বিয়ের প্রথম প্রথম আমার শাশুড়ি আমাকে খুব কম পছন্দ করতেন কারণ একটাই আমি সিলেটী মেয়ে বলে, আমার শ্বশুর দীর্ঘসময় সিলেটে ছিলেন সরকারি চাকুরী করতেন। আমার বাবার সাথে তাই আমাদের বাড়িতে একটু আসা যাওয়া করতেন। শ্বশুরের ইচ্ছে ছিল একটা সিলেটী মেয়ে বিয়ে করে নিবেন ছেলের জন্য তাই আমার সাথে বিয়ে দেন। প্রথমে আমার শ্বাশুড়ির অমত ছিল এ বিয়েতে কারণ উনার ইচ্ছে ছিল উনার বোনের মেয়ের সাথে আমার স্বামী তন্ময়ের বিয়ে দিবেন এ নিয়ে দুজনের মধ্যে দা কুমড়া যুদ্ধ হয়েছে। একপর্যায় আমার শ্বশুর রাজি করান শাশুড়ি কে এ তাই বিয়ে হয়।
বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির কথা শুনতে প্রচুর সমস্যা হতো বুঝতাম না তারওপর বিয়ে হলো স্বমাীর নতুন চাকুরী তাই সবাই ঢাকাতে চলে আসে আর আমার শ্বশুরও অবসর নেন চাকুরী থেকে। ঢাকাতেই স্যাটেল হোন। আমি ওদের ভাষাটা বুঝতে পারতাম না কিরকম টান দিয়ে কথা বলে, আর আমার স্বামীরা অরিজিনাল বিক্রমপুরী। সব মিলিয়ে কথা বলে ঢাকাইয়াসহ কিরকম গজা খিঁচুড়ি ভাষাটা বাট সিলেটী ভাষা এতবছরেও রপ্ত করতে পারেনি। আমার স্বামী অনেকটা সাদামাটা ছেলে কথা কম বলে কিন্তু জ্ঞানী মানুষ। বিয়ের পর আমার স্বামীর পিছনে লাগতাম ও একটু ভুল করলে বলতাম আমি ভালো না তো তোমার ওই নোয়াকাইল্লা মেয়ে ভালো আমায় বিয়ে করছ কেন। আমার খালা শ্বাশুড়ির স্বামীর বাড়ি নোয়াখালী তাই সুযোগ বুঝে ওকে পঁচানি দিতাম আর ও রেগে গোল মরিচের মতো লাল হগো। আমি চলে যাবো সিলেট বাবার বাড়ি। এটা বলার পর তন্ময় রেগে যেতো মুলত ওকে রাগানোর জন্য এসব বলতাম।
ওর অফিসে কোন মেয়ে ওর সাথে ছবি তুলে আপ দিলে আর ওকে ট্যাগ দিলে ওকে বলতাম আমরা সিলেটী মেয়ে এত গায়ে পড়ি না বাপরে বাপ এখানকার মেয়েরা এত গাঁয়ে পড়া জানতাম না। আজব মেয়েরা ও আমায় বলতো তনিমা তুৃমি কি আমায় সন্দেহ করো। আমি বলতাম একটু একটু এভাবে খুনসুটি করতাম দুজনে। তখন ও রেগে যেতো আর ওর রাগি চেহারাটা দেখতে আমার খুবই ভালো লাগতো। বিয়ের পরই শ্বশুর শাশুড়ি যখন ঝগড়া শুরু করতো তখন ওদের ম্যানেজ আমায় দিতে হতো। আমার শাশুড়ি একটু রাগি তবে উনার ভেতর অনেক নরম। বিয়ের পর সমস্যায় পড়লাম আমি তো তিনবেলা ভাত খাই কিন্তু ওরা সকালে হালকা নাস্তা খায়। আমার শ্বশুর আমাকে বলতেন তুমি সকালে ভাত খেও কিন্তু আমি খেতাম না।অভ্যাস তো করতে হবে আমি তো একটা নতুন জায়গায় আসছি।
আমার শাশুড়ি এত চা খান না কিন্তু শ্বশুর আমার হাতের চা ছাড়া খান না। আমি নিজে চা খাই না কিন্তু শ্বশুর কে ঠিকই চা করে দিতাম। চা টা খেয়ে শ্বশুর বলতেন তুমি এতো ভালো চা করতে পারো তোমার শাশুড়ি পারে না।এটা শুনে শাশুড়ি রেগে যেতেন। আমি তন্ময়কে বলতাম আমরা সিলেটীদের চা, পান ছাড়া চলেই না। তোমাদের মতো না। আর বিয়ের পর সিলেট থেকে ভালো কিছু চা পাতা কিনে আনি। স্বামী রেগে গিয়ে বলতো হইছে আর সিলেটীদের গুণগান করতে হবে না।
একদিন কি হলো রান্না করতে গিয়ে হাত পুঁড়িয়ে ফেলি। শ্বশুর এবং শাশুড়ি মা ডাক্তারে নিয়ে যান তন্ময় অফিসে ছিল এসে খুব উত্তেজিত হয়ে গেল ওর ধারণা আমার অসাবধানতার জন্য এমন হয়েছে। পুরো এক মাস কোন কাজ করতে পারিনি এই সুযোগে শাশুড়ি মা অনেক সেবাযত্ন করেছেন নিজের মায়ের মতো খেয়াল রেখেছেন।
যাক হাত পুড়ে যাওয়ায় শাশুড়ি যে আমায় নিজের মায়ের মতন ভালোবাসেন সেটা জানা হলো। চুলে বেনি করে দিতেন তেল দিয়ে দিতেন এমনকি কাপড়গুলো ধুয়ে দিতেন। আমাকে প্রায়ই বলতেন ছেলেদের একটু টাইট দিবা বউ মা নয়তো কন্ট্রোল করা যায় না। এরপর থেকে বউ শাশুড়ি মিলে বিকেলবেলা ঘুরতে যেতাম পার্কে ছুটির দিনে খুব সকালে হাঁটাহাটি করতাম। একদিন হলো ঘুম থেকে উঠে তন্ময় আমায় খুঁজে না পেয়ে খুঁজতে লাগলো।শাশুড়ি মায়ের পায়ের ব্যথা তাই উনি যাননি। যখন ফিরে এলাম তন্ময় তো রেগে গিয়ে তুলকালাম কান্ড ঘটালো ওর ধারণা আমি সিলেট চলে আসছি।
বেচারা এমনটাই ভাবা শ্রেয় আসলে আমি প্রায়ই ওকে থ্রেট দিতাম তুমি আমায় সময় দেও না আমি বাপের বাড়ি চলে যাবো যাক কোনভাবে ম্যানেজ দিলাম। তারপর অন্য একদিন বিকেলবেলা পার্কে বসে ফুচকা খাচ্ছিলাম আমি আর শাশুড়ি মা।শ্বশুর মসাই দুমাস হলো নিজের গ্রামে গেছেন তাই আমাদের ঘুরাঘুরি একটু বেশী হচ্ছে। কখন যে অবেক্ষণ হয়েছে বুঝতে পারিনি। বাসায় এসে দেখি তন্ময় বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ও তো তীক্ষ্ণ দৃষ্ঠি দিয়ে তাকিয়ে আছে। রেগে গিয়ে বললো কালই তোমায় বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিবো।
আমি তো মহাখুশি কতদিন যাইনি সিলেট। শাশুড়ি মা রেগে গিয়ে বললেন বউ মা একা যাবে কেন তুইও কয়দিন থেকে। যাক শাশুড়ি মায়ের বকুনি খেয়ে তন্ময় নিয়ে আসলো সিলেট। আগের দিন রাতে ট্রেনে আসছি পরের দিন আবার রাতে ও চলে যায়। মা বা অনেক বার বলেছে ওকে থেকে কিন্তু থাকেনি। ও যাবার সময় আমায় বলে এতো জামাই আদর আমার কপালে নেই চাকুরীজীবী মানুষ বলে কথা। আমি চলে যাচ্ছি তনিমা তুমি যতদিন ইচ্ছে থেকে যাও তুমি না বলা পর্যন্ত নিতে আসবো না।আমার প্রতি তোমার কোন টান নেই একরকম অভিমান নিয়ে চলে গেল।
ও চলে গেল মাত্র তিনটা দিন বাপের বাড়ি আসছি কিন্তু মনে হচ্ছে তিনবছর। বিয়ের পর একটা দিনও তন্ময় কে ছাড়া থাকিনি,ওর প্রতি টানটাও যেন বেড়ে চলেছে। ওর শূন্যতা অনুভব করছি ওকে ফোন দিলে ঠিকমতো কথা বলে না। শাশুড়ি মাও চলে গেলেন উনার বাপের বাড়ি। এদিকে তন্ময় বাসায় একা না জানি কি খাচ্ছে। পাঁছদিনের মাথায় বাবা কে নিয়ে চলে গেলাম ঢাকায়। আসলে বিয়ে হলে বুঝা যায় স্বামীর প্রতি টান কতটুকু বিয়েটা না হলে টের পেতাম না। রাতে যখন তন্ময় বাসায় ফিরলো দরজাটা প্রথম আমিই খুলে দেই।আমাকে কতখানি খুশি হয়েছিল তা আমি ওর হাসিমুখ দেখেছি। কি ব্যাপার তনিমা ফিরে এলে যে বলে জড়িয়ে ধরলো।
আমি আসবো না কেন স্বামীর প্রতি টানকতটুকু বুঝতে হবে তো। তন্ময় আমাকে জড়িয়ে ধরলো সত্যি তনিমা তুমি আমায় এত ভালোবাসো আমি বুঝতে পারিনি। হইছে এখন ন্যাকামো ছাড়ো বাবা ভেতরে আছে ফ্রেশ হয়ে বাবার সাথে কুশল বিনিময় করো। আচ্ছা বাবা আমি ফ্রেশ হচ্ছি তুমি আমায় খেতে দাও। যাক এতদিনে ও বুঝতে পেরেছে ওর প্রতি আমার টান কোন অংশে কম নয় বিয়ে না হলে আমিও বুঝতে পারতাম না স্বামী স্ত্রীর প্রতি টান কতটুকু থাকে।