প্রিয়তম

প্রিয়তম

মাঝরাতে আমার পেটের উপর তুলতুলে,লোমশ একটা হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুম ভেঙে গেল। আমার সারা শরীর শিউরে উঠলো! হৃৎপিণ্ড কৈ মাছের মত তড়পাচ্ছে। আশ্চর্য! এটা কার হাত? আমি ডানদিকে পাশ ফিরে শুয়েছি। পুতুল টেডি বিয়ারের মত তুলতুলে হাত এমনভাবে আঁকড়ে ধরে আছে যা আমাকে রীতিমতো ভড়কে দিল। আতঙ্কে,তৃষ্ণায় আমার বুকের ছাতি ফাটার উপক্রম।

মনে হচ্ছে আমার গলার ভেতর কেউ একগাদা কাপড় সেঁটে দিয়েছে তা না হলে আমি চিৎকার করতে পারছি না কেন? আমার বা পায়ে হালকা ঝাঁকুনি হল। আতঙ্কের স্রোত আমার মেরুদণ্ড ভেদ করে শিরা, ধমনীতে তোলপাড় করে দিচ্ছে। আমার পাশে কে তা আমি ঘাড় ঘুরে দেখার সাহস পাচ্ছি না। তবে কি অশরীরী কিছু? দরজা,জানালা ভালোমত বন্ধ করা। বাতি নিভিয়ে ঘুমানোর অভ্যেস আমার। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কোনো অবয়ব দেখতে পাচ্ছি না। আমি অস্পষ্ট কণ্ঠে জুঁইকে ডাকার চেষ্টা করলাম। ফ্যাসফ্যাসে গলায় কেবল জ…জ উচ্চারিত হল কিন্তু এতটাই ধীরগতিতে যা আমার কান অবধি পৌঁছালো না।

পরক্ষণেই মনে হল, জুঁই বাসায় নেই। গ্রামের বাড়িতে। নিজের ভেতর খানিকটা সাহস সঞ্চার করার চেষ্টা করলাম। আমার ডানহাত দিয়ে এক ঝটকায় এই লোমশ হাতটা সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তিরতির করে আমার ডানহাত কাঁপছে ঠিক যেমনটা মৃদুমন্দ বাতাসে ধানের শীষ কাঁপতে থাকে ঠিক অমন। আমি মনে মনে আয়াতুল কুরসী পড়ার চেষ্টা করছি কিন্তু আমার আমার মাথা এখন ফাঁপা ফুটবলের মত ফাঁকা।

তুলতুলে সেই অশরীরী কিছুর সন্ধানে আমি ধীরে ধীরে আমার পেটের উপর হাত রাখলাম । কী আশ্চর্য কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই! এটা কীভাবে সম্ভব?

আমি দৌড়ে গিয়ে বাতি জ্বালিয়ে দিলাম। সারা শরীর ঘেমে একাকার। মুখের উপর জগ তুলে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিলাম। জগের পানি ছলকে ছলকে এসে আমার শাড়ি,ব্লাউজের খানিকটা ভিজে গেল।

আমি খাটের উপর ধপাস করে বসে পড়লাম। রাত এখন কয়টা বাজে? দুইটা/ আড়াইটা হবে বোধ হয়। নিচের ঘর থেকে এস্রাজের কাটা কাটা সুর আমার কানে বাজছে। কী আশ্চর্য! এত রাতে এস্রাজ বাজাচ্ছে কে? সাবিত তো নেই। মনে হচ্ছে ছড় এখন এস্রাজের উপর নয় বরং আমার কলিজার উপর টানা হচ্ছে। এস্রাজের উপর যখন ধীরে ধীরে ছড় টানা হয় তরঙ্গায়িত সুর শ্রোতাদের মোহগ্রস্ত করে দেয়।

শুভায়ু সেন মজুমদার যেমন এস্রাজে ” তুমি রবে নীরবে ” সুর তুলে হাজারো শ্রোতাকে মুগ্ধ করে দিয়েছে ঠিক তেমন সাবিতের ” যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে জীবনে অমর হয়ে রয়” এই সুর আমাকে এখন মাতাল করে দিচ্ছে। সাবিতের সবচেয়ে পছন্দের গান। বিয়ের পাঁচদিন পর আমাকে গেয়ে শুনিয়েছিল।

সচরাচর পুরুষ মানুষের গলা যেমন ফাঁটা বাশের মত ফ্যাসফ্যাসে হয় ওর গলা মোটেই অমন নয়। একেবারে নিখুঁত, নিপাট। ষষ্ঠী মধু খেয়ে প্রতিদিন সা-রে-গা-মা -পা রেওয়াজ না করলেও বছরের পর বছর সেই কণ্ঠ অক্ষত থাকবে। মাঝে মাঝে প্রতীক হাসানের কণ্ঠের সাথে ওর কণ্ঠ গুলিয়ে ফেলতাম।

ড্রয়িংরুমে বড় একটা ছবি বাঁধাই করা৷ হাস্যেজ্জ্বল মুখে ও বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী ড.লীনা তাপসী খানের কাছ থেকে ক্রেস্ট নিচ্ছে। সম্ভবত কোনো অনুষ্ঠানে গেয়ে বিজয়ী হয়েছিল। কী ছিল সেই অনুষ্ঠান তা জানার আগ্রহ আমার কখনো হয়নি। সেদিন সাবিত আমাকে আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করেছিল, ” বলতো মোহিনী, যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে গানের গীতিকার এবং সুরকারের নাম কী? ”
আমি আনমনে উত্তর দিয়েছিলাম, ” মান্নান মোহাম্মদ। ”
ও মৃদু হেসে বলল, ” উঁহু হয়নি। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। গানের কথা কখনো এত সুন্দর হয় তুমি বলো? ”

আমি কিছু না বলে জানালার দিকে তাকিয়ে নারকেলের চিরল পাতা দেখি। পাশেই পেয়ারা গাছটায় এক মেটে শালিক চোখ আঁধবোজা করে বসে আছে। সূর্যের তেরছা আলো ঘরে প্রবেশ করেছে। আমি জানালার দিকে তাকিয়েও বুঝতে পারি সাবিত আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে এবং এটাও বুঝতে পারি ” তুমি আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয়” লাইন বলতে বলতে ওর চোখে জলে ভরে গেছে,কণ্ঠ খানিকটা কাঁপছে। আমি সেই চোখের জলের গভীরতা মাপার চেষ্টা করিনি। যার হৃদয়ের গভীরতা মাপা হয়নি তার চোখের জলের গভীরতা মাপা অর্থহীন। এ কী শুধুই কান্না নাকি রঙ? কীসের রঙ? বেদনার?

আমি তো ওকে কোনো অধিকার থেকে বঞ্চিত করিনি। নাটকীয় ভঙ্গিতে কখনও ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলিনি, ” এই কুত্তা তুই আমাকে টাচ করবি না ভুলেও”। নিরাসক্তি সত্ত্বেও শরীরী আহ্বানে আমি তো সাড়া দিয়েছি। পুরুষ মানুষের জীবনে এর চেয়েও আর বেশি কিছুর প্রয়োজন আছে? কী জানি অতকিছু জানি না, বুঝি না।

এই চার মাসে আমি শুধু এইটুকু বুঝেছি ভোরবেলায় এলোমেলো চুল আর শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে আমার চোখে অকারণে জল এসে যায়। মনে হয় বিছুটি পাতা দিয়ে আচ্ছামত কেউ গা ঘষে দিয়েছে, এখন অসম্ভব জ্বালা করছে। কলের প্রত্যেক ফোটা জল গায়ে এসে লাগলে সেই জ্বলুনি আরও বেড়ে যায়। সেই জলের ফোটা যেন চিৎকার করে একজনের নামই বলে,” অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী”।

” তুমি আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয়” সাবিত যখন আমাকে উদ্দেশ্য করে গাইতে থাকে আমার তখন চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করে ” স্টপ ইট,প্লিজ স্টপ ইট। আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয় অন্য কেউ। তুমি শুনতে চাও কে সে? সে অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী আর আমি মোহিনী ফেরদৌস। পার্থক্যটা কোথায় তুমি ধরতে পেরেছো সাবিত? ”

আশ্চর্যের বিষয়, আমি ওকে কিছুই বলতে পারিনি৷ মনে হয়েছে কোনো অদৃশ্য হাত আমার গলা চেপে ধরেছে। আমি শত চেষ্টাতেও একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারিনি। আমার অনুচ্চারিত কথাগুলো একজন ঠিকই প্রত্যেক মুহূর্তে অনুভব করেছে। সে আমার অনিরুদ্ধ। ফোনের ওপাশ থেকে যখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজে ভাঙা ভাঙা গলায় শুনি, ” মোহিনী আমি কী করে বাঁঁচবো? ” ঠিক তখন মনে হয় আমি হরিণীর মত একছুটে ওর কাছে চলে যাই। পরক্ষণেই এই দেয়াল আর সামাজিক শিকল আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে।

অনিরুদ্ধ চরম আক্রোশে বলতে থাকে, ” তোমার স্বামী একটা আস্ত শুয়োর। ওকে আমি রাম দা দিয়ে কেটে আটত্রিশ টুকরা করব। তারপর বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গায় ফেলব। দুনিয়ায় কি মেয়ে মানুষের এত অভাব পড়েছিল যে বেছে বেছে তোমাকে বিয়ে করতে হলো?”

” সবই নিয়তি, মেনে নাও অনিরুদ্ধ ” এই বলে আমি ওকে সান্ত্বনা দিতে পারছিলাম না কারণ নিয়তিকে তো আমিও মানতে পারিনি।

ডানাভাঙা ঘুঘুর মত আমি এই বিশাল বাড়িতে আমি ছটফট করতে থাকি। সাঁড়াশি দিয়ে কেউ যেন কলজেটা চেপে ধরেছে। নিশুতির গাঢ় অন্ধকারে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক অসহ্য লাগে। মনে হয় আমার যন্ত্রণাকে ওরা পরিহাস করছে। আমক কানে হাত চাপিয়ে বসে থাকি। কত রাত নির্ঘুম কেটে গেছে কে জানে!

আমার নিঃশব্দ কান্নার আওয়াজ কী করে সাবিতের কানে পৌঁছাত আমি আন্দাজ করতে পারি না। আমার চোখের দিকে না তাকিয়ে ওপাশ ফিরেও মাঝে মধ্যে বলত, ” ঘুমাও মোহিনী, অনেক রাত। তোমার মাথা ব্যথা করবে কিন্তু। ” আমি রীতিমতো ভড়কে যেতাম। ও কী করে টের পেত যে আমি ঘুমাইনি?”

খানিক বাদেই আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতাম। স্বপ্নে ঘুমের ঘোরে চলে যেতাম দার্জিলিং। কী কনকনে ঠান্ডা!
অনিরুদ্ধ আমাকে কতবার বলেছে, ” আমরা হানিমুনে অবশ্যই দার্জিলিং যাব। প্রথমে ‘ জেট এয়ার’ বিমানে যাব কলকাতা তারপর ‘ এয়ার ইন্ডিয়া ‘ বিমানে শিলিগুড়ি। পুরোটা সময় থাকব মেঘের কাছাকাছি। তুলোর মত মেঘ আমার ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হবে খুব৷ শিলিগুড়ি নেমে চান্দের গাড়িতে পৌঁছে যাব ভূ-পৃষ্ঠ থেকে সাত হাজার ফুট উপরে অবস্থিত নৈসর্গিক দার্জিলিং। আমরা ঘুরে দেখব ম্যাল, জাপানিজ ট্যাম্পল, চা বাগান, টাইগার হিল। কখনও কখনও আচমকা অনিরুদ্ধের হাত ছুঁয়ে বলব ” ওমা তোমার হাত তো জমে বরফ হয়ে গেছে!”

আধঘুমে আমি টের পেতাম আমার অনাবৃত পেটে অন্য কারো হাত। সে হাত তো অনিরুদ্ধের নয়। অনাগ্রহে সে হাত সরিয়ে দেয়ার সময় টের পেয়েছিলাম সাবিতের বুড়ো আঙুল বেশ ছুলে গেছে। কিছু একটার সাথে আঘাত পেয়েছে বোধ হয়। বেশ খানিকটা অংশ জুড়ে দগদগে ঘা। একবার আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে ” কেমন করে ব্যথা পেলে? বেশি লেগেছে? ” পরক্ষণেই মনে হল আমার জিজ্ঞেস করার কী আছে? আমি কি ডাক্তার? ব্যথা পেয়েছে ডাক্তারের কাছে যাবে।

সকালবেলায় ও খটখট করে এটা সেটা খুঁজতে থাকে। ” ঘড়ি কোথায়? মোজা কোথায়?” বলতে বলতে অস্থির হয়ে যায়। আমি খাটে শুয়ে বামহাতের উল্টো পিঠ কপালের উপর রেখেই বলি, ” সেকেন্ড ড্রয়ারে দেখ। উঠে গিয়ে আমার খুঁজে দিতে ইচ্ছে করে না। কখনও গলা জড়িয়ে ঢং করতে মন চায় না। খটখট ড্রয়ার টানার শব্দে ঘুম ভেঙে বরং বিরক্ত লাগে। স্বামী না আসা অবধি বাঙালী বধূদের মত উপোস থাকার ঢঙও আমি পালন করতে পারিনি। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে কখনও হাসিমুখে দরজা খুলিনি। ভ্রূ কুঁচকে বরং কর্কশ গলায় জুঁইকে বলতাম ” কানে শুনতে পাস না? যা দরজা খোল। ” আমার ধমক খেয়ে কাজের মেয়েটা চমকে যেত। ”

বুঝতে পারছিলাম জীবনটা বিষিয়ে যাচ্ছে। সেদিন একটু বেশিই উতলা হয়ে অনিরুদ্ধকে ফোন করে বলেছিলাম, ” আমি আর এখানে এক মুহুর্ত থাকতে পারছি না। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ”

ওপাশ থেকে দৃঢ় কণ্ঠে অনিরুদ্ধ জানালো, ” আমি অবশ্যই আসব মোহিনী। শুয়োরটাকে কেটে টুকরো টুকরো যদি না করি তবে আমার নামে কুত্তা পুষো। ”

সেদিন রাত আড়াইটায় অনিরুদ্ধের ফোনে আমার ঘুম ভাঙে। অনিরুদ্ধ ধীরে ধীরে বলল ” আমি এসেছি মোহিনী তোমার গেটের সামনে। পেছনের দেয়াল টপকে ঝোপ ঝাড়ের ভেতর দিয়ে এসেছি। দরজা খোলা রাখো।

আমার শরীর কেঁপে উঠল। কী এক অন্ধ মোহে আমি ধীর পায়ে গিয়ে দরজা খুললাম। মিনিট দশেক পর অনিরুদ্ধ এল। ফোঁটায় ফোঁটায় ঘাম জমেছে ওর নাকের উপর। আমি ঘাড় ঘুরে পেছনের দিকে তাকালাম। সাবিত জেগে যায়নি তো? অনিরুদ্ধের হাতের দিকে তাকাতেই আমি আঁতকে উঠলাম। অল্প আলোয় ধারালো চাপাতি ঝিকমিক করছে।৷ আমি ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলাম, ” তুমি সত্যি খুন করবে ওকে? ”
অনিরুদ্ধ চোয়াল শক্ত করে উত্তর দিল, ” অবশ্যই খুন করব। সে তো নিকৃষ্টতম খুন করেছে। তোমাকে,আমাকে খুন করেছে। বলো করেনি?”

আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালাম। সাবিত অঘোরে ঘুমুচ্ছে। সারাদিনের অফিসে ক্লান্তি ওকে রাতে চেপে ধরে। সহজে জাগবে না। অনিরুদ্ধ বিড়ালের মত পা চেপে চেপে ওর কাছে গেল। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। আমার পা মৃগী রোগীর মত ঠকঠক করে কাঁপছে।

অনিরুদ্ধ ধারালো চাপাতির দিজে নিষ্ঠুর দৃষ্টিতে তাকালো তারপর কিছু বুঝে উঠার আগেই সাবিতের গলা বরাবর কোপ দিল। একটাবার আর্তনাদ হল শুধু৷ তারপর কোরবানির পশুর মত ঘড়ঘড় আওয়াজ শোনা গেল। রক্ত ছিটকে এসে অনিরুদ্ধের গালে এসে লাগলো। ” ওমা গো” বলে আমি দরজায় পিঠ ঘেষে বসে পড়লাম।

রক্তমাখা মুখে অনিরুদ্ধ তৃপ্তির হাসি হাসল। নিখুঁত, নিপাট কণ্ঠের সাবিত আর নেই। ফ্যালফ্যাল চোখে একটাবার আমার দিকে তাকিয়েছিল। ও কি ভেবেছিল আমি দৌড়ে ওর কাছে যাব? অনিরুদ্ধের পায়ে ধরে বলব ” প্লিজ ওকে মেরো না। ” অনিরুদ্ধ গুণে গুণে লাশ আটত্রিশ টুকরা করল। কাঁপা গলায় বলল, ” যাও মোহিনী একটা বস্তা আনো। সকাল হতে চলেছে। বস্তায় টুকরোগুলো ভরে আজ তোমার খাটের নিচে রেখে যাব৷ কাল এসে ব্যবস্থা করব। ”
ভোরের আলো ফোটার আগেই অনিরুদ্ধ চলে গেল।

নিচের ঘর থেকে এস্রাজের সুর আমি এখনও শুনতে পাচ্ছি। দৌড়ে আমি নিচের ঘরে গেলাম। দরজা খুলে দেখলাম কেউ নেই। ঠকঠক পায়ে আমাদের বেডরুমে এলাম। আমার খাটের নিচে কি সাবিতের লাশ? আমি কাঁপা হাতে খাট থেকে ঝুলতে থাকা চাদর সরিয়ে চোখ বড়বড় করে খাটের নিচে তাকালাম৷

না,খাটের নিচে কিছুই নেই। কিছু থাকার কথাও নয়। আমি খাটের নিচে কেন তাকালাম কিছু নেই তা জেনেও? আমার মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে? আমি মেঝেতে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। সেদিন যখন অনিরুদ্ধকে ফোনে বলেছিলাম ” আমি আর এখানে থাকতে পারব না এক মুহূর্ত। ” অনিরুদ্ধ প্রতিউত্তরে বলেছিল সাবিতকে ও খুন করবে। আর তারপর থেকে আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। সাবিতকে খুন করার বীভৎস দৃশ্য আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। অনিরুদ্ধ কি সত্যি ওকে খুন করবে? না,অনিরুদ্ধ ওকে খুন করতে পারে না। আমি ওকে খুন করতে দেব না।

এখন রাত প্রায় তিনটা। আমি উদভ্রান্তের মত ফোনটা হাতে নিলাম। অনিরুদ্ধকে ফোন দিলাম। মিনিট তিনেক পর ওপাশ থেকে অনিরুদ্ধের কণ্ঠ ভেসে এলো, ” কী হয়েছে মোহিনী? এত রাতে ফোন দিলে যে! এনি প্রবলেম?”
আমি কান্নাভেজা কণ্ঠে চিৎকার করে বললাম, ” আই ওয়ান্ট টু ফরগেট এভরিথিং”

ওপাশ থেকে অনিরুদ্ধ মৃদু হেসে বলল, ” আমিও তাই চাই মোহিনী। এক জীবনে কে তোমার প্রাণের চেয়ে প্রিয় তা না ভেবে তুমি কার প্রাণের চেয়ে প্রিয় তা ভাবাই যুক্তিযুক্ত। তুমি তোমার যুক্তিতে জিতেছো আর তোমাকে বিজয়নী বানানোর কৃতিত্ব কিন্তু আমার।”

আমি তৎক্ষণাৎ ফোনটা রেখে সিম কার্ড খুলে ভেঙে গুড়িয়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিলাম। তিন বছরের ভালোবাসা তুমি বাষ্প হয়ে উড়ে যাও। আমার বুকে জমাট বাঁধা বরফ হয়ে আর থেকো না।

আমি অন্য ফোনটা দিয়ে সাবিতকে কল দিলাম। বারবার রিং হচ্ছে সাবিত ধরছে না কেন? বিজনেসের কাজে চট্টগ্রাম গিয়ে দুনিয়া উদ্ধার করে দিচ্ছে সে! এত বিশাল এই বাসায় আমি একলা পড়ে আছি। তখনও টপ টপ করে চোখের জলে ফোনের স্ক্রিন ভেসে যাচ্ছে। আমি আঁচল দিয়ে মুছে নিচ্ছি বারবার।

ফোন রিসিভ হল মিনিট দশেক পর। আমার কান্নার আওয়াজ শুনে সাবিত জিজ্ঞেস করল, ” এমন করছো কেন? কী হয়েছে মোহিনী? বল আমাকে। ”

আমি তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বললাম, ” কাল সকালের মধ্যে তুমি যদি না আসো আমি ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করব। ”

ওর কোনো প্রতিউত্তর না শুনে ফোন রেখে দিলাম। কখন আমার দু চোখের পাতা এক হয়ে গেছে টের পাইনি। একটাবার চোখ মেলে শুধু দেখেছি সকালের মিঠে আলো জানালা গলে ঘরে ঢুকেছে। দুটো চড়ুই এ ডালে ও ডালে নেচে বেড়াচ্ছে। ফ্লোরেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। মাথার নিচে বালিশ নেই,ঘাড় খানিকটা ব্যথা করছে। চোখ দুটো ভারী ভারী লাগছে ভীষণ। আমি আবার চোখ বন্ধ করলাম।

কলিংবেলের আওয়াজে ধরফড় করে উঠে বসলাম। এখন দুপুর নাকি বিকেল আন্দাজ করতে পারছি না। আমি দৌড়ে দরজা খুলতে গেলাম এমনভাবে আমি কোনোদিন দরজা খুলতে যাইনি৷ দরজা খুলে আমি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে বাচ্চা মানুষের মত কান্না জুড়ে দিলাম। সাবিত ঘটনার আকস্মিকতায় খানিকটা হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল, ” মোহিনী কী হয়েছে? প্লিজ আমাকে বলো। ”

আমি সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ওকে আরও শক্ত করে কাঁকড়ার মত আঁকড়ে ধরি। কান্না জড়ানো কণ্ঠে ভাঙা ভাঙা গলায় বললাম, ” তুই যদি আমাকে আর কখনো একলা বাসায় ফেলে যাস আমি তোকে কেটে আটত্রিশ টুকরা করব তারপর সেই টুকরা বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গায় ফেলব। ”

সাবিত আমার কানের কাছে মুখ এনে শুধু মৃদু হেসে বলল, ” আচ্ছা, আমাকে যে টুকরো টুকরো করবে কিন্তু এত কঠিন কাজ কি তুমি একা পারবে? তোমার সহকারী হিসেবে কে থাকবে? অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী?”
আমি চোখ ছানাবড়া করে বললাম, ” এই তুই কী বললি?”
সাবিত কান ধরে জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল, “সরি, দুষ্টুমি করে বলেছি। আর বলব না।”

আমি আতঙ্কিত কণ্ঠে তখনও বিড়বিড় করে বলছি ” কাল একটা তুলতুলে ভূত এসেছিল রুমে। ”
এই কথা শুনে সাবিত তো হেসেই খুন। খানিক বাদেই সাবিত আমার চিবুক ছুঁয়ে বলল, ” আচ্ছা মোহিনী ভাবছি আমরা দার্জিলিং বেড়াতে যাব। টাইগার হিলে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখব। তুমি যাবে?”

আমি কোনো উত্তর না দিয়ে ওর বুকে বিড়ালছানার মত চুপটি করে মুখ লুকিয়ে থাকি। মনে হচ্ছে আমি এখন টাইগার হিলে দাঁড়িয়ে আছি। দক্ষিণে কার্শিয়াং শহর আর সাপের মত একেবেঁকে যাওয়া তিস্তা নদী আর মহানন্দা নদের টলটলে জল দেখছি। আমার বিড়বিড় করে বলতে ইচ্ছে করছে ” আমার অতীত তুমি মহানন্দার জলে মিশে যাও। ”

টাইগার হিলে দাঁড়িয়ে আমি সাবিতের সবচেয়ে প্রিয় গানটা গাইবো ” যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে জীবনে অমর হয়ে রয়। সেই প্রেম আমাকে দিয়ো জেনে নিয়ো তুমি আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয়। ”
আচ্ছা ও কি আমার কণ্ঠ শুনে আশ্চর্য হয়ে বলবে ” বাহ মোহিনী! তুমি তো বেশ ভালো গাও। ”

” তুমি আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয়” যখন এই লাইন বলব তখন কি সাবিতের চোখে জলে ছলছল করবে? আমি চাই ওর চোখে জল আসুক। আমি জানি সেই জল বেদনার নয়, নিগূঢ় অর্থের। সেই অর্থের মর্মার্থ বোঝার সাধ্য সবার নেই।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত