মুচকি হাসি

মুচকি হাসি

কেউ প্রেম করেনি, পঁচিশ বছর কাটলো কেউ প্রেম করেনি।
১৯ বছরে মেডিকেলে চান্স, ২৪ বছরে এমবিবিএস পাশ আর ২৫ বছরে ইন্টার্ন শেষ করেও একটা প্রেমিকা জোটাতে পারিনি। প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি আমাকে একবারও সুদৃষ্টি দেয়নি।

বলা যায় হুট করেই পরিবারের ফিক্সিং করা ম্যাচে আমার জীবনের নতুন ইনিংস শুরু হয়।

বাসর ঘরে ঢোকার আগেও ভীষণ আফসোস হচ্ছিল, ”ইস, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এরেন্জ ম্যারেজ! চিনিনা, জানিনা হুট করেই বিয়ে, আর এই কয়েক মিনিটের পরিচয়ে বিয়ে করা মানুষটার সঙ্গে কাটাতে হবে সারাটা জীবন।”
এসব ভাবতে ভাবতে আমার চোখ দিয়ে গড় গড় করে পানি বেরিয়ে আসলো।

তারপরও মেনে নিলাম। সত্যি বলতে দেয়ালে পিঠ ঠেঁকে গেলে মেনে নিতেও হয়। জীবন জীবনের মত করে চলবে।
তারপর নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম, “আমার বাবা আমার মাকেও চিনতো না। তাদেরও ওই কয়েক মিনিটের পরিচয়ে বিয়ে। তারা তো অনেক সুখী কাপল। আমরাও তাহলে তাদের মত সুখী হবো।”

 

বিশ্বাস করুন, এই সিচুয়েশনে আমার বাবা-মাই আমার একমাত্র মোটিভেশন ছিলো।

যাহোক ঘরে ঢুকেই দেখি বউ অঝোর ধারায় কাঁদছে। এরেন্জ ম্যারেজে মেয়েদের এই কান্নাটা ঐতিহ্যবাহী। চোখের পানি মুছতে মুছতে মেয়েটা দুই দুইটা টিস্যুর বক্স খালি করে ফেলেছে।

মেয়েদের জীবনটা আসলেই এমন স্যাক্রিফাইসের। বড় হতে না হতেই অপরিচিত একটা মানুষের সঙ্গে ঘর করতে হয়, হুট করেই অপরিচিত একটা বাড়িতে গিয়ে উঠতে হয়, নিজের বাবা-মাকে ছেড়ে আসতে হয়। সেজন্য মেয়েদের এ কান্নাটা একদমই যৌক্তিক।

আমি বউয়ের চোখের পানি আঙ্গুলে মুছে দিয়ে যতটুকু পারি সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে বললাম, “দেখো, মেয়েদের জীবনটাই এমন। বাবা-মাকে ছেড়ে অন্য একটা সংসারে আসতে হয়। এই দেখো আমার মা তার বাবা-মাকে ছেড়ে এসেছে, তোমার মা তার বাবা-মাকে ছেড়ে এসেছে। আমাদের মেয়ে হলে সেও আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। আর কেঁদো না প্লিজ।”

বউ এবার আরো জোরে কাঁদতে কাঁদতে বলা শুরু করলো, “এসব তো আমি মেনে নিতে পারবো। কিন্তু রাসেলকে আমি কীভাবে ভুলে থাকবো? ওর সাথে আমার সাত বছরের রিলেশন। আব্বু আম্মু কিছুতেই রাসেলকে মেনে নিতে চায় না। ওর মত করে আমাকে কেউই ভালোবাসতে পারবো না। ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।”

বউ অনবরত কেঁদেই চলছে। ওর কান্না দেখে আমি ভীষণ আপ্লুত। জীবনে কোন মেয়ের ভালোবাসা পাইনি। আজ খুব কাছে থেকে দেখলাম একটা মেয়ে কাউকে ভালোবাসলে তাকে কাছে পাবার জন্য কী আপ্রাণ চেষ্টা করে।

বউ তখনো কেঁদেই চলছে। কাঁদতে কাঁদতে হাত জোর করে বলছে, ”আপনি প্লিজ আমাকে রাসেলের কাছে নিয়ে চলেন। ওকে ছাড়া আমি মরে যাবো। আপনার পায়ে পরি প্লিজ, প্লিজ আমাকে নিয়ে চলেন।”
আমার চোখ অশ্রুতে আবারও ঝাঁপসা হয়ে গেল। ভাবলাম সব হয়তো ঠিক হয়ে যাবে একসময়।

যাহোক বউকে বিছানায় ঘুমাতে দিয়ে আমি মেঝে শুয়ে পড়লাম। তারপর সারারাত আমরা দুজনের কেউই ঘুমাতে পারিনি। এক মিনিটও না।

পরদিন সকালে বউকে রাসেলের হাতে তুলে দিলাম। ওদের দুজনকে তখন পৃথিবীর সবথেকে সুখী একটা কাপল মনে হচ্ছিল। ওরা দুজন দুজনকে কাছে পেয়ে এতটা খুশি ছিলো যা কোন সাহিত্যিকও বর্ণনা করতে পারবে না। ওদের বিয়ে দিতে পেরে আমিও ভীষণ খুশি।

যাহোক ওদেরকে পাশাপাশি সিটের দুটো টিকিট গিফট করলাম। ওরা এখন কক্সবাজার যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর, প্রথম আলোর শিরোনাম-

“নববধূকে তাঁর প্রেমিকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে উদারতার পরিচয় দিলেন সাঈদ।”
কালের কন্ঠের শিরোনাম-

“নিজের বউকে তাঁর প্রেমিকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন আবু আল সাঈদ।”
আমাকে নিয়ে অনেক অনেক মানুষ ফেসবুকে স্টাটাস দেয়া শুরু করলো। সবাই আমার মহানুভবতা, উদারতা নিয়ে ব্যাপক প্রশংসা করতে লাগলো।

হ্যাস ট্যাগ দিয়ে অনেকেই লিখলো ‘ভালোবাসা জিন্দাবাদ’, ‘মানবতা এখনো মরে নি’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি নিউজগুলো পড়ছি, মুচকি মুচকি হাসছি আর বিবেককে প্রশ্ন করছি, ”আচ্ছা, আমার বউয়ের যদি এই বড় ধরনের মৃগী রোগ না থাকতো তাহলে কি পুরো দেশ আজ আমার এই উদারতা, এই মহানুভবতা দেখতে পেত? মানুষ কি আজও বলতো মানবতা এখনো মরেনি?”

যাহোক এসব ভাবনা ছেড়ে ঘুমানোর জন্য রেডি হচ্ছি। সারারাত মেয়েটার শরীরে কী খিঁচুনী আর বার বার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল। অনেক ঝামেলায় আল্লাহ আল্লাহ করে রাতটা পার করছি। সারারাত ঘুমাতে পারেনি, এক মিনিটও না।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত