আজ রাতে আমার ঘুম আসছে না। ঘুম না এলে গান শোনা আমার ছোটবেলাকার অভ্যাস। এই পর্যন্ত পনেরো টা গান শুনে পার করে দিলাম। তবু দুচোখের পাতায় এক ফোঁটা ঘুম নিয়ে আসতে সক্ষম হলাম না। আজ সন্ধ্যায় মা যখন আমাকে বললো আগামীকাল আমাকে অরুণিমাদের বাড়ি যেতে হবে আমার বিয়ের নেমন্তন্ন পত্র নিয়ে তখন থেকেই আমি কেবল অরুণিমা কে নিয়েই ভাবছি। আমার নিরবচ্ছিন্ন ভাবনা জুড়ে অরুণিমা পারদের মতো উঠানামা করছে। কাউকে ভুলে যেতে চাইলে তার স্মরণ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হয়। তবেই সেই বিশেষ মানুষের উপর থেকে মন মস্তিষ্কের দিক পরিবর্তন করাটা অনেকটা সহজ হয়ে দাঁড়ায়। আমি কয়েকশো বার চেষ্টা করে অনেক বছর ধরে অরুণিমা কে আমার চিন্তা জগৎের বাইরে বের করতে পেরেছি। কাউকে ভুলে থাকার প্রাণপণ প্রচেষ্টার মাঝে বন্ধু মহলের সন্ধ্যাকালীন এক আড্ডাই আমি যখন হো হো করে হেসে উঠি তখন আমি নিজেকে দেখে অবাক হয়ে যাই। মনে মনে নিজেকে বলি “বাহ! এভাবেই জীবনে মুভ অন করতে হয় রে ভাই।” পরক্ষণই আমি একটা মানসিক স্বস্তি পাই। এই ব্যাপার টা বিরাট একটা সফলতা ভেবে দিন শেষে আমি নিজের কাছে বারবার উপস্থাপন করেছি। অরুণিমা কে ভুলে থাকার অভ্যাস গুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত করেছি। সফলও হয়েছি অনেকবার।
কিন্তু এতগুলো বছর পর যখন আবার নতুন করে সেই মানুষটার কথা পরিবারে আলোচনা হয় তখন সত্যি কথা বলতে মনে হয় কেন যে হৃৎপিন্ড গুলো বুকের বাঁদিকে রাখা হয়েছে ঠিক বুঝি না। এত এত বছর ধরে যার প্রতি হৃদয় ভর্তি ঘেন্না পুষে রাখি তার দুটো ভালো গুণ কিমবা তার সঙ্গে কাটানো দুটো ভালো মুহূর্ত সামনে আসতে না আসতেয় তার প্রতি পুষে রাখা সব ঘেন্না, বিদ্বেষ যেনো নিমিষেই বিশুদ্ধ জল হয়ে যায় শুধুমাত্র মানুষ টাকে প্রকৃত ভালোবাসার সংজ্ঞায় ভালোবাসা হয় বলে। নতুবা এমনটা হত না। অরুণিমার প্রতি আমার অভিমান গুলোও যেনো আজ সেভাবে বিন্দু বিন্দু জল হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের বাড়ির রান্নাঘরে, ছাদে, সিঁড়িতে, আমাদের প্রত্যেকটা ঘরের বিছানার কোণায় কোণায়, জানালার গ্রীলে ছোটবেলাকার অরুণিমার স্পর্শ লেগে আছে। অরুণিমা ওর মায়ের সঙ্গে আমাদের বাড়ি এসে আমার মন চুরি করেছিল। কিন্তু আফসোস সে মন আমি আজও রিটার্ন পেলাম না। প্রাপ্তবয়স্ক হলে আমি কতবার যে ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম “অরুণিমা আমাকে ছেড়ে কোনদিন কোথাও যাবি না তো?” ও বলতো “না রে পাগল। কোথাও যাবো না। তোর সঙ্গেই থাকবো।” আসলে যারা বলে কখনওই ছেড়ে যাবো না, তারাই তাড়াতাড়ি ছেড়ে চলে যায়, বিষাদের কারাগারে উল্টোদিকের মানুষ টাকে চিরস্থায়ী ভাবে বন্দী করে। আমাকেও অরুণিমা এভাবেই বন্দী করেছিল। সেবার অরুণিমার বিয়েতে মা বাবা সকলেই গেছিলো যাইনি কেবল আমিই। কেনই বা যাবো? সে তো আমার কেবল বন্ধু ছিল না। আমার প্রেমিকাও ছিল। আর প্রেমিকার বিয়েতে প্রেমিক উপস্থিত থাকার দুঃসাহসিকতা দেখাতে যায় না। আমিও দেখাইনি। বিয়ের দুদিন আগে চোখে জল নিয়ে বললো মামার পছন্দ করা পাত্র কে বিয়ে করতে হবে। কারণ ওর বাবা মারা যাবার পর থেকেই ওর মামা ওদের পরিবারের সব দায়িত্ব একলাই সামলিয়ে এসেছে এযাবৎ। তাই ওকে ওর মামার কথা রাখতে হবে। আমিও চেঁচিয়ে বলেছিলাম “আর আমি কি ফ্যালনা নাকি? আমার ভালোবাসা টা ফেরত দে এখুনি। কেনই বা যে তোর মায়ের সঙ্গে আমার মায়ের বন্ধুত্ব টা হয়েছিল! নাহলে না তুই আমাদের বাড়ি বেড়াতে আসতিস আর না আমি তোকে ভালোবাসতাম। চলে যা এখান থেকে আর কখনওই আমার সামনে আসবি না।” প্রকৃতপক্ষে আমি সেদিন অরুণিমা কে চলে যেতে বলিনি আমার কাছে থাকতে বলেছিলাম। অরুণিমার চলে যাবার পর সেদিনই মনে মনে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি আর কখনওই বিয়ে করবো না। তারপর অনেকগুলো বিয়ের প্রস্তাব কে আমি গুরুত্ব দিইনি কিন্তু এবার আর না করতে পারিনি। এসব কিছু ভাবতে ভাবতে ভোর হয়ে এলো।
অরুণিমা দের বাড়িতে সোফায় বসে বসে ভাবছিলাম সাহস করে এখানে আমি চলে এলেও এখানে আমার আসাটা কিন্তু একদম উচিত হয়নি। এখানে বাবাকেই পাঠালে বরং ভালো হতো। ভিতরে ভিতরে আমার যে অরুণিমার প্রতি দুর্বলতাটা এখনো কাটেনি বাড়ি থেকে বের হবার আগে ঠিক ঠাহর করতে পারিনি। নাহলে কখনই এখানে আসতাম না। আমাকে অরুণিমা ভালো না বাসতে পারে কিন্তু আমি তো আজও অরুণিমা কে ভালোবাসি। আমাকে দেখে অরুণিমার মাঝে কিছু প্রতিক্রিয়া না হলেও ওকে দেখে আমার ভিতরে যে ঝড় বইছে সে কথা আর কাকে বলি? সাত বছর পর অরুণিমা কে দেখছি তবু মনে হচ্ছে গত সন্ধ্যাবেলা তেয় বোধহয় ওর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল। চেহারার পরিবর্তন আমার চোখে মোটেও ধরা পরছে না। ওর চোখের দিকে তাকালেই আমার চোখদুটো ওর চোখে আটকে যাচ্ছে বারবার। ঠিক আগের মতো। আমি আমার অনিয়ন্ত্রিত চোখদুটো কে সরিয়ে নিয়ে পকেট থেকে মোবাইলটা বিনা কারণেই বের করলাম। মোবাইলটা হাতে নিয়ে কি যে করছি নিজেই জানি না। ঠিক তখনই অরুণিমার শাশুড়িমা বললেন, ” আমার তো ভীষণ ইচ্ছে ছিল আমার ছেলেটাও এখানেই কিছু একটা করুক। অত দূরে ছেলেটা থাকে আমার প্রাণটাও ওখানে পড়ে থাকে। অরুণিমা কেও একলা একলা থাকতে হয়।”
আমি সহানুভূতি দেখিয়ে বললাম “মায়ের মন তো! এইটুকু মনে হবে। এগুলো আসলে দুশ্চিন্তা।”
তারপর অরুণিমার দিকে তাকিয়ে বললাম ” মা-ই তো একমাত্র সারাজীবন সন্তানের পাশে থাকে। সন্তানের কথা ভাবে। নাহলে এই পৃথিবীতে কে কার কথা ভাবে বলুন তো? সবাই আসলে স্বার্থপর। কেউ কথা রাখে না।” আমার কথা গুলো শুনে অরুণিমা মাথাটা নিচু করে নিল। আমার গলাটা একটু ভারী হয়ে আসছিল। অস্বস্তি হচ্ছিল ভিতরে ভিতরে। তারপর অরুণিমার রাখা গ্লাসের জলটা হাতে তুলে নিলাম। গ্লাসের অর্ধেক জলটা পান করে বললাম “জানেন মাসিমা বিয়েতে সেরকম কাউ কেই বলা হয়নি। আসলে বলতে গেলে আমার বিয়ে করবার কোন ইচ্ছেই ছিল না। ভেবেছিলাম সারাটা জীবন একা একাই এভাবে কাটিয়ে দেবো। কী হবে এসব বিয়ে সাদি করে? কিন্তু আমার মা যিনি আপনার মতোই এতটা মিষ্টি, আমাকে প্রচণ্ডরকম ভালোবাসে, আমাকে বলেছে বিয়েটা আমি যেনো করে নিই। কারণ ওনার মনে হয় উনি পৃথিবীতে আর বেশীদিন থাকবেন না। এসব কথা শুনে আমার মাথাটা কি আর ঠিক থাকে বলুন তো??” অরুণিমা আবার আমার দিকে একবার তাকালো। তারপর অরুণিমার শাশুড়িমা বললেন – “একদম ঠিক করেছো বাবা। হ্যাঁ মায়ের কথা রাখতে হয়। পৃথিবীতে আপন বলতে মায়েদের একমাত্র সন্তানরাই তো আছে। ওদের কে নিয়েই আমাদের পৃথিবী।”
বরফের শরবত আমার ভীষণ পছন্দ। সে কথা অরুণিমা জানে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা দোকান গুলোতে কত দফা যে আমরা বরফের শরবত খেয়েছি সে কথা কে আর মনে রাখে?
অরুণিমার দেওয়া বরফের শরবত টা আমি খাইনি। আমি কেবল জলের গ্লাস টাই হাতে তুলে নিয়েছিলাম। কারণ অরুণিমার হাতের তৈরি শরবত টা আজ আমার গলা দিয়ে একদম নামবে না। কারণ ওটা কেবল শরবত নয়, শরবতের সঙ্গে আমাদের আগেকার বছরগুলোর আবেগ জড়িয়ে আছে। এরপর আমি ব্যাগ থেকে বিয়ের কার্ডটা বের করে অরুণিমার শাশুড়ির হাতে দিয়ে বলি “এই নিন মাসিমা। বাড়ির সকলেই আসবেন। আর জানেন? এখানে আসার সময় মা আমাকে বললো অরুণিমার শাশুড়িমা যেনো আমাদের পর না ভাবেন। নিজের ছেলের বিয়ে ভেবেই যেনো আসে। তাই অরুণিমার সঙ্গে আপনি না এলে মা ভীষণ কষ্ট পাবে।”
– হ্যাঁ বাবা নিশ্চয় যাবো। আর আমি অরুণিমার কাছে শুনেছি তোমার মা অরুণিমাকে ছোটবেলায় কতোই না ভালবাসতো! স্নেহ করতো! অরুণিমার বিয়েতে তোমার মায়ের সঙ্গে আমার একবার সাক্ষাতও হয়েছিল। উনি সত্যিই ভীষণ সুন্দর একটা মনের অধিকারী।
আমি মুচকি হেসে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াই। তারপর অরুণিমার দিকে একবারও না তাকিয়ে মাসিমাকে বলি “তাহলে আসছি। ভালো থাকবেন। বিয়ের তারিখটা অবশ্যই মনে রাখবেন।” বলেই আমি হনহন করে হেঁটে বাড়ির বাইরে বের হয়ে আসি। ততক্ষণে আমার চোখদুটো ভিজে গেছে। দমিয়ে রাখা যন্ত্রণাটা সতেজ হয়ে বুকের বামদিকে হাহাকার করে উঠছে। হেলমেট টা মাথায় দিয়ে বাইকে স্টার্ট দিতে গিয়ে বুঝতে পারি বাইকের চাবিটা ভুল করে ভিতরে ফেলে রেখে চলে এসেছি। বাইক থেকে নেমে হেলমেট টা খুলে পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছি আর দেখি অরুণিমাও বাইরে বেরিয়ে এসেছে। অরুণিমাকে দেখে আমার চোখ থেকে গড়গড় করে জল বেরোতে শুরু করেছে। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম “চাবিটা ভিতর থেকে এনে দে অরুণিমা। আমাকে ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি।” অরুণিমা কোন কথা না বলে আমার কাছে এগিয়ে আসে। কাছ থেকে আমি দেখি অরুণিমারও চোখে জল। তারপর আমার হাতে বাইকের চাবিটা দিয়ে অরুণিমা বলে “তোর বিয়েটা অনেক আগেই করবার দরকার ছিল। তোর যদি মনে হয় আমি তোর খেয়াল রাখি না, তোকে ভালোবাসি না, তাহলে তুই ভুল ভাবতিস। আমার মনে তোর জায়গাটা কেউ কোনদিন নিতে পারবে না বুঝলি?” আমি কোন কথা বলিনি। শুধু চোখ দুটো বারবার মুছছিলাম। অরুণিমার কথা বলা শেষ হলে নিজের চোখদুটোও অরুণিমা মুছে নেয়। তারপর আমার জামার বুক পকেটে কি যেনো একটা জিনিস রেখে বলে “সাবধানে যাস। আর শরবত টা তো খেতে পারতিস। পাশের বাড়ির বরফ নিয়ে শরবত টা তোর জন্য তৈরি করেছিলাম। আমাদের ফ্রিজটা দুইদিন ধরে কোন কাজ করছে না।”
বাইক চালিয়ে অরুণিমার বাড়ি থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে চলে এসেছি। সামনে একটা পেট্রল পাম্প দেখে থেমেছি বাইকের জন্য দু লিটার পেট্রল কিনবো বলে। হঠাৎ অরুণিমার কথা মনে আসতেয় আমার জামার বুক পকেটের কথাটা মনে পড়ে গেলো। তারপর জামার পকেটে হাত রেখে দেখি অরুণিমা আমার হবু স্ত্রীর একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি দিয়েছে আর উল্টোদিকে লিখেছে “আমি আর কাকিমা মানে তোর মা দুজনে মিলে তোর জীবন সঙ্গী পছন্দ করলাম। আমাকে ভুলে মন দিয়ে সংসার করিস এবার।” লেখাটা পড়ে আমি একটা আত্মতৃপ্তির হাসি হাসলাম তারপর বলে উঠলাম “আমি তোকে ভালোবাসি বলেই এবার আমি তোকে ভুলে যাবো।”
[সমাপ্ত]