– এই শুনছো?
– হ্যাঁ, বলো?
– এই যে, আমার দিকে তাঁকাও।
– কী?
– দেখ না আমায় কেমন লাগছে?
– এত সেজে কোথায় যাবে?
– ও মা! কাল তোমায় বললাম না?
– কী বলছো?
– এক্কেবারে মন ভোলা তুমি!
– কাহিনী না করে এবার একটু বলো?
– আম্মু যে যাইতে বলছে,বললাম না তোমায়?
– ওহ….সাবধানে যাইও।
– মানে কী? তুমি যাবে না আমার সাথে?
– কীভাবে যাবো বলো? দেখছো অফিসের কত কাজ!
– তো??? এখন উঠো, অনেক হইছে কাজ।
– আমারও যাইতে হবে?
– অবশ্যই আপনারও যেতে হবে।
– তুমি একাই যাও না প্লিজ…….
– আবার কথা বলো? উঠো তাড়াতাড়ি, সাওয়ার নাও।
– তুমি কী করবা এখন?
– আমার আর একটু সাঁজার বাঁকী আছে।
– আরও কী সাজবা?
– তোমাকে এত বুঝতে হবে না সুইট বাবু।
– একটা কথা ছিল?
– হুম, বলো?
– তোমাকে না অনেক সুন্দর লাগছে।
– ইশশ! তুমি না বড্ড ফাজিল হইছো।
শ্বশুর বাড়ি পৌঁছাতেই পিচ্চি শালীকা টা “দুলাভাই”,”দুলাভাই” বলতে বলতে কোলে এসে উঠল। ওর নাম মাইসা। বয়স ছয় বৎসর। দুলাভাইকে অনেক ভালবাসে। আমি যতক্ষণ এখানে থাকবো,আমার কাছ থেকে একটুও নড়বে না।
– দুলাভাই আসতে না আসতেই তোর কোলে এসে উঠা লাগবে?
– হুম, লাগবে।
– কোল থেকে নাম।তোর দুলাভাই ফ্রেশ হোক আগে।
– না, নামবো না। দুলাভাই দেখেন তো আপু কেমন করে?
– আহা,মিষ্টি! মাইসা থাক না কোলে, আমার তো সমস্যা হচ্ছে না।
– এখনই এত আদর দিয়ে বাদর বানাইও না।
– দুলাভাই!দেখছেন, আপু কি বলে গেলো?
– না বলে তোমার আপু।মাইসা পড়াশোনা ক্যামন করছো?
– আমার তো পড়তে ইচ্ছাই করে না।
– ও মা! তাহলে কী ইচ্ছা করে তোমার?
– সারাক্ষণ আপনার কোলে উঠতে ইচ্ছা করে। জানেন, দুলাভাই, আপনার মত কেউ আমাকে আদর করে না।
– তাহলে আম্মুর সাথে আমাদের বাসায় যাও না কেনো?
– আমি তো যাইতেই চাই দুলাভাই। আম্মুও আপুর মত সারাক্ষণ বকা দেয়!
– মাইসা আম্মু কোথায়?
– আম্মু রান্নাঘরে।
– চলো, আম্মুর সাথে দেখা করে আসি।
মাইসাকে কোলে নিয়েই রান্নাঘরে চলে গেলাম,শ্বাশুড়ি মার সাথে দেখা করার জন্য। মিষ্টিকে বিয়ে করেছি ১ বৎসর হবে। মিষ্টির একমাত্র ছোট বোন মাইসা। তবে, মিষ্টির থেকে মাইসা অনেক ছোট। বিয়ের দিন থেকেই অনেক আদর করি মাইসাকে। কেনো জানি অনেক ভাল লাগে মাইসাকে। আর, পিচ্চিটাও আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝে না। বিকালে বিছানায় বসে বসে মিষ্টির সাথে গল্প করছিলাম। মাইসা দৌড়ে এসে বলতেছে…….
– দুলাভাই? দুলাভাই?
– হ্যাঁ, দুলাভাই!
– চলেন মেলায় যাবো।
– মেলায়? কোথায় মেলা হচ্ছে?
– আরেহ্ আমাদের পাশের এলাকায়। (মিষ্টি)
– হুম, দুলাভাই। চলেন না যাই?
– মাইসা তুই মাঝে মাঝে এমন জেদ করিস কেনো??
– আপু চলো না তুমিও যাবে আমাদের সাথে?
– না। তোর দুলাভাইও যাবে না। আর এখন এই ঘর থেকে যা!
– মিষ্টি? পিচ্চির সাথে এমন করো কেন সব সময়?
– তুমি ওকে পিচ্চি বলছো? বড়দের মত কথা বলে সব সময় আর পড়াশোনায় গোল্লা!
– মাইসা যাও আম্মুকে বলে এসো যে, আমরা তিনজনই মেলায় যাচ্ছি।
– আচ্ছা, দুলাভাই।
– আম্মুর কাছ থেকে সেজে এসো,যাও।
– আপু দেখছো, দুলাভাই কত্ত ভাল??
– তাহলে আমি কী?
– তুমি একটা পঁচা!
পিচ্চিটা লাফাতে লাফাতে আমার শ্বাশুড়ি মার কাছে সাজতে গেল। পিচ্চিদের আবদারই অন্যরকম। অল্পতেই অনেক বেশি খুশি হয়ে যায়।
– কী করলে এটা? (মিষ্টি)
– কী করলাম?
– তুমি মাইসাকে মেলায় নিয়ে যাইতে চাইলে কেনো?
– কেনো? মেলায় নিয়ে গেলে কী হবে?
– তুমি জানো, ও মেলায় গেলে একটার পর একটা জিনিস নিতে চায়। বিরক্ত করে অনেক।
– আচ্ছা, করুক না বিরক্ত! তুমি যাবে না আমাদের সাথে?
– না। মাইসাকেই নিয়ে যাও।
– তুমিও চলো আমাদের সাথে!
– কীভাবে যাবো? আম্মু বললো, অনেক গুলো কাজ পড়ে আছে।
– অামি তাহলে আম্মুকে গিয়ে বলি, “আপনার দুই মেয়েকে নিয়ে মেলায় যাচ্ছি। পরে এসে কাজ গুলো করবে নি মিষ্টি”।
– আহারে! তুমি আম্মুর কাছে গিয়ে এই কথা বললে, আম্মু কখনও ‘না’ করবে?
– তাহলে তো হয়েই গেল। রেডি হও তুমিও এইদিকে মাইসা এসে বলতেছে,,, “দুলাভাই, আম্মু না আমাকে বকা দিছে”। চলেন তো দুলভাই, ‘আমি আর আপনি মিলে আম্মুকে বকা দিবো’। আমি সামান্য একটু মুচকি হেসে বললাম,, “চলো বকা দিবো আম্মুকে”।
– এবার বকা দাও আম্মু। দুলাভাইকে নিয়ে আসছি সাথে করে।
– বাবা, তুমি মাইসার কথায় সায় দিও না। অনেক জেদ করে মেলায় গিয়ে।
– কিচ্ছু হবে না আম্মা। মিষ্টিও যাবে আমাদের সাথে।
– মিষ্টিও যাবে তোমাদের সাথে?
– হ্যাঁ।
– সাবধানে যাইও বাবা।
– মাইসাকে সাজিয়ে দেন তাহলে।
– তুমি মিষ্টিকে বলো,মাইসাকে সাজিয়ে দিতে। আমার একটু কাজ আছে।
– আচ্ছা।
– মিষ্টি কই তুমি? হইলো তোমার?
– এইতো হয়ে গেছে। একটু দাঁড়াও…..
– মাইসাকে একটু সাজিয়ে দাও তো?
– আমি পারবো না।
– দুলাভাই!
– আম্মু কাজ করছে, তোমাকে সাজিয়ে দিতে বলল।
– এইদিকে আয় তাহলে পেত্নী।
– দুলাভাই দেখছেন, আপু আমাকে পেত্নী বলল??
– উফফ! তোমাদের দুই বোনকে নিয়ে আর পারি না। মাইসা আর মিষ্টিকে সঙ্গে করে নিয়ে মেলায় আসলাম। মাইসা এখনও আমার কোলে।
– মাইসা, এখন কিন্তু একটুও জেদ করা যাবে না?
– আচ্ছা দুলাভাই।
– এইতো ভাল মেয়ে। কী নিবা তুমি?
– কাঁচের চুড়ি।
– বাব্বাহ্! কাঁচের চুড়িও পড়ো তুমি?
– আপুর গুলা পড়ি দুলভাই।কিন্তু, সেগুলো তো আমার হাতে বড় হয়!!
– ওকে। নিয়ে দিবো কাঁচের চুড়ি। মিষ্টি তুমি কী নিবা?
– চলো, একটা পায়েল দেখি…..
– তাহলে আমিও পায়েল নিবো। (মাইসা)
– মাইসা, এইতো তোর শুরু হয়ে গেল!
– আমি আমার দুলাভাইকে বলছি, তোমার কী?
– আমার অনেক কিছু। আর মেলায় এসেও তুই তোর দুলাভাইয়ের কোলে কেনো?
– মিষ্টি তুমিও কী মাইসার মত পিচ্চি হয়ে গেছো?
সন্ধ্যায় মেলা থেকে মিষ্টি আর মাইসাকে নিয়ে বাসায় ফিরলাম। ওদের পছন্দ মত সব নিয়ে দিয়েছি। তবে, মাইসা এটা ওটা নেওয়ার জন্য খুব বেশি জেদ করে নি।
– কই?মাইসা তো মেলায় গিয়ে খুব বেশি জেদ করলো না? (আমি)
– দুলাভাইকে দেখে ভদ্র হয়ে গেছে। (মিষ্টি)
– মিষ্টি আমি তাহলে এখন বাসায় চলে যাই?
– আজকের রাতটা এখানে থেকে যাও না?
– তুমি দেখো নাই, এই কয়টা দিন বাসায় থাকলেও, কি পরিমান অফিসের ফাইল গুলোনিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়?
– আচ্ছা, তাহলে আম্মুকে বলি দাঁড়াও,,,খেয়ে যাইও…
– খাইতে হবে না আমি বরং চলে যাই!
– খেয়ে যেতেই হবে তোমার।
– রাতে বাসায় গিয়ে খাবো নি, আচ্ছা?
– না। আম্মুউউউ…..
মিষ্টি আম্মুকে ডাকতে ডাকতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।এদিকে মাইসা এসে আমার পাশে দাঁড়াল। শালীকার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে, আমাদের সব কথা সে শুনে নিয়েছে।
– দুলাভাই?
– হ্যাঁ, বলো মাইসা?
– আপনি চলে যাবেন?
– হ্যাঁ। কালকে আবার আসবো পিচ্চি।
– উঁহুহুহুহু। তাহলে, আপনার সাথে আমিও যাবো।
– তুমি কোথায় যাবে?
– আপনার সাথে।
– এ চলো খাবে? (মিষ্টি)
– দেখছো, মাইসা কী বলতেছে?
– এই তুই এখানে কী করিস?
– আপু আমি দুলাভাইয়ের সাথে যাবো?
– কিহহ্? থাপ্পর খাবি একটা! যা এখান থেকে…..
– দুলাভাই!
– মিষ্টি চুপ করো তো।
মাইসা দেখি আমার কোলে এসো।। পিচ্চিদের কখনও ভয় দেখিয়ে, বকা দিয়ে বুঝানো সম্ভব না। আদর করে মাইসাকে সুন্দর মত বুঝিয়ে মিষ্টিদের বাসা থেকে নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে আসলাম। অফিসের অনেক কাজের চাপ বেড়েছে, এক মুহূর্তেরর জন্যও বসে থাকার সময় নেই।
– ঠিকভাবে বাসায় গেছো? (মিষ্টি)
– হ্যাঁ।
– কী করো এখন?
– ফাইল গুলা দেখতেছি।
– রাতে কিন্তু তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে যাবে?
– হুম।
– ফ্রিজে খাবার রাখা আছে, ক্ষুর্ধা লাগলে খেয়ে নিও।
– আচ্ছা বাবা!ক্ষুর্ধা লাগলে খেয়ে নিবো।
– ওকে। ঘুমানোর আগে আমায় অারেকবার ফোন দিবা, ঠিক আছে?
– আচ্ছা,দিবো। মাইসা কই?
– মাইসা আর কই! তোমার সাথে যাবে বলে, এখনও মন খারাপ করে বসে আছে।
– আর তুমিও না, সারাদিন ছোট বোনটার সাথে খ্যাচ খ্যাচ করো। এখন ফোনটা রেখে মাইসার কাছে যাও।
– ওকে।
পরের দিন সকাল বেলা কলিং বেলের অসহ্য শব্দে, বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলাম। কিন্তু, মনে হচ্ছে কে যেনকলিং বেলে চাপ দিয়ে ধরে রেখেছে। এত বার চাপ দেওয়ার কি আছে, বুঝলাম না। দরজা খুলেই তো আমি শকট্!!
– মিষ্টি তুমিইইইই?
– কী ব্যাপার? তুমি ফোন রিসিভ করছিলে না কেনো? আর দরজা খুলতে এত দেরি হয়???
– কিন্তু, তুমি এত সকালে কেনো???
– কাল রাতে একবার তোমার সাথে কথা বলার পর থেকেই তোমার আর কোন খবর পাচ্ছিলামনা, তাই খুব টেনশন হচ্ছিল।
– না মানে, হইছে কী জানো..?
– তোমায় এমন দেখাচ্ছে কেনো? শরীর ঠিক আছে তো তোমার?
– হ্যাঁ, ঠিকই তো আছে।
– কই! দেখি…
বলতে বলতেই মিষ্টি আমার কপালে হাত দিল। হঠাৎ করেই তো কাল রাতে থেকেই শরীরে অনেক জ্বরউঠেছে, বিছানা থেকেও উঠতে পারছিলাম না। মিষ্টি যে আমাকে গত রাতে ঘুমানোর আগে ফোন দিতে বলেছিল,কিছুই তো জ্বরের ঠেলায় মনে নাই।
– তোমার শরীর তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে?
– কই?
– কই মানে? এত জ্বর কীভাবে উঠল শরীরে?
– কোথায় বেশি জ্বর!
– আবার? আমাকে কাল রাতে জানালে না কেনো?
– এত অস্থির হচ্ছো কেনো? ঠিক হয়ে যাবে তো।
– আগে বলো, আমাকে একটা বার জানালে না কেনো?
– আমি জানি, তুমি জানতে পারলে, কাল রাতেই চলে আসতে, তাই ইচ্ছা করেই তোমায় কিছু বলি নি।
– উঁহু! কী মনোবিজ্ঞানী গো তুমি! কষ্ট হয় নি তোমার? ঔষুধ খাইছিলে কাল রাতে?
– খাইছিলাম তো।
– তাহলে, এখনও শরীর গরম কেনো তোমার? একটা text করলে কী হতো?
– বাবার বাড়িতে গেছো অনেক দিন পর,তার মাঝে তোমারে টেনশন দেই কীভাবে, বলো?
– ইশ! কী সভ্য ছেলে! এরপর থেকে কখনও যেন এমন আর না হয়, মনে থাকবে???
– জ্বী, মনে থাকবে।
– এখন কান ধরো।
– এই অসুস্থ শরীর নিয়ে কানও ধরতে হবে?
– আচ্ছা, তাহলে ধরতে হবে না লক্ষীটি। মিষ্টি আমার বুকে মাথা রেখে বলতেলাগল…..
– আমি তোমাকে এত্তো ভালবাসি,তুমি বুঝোনা?
– হ্যাঁ, বুঝি তো।
ও মা! আমার বউয়ের সাথে সাথে দেখি, আমার পিচ্চি শালীকাও এসেছে। আমি তো মিষ্টির সাথে কথা বলতে বলতে মাইসাকে একদমই খেয়াল করি নাই।
– মাইসা? কেমন আছো?
– দুলাভাই আপনার সাথে কথা বলবো না।
– সে কী! রাগ করছো আমার উপর?
– হুহ! আপনি পঁচা। আপনি শুধু আপুকেই আদর করেন।
– হায় আল্লাহ্! কী বলে আমার পিচ্চি শালীকা!!! তারপর, মাইসাকে কোলে তুলে নিয়ে,ওর গালে কয়টা চুমু দিলাম।
সমাপ্ত