কি রে ইতি আজ কতো হলো? বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করলো ইমন। কিন্তু ইতি যেন শুনছেইনা। রাত প্রায় এগারোটা। এতো রাতে আজ ইতি বসে আছে চৌরাস্তার এই ল্যাম্পপোস্টের পাশে। হালকা আলোতে পরির মতো লাগছে মেয়েটাকে। সুতির ফ্রক আর পায়ে একজোড়া সেন্ডেল নিয়ে চুপ করে বসে আছে সে। ইমন আবার জিজ্ঞেস করছে, ” কি রে মহারানী কতো হলো? ” ইতি এবার ইমনের দিকে তাকালো। কেনরে সাহেব? আমার হিসেব তুই জানতে চাইছিস কেনো? কম হলে কি তুই কি পূরণ করে দিবি?
ইমন আস্তে করে একটা সিগারেট ধরালো। সিগারেটে চুমু দিয়ে বেশ ভালো করেই ধোঁয়া উড়াচ্ছে আর ভাবছে কি মায়াবী মেয়েটা! ল্যাম্পপোস্টের কাছে প্রতিদিন আসে ফুল বিক্রি করে আর সুযোগ করে বই পড়ে। ইতির সেই সামর্থ্য নেই ফুল বিক্রির টাকা দিয়ে আলো জ্বালানোর। কারন এই টাকাটা তার ঔষধ কিনতে আর একবেলা বাবা মাকে নিয়ে খেয়েই শেষ হয়ে যায়। এতো ছোট মেয়ে তবুও কি ভয়াবহ ট্রাজেডির সম্মুখীন কিন্তু হাল ছাড়েনি স্বপ্ন দেখার। এরাই দেশের ভবিষ্যৎ। ইমন প্রায় ৮ বছরের সিনিয়র ইতি থেকে। কি মায়ায় সে প্রতিদিন ইতির সাথে দেখা করতে আসে সে নিজেও জানেনা। তবে না এসে থাকতে পারেনা।
ইতি : বেশতো! সাহেব ধোঁয়ার মাঝেই বেঁচে থাকো।
ইমন : আজ কয়টা মালা আছে কাঠগোলাপের?
ইতি : দশটা।
ইমন: দে। সবগুলো আমাকে।
ইতি : কিন্ত, এতোগুলো মালা দিয়ে কি করবেন সাহেব?
ইমন: তুই জেনে কি করবিরে?
ইতি : না, কিছুনা। আমার বিক্রি হলেই হলো। নিন।
ইমন : মালা নিয়ে ইতির হাতে দাম দিয়ে চলে গেলো।
ইতি : ইতি বাজারে গিয়ে আগে ঔষধ কিনেছে। তারপর প্রতিদিনের রেশন। রেশন নিয়ে বাড়ির পথে হাটতে শুরু করলো। হঠাৎ ইমন তার সামনে এসে হাজির। ইতি কালকে খুব গল্প করবো কেমন?
ইতি : ঠিক আছে সাহেব। পরের দিন:
ইতি : আচ্ছা সাহেব! আপনি প্রতিদিন আমার কাছে ফুল নিতে আসেন কেনো? ফুল কি আপনার খুব ভালো লাগে?
ইমন : হ্যাঁ। আচ্ছা ইতি তুই কোন ক্লাসে পড়ালেখা করছিস?
ইতি : ক্লাস এইটে সাহেব। কেন?
ইমন: তুই কি সামনে আরো পড়ালেখা করবি? নাকি এতেই শেষ?
ইতি : কেন? স্কলারশিপ পাইলে পড়বো সাহেব। নাইলে পড়ালেখার খরচ দিবে কে?
ইমন : স্কলারশিপ! তুই কি এখন স্কলারশিপের টাকায় পড়ালেখা করছিস ইতি?
ইতি : হ্যাঁ!
ইমন: শুন কাল থেকে ফুল বিক্রি করতে আসবিনা। মনোযোগ দিয়ে বই পড়বি। আমি তোর প্রতিদিনের খরচ দিবো কেমনন?
ইতি : খুব খারাপ! আপনি কাল থেকে আসবেননা সাহেব। আপনি দয়ায় বাঁচিনা। আপনি কেন খরচ দিবেন আমার? আমি কি কর্ম করিনা?
ইমন: আরে! তুই এভাবে বলছিস কেনো? দেখ রাগ করিসনা। প্লিজ!
ইতি : আমার কি আর রাগ মানায় সাহেব? মানালেতো আর আপনি এই কথা বলতেননা।
ইমন : চুপ হয়ে বসে আছে। হঠাৎ করেই তার চিন্তারাজ্য পরিবর্তন হলো। ইতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ যেন নিমিষেই দ্বিগুণ হয়ে গেলো। মেয়েটা শুধু মায়াবীই না, ব্যতিক্রমও বটে। অনেকের সাথেই মিশেছে কিন্তু ইতি নামের এই মেয়েটার চরিত্র তাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। এজন্যইতো পরিচয় হওয়ার পর থেকে প্রতিদিনই চলে আসে বিভিন্ন বাহানায় তাকে চোখেচোখে রাখতে যেন কোন অমঙ্গল তাকে ছুঁয়ে না যায়। কিচ্ছুক্ষণ বসে থাকার পর! ইতি আগামী দুতিন বছর আমি আর এখানে আসবোনা। আমাদের দেখা হবেনা ততোদিন। ইতিও যেন ধাক্কা খেলো। কিন্তু বুঝেনা কি অনুভূতি কাজ করছে তার মাঝে।
ইতি : কেন সাহেব?
ইমন: আমি লন্ডন যাচ্ছিরে ইতি। সেখানে পিএইচডি করবো। তারপর ফিরবো।
তোর সাথে তখন দেখা হবে। কেমন? তোদের এড্রেস পরিবর্তন করবিনা কেমন? আর হ্যাঁ ঐযে আমার বন্ধুর শোরুমে গিয়ে যখনি আমার কথা বলবি তখনি আমার সাথে কথা বলিয়ে দিবে কেমন? ওকে? যেকোনো প্রয়োজনে পাশে পাবি।
ইতি: মুচকি হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
ইমন: আচ্ছা ইতি! আসি।
ইতি : আচ্ছা।
ইমন : চলে যাচ্ছে। হঠাৎ কে যেন ইমনের হাত ধরে ফেলেছে। পিছনে ঘুরে দেখে ইতি। কি হলো? তুই এখানে?
ইতি : সাহেব আমার পক্ষ থেকে একটা ফুল নিয়ে যান। উপহার। এটা উপহার মনে করে রাখেন।
ইমন : ফুল নিয়ে ইতিকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো।
এরপর কেটে গেলো পাঁচ বছর ইমন এখনো আসেনি। অথচ ইতি প্রতিদিন আসে এই ল্যাম্পপোস্টে। যোগাযোগের মাধ্যম সব বন্ধ। তার বন্ধুও শোরুম বন্ধ করে অনেক আগেই বিদেশ পাড়ি জমিয়েছে। কেউ কেউ ইতির উপর হাসে আবার কেউ খোঁটা দেয় সাহেব! আসবেনারে ইতি। ফুল বিক্রি করতি। তুই কোন ফুল ছিলি না যে তোর সাহেব আসবে। যা যা ।
কিন্তু ইতি রিসপন্স করতোনা কারও কথায়। সে চুপচাপ শুধু শুনতো। এভাবে একদিন ইতিও পুরো পরিবার নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো। কেউ জানেনা তার খবর। কোথায় কি করছে? কেমন আছে? কেউইনা। ইতি অভিমানে বলে যায়নি। কিন্তু কোন এক কোনে একটু হলেও বিশ্বাস নিয়ে গিয়েছিল যে ইমন আসবে। খুঁজবে তাকে। কিন্তু! আজ প্রায় সাত বছর। ইমন আসেনি। আশা প্রায় শেষের দিকে। সে বিশ্বাস করছে যে ইমন তাকে আর দেখতে আসবেনা। আর কথা ঐ পাগল লোকটার সাথে যে একজন সামান্য ফুলওয়ালীর জন্য সময় নষ্ট করতো ঘন্টার পর ঘন্টা। এদিকে প্রায় সাতবছর পর ইমন এসেছে। এসেই খোঁজ করে ইতির। কিন্তু ইতি কোথাও নেই। এদিকওদিক খোঁজ করে ভেঙে পরে ইমন। প্রায় মাসখানিক পর ল্যাম্পপোস্টে একজন ইমনকে দেখতে পায়। দেখেই ছুটে আসে। ভাইয়া! আপনি কি ইতিকে খুঁজছেন?
ইমন : হুম্ম। প্লিজ বলুননা। কোথায় মেয়েটা।
জানিনা। ইমন হতাশায় ভেঙে পড়ে। একদিন ইতির খোঁজে বেরিয়েছে ইমন। এমন সময় পিছন থেকে একটা কআআর এসে খুব জোরে ধাক্কা দেয় তাকে। সেন্সলেস ইমনকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে রেফার্ড করা হয় শহরে। সেখানে দ্রুত তাকে এমারজেন্সিতে নেইয়া হয়। এমারজেন্সি থেকে ওটিতে। মাথায় গভীর আঘাত পাওয়ার কারনে অপারেশন প্রয়োজন।
কিন্তু ওটিতে সেন্সলেস ইমনের সামনে ইতি। ইতি খুব শকড। ইমনের এই অবস্থা? কিভাবে? চোখ দিয়ে পানি পরছে। দ্রুত ইমনের অপারেশন শেষ করে সিফট করা আইসিইউতে। ইতি শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। সে কখনো ভাবেনি তার এমনকিছু দেখতে হবে। এমন সময় সে শুনতে পায় কে যেন বাইরে বলছে, “ইতি নামের কাউকে খুঁজছে। লন্ডন থেকে আসার পর থেকেই।আজও তার খোঁজেই বেরিয়েছিল। ” এই কথা শুনে ইতি আরও বেশি কষ্ট পায়। কিন্তু সময়টা এখন ভেঙে পড়ার না। ইমনের বেস্ট এন্ড বেস্ট ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করলো। অবহেলার কোনো সুযোগ নেই। প্রায় ৮ ঘন্টা পর ইমনের জ্ঞান ফিরেছে। আল্লাহর রহমতে সে এখন আউট অব ডেঞ্জার। চোখ খুলেই সামনে দেখতে পেলো ইতিকে। কিছু বলার চেষ্টা করার আগেই ইতি তাকে বারন করে উঠলো।
ইতি : না সাহেব। সুস্থ হওয়ার পর কথা বলবেন। এখন একদম না।
ইতি পুরো কেয়ার নিয়ে ইমনকে সুস্থ করলেও ইমন প্রায় পুরো দুবছর হাঁটতে পারবেনা এমনকি বসতেও পারবোনা। মেরুদন্ডের হাড় ভেঙে যাওয়ার কারনে এই রেস্ট্রিকশন। এদিকে অসুস্থ ইমনকে ইতি দেখাশুনা করেই যাচ্ছে। সাথেই আছে দুজনে। একদিন ইমন জানতে চাইলো, ইতি বিয়ে করেছিস?
ইতি : না। আপনি?
ইমন: না।
ইতি : একটা পরিকে ভালবেসে ফেলেছিলাম তাই। তুই?
ইতি : এমনি। ঐ পরি কি জানে?
ইমন: না। জানবেওনা।
ইতি : কেন?
ইমন: তার উপর বোঝা হতে চাইনা। সে ভালো থাকুক। আমি অকেজো এখন ইতি। আচ্ছা! তুই কতদিন এখানে থাকবি?
ইতি : আপনি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত। এরপর বাইরে যাবো বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য।
ইমন: আবার হারিয়ে যাবি নাতো?
ইতি: পরিকে এনে দিবো। আর মনে থাকবেনা ফুলওয়ালীকে
ইমন: মুচকি হাসছে আর মনে ভাবছে পরিটাতো তুই।
তোকে আমার কাছে রেখে বন্দি করতে চাইনা ইতি। তুই উড়ে বেড়া। তুই সফল হো। পুরো দুই বছর তিনমাস পর: ইমন সুস্থ হয়ে গেছে। হাঁটাচলা করতে পারে। একদিন হেঁটে হেঁটে ইতির রুমে গেলো। সেদিন ইতি চলে যাবে বিদেশ রাতের ফ্লাইটে। গিয়ে দেখে ইতি কোথাও নেই। এমন সময় ইতির ডায়েরি ইমনের হাত লেগে পরে যায়। ইমন ডায়েরীটা হাতে নিয়ে দেখে সেখানে লেখা আছে, “অপেক্ষা শেষ হলো কিন্তু ভয় দেখিয়ে। ” তার জীবনে একটা পরি আছে। আমার ধারনা ভুল ছিল।” ইমনের আর বুঝতে বাকী রইলোনা যে ইতিও তাকে ভালবাসে। কিন্তু ইতিকে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কিছুই বলেনি। বিমানবন্দরে যাওয়ার সময় একটা নীল রঙের খাম দিয়ে বলে, বিমান যখন উড়ান দিবে তখন দেখবি।
ইতিও তাই করে। দেখে একটা ইয়েলো কাগজে লিখা পরিটা তুই। ফিরে আসলে বিয়ে করবো? করবিতো? ইতি কাগজ দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলো। আজ তার ভালবাসা তার কাছে। আটকাতে পারছেনা নিজেকে। পৌঁছে ইমনকে টেক্সট দেয়, “হুম্ম”। ভালো থেকো দুইজনই অপেক্ষা শেষ করে প্রায় তিনবছর পর বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শুরু করে নতুন জীবন। আর প্রতিদিন ল্যাম্পপোস্টে গিয়ে আডডা দেয় ইচ্ছামত যেখান থেকে ভালবাসা জন্মেছিলো। বেঁচে থাকুক তারা এভাবেই ভালবাসায়।।