জীবনের সেরা উপহার

জীবনের সেরা উপহার

হীরা আমার এক ইয়ার জুনিয়র। আমাদের কলেজের সাথেই স্কুল। আমি পড়তাম এইসএসসি ফার্ষ্ট ইয়ারে। আর হীরা পড়তো ক্লাস টেনে। মেয়েটি একদিন পিছন থেকে আমাকে ডাক দিলো…

–রাতুল ভাইয়া..?

আমি দাড়িয়ে গেলাম। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি একটি বোরকা পরা মেয়ে..! শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। সে বললো…

–আমি হীরা, ক্লাস টেনের পড়ি। আপনার ফোন নাম্বারটা কি পেতে পারি ? আমার ফোন ছিলনা। আর তখন কারো কাছে ফোন থাকা মানে সে বড়লোকের সন্তান। আমি খুব সহজ ভাবেই উত্তর দিলাম…

–সরি আমার তো কোনো ফোন নেই..!
–আপনি ফোন ইউজ করেননা..?
–ফোন ইউজ করিনা বললে ভুল হবে, আসলে আমার মত ছেলের ফোন ইউজ করার এবিলিটি নেই..!
–ও আচ্ছ ঠিক আছে।
–ফোন নাম্বার কি দরকার..?
–না ঠিক আছে.. আসি…!

আমি কিছু বলে ওঠার আগেই মেয়েটি চলে গেল। তারপরের দিন মেয়েটি আবার আমার সামনেএসে দাড়ালো। হাতে একটি নোকিয়া ১১০০ মডেলের মোবাইল বক্স। মেয়েটি কিছুটা সংকোচের সাথে বলল…

–যদি কিছু মনে না করেন, আপনাকে আমি এই মোবাইলটা দিতে চাই..! মেয়েটি মোবাইলের বক্সটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিল আমি অবাক হলাম! এই মেয়ে আমাকে মোবাইল দিবে কেন..? আমিতো মেয়টিকে চিনিওনা..! আমি বললাম…

–কেন দিবেন..? আর আমিও বা নিব কেন..? মেয়েটি আরো সংকোচের সুরে বললো

–ভালবাসি বলে দিলাম। আর ভালবেসে কেউ কিছু দিলে নিতে হয়..! আর আমাকে আপনি নয় তুমি করে বললে খুশি হব..। আমার সারা শরীর যেন ঠান্ডা হয়ে গেল এক নিমিষেই। এই প্রথম কোনো মেয়ে আমাকে ভালবাসার কথা বলছে..! আমি কি করবো, ভেবে পাচ্ছিলাম না..! বললাম..

–সে না হয় তুমি করে বললাম। কিন্তু মোবাইলটা আমি নিতে পারবোনা। সরি…!

আমি চলে আসলাম। মেয়েটি সেখানে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলো। মেয়েটি সম্ভবত খুব কষ্ট পেল। আমি চাইনি মেয়েটি আমার দারা কোনো কষ্ট পাক। আমি সেদিন বাসায় গিয়ে একটুও শান্তি পাচ্ছিলামনা। কেন যেন মনে হলো অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি মেয়েটির প্রতি। আমি বুকে হাত রেখে বলতে পারি, আমি বুঝার পর থেকে সজ্ঞানে কাউকে কোনোদিন আঘাত বা কষ্ট দেইনি। তারপরের দিন কলেজে গিয়ে মেয়েটিকে বুঝিয়ে বললাম…

–হীরা, তুমি হয়তো গতকালকে আমার কথায় মনে মনে ভীষন কষ্ট পেয়েছো। দেখ, আমি খুবই গরীব পরিবারের সন্তান। আমার মা বাবার অনেক স্বপ্ন আমাকে নিয়ে। আমি প্রেম ভালবাসার ধারে কাছেও যেতে চাইনা..! আমাকে ক্ষমা করো প্লিজ..! মেয়েটি খুব সহজেই বলে দিল..

–না আপনি তো কোনো অন্যায় করেননি। আপনি কেন ক্ষমা চাইবেন..? বরং আপনি আমাকে ক্ষমা দিবেন। আর একটা কথা, আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো সারাজীবন।

এরপর হীরার সাথে আমার দেখা হতো কিন্তু কথা হতোনা। এইসএসসি পরীক্ষার আগে বাবা ভীষন অসুস্থ্য হয়ে গেল। পরীক্ষার জন্যও টাকা দরকার। আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমার পরীক্ষা দেওয়া হবেনা। আগে বাবাকে সুস্থ্য করতে হবে। তাই বাবার রিক্সাটা নিয়ে আমিই রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লাম। একদিন বাসায় এসে আমি জানতে পারি, মায়ের কাছে আমার কোন মামা বেশ কিছু টাকা দিয়ে গেছে বাবার চিকিৎসা করাতে এবং আমার পরীক্ষার খরচ চালাতে। বাবাকে চিকিৎসা করালাম, বাবা সুস্থ্য হল। আমিও ভালমতো পরীক্ষা দিলাম। এবং আল্লাহর রহমতে ভাল রেজাল্ট করলাম। আমি অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর কয়েকটা টিউশনি নিজ থেকেই আমার হাতে এসে ধরা দিল। আল্লাহর রহমতে অনার্স মাষ্টার্স শেষ করতে আমার কোনো কষ্টই হলোনা।

কেমন যেন খুব সহজেই হয়ে যাচ্ছিল সব। মাষ্টার্স শেষ করার পর ভাল একটা চাকরিরও অফার চলেআসে। চাকরিতে জয়েন্ট করলাম। এবার বিয়ে করার পালা। মা বাবাও মাথা খেয়ে ফেলছে বিয়ে করার জন্য। তখন আমার মনে পরে গেল হীরার কথা! আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম হীরার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমি আর ওদিকে পা বাড়ালাম না। একটু কষ্ট পেলাম। হীরা বলেছিল আমার জন্য অপেক্ষা করবে। যাকযা হবার হয়েছে। আল্লাহ হয়তো চাননি যে আমার সাথে হীরার বিয়ে হোক। মা বাবাকে বললাম মেয়ে দেখতে। তারা আগে থেকেই মেয়ে ঠিক করে রেখেছিল। আমি মেয়ে দেখতে যাইনি। বাবা মা দেখে পছন্দ করেছে, তাতেই যথেষ্ঠ। শুধু নামটা জানি। আমার হবু স্ত্রীর নাম সুরাইয়া। বিয়ে হয়ে গেল আমার। বাসর ঘরে ঢুকার আগে মা আমার হাতে বিশ হাজার টাকা দিয়ে বললো

–টাকাগুলো বৌমার হাতে দিবি..! আমি অবাক হয়ে বললাম…
–কিসের টাকা..?
–দিলেই বুঝবি..!

আমি বাসর ঘরে ঢুকতেই বৌ আমাকে সালাম করতে এগিয়ে আসলো। আমি তাকে থামিয়ে খাটে বসালাম। টাকাটা দিয়ে বললাম.. “মা তোমাকে দিতে বললো!” মনে হলো বৌয়ের মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল “আমি তো ফেরত নেবার জন্য টাকা দেইনি..!” আমি অবাক হয়ে বললাম “ফেরত মানে..!?”

বৌ তখন বলতে লাগলো “আমি তোমাকে মিথ্যে বলবোনা। তোমার সামনে যে বসে আছে, সে আর কেউ না, সেই হীরা। সুরাইয়া জাহান (হীরা)। যাকে তুমি সাত বছর আগে ফিরিয়ে দিয়েছিলে। আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম, তোমার অপেক্ষায় থাকবো। আসলে আমি তোমার সাদাসিধে মনটাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম প্রচন্ডভাবে। আমি আমার বাবাকে তোমার কথা বলেছিলাম.. ‘জীবনে কিছু চাইনা বাবা। শুধু রাতুলকে চাই।’

বাবা আমার চাওয়াটাকে মল্যায়ন করেছিলো। একদিন তোমাকে রিক্সা চালাতে দেখে আমি অবাক হই। এবং তখনই তোমার বাসায় এসে তোমার মায়ের কাছে সব জানতে পারি। মাকে আমার ভালবাসার কথা খুলে বলি। তারপর আমার বাড়ি গিয়ে বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে তোমার মায়ের কাছে টাকাটা দিয়ে যাই, এবং বলি যেন তোমাকে না বলে। আমি জানতাম তুমি জানলে টাকাটা রাখবেনা। সেই টাকাই আজ মা ফেরত দিল। তুমি অনার্সে ভর্তির পরে যে টিউশনি ধরেছিলে, সে সবগুলো আমারই ঠিক করা। তুমি মাষ্টার্স পাশ করার পর বাবাকে বলে তোমার চাকরির ব্যাবস্থা করে দিই..! এসবকিছু করেছি তোমাকে পাবার জন্য! আল্লাহ আমার চাওয়া পুরোন করেছেন..! আমি আর কিছু চাইনা, তোমার ভালবাসা চাই।”

বৌয়ের কথা শুনে আমার দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো। বললাম “আমি স্বপ্ন দেখছিনা তো! আল্লাহ আমাকে এতবড় উপহার দিবেন, কোনোদিন কল্পনাও করিনি..! বাবা মা বিয়ের কথা বললে আমি তোমার খোঁজ করতে গিয়ে জানতে পারি, তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে! কিন্তু আল্লাহ যে আমার সাথেই তোমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন তা জানতামনা। আল্লাহ্ তোমাকে আমার জীবনে পাঠিয়েছেন আমার জীবনটাকে আলোকিত করতে, আমার জীবনটাকে স্বর্গীয় করে তুলতে। সত্যিই তুমি আমার জীবনের সেরা উপহার..! আলহামদুলিল্লাহ্!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত