখিনি।তুখোড় ছেলে, কি উদ্যম! এত অল্প বয়সে বাবার বিজনেস দেখছে, ফ্যামিলি
মেইনটেইন করছে, চেহারায় কোনো ক্লান্তি নেই।কোনো লালটু পালটু নেই, শুধু কাজ অার
কাজ!ডিসিপ্লিনড লাইফ।অামার সামনে বসা অবস্থায় একটা ফোনও সে রিসিভ করেনি।অামাকে নিজে এসে
গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলো। শুনে বিরক্তিতে অামার মুখ তেতো হয়ে গেলো।
— এটা মিনিমাম কার্টেসী বাবা, ঐ লোকের জায়গায় অামি হলেও তা করতাম।অার বাবার বিজনেস সামলাচ্ছে
মানে যাদের নিজের কিছু করার সামর্থ্য নেই, তারাই এইসব করে।
বাবা অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে অামার দিকে তাকালেন।অামি তাঁর দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ভাতের পাতে পানি
ঢেলে চলে অাসলাম।

যা হবার হোক, বিয়ে করবো না অামি।অামার নিজের একটা ক্যারিয়ার অাছে, ইউনিভার্সিটিতে একটা ভালো
ছাত্রীর ইমেজ অাছে।অামি জানি, অামি যেদিন শাড়ি পরে ভার্সিটিতে যাই, অামার হেটে যাওয়া দেখলে
অার ৫টা ছেলের হার্টবিট বেড়ে যায়, অামার বাকি বান্ধবীদের গা জ্বলে যায় হিংসায়।অাবৃতি জানি, ড্রাইভিং
জানি, অামার অনেক গুণের মধ্যে অারেকটি গুণ অামি ভালো গান করি।অার অামার কিনা এমন এক বেকুবের
সাথে বিয়ে ঠিক করা হয়েছে, যে মায়ের কথায়, পাত্রী না দেখে হ্যাঁ বলে দিয়েছে।কিছুতেই না,
অামি কিছুতেই অামার ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে এমন গাঁধাকে বিয়ে করতে পারি না।অামি প্রথম শ্রেণির
একজন অফিসার হবো।অথবা কলেজের টিচার হবো।টিভি টকশোতে অামায় ডাকা হবে।
গোলাপী রংয়ের জর্জেট শাড়ি পরে অামি অামাদের ইউনিভার্সিটির এক ফাংশানে গান গেয়েছিলাম।
সেই ফাংশানের পর অামি মিনিমাম ১০০টা ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছি।
সেলিব্রিটি লাইফ হবে অামার।এই স্বপ্ন জলে যেতে দিবো না অামি।এখনি বিয়ে করতে পারবো না।
কিন্তু,
বাবা তাঁর অতি পছন্দের ছেলের মাকে কথা দিয়ে ফেলেছেন।
অামি অবশ্য জুনাইদ সাহেবকে দেখিনি। টেক্সট রিপ্লাইয়ের জন্য ওয়েট করলাম।পুরো
রাত চলে গেলো, জবাব নেই।শালা…
মেসেজ দেখেইনি নাকি??
সকালে একরাশ মন খারাপ নিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম।
মাই গড! ১০টা বাঁজে!
মা স্কুলে, বাবা অফিসে।একা বাসায় অামার পড়াশোনা
ভালো হয়!কিন্তু না, টেক্সট রিপ্লাই না পেয়ে পুরামন বিরক্তিতে ভরে অাছে।তাঁর চেয়ে বরং
লোকটার সাথে সরাসরিই কথা বলে অাসি।একটু স্মার্ট হয়ে গেলাম।যেনো অামাকে ছাতার
পাঁতা মেয়ে না মনে হয়…
জুনাইদের অফিসের রিসিপশানে গিয়ে পড়লাম বিপদে,
–ম্যাম, অাপনার নাম?
–রুমু!!
–অাপনি স্যারের কি হন??
–অামি স্যারের কিছুনা।এমনি দেখা করতে এসেছি।
–ম্যাম, এনি রেফারেন্স??
সাহস কি লোকটার!!অামার কাছে রেফারেন্স চায়???
অারে হাঁদারাম, তোর বস অামারে বিয়ে করার জন্য নেতানেতি করে পড়ে অাছে…
অামি মেজাজ কন্ট্রোল করলাম!রিসেপশানে দাঁড়িয়ে অামি জুনাইদ সাহেবকে ফোন করলাম,
–হ্যালো, অামি দেখা করতে অাসছিলাম!
–কে অাপনি??
শালার বেটার সাহস দেখো, অামারে জিগায় অামি
কে!!অারে গর্ধভ তোর মাথা,..
—অামি রুমু!
সে টুক করে ফোন কেটে দিলো।
অামি অাবার রিং করলাম।ধরলো না…
অামি রিসেপশানে, অাবার কথা বলতে গেছি,
–এঁই রুমু…
পিছন থেকে ডাক শুনে ফিরে তাকালাম।রিসেপশা নের লোকটা উঠে দাঁড়ালো, ইনিই তাহলে জুনু বাবু।
পড়নে হালকা ধুসর শার্ট, ঠান্ডা চেহারা, কি সুন্দর চোখ!
ছেলেটা অাসলেই হ্যান্ডসাম!
নিজে চলে এসেছে অামাকে রিসিভ করতে..
–অামি অনেকক্ষণ হলো, এসেছি(একদম মিথ্যে করে বললাম)!
–ইয়ে মানে সরি, সরি অাসলে..অফিসে কেউ
জানেই না তো এখনো..অামাকে অাগে ফোন দিতেন..
মোবাইল হাতে নিয়ে
ভদ্রলোক অামতা অামতা করতে করতে হাত থেকে মোবাইল ফেলে দিলেন।
–রুমু ম্যাডাম, অাপনি কিছু মনে না করলে, অামার বাইরে
কোথাও বসি?? ইয়ে মানে অফিসে…
ওওওও বুচ্ছি, অফিসে বসলে তোর ইজ্জত যায়,
অামাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বাইরে দামি রেস্টুরেন্টে নিয়ে টোপ গেলাবি।এ অামি কিছুতেই হতে দিবো না।
অামি শক্ত গলায় দৃঢ়ভাবে বললাম,
–না, অামি অাপনার অফিসেই বসবো।অাপনার কেবিন যেনো কোনদিকে??
উনি অামাকে উনার কেবিনে নিয়ে গেলেন, যাবার সময় অামাকে সামনে নিয়ে নিজে পিছনে হাটতে লাগলেন..
কেবিনে বসালেন।
—কিছু বলি???
—নো থ্যাংকস!
ভদ্রলোক টেবিলের কাগজপত্র ঠিক করতে গিয়ে, উনার পানির গ্লাসটা ফেলে সব ভিজিয়ে ফেললেন।
পানি মুছতে গিয়ে কলমদানিটা ফেলে দিলেন…
এইটা তো দেখি মহাগাধা!! এই লোক কি করে এত
বড় কোম্পানি সামলায় কে জানে??
হুহহহহ, এই বাবার তুখোড় ছেলে।জিরাফের মত লম্বা।
এই লেবেন্ডুস!! অামি সোজা টপিকে চলে গেলাম।
–অামি অাসলে অাপনাকে এখন বিয়ে করতে
পারবো না।অামার সময় নেই।
–জি অাচ্ছা!
–অাপনি ম্যামকে একটু বলে দিয়েন বুঝিয়ে।
–জি, জি বলবো।
গাধাটা এমনভাবে জি জি বললো যেনো, মনে হলো এটা একটা বিশেষ সুসংবাদ।
গাধাটা অামায় গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলো। অফিসের সবাই বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে দেখলো।
অামি গাড়িতে উঠে বসলাম।জুনাইদও অামার পিছে পিছে গাড়িতে উঠে বসলো।
অামি তো অবাক।
— জুনাইদ সাহেব, অাপনি কি কোথাও যাবেন?? নামিয়ে দিবো??
–জি??? জিঁ না..জিব কামড়ে বললেন,
ইয়ে মানে ভুল করে উঠে পড়েছি…
অাসলে অাপনাকে দেখে অামার সব তালগোল পাকিয়ে গেছে।
সর্বনাশ, বলে কি??
এই মহাবলদকে বাবা চয়েস করেছে…
–ওকে ফাইন, উঠেছেন যখন বসে থাকুন।নামার দরকার নেই, অফিসের সবাই উপর থেকে কৌতুহলী
চোখে দেখছে, নামলে অাবার কি না কি ভাবে!!! অামি সামনেই অাপনাকে নামিয়ে দিবো।
গাড়িতে জুনাইদ মাথা নিচু করে বসে থাকলো।কপাল বেয়ে টুপ টুপ করে ঘাম পড়ছে।ঘেমে শার্ট
ভিজে একাকার। গাড়িতে ফুল এসি।অাশ্চর্য!! অামি একটা কফিশপে গিয়ে থামলাম।
–অাপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?? অাপনি যেতে
পারবেন তো?? অাপনার গাড়ি কোথায়?? ফোন দিন ড্রাইভারকে।
–অাসলে মোবাইল অফিসে ফেলে এসেছি।ভুল
করে গাড়িতে উঠে পড়েছি তো!! অামি রিক্সায় চলে যাবো।
–অামার মোবাইল থেকে ফোন দিন।
–ইয়ে মানে, গাড়ির চাবি সাথে নিয়ে চলে এসেছি।
অামি হতবাক।একটা মানুষ একটা মেয়েকে দেখে এত নার্ভাস হয় কি করে??
–অাপনার কি অানইজি লাগছে??
—জি জি না…
–অামাকে না দেখেও বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলেন কেনো???
–দেখেছি তো, অাপনাকে।
–সে তো ছবির দেখা।
—অাপনার ইউনিভার্সিটিতে দেখেছি।বেশ কয়েকবার দেখেছি।অাপনি কি না কি ভাবেন তাই সামনে যাইনি!
অাপনাকে ১ম দেখার পর পুরো ২দিন অামার মাথা ঝিম ঝিম করছিলো।রাতে ইনসমনিয়া হয়ে গেলো,
ঘুমোতে পারিনা, খেতে পারিনা…একটানা কয়েকদিন অাপনাকে না দেখতে পেলে অামার শরীর খারাপ
হয়ে যায়।গা কাঁপিয়ে জ্বর চলে অাসে… অাপনাকে অাজ সামনে থেকে দেখে সব এলোমেলো হয়ে গেছে..অামার বোধহয়
জ্বর চলে এসেছে…রুমু, অাপনি বললে অামি অপেক্ষা করতে রাজি অাছি, কিন্তু তাতে অামি সত্যিই
অসুস্থ হয়ে পড়বো বোধহয়..
শুনে অামি হতভম্ব!
–জুনাইদ সাহেব, অাপনার ম্যামকে কিছু বলতে হবেনা।যা বলার অামিই বলবো।
সেদিন সন্ধ্যায়ই জুনাইদের সাথে অামার অাখত হওয়ার
কথা ঠিক হলো, কিন্তু অামার কি যে হলো, অামি বাবাকে সোজা বিয়ের কথাই বলে ফেললাম। তারপর অনেকদিন…
অামার অার সেলিব্রিটি হওয়া হলো না! কিন্তু অামি এখন একজনের কাছে সেলিব্রিটি।অামাকে দেখলে
একজন এখনও ভীষণ নার্ভাস হয়ে যায়।অামার হাত ধরলে তাঁর সমস্ত শরীর কেঁপে উঠে!অামি মন
খারাপ করলে তাঁর নাওয়া খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। সে অবশ্য অামাকে বুঝতে দিতে চায় না।

জুনাইদের কাছে অামি পৃথিবীর সবথেকে বড় সেলিব্রিটি…..

 

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত