শাড়ীটা সামলে রিকশায় উঠতে যে কিছুটা বেগ পেতে হলো নিহা’র সেটা বুঝতে পেরেই জুনাইদ বললো
– সি এন জি নিলেই ভালো হতো!
বরাবরের মতোই নিহা চুপ করে রইল। জুনাইদ ভেবেই পায় না – এই কি সেই মেয়ে! যে কিছুক্ষণ আগেও ছোটখালার বাসায় সবার সাথে কি হাসিমুখেই না কথা বললো ; খাওয়ার টেবিলে আমার পাশের চেয়ারে বসে ছিলো ; সোফাতেও আমার সাথেই বসে ছিলো আর এখন এই ছোট্ট রিকশায় আমার থেকে সরে বসার চেষ্টায় যে কোন সময় পড়ে যাবে!
বিয়ের পাঁচটা দিন হতে চললো আর বউটার হাতটাই এখনো ধরা হলো না। আর মাত্র দুই দিন পর হানিমুন – যে ভাবে আমাকে দেখলে বিষন্ন হয়ে থাকে এই মেয়ে নিশ্চিত হানিমুনে গিয়ে হোটেলে বসে বসে উপন্যাস লিখে ফেলবে আর আমি! দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসতে চায় কিন্তু জোর করে ফেরত পাঠাই। ইচ্ছে করে দম নিয়ে এক দৌড়ে বড়মামার দোকানে গিয়ে বলে আসি –
– বড় মামা খুঁজে খুঁজে এই বিষন্ন মেয়েটাকেই আমার জীবন সংগী হিসেবে বাছাই করলেন! খালি যে বলেন – বুঝলি ভাগিনা দুনিয়াটা খুব গরম হইয়া গেছে!
– কেন গরম হইছে জানেন – এই মেয়ের জন্য – আকাশের সব মেঘ এই মেয়ে নিজের মধ্যে নিয়া আসতে পারে ;
পানির মতো ছলছল করে এই মেয়ে আপনাদের সবার সামনে হাসে কিন্তু আমার সাথে একা হলেই মেঘদের দাওয়াত দিয়া বইসা থাকে। কিন্তু বলা আর হয় না জুনাইদের – মনে হয় – কী যেন একটা আছে মেয়েটার মাঝে খুব টানে – ভীষণ আপন।
এই আপন’কে নিয়ে অভিযোগ তো দূরের কথা দীর্ঘশ্বাস টাও বের করতে চায় না জুনাইদ।
ছোটখালার বাসা থেকে দাওয়াত খেয়ে জুনাইদ আর নিহা বাসায় ফিরছিলো ; জুনাইদের বাসা থেকে ছোটখালার বাসা রিকশায় পনেরো মিনিট এর মতো লাগে ; বাসার কাছাকাছি আসতেই জুনাইদ রিকশাটা বড় বাজারের দিকে নিতে বললো। একই মফস্বলে বেড়ে উঠেছে জুনাইদ আর নিহা তাই নিহা চিনতে পেরেই জানতে চাইলো –
– বড় বাজার কেন যাচ্ছি?
জুনাইদ বললো – আমি তো জানি আপনি, তুমি আর তুই তিনটা সম্বোধন আছে বাংলায় ; আমার ক্ষেত্রে কি একটাও প্রযোজ্য নয়? নিহা এবারেও চুপ করেই থাকে।
জুনাইদই বলে – আমার কাজিনগুলো একেকটা বদের হাড্ডি – এগুলোর দুষ্টুমিতে দুপুরের খাবারটাও ঠিকভাবে খেতে পারেন নাই ; চলেন এখন ফুচকা খেয়ে আসি ; এই শহরের বেস্ট ফুচকা তো বড় বাজারেই পাওয়া যায়, তাই না?
নিহা তার মেঘমূর্তি ভেংগে কোনো কথাই বলে না কিন্তু ভাবনায় পড়ে – বিয়ের রাতেই এই লোকটাকে বলেছিলো – বউ হিসেবে মানসিকভাবে গোছাতে আমি কি কিছুটা সময় পেতে পারি?
জুনাইদ বোধ হয় এটা আশা করে নি – কতক্ষন যে চুপ করে ছিলো – নিহা জানে না ; মাথা নিচু করে ছিলো তাই ঘড়িতে কত সময় এভাবেই কাটলো বুঝতে পারলো না। পরে জুনাইদ বললো – আমি তো ফ্লোরে ঘুমাতে পারি না – কেন জানি মনে হয় ঘুমালেই সারিবদ্ধভাবে পিঁপড়ারা আমার কানের ভিতর ঢুকে যাবে!
নিহা সাথে সাথেই বললো – খাট তো যথেষ্ট বড় ; আমি বাম পাশের কোণায় শুয়ে থাকতে পারবো। কী যে স্বস্তি পেলো নিহা লোকটা মেনে নেয়াতে – তবে লোকটার কথা শুনে হাসিও পেল আবার খুব মায়াও হলো, বেচারা নিশ্চয়ই কত শখ করে বিয়ে করেছে, বাসর রাত নিয়ে তার হয়তো কত স্বপ্ন ছিলো কিন্তু নিহা নিরুপায় ; এভাবে হুট করে অচেনা একজন পুরুষ তার সামনে এগিয়ে আসবে ব্যাপারটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না ; তাই কিছুটা সময় চেয়ে নিলো জুনাইদ এর কাছে।
নিহার শাড়ী পড়ে রিকশায় উঠার ঝামেলা বা খাবার ঠিকভাবে খেতে না পারা – ছোট ছোট এই ব্যাপারগুলো কি দারুণভাবেই না এই অচেনা লোকটা লক্ষ্য করছে ; নিহার মনে হলো এই ছোট্ট ব্যাপারগুলোই জুনাইদ এর জন্য একটা বিশাল জায়গা তৈরি করছে তার ভিতরে। দোকানে কর্মরত ছেলেটা নিহার হাতে ফুচকাটা দিতেই তার ভাবনায় ছেদ পড়লো – পাশের চেয়ারে বসে জুনাইদ মোবাইলে মনোযোগী। নিহা বললো – আপনি খাবেন না ফুচকা? হাত থেকে মোবাইলটা পড়েই যেতো – কোনরকমে সামলে জুনাইদ বললো
-ছোটখালার বাসায় এত খেয়েছি যে এখন আর বিন্দু পরিমান জায়গা নাই পেটে!
খুব খুশি মনেই জুনাইদ নিহাকে সিন এন জি তে করেই বাসায় নিয়ে আসলো! অন্তত সম্বোধন তো একটা পেয়েছে এই খুশিতেই দুই দিন কেটে গেলো জুনাইদের। কিন্তু আজ সকাল থেকেই মেঘেরা এইবার জুনাইদ এর কাছেই ভাড়া থাকতে এসে গেলো! আজ রাতেই নিহাকে নিয়ে সে যাবে কক্সবাজার আর এই সব প্ল্যান করেছে জুনাইদ এর একমাত্র দুলাভাই তাও আবার বিয়ের তারিখ ফিক্সড হবার সাথে সাথেই পাঁচ দিনের জন্য কক্সবাজারে হানিমুনের সব ব্যবস্থা করে ফেলেছেন নিজ দ্বায়িত্ব – নিজ খরচে! সেটা আবার সারপ্রাইজ বলে বিয়ের দিন গিফট করেছেন। সাধে কি আপা সারাক্ষণ দুলাভাই কে বেকুব বলে! জুনাইদ এর বলতে ইচ্ছে করে – দুলাভাই – আপনাদের যুগ আর নাই – এ যুগের মেয়েরা বিয়ের আগে নেয় সাজের প্রস্তুতি আর বিয়ের পর নেয় মানসিক প্রস্তুতি!!!
ধুর – হানিমুনে না গিয়ে আত্মীয় স্বজনদের বাসায় ঘুরে দাওয়াত খাইতাম অন্তত তখন সবার সাথে বউটার হাসি মুখটা দেখতে পেতাম! মিহি সুরের গলার আওয়াজটা শুনতে পারতাম! আমার সাথে হানিমুনে এই মেয়ে নিশ্চিত সারাদিন হোটেলে পাশ ফিরে শুয়ে – বসে থাকবে আর আমি একা একা সৈকতে হাঁটবো আর নতুন বিবাহিত যুগলদের আহ্লাদ দেখে দীর্ঘশ্বাস আটকাতে গিয়ে এইবার শ্বাসটাই আটকে ফেলবো! তবুও যেতেই হবে – এই মায়াবিনী মেয়েটা যে আমার ভীষণ আপন। আপনের টান উপেক্ষা করার সাধ্য আমার নাই।
বাসা থেকে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাতে কক্সবাজারমুখী বাসে উঠে বসে জুনাইদ আর নিহা ;
বাসটা ছাড়তেই আচমকা জুনাইদ এর ডান হাতটা ধরে নিহা বলে – আংটি বদলের সময় তোমার অনামিকার নখের ঠিক নিচের এই তিলটাকে কী ভীষণ আপন মনে হলো! রাখবে কি আমায় এই তিলটার মতো আপন করে সারাজীবন তোমার মনের ঘরে?
জুনাইদ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে – তার কত কী বলতে ইচ্ছে করে কিন্তু একটা শব্দও গলা দিয়ে বের করতে পারে না ; জুনাইদ এর জানতে ইচ্ছে হয় – এই অপ্রকাশিত সুখকর অনুভূতির নামই কি ভালোবাসা!