বিয়ের পরের দিন সকালে শ্বাশুড়ি বলল,”বৌমা তোমার গয়না গুলা আমার কাছে দিয়া যাও । ছোটো মানুষ কই না কই রাখবা বাড়ি ভরা মেহমান হারাইয়া যাইব। তার তে ভালো নিয়া আহো আমি আমার আলমারিতে রাইখা দেই।”
সরলমনা মিনু শ্বাশুড়ির হাতে নিজের গহনা গুলো দিয়ে আসলো। কিছুদিন পরে মিনু বাবার বাড়ি যাওয়ার সময় গহনা গুলো চেয়েছিলো কিন্তু শ্বাশুড়ি নানা অযুহাত দেখিয়ে আর দেয় নি।
প্রায় ৩ বছর পরে ননদের বিয়েতে দেখে ননদের গায়ে তার গহনার মত গহনা। গহনাগুলো দেখেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো।এই গহনাগুলো ছিলো তার মায়ের শেষ চিহ্ন।ছল ছল চোখে পূরনো স্মৃতি ভেসে উঠলো মিনুর চোখের সামনে। মৃত্যুর আগে মিনুর মা মিনুর হাতে গহনা গুলো দিয়ে বলেছিলো,” মা রে সবাই সবটা আদায় করে নিয়েছে তোর জন্য সামান্য এইটুকুই রেখেছিলাম নে এইটা রাখ আর পারলে আমায় মাফ করিস আমি তোর ভবিষ্যৎ এর জন্য কিছুই করে যেতে পারলাম না”।
বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করার কিছুদিন পরই মিনুর মা স্ট্রোক করে আর তার পরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।মায়ের মৃত্যুর পরই বাবা তড়িঘড়ি করে মিনুকে বিয়ে দিয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাচলো। আর যেচে পড়ে কখনো মিনুর খোঁজ নেয়নি।তবে মিনু মাঝে মাঝে তার বাবার কাছে যায় স্বামী কে নিয়ে। শত হলেও পরের ছেলে তার ও ইচ্ছে হতে পারে শ্বশুর বাড়ি বেরানোর। প্রত্যেক টা ছেলেই তার কল্পনার ক্যানভাসে রঙ তুলিতে খুব সুন্দর, অমায়িক হাসি দেওয়া,টানাটানা চোখ, লম্বা কেশ, ঠোটের কোণে তিল থাকা একটা মেয়ের ছবি আকেঁ। আর শ্বশুর বাড়ি বেরানোর ইচ্ছে পোষন করে। মিনু দেখতে অপরুপ সুন্দরী না।
সে দেখতে শ্যাম বর্নের আর খুব বেশি লম্বাও না।তার স্বামীর সব সময় আক্ষেপ ছিলো তার স্ত্রী কুৎসিত,সে এমনটা চায় না। এমনিতেই সৌন্দর্য দিয়ে মিনু তার স্বামীকে সুখি করতে পারে নি তাই শ্বশুর বাড়ি বেড়ানোর অধিকার থেকে মিনু কখনো তার স্বামীকে বঞ্চিত করতো না। বাবার পাশের মহিলাকে সহ্য করতে না পারা শর্তেও সে মাঝে মাঝেই বাবার বাড়ি যেত। মিনুর বড় ভাই দুইজন আগেই বিয়ে করে আলাদা হয়ে গিয়েছিলো আর তারা মিনুর কোনো খোজ নিতো না।সবাই সংসার নিয়ে ব্যস্ত। “বউমা হিমেল কে ডেকে দেও”,শ্বাশুড়ির ডাকে ধ্যান ভাঙে মিনুর।চোখের জল মুছে তৎক্ষনাত চলে যায় তার বরকে ডাকতে।
ঘরে এসে দেখে হিমেল ঘরে নেই। ছাদে যেয়ে দেখে তার বর পাশের বাড়ির ভাবির হাত ধরে খুব সুন্দর করে হেসে হেসে গল্প করছে। মুচকি হেসে মনে মনে বলে উঠলো মিনু,”কখনো আমার সাথে দেখি না এভাবে কথা বলতে। আমাকে হয়ত শুধু রাতেই প্রয়োজন তাই রাতে আমার সাথে কথা বলে “।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছাদের দরজায় কড়া নেড়ে অন্যদিকে তাকিয়ে মিনু বলে, আপনাকে মা ডেকেছে।” আর নিঃশব্দে ছাদ থেকে নেমে আসে। শাড়ীর আচল দিয়ে চোখের নোনাজল মুছে মুচকি হেসে ননদের পাশে গিয়ে ননদ কে খাইয়ে দেয়।এই বাড়ীতে এই একটা মানুষই মিনুকে বোঝে আর ভালোবাসে।মিনু ও খুব আদর করে ননদকে।তাই ননদকে বলে “শোনো বোন, বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে পড়াশুনা বন্ধ করে দিও না। নিজের একটা পরিচয় আছে তা মজবুত করো। নিজেকে এমন ভাবে প্রস্তুত করো যেনো তোমায় সবাই সম্মান করে। তোমায় অবহেলা করার আগে অন্তত একবার ভাবে। নিজেকে এমন ভাবে প্রস্তুত করো জেনো একটা কিছু পছন্দ হলে স্বামীর মুখের দিকে তাকাতে না হয় যে সে কিনে দিবে কিনা?”
সব কথা গুলো এক নিঃশ্বাসে বলে দ্রুত সেই জায়গা থেকে সরে যায় মিনু।কিছুদিন আগে বরের ড্রয়ার গুছাতে যেয়ে চোখে পড়েছিলো এক ডিভোর্স পেপার আর আজ পাশের বাড়ির ভাবি। সব কিছু নিয়ে ভেবে সেইরাতেই ছোট্ট একটা চিরকুট লিখে বরের বালিশের পাশে রেখে বেড়িয়ে পরে এক অজানা গন্তব্যে মিনু। এইটুকু বলেই থামলো মেয়েটি।পাশে বসে থাকা ডাক্তার বাবু জিজ্ঞাসা করলো, “তারপর!চিরকুটে কি লিখা ছিলো”।
একটু দম নিয়েই মেয়েটি আবার বলা শুরু করলো।
চিরকুটে লিখা ছিলো,”মা মারা যাওয়ার পর থেকেই আমি খুব একা হয়ে গিয়েছি।আমি সবার সংসারেই আগাছার মত ছিলাম।শেষ ভরশা ছিলে তুমি। তোমায় আকড়ে বাচতে চেয়েছিলাম তবে তুমি আমায় কখনো মন থেকে মেনেই নেও নি,টাকার প্রয়োজন ছিলো তাই আমায় বিয়ে করেছিলে। ভালোবাসবে আর কি?
তাই আজ তোমার জিবনের আগাছা পরিষ্কার করে দিয়ে চলে গেলাম। চলে গেলাম এক অজানা গন্তব্যে। তবে কি জানো!আমি কখনো তেমন কিছু চাই নি। জিবনে চেয়েছিলাম একটু ভালোবাসা। আসলে অভাগী যেইদিকে যায় সেই দিকই পুড়ে যায় আর তাই আজ তোমায় মুক্তি দিয়ে গেলাম। ড্রয়ারে তোমার আনা ডিভোর্স পেপার এ সাইন দিয়ে দিয়েছি।”
ইতি তোমাদের সংসারের জঞ্জাল এইটুকু বলেই চুপ হয়ে গেলো মেয়েটি। মেয়েটি আজ চাঁদ দেখছে।চাদেঁর আলোয় মেয়েটির মাঝে একটি অন্য রকম সৌন্দর্যতা লুকোচুরি খেলছে। আর খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে একমনে কি জেনো ভাবছে! প্রায় চার বছর পাগলা গারদে থাকার পর কিছুদিন যাবত মেয়েটি সুস্থ।তার দায়িত্বে থাকা ডাক্তার মানে আমি তাকে খুব ভালোবাসি। আর তাই আমি আমার মনের কথা বলতে আর মেয়েটির আবদার রাখতেই মেয়েটিকে নিয়ে রাতে নদীর পাড়ে এসেছি। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে প্রান ভরে শ্বাস নিচ্ছে মেয়েটি।
এই চার বছরে আমি মেয়েটিকে যত দেখেছি তত অবাক হয়েছি। চার বছর আগে এক রোড অ্যাকসিডেন্ট এ মেয়েটি মাথায় আঘাত পায় আর মানসিক ভাবে খুব ডিস্টার্ব থাকায় তার মেমোরি লস হয়।আমি নিজেই তাকে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক করেছি।তবে ও ওর স্মৃতি শক্তি ফিরে পাওয়ার পর নিজের বিষয়ে কিছুই আমায় জানায় নি।আজ হঠাৎ বিকেলে বললো, “ডাক্তার বাবু!আমায় রাতে একটু নদীর পাড়ে নিয়ে যাবে?”ওর কথায় আমি অনেকটা অবাক হয়েছি কারন আগে আমি হাজার চেষ্টায় ও রুম থেকে বের করতে পারতাম না ।নদীর পাড়ে আসার পরই বললো, ডাক্তার বাবু একটা গল্প শুনবে!আমি ওর কথা রাজি হয়ে যাই ও আমায় উপররে গল্পটি শোনায়।
ওহ বলাই হয় নি আমি মেয়েটিকে মধুমিতা বলে ডাকি।কারন,আমি ওর নাম জানি না। এমনকি সুস্থ হওয়ার পর ও ওর পরিচয় দিতে ইচ্ছুক ছিলো না তাই আমি মধুমিতা বলেই ডাকি। কিছুক্ষণ আকাশ দেখার পর হঠাৎ মধুমিতা আমায় বললো, “ডাক্তার বাবু ভালোবাসো!” মধুমিতার কথা শুনে আমি হঠাৎ চমকে উঠলাম।
মধুমিতা : চমকে না উঠে উত্তর দেও।
আমি : হুম
মধুমিতা : আচ্ছা চলো নৌকায় উঠি।
আমি:হুম
মধুমিতা : গল্পটা শুনে একবার ও জিজ্ঞাসা করলে না আমি কার গল্প বললাম
আমি : হুম
মধুমিতা : কি হুম,হুম শুরু করলা?
আমি : নাহ,কিছু না। আচ্ছা চিরকুট লিখে বেড়িয়ে যাওয়ার পর কি আর মিনুকে তার বর খুঁজে পেয়েছিলো?
মধুমিতা :বাকিটুকু আমার থেকে তুমি নিজেই ভালো জানো।
আমি :ওর কথা শুনে আমি একটু ভড়কে গেলাম। কাপাঁ গলায় জিজ্ঞাসা করলাম মানে?
মধুমিতা : মানে মিনু আর কেউ নয় আমি নিজেই।
আমি : ওর কথা শুনে চমকে গেলাম । এই মেয়েটা আর ও ৭ বছর আগে মাকে হারিয়ে জীবন যুদ্ধে লড়াই করেছে!
মধুমিতা :কি ভাবছো, ডাক্তার বাবু?
আমি : বিয়ে করবে আমায়!!!! মধুমিতা ছলছল চোখে তাকালো।
আমি সেইদিন বুঝি নি মধুমিতার মনের আকুতি। আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার মধুমিতাকে। আমি জানতাম না আমার মধুমিতা একটু আশ্রয় খুঁজেছিলো। সেই রাতে আমি যখন মধুমিতাকে আঁকড়ে ধরেছিলাম আমার বুকের সাথে তখনি ও আমায় বলেছিলো, ডাক্তার বাবু! এই বুকে এত শান্তি কেনো বলতে পারো?
আমি : নাহ
মধুমিতা : কারন,এইটা শুধু মধুমিতার জন্য বরাদ্দ করা তাই।
আমি : ওর কথা শুনে হাসলাম।
মধুমিতা : ডাক্তার বাবু! এই বুকে এত সুখ কেনো? জানোনা আমার কপালে সুখ সয় না?
আমি : চুপ, মধুমিতা। এখন থেকে আর বাজে কথা বলবে না।
মধুমিতা : আচ্ছা ডাক্তার বাবু! আমার অনুপস্থিতি তোমায় কতটা কষ্ট দিবে?
আমি : এইসব বলছো কেন?
মধুমিতা : কারন, আমি আজ শান্তিতে ঘুমাবো। তোমার এই বুকে আর কেউ আমায় ডাকলেও আমি উঠবো না। আর কেউ আমায় তোমার থেকে আলাদা করতে পারবে না। কেউ বলবে না, এই মেয়ে আমার ছেলের জীবন থেকে সরে যাও? কেউ বলবে না এই মেয়ে আমার ভালোবাসা আত্নসাৎ করেছিস। দেখিস তুই কখনো সুখি হবি না। জানো ডাক্তার বাবু তোমার মত কেউ না আমায় কখনো ভালোবাসে নি।এই ৪ বছর তুমি আমার জন্য অনেক কিছু করেছো । তবে সবটাই ভুল। সেইদিন যদি আমায় তুলে না আনতে রাস্তা থেকে আজ তোমায় কষ্ট পেতে হতো না।তুমি শ্রেয়াকে বিয়ে করে নিও। ও তোমায় খুব ভালো…
আমি :হঠাৎ করেই খুব জোড়ে একটা শ্বাস নিলো আমার মধুমিতা। নিরব শ্রোতা হয়ে শুধু শুনলাম মধুমিতার সব কথা। আমি কোনো মতো নৌকা ঘাটে এনে হসপিটালে নিয়ে গেলাম মধুমিতাকে ।কিন্তু পারলাম না আমি আমার মধুমিতাকে বাঁচাতে পারলাম না।
আমার সাথে যাওয়ার আগে মধুমিতার শরীরে পয়জন ইনজেকশন এর মাধ্যমে পুশ করে দিয়েছিলো শ্রেয়া তা আমার জানা ছিলো না।শ্রেয়া আমার বান্ধুবী ছিলো। চলে গেলো আমায় ছেড়ে মধুমিতা?
গৃহ ত্যাগ করেছিলাম আমি। মা কে ছেড়ে চলে এসেছিলাম দূর দেশে। মা এখনো আমায় মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে বলে, সে মধুমিতাকে আমার জীবন থেকে সরে যেতে বলেছিলো আমার ভালোর জন্য। আর সেই আমি নাকি নিজের ভালো না বুঝে তাকে ভুল বুঝে বসে আছি।
আমি ভাবি!একা একা ভাবি! মেয়েটি কি পেলো জিবনে? আজ ও রাতের আকাশে আমি আমার মধুমিতাকে খুঁজি । আজও নদীর পাড়ের নৌকায় রাতে আমি একা ভেসে বেড়াই। অনুভব করি আমার মধুমিতা আমায় আঁকড়ে ধরে ঘুমাচ্ছে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে।