— দেখ আমাদের বিয়ে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমি তোকে কখনই স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারবো না। বাসরঘরে ঢোকার পর যখন স্ত্রীর মুখে সালামের পরিবর্তে এই কথা শুনতে হয় তখন কেমন অনুভূতি হয় বলতে পারেন? আমি জানি কেউই পারবেন না। কারন আমিই হয়তো প্রথম পুরুষ যে বাসরঘরে স্ত্রীর মুখে এই কথা শুনলাম। কিছুসময় পূর্বেই আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। কিন্তু এই বিয়েটাকে বিয়ে না বলে দুর্ঘটনা বলাই ভাল। আপনাদেরকে ঘটনাটা খুলে বলা অতি জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমি আরমান হোসেন। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আর আমার স্ত্রী মোসাঃ ইসরাত জাহান ইশিতা ওরফে কটকটি সুন্দরীও আমার সাথে একই ডিপার্টমেন্টে পড়াশোনা করে। সেই কলেজ জীবন থেকেই আমি আর ইশিতা চরম বন্ধু। একজন অপরজনকে ছাড়া থাকতে পারিনা। কলেজ জীবনের পর বিশ্ববিদ্যালয়েও আমরা ছিলাম চরমের উপর চরম বন্ধু। আমাদের বন্ধু মহলের সবাই ভাবতো আমরা দুজন প্রেমিক জুটি। কিন্তু আসলে তা নয়। আমরা সবসময় বন্ধু ছিলাম। কিন্তু কোন এক বিখ্যাত ব্যাক্তি একটা বানী ঝেড়েছিলেন। ‘একজন ছেলে আর মেয়ে কখনোই ভাল বন্ধু হিসেবে থাকতে পারেনা। তারা কেউ না কেউ প্রেমে পড়বেই।’ এই বানী আসলেই সত্য। শুধু সত্য নয়, চরম সত্য। বন্ধুত্বের বাগানে কখন যে ভালবাসার বীজ আমার হৃদয়ের জমিতে বপন করা হয়ে গেছে তা আমি বুজতেই পারিনি।
তো গত দেড় বছর আমি ইশিতার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছি। কিন্তু কখনো তাকে বলতে পারিনি। কারন ইশিতার আচরনে কখনই মনে হয়নি যে আমি আর সে বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু হতে পারি। যার কারনে আমি মনে মনেই ভালবেসেছি তাকে। হয়তো সাহস করে বলতে পারতাম, কিন্তু মনে ভয় ছিল। যদি ইশিতা প্রত্যাক্ষান করে? যদি আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়? অবশেষে ইশিতা আমার বউ হয়ে এসেছে। কিন্তু সেটাও এক দুর্ঘটনাবশত। একদিন সকালে ইশিতার ফোন এলো। আমি তখন ঘুমের সাগরে গোসল করছিলাম। ফোন দিতেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গুড়ো হয়ে গেলো। ঘুম ঘুম চোখে ফোন ধরলাম।
– হ্যা ইশিতা বল।
– দোস্ত তুই এখনো ঘুমাচ্ছিস? জানিস কয়টা বাজে?
– আরে ধূর আজ শুক্রবার। আজকেও ঘুমাতে দিবি না নাকি?
– তোর ঘুমের নিকুচি করি। দশ মিনিটের মধ্যে আমার সাথে দেখা করবি।
– দোস্ত এটা কিন্তু মানসিক টর্চার হয়ে যাচ্ছে।
– তোর টর্চারের গুলি মারি জলদি আয়।
– আরে ইশিতা শোন।
টুট টুট টুট টুট নাহ এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা গেল না। সাধের ঘুমটা বিসর্জন দিয়ে হাজির হলাম ইশিতার সামনে। আজ ইশিতাকে অনেক আনন্দিত লাগছে।
– কিরে কটকটি সুন্দরী আজ এত খুশি খুশি লাগছে কেন তোকে? আমার কথা শুনে ইশিতার খুশি যেন আরো বেড়ে গেল।
– জানিস আজ আমায় দেখতে আসবে। ইশিতার মুখে এই কথা শুনে ভেতর থেকে একটা চাপা হাহাকার অনুভব করলাম। কিন্তু নিজেকে সংযত রেখে বললাম,
– বলিস কিরে? তাই নাকি? উফ কতদিন দাওয়াত খাইনা। এবার পেটভরে তোর বিয়ের দাওয়াত খাবো।
– ইশ আসছে বিয়ের দাওয়াত খেতে। তোকে আমার বিয়েতে দাওয়াত দিব না।
– না দিলে নাই। আমি দাওয়াত ছাড়াই বিয়ের খাবার খেতে পারবো।
– দোস্ত তুই এতো ছ্যাচড়া কেন? দাওয়াত ছাড়াই খেতে যাবি?
– আমার জীবনের একমাত্র বন্ধুর বিয়ের খাবার আমি খেতে পারবো না তাকি হতে পারে?
– হা হা হা। ভালই বলেছিস। তবে দোস্ত তোকে খুব মিস করবো। (মুখটা গোমড়া করে)
– আমি তোকে মোটেও মিস করবো না।
– তবে রে বান্দর!
ইশিতাকে পাত্রপক্ষ দেখে পছন্দ করেছে। পাত্র মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। ইশিতার কপালটা খুবই ভাল, এমন একটা ছেলে তার ভাগ্যে। এদিকে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। ইশিতাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো আমি? একদিন বিকেলে ইশিতার ফোন আসলো।
– হ্যালো ইশিতা।
– আরমান কই তুই?
– আমি তো বাসায়। কেন কি হয়েছে?
– তুই এখনি আমাদের বাসায় আয়।
– কেন? ইশিতা তোর গলা এমন লাগছে কেন? কি হয়েছে?
– কিছু হয়নাই। তুই তাড়াতাড়ি আমাদের বাসায় আয়।
ইশিতাদের বাসায় বসে আছি। আমার সামনে ইশিতার বাবা মা এবং তার বড় বোন রাজিয়া বসে আছে। আর রাজিয়ার ছোট্ট মেয়ে মাইশা আমার কোলে বসে আছে।ইশিতার বাবাকে আমি সবসময় একটু ভয় পেতাম। কারন ভদ্রলোকের চোখে সবসময় সন্দেহের দৃষ্টি। তাই তাকে আমি সবসময় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি।
– তোমার বাবা মাকে কাল আমাদের বাসায় আসতে বলবে। আমি মাইশার সাথে একটু দুষ্টুমি করছিলাম। এমন সময় ইশিতার বাবা গুরুগম্ভীর কন্ঠে আমাকে উপরের কথাটা বললো। কথাটা শুনে আমি চমকে তাকালাম।
– জী আঙ্কেল কিছু বললেন আমাকে?
– হ্যা কালকেই তোমার বাবা মাকে সাথে নিয়ে আমাদের বাসায় চলে আসবে।
– কিন্তু..
– কোন কিন্তু নেই। যা বলছি তাই করবে। আমি আর কোন কথা না বলে সেখান থেকে চলে এলাম। কাহিনির আগা মাথা কিছুই মাথায় ঢুকছে না। হঠাৎ আব্বু আম্মুকে কেন এমন জরুরি তলব? ব্যাপারটা বোঝার জন্য ইশিতাকে ফোন দিলাম। দুইবার রিং বাজার পর ফোন ধরলো।
– কিরে ইশিতা তোর মিলিটারি বাপ আমার আব্বু আম্মুকে ডাকলো কেন হঠাৎ?
– ওই ফাজিল ছেলে আমি মিলিটারি? তুমি আর কোনদিন এই নাম্বারে ফোন দেবে না। আর কালকে অবশ্যই তোমার বাবা মাকে নিয়ে আসবে। বাপরে বাপ। ইশিতার ফোন দেখি ইশিতার বাপের কাছে। নাহ কাহিনি বোঝা আর হলো না। এখন কাল আব্বু আম্মুকে ইশিতাদের বাসায় নিতেই হবে। কারন ইশিতার বাপ লোকটা মোটেও সুবিধার না।
আব্বু আর আম্মুকে নিয়ে ইশিতাদের বাড়ি গেলাম। ইশিতার বাবা মা আর আমার বাবা মা কি কথা বললো জানিনা। তবে বাসায় ফিরে আব্বুর মুখে যা শুনলাম তাতে আমার মাথায় এভারেষ্ট ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা। ইশিতার বিয়ে হচ্ছে না। কারন পাত্রপক্ষের কে যেন আমাকে আর ইশিতাকে একসাথে দেখেছে। তারপর তারা এই বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে। কারন তারা ভেবেছে আমি আর ইশিতা একে অপরকে ভালবাসি। এমনকি ইশিতার বাবা মাও এটা মনে করছে। তাই আমার বাবা মা এবং ইশিতার বাবা মা আলোচনার পর এই সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছে যে, ইশিতার বিয়ে আমার সাথে হবে। তাও আবার এক সপ্তাহের মধ্যেই।
– বাবা আমি ইশিতাকে বিয়ে করতে পারবো না।
– কেন পারবি না? প্রেম করার সময় তো ঠিকই প্রেম করতে পেরেছিস, তাহলে বিয়ে কেন করতে পারবি না?
– বাবা আমি আর ইশিতা শুধুই বন্ধু ছিলাম। এর বেশি কিছু নয়।
– ও তাই? তাহলে এই ডায়রিতে যা লেখা আছে সবই মিথ্যা? এই কথা বলেই বাবা একটা ডায়রি আমার দিকে ছুড়ে দিল। এইটা আমার ডায়রি, এই ডায়রিতেআমার মনের সকল কথা লেখা আছে। যার বেশির ভাগই ইশিতাকে নিয়ে।
– বাবা তুমি আমার ডায়রিতে হাত দিয়েছো কেন?
– হাত দিয়ে কি বিশাল অপরাধ করে ফেলেছি নাকি?
– এটা আমার ব্যক্তিগত…! আর বলতে পারলাম না। বাবার গরম চাহনি দেখে আমার গলা শুকিয়ে গেল।
– কি হলো কথা বন্ধ হয়ে গেল কেন? যত কিছুই বলো তোমার বিয়ে ইশিতার সাথেই হচ্ছে। ভাই অনেক হয়েছে। এবার অতীত থেকেবাস্তবে ফিরে আসেন। আসুন দেখি আমার বাসরঘরে আর কি হতে যাচ্ছে।
– কি বললি তুই? (আমি)
– বললাম তোকে আমি কখনো স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারবো না। (ইশিতা)
– হুহ আমি মনে হয় তোকে বউ হিসেবে মেনে নিতে বসে আছি। (কিছুটা রাগি সুরে)
– কি ব্যাপার তুই আমাকে তুই করে বলছিস কেন?
– তো কি বলবো তোকে?
– আমি তোর বিয়ে করা বউ। আমাকে তুমি করে বলবি।
– ও তুই আমার বিয়ে করা বউ আর আমি তোর বিয়ে করা দোস্ত নাকি যে আমাকে তুই করে বলছিস?
– আচ্ছা ঠিক আছে আমি তোমাকে তুমি করে বলবো তুমিও আমাকে তুমি করে বলবে।
– তুমি করে বললেই কি আর না বললেই কি?
আমাকে স্বামী হিসেবে তো মেনে নিবি না। (কিছুটা অভিমানি সুরে) হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ার মতো দ্রুত গতিতে ইশিতা আমার কাছে চলে এলো। একেবারে কাছে সে। ওর গরম নিশ্বাস অনুভব করছি আমি।
– কে বলেছে মেনে নেব না? বিয়ের আগে থেকেই তোমাকে স্বামী হিসেবে বরন করে নিয়েছি। (ইশিতা) এই কথা শুনে একশো ডিগ্রি অবাক হলাম। এই মেয়ে বলে কি?
– কি বললা তুমি? (আমি)
– কি বললাম আমি?
– বিয়ের আগে থেকেই যদি স্বামী হিসেবে মেনে নিয়ে থাকো তাহলে ওই মেরিন ইঞ্জিনিয়ারের সাথে…
– ওটা শুধুই নাটক ছিল। তোমাকে ভালবেসেছি তোমার সাথে দেখা হওয়ার প্রথম দিন থেকেই।
– কি?
– জী। আমি জানতাম তুমিও আমাকে ভালবাসো।
– তাহলে বলোনি কেন?
– তুমি কি জানো না মেয়েদের বুক ফাটে তবুও মুখ ফোটে না।
– ও তাই?
– হুম তাই। আমি মনে করেছিলাম তুমি আমাকে প্রথমে বলবে। কিন্তু তুমিতো একটা গাধারাম।
– হুম আসলেই।
– ভাগ্যিস আঙ্কেল তোমার ডায়রিটা আমাকে দেখিয়েছিল। তারপরই তো এই নাটক সাজাতে হলো। রাখবো তোকে এই বাহুডোরে, রাখবো তোকে এই অন্তরে, চিরদিন থাকবি তুই এই হৃদয়ের মাঝে, থাকবি তুই আমার রক্তে মিশে।