প্রবাস

প্রবাস

‘একি আপনি রান্না ঘরে কি করছেন?’ দুপুর ১২ টা বাজতে চললো। বিছানায় শুয়ে বই পড়তেছিলাম। রান্না ঘরের টুং টাং আওয়াজ কানে আসায় বুঝতে পারলাম নীলা রান্না করতেছে। তাই চুপি চুপি গিয়ে রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে নীলার কার্যকলাপ দেখছিলাম। হঠাৎ করেই পেছনে ঘুরে দরজায় আমাকে দাঁড়ানো দেখে উপরের কথাটি বললো। আমি মারুফ, প্রবাসে মধ্যপ্রাচ্যে থাকি। প্রতি দুই থেকে আড়াই বছর পর পরই দেশে আসা হয় প্রায় ছয় মাসের ছুটি নিয়ে। দেশে যেহেতু কোনো কাজ করতে হয়না সেহেতু এই ছুটির সময় টা পরিবারের সাথেই কাটাতে পারি। আর রান্না ঘরে যিনি রান্না করছেন, সে মানে নীলা আমার সহধর্মিণী। বেশিনা, মাসদুয়েক হবে বিয়ে নামক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছি আমরা। এই দুই মাসেই যেন দুজন দুজনের আত্মার সাথে মিশে গেছি। আমাদের বিয়েটা ছিলো এ্যারেঞ্জ ম্যারেজ, এবং পুরো গুরুদায়িত্ব ই ছিলো আমার ‘মা’য়ের ওপর।

এবার ছুটি থেকে আসার পর ই ‘মা’ কথা উঠালো যে আমাকে বিয়ে দিবে। আমি বললাম এতো জলদির কি আছে, কিন্তু না সে দিবেই। তার নাকি একা থাকতে আর ভালো লাগেনা (আমি ছোট থাকতেই আমার বাবা মারা যায়। মায়ের কাছেই আমার মানুষ হওয়া)। সব দিক ভেবে আম্মুর কথায় মত দিয়ে দিলাম৷ বেচে থাকলে তো বিয়ে করাই লাগবে, তাই তাল বাহানা করে আর কি লাভ? এরপর আম্মু যেন যুদ্ধে নামলো, মেয়ে দেখার যুদ্ধ। এই মেয়ের এই সমস্যা তো ঐ মেয়ের ঐ সমস্যা, পছন্দমতো মেয়ের খোজ পাওয়া যেন দুস্কর প্রায়।

তাই আমি জেদ ধরে বসলাম যে নেক্সট এ যেই মেয়ে কে দেখতে যাবে, সেই মেয়ের যতো সমস্যা ই থাকুক নাকেন আমি বিয়ে করবো। কিন্তু ঐ যে, মায়েরা বলেনা? যে মায়ের পেটে আমাদের জন্ম। আমরা কি আর তাদের সাথে পারি? তাই আমাকে লুকিয়ে আরও বেশ কয়েকটা মেয়ে দেখে অবশেষে নীলা কে পছন্দ করলো এবং দুই পরিবারের সম্মতিতে আমাদের দুজনকে এক জোড়ায় বেধে দিলো। গতকাল বিকেলে আম্মু নানু বাসায় গেছে, ছোট মামা নাকি অসুস্থ তাই দেখতে। আজ সকাল থেকে চুপচাপ ই ছিলাম, সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে আমি কোরআন শরিফ নিয়ে বসলাম, আর নীলা গেলো সকালের নাস্তা তৈরি করতে। এরপর দুজন মিলে নাস্তা করে আমি বসে গেলাম বই নিয়ে আর নীলা অন্যান্য কাজ করে এখন দুপুরের খাবার তৈরি করছে। বই পড়া থেকে মন উঠে যাওয়াতে ভাবলাম নীলার সাথে একটু দুষ্টুমি করি গিয়ে, কিন্তু নাহ ধরা খেয়ে গেলাম।

নীলা:- কি হলো বললেন না যে, আপনি এখানে কি করছেন?

আমি:- ‘কিছু না বলে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম এবং সেই অবস্থায় ই চুলা টা বন্ধ করে দিলাম।’

নীলা:- আবার চুলা বন্ধ করলেন কেন, হঠাৎ কি হলো আপনার।

আমি:- স্ স্ স্ স্ চুপ কোনো কথা নয়।

বলেই কোলে তুলে নিলাম। আর নীলা দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ লুকালো। পাগলি টাকে সোজা রুমে নিয়ে এসে খাটে শুইয়ে দিয়ে উপরে কাথা টেনে দিলাম। আর কানে কানে বললাম ‘আমি ডাকার আগ পর্যন্ত এখান থেকে যেন না উঠা হয়। চুপচাপ শুয়ে থাকো।

এরপর বেডরুমের দরজা টা বাইরে থেকে লক করে সোজা চলে গেলাম রান্নাঘরে। আজ আমার দিন, বউ কে ইম্প্রেস করার দিন। মু হা হা হা। দেখলাম গরুর গোস্ত রান্না করছিলো ও। যাই হোক আমার জন্য ই ভালো হলো, চুলা টা জ্বালিয়ে গোস্তের ডিশ টা একটু নেরেচেরে নিলাম। আর ফ্রিজ থেকে মুরগী টা বের করে বিরিয়ানী রান্নার প্রস্তুতি নিয়ে কাজে নেমে গেলাম। আজ আম্মু ও বাসায় নাই, নীলা ও রুমে বন্দী। আমি যা চাইবো তা ই হবে। (কালা চশমা ইমু হবে) সকালে আসলাম চাচা দুধ দিয়ে গেছিলো পাচ লিটার। সেটা দেখলাম হালকা জ্বাল দিয়ে রেখেছে। গরুর গোস্ত টা হয়ে গেলে সেটায় দুধের পাতিলা টা বসিয়ে পায়েস বানিয়ে নিলাম। মিষ্টি টা একটু কম ই দিলাম, কারন পায়েসে মিষ্টি কম হলে সেটা নীলার থেকে পুষিয়ে নিবো।

সব হয়ে গেলে সালাদ কেটে টেবিলে সুন্দর করে সাজিয়ে রুমের দিকে চললাম। গিয়ে দেখি বউটা আমার ফোনে ভিডিও গেমস খেলতেছে। তাড়া দিয়ে বললাম যেন ঝটপট গোসল টা সেরে নেয়, এই বলে ওকে টয়লেটে পাঠিয়ে নীলার জন্য কেনা নতুন শাড়ি টা বিছানায় সুন্দর করে রাখলাম যাতে ওর চোখে পরে। কাল একটু মার্কেটে গিয়েছিলাম, দেখলাম সাদা জামিনে লাল পাড়ের সুন্দর একটা শাড়ি। নীলা কে মানাবে খুব তাই নিয়ে নিয়েছিলাম। অবশ্য নীলাকে এখনো দেখাইনি। গোসল করে বেরিয়ে আসলে নিজ হাতে ওকে শাড়ি পরিয়ে দিলাম। নীলার দিকে তাকিয়ে দেখি আমার পানে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। হয়তো ভাবছে আজ এমন পাগলামি করার মানে কি, কিন্তু মানে খুজে পাচ্ছে না। শাড়ি টা পড়িয়ে নিজ হাতে সাজিয়ে দিলাম। এরপর আমিও ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসতেই নীলার প্রশ্ন?

:- কি হয়েছে আজ আপনার? আর এই শাড়ি কোথায় পেলেন।
:- কি আর হবে, কিছুই না। আর শাড়ি টা কাল নিয়ে আসছিলাম কিন্তু তোমাকে দেওয়া হয়নাই।
:- সে নাহয় বুঝলাম। কিন্তু রান্নাঘরে অমন পাগলামো করার মানে কি? আর এতক্ষণ কোথায় ছিলেন আর কি করলেন। আর আমাকে যে রান্নাঘর থেকে তুলে এনে খাটে বসিয়ে রাখলেন তা জনাব দুপুরে খাবেন কি? নাক আজ না খেলে ও চলবে।

:- আরে বাবা এতোগুলা প্রশ্ন একসাথে করলে উত্তর দিবো কি করে। আর আজ দুপুরে নাহয়তোমার মিষ্টি খেয়েই থাকলাম। (নীলার পছন্দের একটা পাঞ্জাবি পড়তে পড়তে)
:- খুউউব না? আচ্ছা একটা একটা করেই উত্তর দেন।
:- দিবো মিসেস নীলা দিবো। সব প্রশ্নের জবাব ই পাবেন। এখন আসো তোহ পাঞ্জাবির বোতাম গুলা লাগিয়ে দাও।
:- ইশ! নিজে যেন লাগাতে পারেনা। শুধু জানে ঢং করতে।
:- পারিনা বলেই তো তোমায় ডাকলাম।

আর আমার দশটা না, পাচটা না, একটা মাত্র বউ। তার সাথে ঢং না করলে কার সাথে করবো? নীলা প্রথমে চিরুনী টা নিয়ে আমার চুল গুলোকে জাত করে আসলো পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে। আমার একদম কাছে চলে আসাতে আমিও নীলার কোমরে হাত রেখে আরও কাছে টেনে নিলাম। নীলার দিকে তাকিয়ে দেখি একমনে বোতাম লাগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে যেন তার কোনো খেয়াল ই নেই। অবশ্য আমি বুঝতে পেরেছি যে এটা লজ্জার লক্ষণ, আর নীলা আমাকে ধরা দিতে চাচ্ছে না। আমিও কম কিসে? বোতাম গুলা লাগানো হলেই কোলে তুলে সোজা ডাইনিং টেবিলে নিয়ে আসলাম আর চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। টেবিলে এতো আয়োজন দেখে নীলা তো অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। আমাকে প্রশ্নই করে বসলো?

:- এগুলা কে করেছে? নিশ্চয়ই বাহির থেকে অর্ডার দিয়ে এনেছেন।
:- কেন? এমন মনে হলো কেন তোমার যে এগুলা বাহির থেকে অর্ডার দিয়ে আনিয়েছি।
:- কেন আবার! আগে তো কখনো রান্নাঘরের  আশপাশে ও দেখিনাই। আর আপনার রান্নার প্রতিভা যে আছে সেটা ও জানা নেই।
:- ওহ তাই বুঝি? তা বাহিরে যখন থাকি তখন কি আমার আরেকটা বউ আছে যে আমাকে সেখানে রান্না করে খাওয়ায়? (প্লেটে বিরিয়ানী বারতে বারতে)

:- থাকতে ও তো পারে। আমি কি সেখানকার ব্যাপারে জানি নাকি হুহ। (চোখে মুখে দুষ্টুমির ভাব এনে)
:- ওহ আচ্ছা! ঠিক আছে এবার গিয়েই বিয়ে করে নিবো। প্রতিদিন কাজ করে রান্না করে খেতে আর ভালোলাগেনা। (প্লেট টা নীলার দিকে বাড়িয়ে)
:- প্লেট দিয়ে আমি কি করবো। আর এমন ভাবনা মুখে বলা তো দূরে মনে আনলে ও পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখবো বলে দিলাম মনে থাকবে? (রেগে-মেগে একাকার)

:- জ্বী ম্যাডাম ফুলি! মনে থাকবে। আর আমি রান্না করতে করতে ক্লান্ত, কেউ যদি মায়া করে মুখে তুলে খাইয়ে দেয় তাই প্লেট এগিয়ে দিয়েছি।
:- এতো ঢং না করে মুখে বললেই তো হয় যে আমার হাতে খাবেন।
:- বুঝোই যখন, তখন আবার জিজ্ঞাস করো কেন।
:- হইছে বাদ দেন, হা করেন।

আপনার সাথে কথায় কখনো পারি ও নাই আর পারবো ও না। এই বলে আমাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। একটু পর আমিও নীলাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিলাম।

:- এই গরুর গোস্ত টা মুখে তুলে দাও।
:- হুম নিন! যত্তসব পাগলদের রেসিপি। মুরগির বিরিয়ানীর সাথে গরুর গোস্তের তরকারী।
:- আমি তো পাগল ই। তোমার প্রেমের পাগল।
:- আমিও তাহলে আপনার প্রেমের পাগলী।
:- হুম পাগলী একটা। দাও খাইয়ে দাও।

পাগলীটার মুখের দিকে তাকালেই বুঝা যায় যে কতো খুশি হয়েছে পাগলী টা। লক্ষ্য টাকা দিয়ে ও এই খুশি কেনা অসম্ভব প্রায়। পায়েস খেতে গিয়ে হলো বিপত্তি। সব ই ঠিক আছে শুধু মিষ্টি কম।

:- পায়েসে মিষ্টি কম দিয়েছেন কেন? আপনি না মিষ্টি বেশি খান। চটাস করে নীলার ঠোটে আলতো করে চুমু একে দিয়ে বললাম,
:- এখন মিষ্টি ওভারলোড হয়ে গেছে। অতিরিক্ত মিষ্টি খেলে ডাইবেটিক্স হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
:- কত্তো পাজি রে! মাথায় এই দুষ্টুমি ছিলো।
:- হিহিহি; হুম।
:- আচ্ছা আম্মু কি আপনার রান্নার প্রতিভার ব্যাপারে জানে? যে তার ছেলে এতো ভালো রাধুনী।
:- ভালো না ছাই। হুম জানে, আর আম্মুকে দিয়েই তো আমার রান্নার হাতেখড়ি। আর আগে ও মাঝে মাঝেই আম্মুকে বসিয়ে আমি রান্না করতাম আর মা ছেলে মিলে খেতাম।

:- বাহ! আম্মু আসুক, আমি আর আম্মু বসে থাকবো আর আপনি আমাদের রান্না করে খাওয়াবেন।
:- আমি কি কাজের ছেলে নাকি যে, প্রতিদিন রান্না করবো?
:- ও আমি বুঝি কাজের মেয়ে?
:- আচ্ছা বাবা আচ্ছা মুখ গোমরা করতে হবেনা। খাওয়াবো রেধে।
:- প্রমিজ?
:- পিংকি প্রমিজ।

এভাবেই হাসি খেলায় ছুটির দিন গুলো কেটে গেলো। আর আমার ও আবার ব্যস্ততার জীবনে ফিরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসলো। মন না চাইলে ও যেতে যে হবে। পুরুষ মানুষের মাথার বোঝা টা একটু বেশি ই। কিন্তু জীবন তো আর থেমে থাকেনা, জীবন জীবনের নিয়মে চলছেই। ব্যবধান পরে আমরা জীবনের সাথে তাল রেখে কতটুকু চলতে পারলাম। আর সেখানেই আমাদের স্বার্থতা কিংবা ব্যর্থতা। যদিও আমি প্রফেশনাল লেখক না। তবুও শখের বসে কিছু লিখার ট্রাই করি। অনেকদিন পর লিখায় হাত দিলাম। কেমন হয়েছে জানিনা। ভুল হলে শুধরে দিবেন। আর আমার জন্য দোয়া করবেন।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত