প্রেম পাক আরেকটু

প্রেম পাক আরেকটু

বাসের থ্রি-সিটটার একদম জানালার দিকে বসেছিল মেয়েটি, ছেলেটি মাঝে এবং আমি ধারে৷ দেখে মনে হল সদ্যবিবাহিত দম্পতি! বয়স কতই বা হবে, মেয়েটির হয়ত এখনও আঠারো হয়নি বা সদ্য আঠারোর গন্ডী পেরিয়েছে! ছেলেটির সদ্য ওঠা গোঁফ নিখুঁত ভাবে কামানো৷

আমি ধেড়ে খোকা, মন দিয়ে তাদের কথাবার্তা শুনছি(কি করব! পাশে বসে অনর্গল প্রেমালাপ করে চলেছে, না শুনে থাকা যায়)!

কথাবার্তা শুনে যেটুকু মনে হল, ছেলেটি রাজমিস্ত্রীর কাজ করে! গাজনের উৎসবে এখন কাজ বন্ধ, তাই শ্বশুরবাড়ি চলেছে নতুন বৌকে সাথে নিয়ে! আরও যেটা বুঝলাম, প্রেম করে বিয়ে নয়, বিয়ে করেই প্রেম! আহা…মন ভরে গেল৷
কথাবার্তার একটা পর্যায়ে মেয়েটি ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে কপট অভিমানে বলে উঠলো,

—কত করে বন্নুম, জিনসের প্যান পত্তে আমাকে ভাল্লাগেনি! আমার কুনু কথাই শুনবেনি! জোর করে পরাল! কেমন সব চিপে ধরে রেখেছে! ভাল্লাগেনি আমাকে!

ছেলেটি মেয়েটির আলগা হাতটা মুঠো করে ধরে বলে উঠলো,
—কত সুন্দর লাগচে জান তমাকে! কাপড় ত ঘরে পরই, বাইরে ব্যারালে এরকম পত্তে হয়৷ ভাল্লাগে!
মেয়েটি হঠাৎ আদরে গলে গেল,
—হুঁউউউ…ভাল্লাগে না ঘড়ার ডিম!
ছেলেটির কনফিডেন্স তুঙ্গে,

—নাগো! সেই সিন্যামার মেইছ্যানাগুলানের মত লাগে! ঘরে কি আর বাপ মায়ের সামনে পরবে? বাইরে বেরিচি বলেই ত, নাহালে কি আমি বলতুম!

মেয়েটি হঠাৎ ভীত হরিণীর মত সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে,

—ঘরকেই ত যাচ্চি! আমার বাপ এগদম এইসব বেভুঙ্গি জামাপ্যান পছন্দ করেনি! নাইটিই পত্তে দেয়নি! ইসকুল যেতুম কাপড় পরে! এরকম পশাকে দেগলে রেগে গসগস করবে!

শাড়ি, কাপড়, জিন্স আর ভালবাসা মেখে বাস তার নিজের ছন্দে চলেছে, চলেছি আমরাও! মেয়েটার খোলাচুল, বাতাসে উড়ে এসে ঝরণার মত গড়িয়ে পড়ছে ছেলেটার কমদামি সানগ্লাস পরা চোখেমুখে! মেয়েটা তার অবাধ্য চুলগুলো দুই কানের পাশে আটকে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টার মাঝে একটু ইতস্থত করে বলল,

—আমি যে চুলটা একটু ছোট করে কেটেচি, মা জানে নাকি?
ছেলেটি মুচকি হেসে বলল,

—না না! মাকে বলিনি! তমাকে লিয়ে বিউটিপাল্লার গেইলুম বলে ত মা জানেনি! মা বলছিল ‘কুথা গেইলি তরা সন্দাব্যালায়’! আমি তখন বল্লুম যে ‘ফুচকা কিন্তে গেইলুম’!

মেয়েটি ছেলেটির হাত থেকে নিজের আঙুলগুলো ছিনিয়ে নিয়ে কপট রাগে বলে উঠলো,
—এ বাবা! তুমি মাকে বলে দিইচ আমরা ফুচকা খেইছিনুম বলে?
ছেলেটির হাসিমুখ অমলিন, জোর করে মেয়েটির আঙুলগুলো নিজের মুঠোবন্দী করে ভরসা জোগালো,

—মা কিছু বলবেনি গো! মা শুদু বলল, সন্দাব্যালা কেউ ফুচকা খায়! উসব অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে পেট ভরালে রাত্তে ভাত খাবার ইচ্ছা থাগবেনি! মা জানেনি তুমি চুল কেটেচ বলে!
মেয়েটি যেন সম্পূর্ন নিশ্চিন্ত হতে পারলোনা,

—বাপেরঘর যেয়ে ভাল করে কিলিপ দিয়ে এঁটে রাখতে হবে! আমার মা ত কিছু বুইতে পারবেনি, কিন্তু ছোটবুনটা বিরাট ঢ্যামণা! পড়াশুনা করে মরেনি ত! সারাদিন সেজেগুজেই ঘুরে, সে ঠিক বুইতে পেরে যাবে চুল কেটেচি বলে! আর বাপ যদি এগবার জান্তে পারে, থাইলে রক্ষা রাগবেনি আমার!

একটা স্টপেজে বাসটা থামার সাথে সাথে আমলকি নিয়ে হকার উঠে এল৷ ছেলেটা দুটো আমলকির প্যাকেট কিনে, মেয়েটার হাতে মশলা আমলকি দিয়ে নিজে মশলাবিহীন আমলকির প্যাকেট ছিঁড়ে ফেলল!

আমার নির্দিষ্ট স্টপেজের ঠিক আগের স্টপেজ একটু বড়, একটু বেশি কোলাহল, বেশি মানুষজন ওঠানামা করে! তাই প্রতিটি বাসই এখানে মিনিট পাঁচদশেক রেস্ট নিয়ে নেয়! আমিও মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম পরের স্টপেজে নেমে যাওয়ার!

থেমে থাকা বাসের জানালা দিয়ে পাশেই একটা ছোট্ট জামাকাপড়ের দোকান দেখা যাচ্ছে! আমলকির টুকরো দাঁতে কাটতে কাটতে মেয়েটি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দোকানের দিকে! দোকানের সামনে তিনটে নাইটি, দুটো বাচ্চা মেয়ের জামা, দুতিনটে বাচ্চা ছেলের জামা আর একটা শাড়ি বাতাসে দোল খাচ্ছে৷ সেইদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে মেয়েটি ছেলেটিকে বলে উঠলো,

—ওই দেখঅ! ঐ যে গো, হলুদ পারা নাইটিটা! দেখতে পাচ্চ? ঐ যে গো, বাঁদিকেট্টা! এই রঙের নাইটিগুলা আমার বিরাট পছন্দ, ভাল্লাগে৷ ওরকম একটা নাইটি একজন পরে! কে বল দিখিনি?

ছেলেটি গভীর চিন্তা করেও উত্তর খুঁজে না পেয়ে কিঞ্চিত বিরক্ত হয়ে বলল,

—যা বাবা! কে মেইছ্যানা কি নাইটি পরে, আমি কি করে জানব! আমি কি লোকের বউগুলানের দিকে হাঁ করে তাকি থাকি নাকি?

মেয়েটি ছেলেটির পেটে চিমটি কেটে খিলখিল করে হেসে উঠলো,
—বাবা গো! কুনু মেইছ্যানার দিকে তাকায়নি! এগবারে সাধুপুরুষ!
এবার দুজনেই হেসে উঠলো!
ছেলেটি হঠাৎ কি মনে করে মেয়েটিকে বলল,
—তুমি বস ত একটু, আমি এই যাব আর এসব!
মেয়েটি ভীষণ চিন্তিত হয়ে উঠলো,

—তুমি নামবে? ক্যানে? নামতে হবে ক্যানে? আমি একলা থাকতে পারবনি! বাস যদি ছেড়ে দ্যায়!
ছেলেটি মেয়েটিকে নিশ্চিন্ত করে বাস থেকে নেমে গেল! আমার আর মেয়েটির মাঝে শুধু একটা সীটের ব্যবধান! আড়চোখে দেখলাম, মেয়েটি তার একটি হাত দিয়ে সেই ফাঁকা সিটটি ঘিরে রেখেছে! ছেলেটি নামার সময় বার বার বলে দিয়েছে তাকে, সাবধান করেছে, ‘সিটটা ঘিরে রাখবে! কেউ য্যামন না বসে পড়েনি’! তাই মেয়েটি নিজের হাত দিয়ে ছেলেটির সিট ঘিরে রেখেছে! এমন সময় বাসের ইঞ্জিন স্টার্ট হল! সাথে সাথে মেয়েটি ভীষণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো! একবার জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে ছেলেটিকে খোঁজার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর বাসের গেটের দিকে ঘুরে উঠে দাঁড়ালো! বাসটি চলতে শুরু করার সাথে সাথে ছেলেটি উঠে এল নিজের সীটে! ওদিকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো মেয়েটি,

—কুথা গেইলে বল দিখিনি? আমি কি ভয় পেয়ে গেইলুম! বাসটা যদি ছেড়ে পালি যেত! আমি এগলা এগলা কি কত্তুম….

হাজারো অভিযোগের উত্তরে ছেলেটি একটা কোল্ডড্রিংক্স এর বোতল মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দিল! ঠান্ডা পানীয়ের স্পর্শে বাকি সব অভাব অভিযোগও ঠান্ডা ততক্ষনে৷ মেয়েটি বোতলটি হাতে নিয়ে আদুরে গলায়,
—তুমি খেইচ? আগে তুমি খাও, তারপরে আমি খাব!

ছেলেটি বোতলের ছিপি খুলে জোর করে মেয়েটির মুখে গুঁজে দিতে গেলে আরেকপ্রস্থ আনন্দের পরিবেশ গড়ে উঠলো! আর ঠিক এমন সময় ছেলেটি একটি পলিথিনের প্যাকেট মেয়েটির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

—লাও! এইটা তমার৷
মেয়েটি নিজের কোলে ঠান্ডা পানীয়ের বোতলটি রেখে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে পলিথিনের প্যাকেটটি খুলতেই উপচে পড়ল একমুঠো ভালোবাসা! একটু আগে দোকানের সেই হলুদ নাইটি, এখন মেয়েটির কোলে! প্রবল বিস্ময়ে মেয়েটি হতবাক, ছেলেটির মুখে বিশ্বজয়ের হাসি!

এত ভালবাসা সহ্য করা যায়!! আমার স্টপেজে থমকে দাঁড়ানো বাস থেকে আমি নামলাম নিতান্ত বাধ্য হয়েই! স্কুলে ঢোকার মুখে অনুভব করলাম, প্রায় চল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রাটাও আজ যেন গোটা শরীরে গোলাপের পাপড়ি হয়ে ঝরে পড়ছে৷

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত