দেখছো এইটা কী?” হাতের ছুরিটা দেখিয়ে বলল মিতু৷
-কথা বলছো না কেন?
-কি বলবো?
-বলছিলাম যে, হাতের ছুরি টা যদি এখন টুপ করে পেটে ঢুকিয়ে দিই! কেমন হবে?
-এইসব পাগলামোর মানে নেই৷
-ভয় নেই তোমার পেটে ঢুকাবোনা৷ নিজেই নিজেকে খুন করবো!
মিতুর হাত থেকে ছুরি টা নেয়ার চেষ্টা করতেই আরেকটু দূরে সরে গেল মিতু৷ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকে বলল,
-তুমি সেই বিকেল থেকে কথা বলছোনা আমার সাথে৷
অসুস্থ শরীর নিয়ে ঘুরঘুর করছি তোমার সামনে৷ একবারও জিজ্ঞেস করেছো? অসুস্থ শরীর নিয়ে কেমন আছি আমি? মিতুর কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বললাম না আমি৷ মিতুর দিকে তাকালাম একবার৷ এখনো হাতে ছুরি টা নিজের দিকে তাক করে আছে৷ কান্না আর রাগ মিশিয়ে মুখটা ততক্ষণে রাগে লাল টমেটো হয়েছে৷ সাথে যোগ হয়েছে গতকালের সর্দিটা৷ প্রাণপণ চেষ্টা করেও চোখের পানি সামলাতে পারছেনা মেয়েটা৷ প্রচন্ড রকমের হাসি পাচ্ছে৷ তাও আমি চুপ করে রইলাম৷ আবারো মিতুর দিকে নির্বিকার ভাবে তাকালাম৷ এবার একটু বিরক্তির আভা ফুটে উঠেছে মেয়েটার মুখে৷ আমি বিকেল থেকেই কথা বলা বন্ধ করেছি মেয়েটার সাথে৷ শ’খানেকবার ঘুরঘুর করেছে আমার সামনে৷ আমি তাও বলিনি৷ চোয়াল শক্ত করে একটা গম্ভীর ভাব ধরে বসে ছিলাম৷ অসুস্থ শরীরে নিজের হাতে বিরিয়ানী বানিয়ে খেয়েছে আমার সামনে৷ যদিও জ্বরের প্রকোপে খেতে পারছেনা৷ আমি তাও কথা বলিনি৷ এর আগে যতবারই রাগ হয়েছে আমাদের মাঝে৷ প্রতিবারই বিরিয়ানীর সামনে নত হয়েছি আমি৷ কিন্তু আজ হার মানিনি৷
-কি হলো? কথা বলছিস না কেন? ও হ্যা! বলবিই বা কেনো!
-তুই করে কথা বলো কেন?
পাল্টা প্রশ্ন শুনে মিতু আরেক দফা রেগে গেল৷ যদিও আমার এই মূহূর্তে প্রচন্ড হাসি চেপেছে৷ মিতুর প্রচন্ড রাগ হলে তোতলায় বেশি৷ মাঝে মাঝে নিজের এই স্বভাবটার জন্য মিতু নিজেই হেসে ফেলে৷ রাগ বেশি হলে চুপ থাকার চেষ্টা করে মেয়েটা৷
-আমি মরে গেলে তুই খুশি তাই না?” নরম গলায় বলল মিতু৷
-হ্যা খুব খুশি৷”
উত্তর দিলাম আমি৷ এবার রাগের বদলে অভিমান এসে ভর করেছে মেয়েটার মুখে৷ প্রিয় মানুষটার মুখ থেকে হয়তো এমনটা আশা করেনি৷ অবশ্য পৃথিবীর কোনো মেয়ে তার স্বামীর মুখ থেকে এরকম কীছু আশা করবেনা৷ মিতুর চটফটে ভাবটা নিথর হয়ে এল৷ মায়ামায়া চোখ দু’টোর মাঝে বেদনা এসে ভর করেছে৷ আমি জানি, তুলতুলে চেহারার নরম মনের মেয়েটা এখন রুমে গিয়ে বালিশ ভেজাবে৷ মায়ামায় চোখ, তুলতুলে গাল আর সদাচঞ্চল মেয়েটার সাথে আমার পরিচয়টা ছিল অদ্ভূত৷ গরমের দুপুর ছিল সেদিন৷ বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি৷ জায়গা হচ্ছিল না কোনোটাতেই৷ বিরক্ত মুখে অপেক্ষা করছিলাম৷ কাঁধে নরম হাতের টুকো পরতেই পেছন ফিরে তাকালাম৷ কারণ জিজ্ঞেস করতেই পাশে দাঁড়ানো বৃদ্ধাকে দেখিয়ে বলল,
-দেখুন৷ এই মানুষটা রাস্তা পার হতে পারছেনা৷ উনাকে দু’হাতে ধরেই পার করাতে হবে৷ আপনি বরং একটু সাহায্য করুন আমার সাথে৷
-উনি কে হয় আপনার?
-আমার কেউ না৷
তবে মানুষ তো৷ আপনি কি সাহায্য করবেন? সেদিন রাস্তা পার করিয়ে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল মানুষ টাকে৷ আমিও ছিলাম মিতুর সাথে৷ প্রথমে ভালোভাবে খেয়াল করা হয়নি৷ এই মোলায়েম চেহারার মেয়েটার মনটাও যে তার চেহারার মতো আমি সেদিনেই বুঝেছিলাম৷ আমি মিতুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
-মানুষকে সাহায্য করতে ভালোবাসেন? মিতু ম্মিত হেসে “হুমম” নামক শব্দটা উচ্চারন করেছিল৷
-আপনি? আমার নিরবতা দেখে পাল্টা প্রশ্ন করে মিতু৷ আমিও মাথা নেড়ে সাই জানায়৷
-রক্ত দিয়েছেন কখনো? জিজ্ঞেস করে মিতু৷আমি অসহায় মুখে উত্তর দিলাম,
-নাহ৷ সিরিন্জ ভয় লাগে আমার!” কথাশুনে মিতুর সেকি হাসি৷ মাঝরাস্তায় খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পরছিল মেয়েটা৷ শেষমেষ হাসি সামলে বলল,
-ছেলে মানুষ হয়ে এসব ভয় পাচ্ছেন! কেমন জানি ব্যাপারটা৷ অদ্ভুত না?
-হ্যা একটু অদ্ভূত৷
-আচ্ছা আমার সাথে থাকুন৷ ভয় কেটে যাবে৷
-কিভাবে কাটবে?
-পরেরবার যখন রক্ত লাগবে কারো৷ আপনার সাথে মিললেই আপনাকে ডাকবো আমি৷
রাজি?” আমার ভয় লাগলেও, মোলায়েম চেহারারমেয়েটার কথা ফেলতে পারিনি আমি৷ অদ্ভূত ভাবে তারপরের দিনগুলোতে আমি মিতুর ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম৷ আমাকে হতাশ করে মিতুর ফোনটা আর আসলোনা আমার কাছে৷ তারপর হুট করে এক বৃষ্টি ভেজা সকালে ফোনের রিংটোনে ঘুম ভাঙে আমার৷ রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে উৎকন্ঠিত গলা শুনতে পেলাম৷ আমার চিনতে দেরী হলো না৷ হ্যা আমার আকাঙ্খিত ফোনটায় এসেছিল৷ সেদিন আমি রক্ত দিয়েছিলাম ঠিকই৷ একহাতে সিরিন্জ লাগানো ছিল৷ অন্য হাতটা মিতুর হাতে ধরে রেখেছিলাম৷ এরপরের দিনগুলো ছিল স্বপ্নের মতো৷ আমার দিনের একটা সময় কাটতো মিতুর পাশে থেকে৷ মিতুর মন খারাপের সময় থেকে শুরু করে৷ মানুষকে সাহায্য করতে ছুটে যাওয়া৷ সবকিছুতেই আমি ছিলাম৷ তারপর হুট করেই মিতুর সাথে আমার যোগাযোগ আটকে গেল৷ চেষ্টা করেও পারিনি৷আমি অনুভব করি, মোলায়েম চেহারার চণ্ঞ্চল মেয়েটাকে ছাড়া আমার চলবেনা৷
আমার সকালগুলো শুরু হতো বিষণ্ণতা দিয়ে৷ সকালের মিষ্টি রোদটা অসহ্য লাগতো আমার৷বিষণ্ণতার পর্দা ভেদ করে আমার মনের ঘরে প্রশান্তির বাতাসটা ঢুকতোনা আর৷ “ভালোবাসি” বলতে না পারার বেদনাটা যখন আমাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছিল৷ পৃথিবীর অসুখী মানুষগুলোর একজন ভাবছিলাম নিজেকে৷ মিতুকে পাওয়ার শেষ আশাটুকু যখন মৃতপ্রায়৷ ঠিক তখনই আবারো সেই কাঙ্খিত ফোন৷ ভেবেছিলাম, অসুখী থাকার কথাগুলো বলবো মেয়েটাকে৷ বুঝিয়ে বলব, তাকে ছাড়া কতোটা বেদনায় কেটেছে আমার৷ কিন্তু বলা হয়নি কিছুই৷ ফোন ধরতেই মিতু ঠান্ডা গলায় বলল, “ইমার্জেন্সী দরকার৷ তারাতারি আয়৷” মনের কথাগুলো আর বলা হয়নি৷ মিতুর কাছে ছুটে গিয়েছিলাম৷ কাছে যেতেই থমথমে মুখ নিয়ে মিতু বলল,
-রক্ত লাগবেনা৷
-মানে? রোগী কই?
-তোর সামনে বসা!
-কি হয়েছে তোর?
-রোগ!
-মানে?
-যেটা শুনসিস সেটাই৷
-খুলে বল৷
-বলছিনা আমার রোগ হয়েছে৷
-রোগের নাম?
-ভালোবাসার রোগ৷ ভালোবাসতে হবে আমাকে৷ পারবিতো?শুনলাম, আমাকে ছাড়া নাকি মরে যাচ্ছিস?
-কে বলেছে এসব?
-শ্বাশুড়ি আম্মা!
-জ্বর এসেছে তোর?
-না তো!
-আবোল-তাবোল বকছিস৷
-চোখ দিয়ে সিরিন্জ ঢুকিয়ে দিবো৷ তোর আম্মার সাথে আমার প্রতিদিন কথা হয়েছে৷ আমি সব শুনেছি৷
-কি ইচ্ছে করছে জানিস?
-বলে ফেল৷
-হাত-পা বেঁধে তুলতুলে গালগুলো টেনে লাল করে ফেলি৷
-আমার অপরাধ?
-বিষণ্ণতার সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছিলি৷
-সাঁতার শিখিয়েছি৷
-শিখেছি?
-নাহ৷
-তবে?
-এই যে মরে যাচ্ছিস৷ তাই তুলতে এসেছি৷
“মিতুর বৃষ্টি ভালো লাগে৷ আর বৃষ্টি মানেই শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসা৷ তাও বৃষ্টিতেভিজবে মেয়েটা৷ হাজার বারণ সত্ত্বেও ভিজবে৷ ভেজার আগে আমি যখন জ্বরের কথা মনে করিয়ে দিই৷ মেয়েটা মুচকি হেসে বলে,
-তুমি আছো তো৷”
প্রত্তুত্তরে আমি আর কিছু বলতে পারিনা৷ চুপচাপ তাকিয়ে থাকি৷ দিন দুয়েক আগেও বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধিয়েছে৷ মোলায়েম মুখটাতে অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট৷ সকালে অফিসের টাইটা বেঁধে দিয়ে বলল,
-কথা বলি একটা?
-হ্যা বলো৷
-ফোন এসেছে একটা৷ রক্ত লাগবে৷ যাবো?” আমি সরাসরি না করে দিয়েছিলাম৷ অন্যসময় হলে বাঁধা দেইনি কখনো৷ মিতুও আমার কথায় সায় দিয়েছিল৷ বিকেলে ঘরে ঢুকতেই মিতু বলল,
-খুব করে বলেছে৷ না যেয়ে পারিনি আমি৷ বিশ্বাস করো আমি সুস্থ আছি৷”
জবাবে আমি, “ভালো করেছো” ছাড়া আর কীছুই বলিনি৷ এরপর থেকে আমি টু শব্দ করিনি৷ নিজেকে খুন করার হুমকি দিয়েছে মেয়েটা৷ তাও আমার নির্বিকতা দেখে কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা৷ সেটা আমি ভালোই জানি৷ রুমে দিকে পা বাড়ালাম৷ মেয়েটা চোখ বন্ধ করে শুঁয়ে আছে৷ মাথার উপরের সিলিংটা সজোরে ঘুরছে৷ অবাধ্য চুলগুলো এলোমেলো হয়েছে ততক্ষণে৷ সর্দির প্রকোপে নাকটা লাল টুকটুকে হয়ে আছে৷ আমি হালকা করে নাকটা টেনে দিই৷ কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিতেই গোলগাল চোখ দু’টো খুলে গেল৷ মুখে দুষ্টুমির হাসি মেয়েটার৷ আমিও হাসি মেয়েটার পাগলামো দেখে৷ আস্তে করে আমার বুকে মাথা রেখে বলল,
-আর কখনো অবাধ্য হবো না৷” আমি চুলে বিলি কেটে দিয়ে বললাম,
-একশবার হবে৷ নয়তো আমি রাগ-অভিমান করবো কার সাথে?
-আবার ভিজবো বৃষ্টিতে?
-একবার ভিজে নাকের অবস্থা দেখেছো? টি শার্ট একটাও পরিষ্কার রাখোনি মেয়ে৷ আবার হলে তোমার নাকটাই কেটে ফেলে দেয়া লাগবে৷